গরম হাওয়ার পোস্টার

গরম হাওয়ার পোস্টার

চলচ্চিত্রে ১৯৪৬-৪৭ এর সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও প্রতিরোধ

শেষ পর্ব

সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রকাশিত : জুলাই ২০, ২০২০

এমএস সথ্যুর গরম হাওয়া
সাতচল্লিশের দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িক বিভেদের প্রেক্ষিতে ১৯৭৩ সালে তৈরি হয় এমএস সথ্যুর ছবি গরম হাওয়া। ইসমত চুঘতাইয়ের একটি রচনার পুননির্মাণ করে চিত্রনাট্য লেখেন কাইফি আজমি ও শামা জাইদি। সিনেমার শুরুতেই ক্ষমতা হস্তান্তর ও দেশভাগ পূর্ব ও পরবর্তী কিছু সময়ের ঘটনা স্থিরচিত্রের মাধ্যমে সথ্যু তুলে ধরেছেন। যে ছবিগুলি সেসময়ের ইতিহাসের তথ্য ও মানবিক সংবেদনশীলতার বিপর্যয়ের ছবি। তিনি স্থিরচিত্রে দেখিয়েছেন, মোহনদাস গান্ধীর হত্যার ঘটনা। যার মাধ্যমে তৎকালীন ভারতবর্ষের অবক্ষয়ের চূড়ান্ত বিন্দুটি চিহ্নিত হয়েছে। ছবির প্রথম দৃশ্যেই দেখা যায়, ট্রেনভর্তি হাজারও মানুষ অসুখী মুখে, চোখের জলে ভারত ত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। The land is divided, lives are shattered. Stroms rage in every hearts, it`s the same here and there. Funeral pyres in every home, the flames mount higher, Every city is deserted, it`s the same here and there. No one heeds the Gita, no one heeds the Koran. Faith has lost all meaning, here and there

দিদিকে পাকিস্থানগামী ট্রেনে তুলে টাঙ্গায় ওঠেন `গরম হাওয়া`র কেন্দ্রীয় চরিত্র মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী সেলিম মির্জা। গল্পের স্থান আগ্রা। কয়েকশো বছর ধরে যেখানে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতিপূর্ণ একত্র বসবাস। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের অন্যতম কেন্দ্রস্থল ছিল আগ্রা। হিন্দু-মুসলমান একত্রে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল এই শহরেই। দেশভাগের পূর্বে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কোনো সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ আগ্রায় ছিল না। কিন্তু `স্বাধীনতা` তথা গান্ধীর মৃত্যুর পরেই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেকার সুসম্পর্ক ভেঙে পড়ে। যার কবলে পড়ে সর্বস্বান্ত হয় অসংখ্য সাধারণ মানুষ। এর কারণ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদের পোষা বুর্জোয়া ও সামন্তদের সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টিকারী চক্রান্ত। সাধারণ ব্যবসায়ী ও মেহনতি মানুষজন সেই চক্রান্ত সেদিন বুঝতে অক্ষম হয়েছিল। ঠিক তেমনই সেই বিদ্বেষ ঊর্বর পরিস্থিতিকে বুঝতে সক্ষম হয়নি গরম হাওয়া সিনেমার প্রধান চরিত্র জুতো কারখানার মালিক সেলিম মির্জা। ৪৭ পরবর্তী দাঙ্গা, দেশভাগ ও দেশান্তরিত হওয়ার ঘটনা সমাজ-মনস্তত্ত্বকে অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। সাধারণ মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল ধর্মীয় বিদ্বেষের বিষ। সরল ভারতপ্রেমী সেলিম মির্জার জীবনে যার ফল হয়েছিল মারাত্মক।

৪৭ এর পরেই ধর্মীয় কারণ সরিয়ে জুতো তৈরির ব্যবসায় নেমে এল হিন্দু বৃহৎ ব্যবসায়ীরা। শাসকবর্গ হিন্দুদের অর্থনৈতিক সুবিধা দিতে থাকলো। ব্যাংকের ঋণ নিয়ে পাকিস্থান চলে যেতে পারে তাই সেলিম মির্জাকে ব্যবসায়িক-ঋণ দেয়া বন্ধ করে দিল ব্যাংক। হিন্দু সুদের কারবারি মহাজনরাও একই অবিশ্বাসের কারণে ঋণ দিতে অস্বীকার করল সেলিম মির্জাকে। এভাবেই ভারতবর্ষ ছেড়ে যে সব মুসলিম পাকিস্থান যেতে চাইল না, তাদের ওপর শুরু হলো অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেয়ার খেলা। তাই সৎ ব্যবসায়ী হওয়ায় সেলিম মির্জার কারখানা-ব্যবসা ধীরে ধীরে মার খেল। জুতো তৈরিতে আধুনিক বিদেশি পদ্ধতি ব্যবহার হলেও সেলিম মির্জা `গান্ধি ভাবনায়` তার দেশীয় পদ্ধতিকেই আগলে রাখতে চাইলেন। তিনি মনে করলেন, দেশে ধর্মীয় হিংসা ও অবিশ্বাসের চিত্র শীঘ্রই বদলে যাবে। তার বড় ছেলে বকর মির্জা মনে করলেন, হিন্দুস্থান, পাকিস্থান, ইউরোপ, আফ্রিকা সব দেশই এক। মানুষ যেখানে সম্মানের সাথে দুবেলার রুটি জোগাড় করতে পারবে, তার সেখানেই থাকা উচিত। বকরের শিশুসন্তান শুধু এটুকু জানতে চায়, পাকিস্থানে ঘুড়ি ওড়ে কিনা! অন্যদিকে মির্জা পরিবারের কর্তা মুসলিম লিগের নেতা হালিম মির্জা পাকিস্থান চলে যেতে চান। কারণ মুসলিম লিগের সমস্ত নেতাই নিজ সম্প্রদায়কে ছেড়ে পাকিস্থান চলে গেছেন। মধ্যবিত্ত সুবিধাবাদ যে কোনো ধর্ম মানে না!

এভাবে একদিন সেলিম মির্জার দাদা হালিম মির্জা পাকিস্থান চলে যান। তার নামে বাড়িটি থাকায় সরকার বাড়ি ক্রোক করে। নিজের বাড়ি ছেড়ে ভাড়া বাড়িতে উঠে আসতে বাধ্য হন সেলিম মির্জা। বাড়ি খোঁজার সময় দেখা যায়, সব বাড়ির মালিকই ভাড়া দেয়ার আগে তার ধর্ম পরিচয় জানতে চাইছে। সেলিম মির্জা বুঝতে পারেন, কিছু মাসের ব্যবধানে পাল্টে গেছে তার পরিচিত আগ্রার সমাজচিত্র। ধর্ম পরিচয়ই সেখানে আসল পরিচয় রূপে উঠে এসেছে। বারবার ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে ও অসম প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে সেলিম মির্জার বড় ছেলে বকরের পূর্বধারণা পাল্টে যায়। সে মন্তব্য করে, এদেশে সম্মানের সাথে ব্যবসা করে বাঁচা আর সম্ভব নয়, আমাদের তাহলে ভিক্ষা করে খেতে হবে। পিতার সাথে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর সে জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে চলে যায় পাকিস্থান। কিন্তু সেলিম মির্জা সবকিছু উপেক্ষা করে এই দেশে পড়ে থাকলেন এই বিশ্বাসে যে, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। বাড়ি (হাভেলি) হারানোর শোকে মারা যান সেলিম মির্জার বৃদ্ধা মা। যদিও সেলিম মির্জার অনুরোধে বৃদ্ধাকে শেষবারের মতো বাড়িটি দেখতে দিলেন পাকিস্থান থেকে আসা তার হিন্দু ব্যবসায়ী বন্ধু।

নতুন দেশ পাকিস্থানে চলে গেছে তার মেয়ে আমিনার প্রেমিক কাজিম মির্জা। ফিরে আশার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বহুদিন পর ফিরে এলেও তাকে পুলিশে ধরে নিয়ে যায়। আমিনা-কাজিমের প্রেম দেশভাঙার মতোই ভেঙে যায় পারিপার্শ্বিকতার নির্মম আঘাতে। অবসাদে থাকা আমিনা বৌদির অনুরোধে সামসাদের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়ায়। কিন্তু পরিবারের ইচ্ছায় সেও একদিন পাকিস্থান চলে যায়। এবারও আমিনা ভেবেছিল সামসাদ ফিরে আসবে। কিন্তু তার মা এসে জানায় অন্যত্র বিয়ে ঠিক হয়েছে সামসাদের। সামসাদের কাছে প্রেমে প্রতারিত হয়ে অবসাদে ব্লেড দিয়ে শিরা কেটে আত্মহত্যা করে সেলিম মির্জার আদরের মেয়ে আমিনা। এখানে পরিচালক সথ্যু আসাধারণ ভাবে দেখিয়েছেন, আমিনার আত্মহত্যাও আসলে একটি রাষ্ট্রীয় হত্যা। ধর্মনির্ভর দেশভাগের ফলাফল। আত্মীয়-স্বজন-সন্তান সব হারিয়ে অসহায় নিঃস্ব সেলিম মির্জার ভাড়া করা টাঙ্গার ঘোড়া একদিন গলির মধ্যে উল্টে দেয় এক ফল-বিক্রেতার ঝুড়ি। সে এলাকায় শুরু হয়ে যায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। জ্বালিয়ে দেয়া হয় সেলিম মির্জার জুতোর কারখানা। ছাদের ওপর থেকে ছোড়া ইটে মাথা ফেটে যায় তার। দেখা যায় সেলিম মির্জা নিজে কারিগর হয়ে জুতো তৈরি ও ফেরি করা শুরু করেন। পরিস্থিতির চাপে তার সহধর্মিণী তাকে পাকিস্থান যাওয়ার পরামর্শ  দিলেও সেলিম মির্জা এদেশ ছেড়ে এই মাটি ছেড়ে কোথাও যেতে চান না।

এরমধ্যেই দাদা হালিম মির্জার হাতে তৈরি একটি বাড়ির প্লানকে ম্যাপ বলে চিহ্নিত করে সেলিম মির্জাকে পাকিস্থানি গুপ্তচর সন্দেহে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। যদিও তৎক্ষণাৎ তিনি ছাড়া পান। এবং পরে আগ্রা কোর্ট তাকে মিথ্যা অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস করে। কিন্তু সমাজ কোর্টের সিদ্ধান্তে গুরুত্ব না দিয়ে তাকে পাকিস্থানি গুপ্তচর সন্দেহে ঘৃণা করতে থাকে। ভারতবর্ষের মাটি ও মানুষকে যিনি নিজের পরিবার আত্মীয়স্বজনের চেয়ে অধিক ভালবাসেন, যিনি জুতো তৈরিতে ভারতীয় পদ্ধতিকেই ধরে রাখতে চাইছেন, তার প্রতি সমাজের এই দৃষ্টি নিছক এক পরিস্থিতির পরিহাস বলেই তুলে ধরেছেন গরম হাওয়ার পরিচালক। প্রকৃতপক্ষে সথ্যু তার ছবিতে সেলিম মির্জার প্রতি সমাজের এই সন্দেহের মাধ্যমে সম্পূর্ণ ভারতে বসবাসকারী মুসলিম সমাজের তৎকালীন অবস্থাকেই ধরতে চেয়েছেন। বলাবাহুল্য, বর্তমান ভারতবর্ষ যারা শাসন করছে তাদের দৃষ্টিতেও আজও মুসলিমরা যে খুব আলাদা, তা নয় কিন্তু। ওদিকে তার ছোট ছেলে সিকন্দর চাকরি পায় না। কারণ সে ভালো হিন্দি জানে না। তাছাড়া সে মুসলমান। এক মুসলিম ইন্টারভিউয়ার সিকন্দরকে বলে, সে যোগ্য হলেও তাকে চাকরিতে নিলে তিনি মুসলমানের পক্ষপাতিত্ব করার অভিযোগে অভিযুক্ত হবেন। কারণ ওই বিভাগে তিনি একমাত্র মুসলমান অফিসার। এমনকি নিজের চাকরি টিকিয়ে রাখার জন্য পাকিস্থান চলে যাওয়া আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগও তিনি বন্ধ করেছেন। সিকন্দর তার সামনে ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে বাড়ি ফেরে।

ছবির শেষের দিকে দেখা যায়, সব সইলেও পরিচিত মহলে `গুপ্তচর` এর মিথ্যে অপবাদ সেলিম মির্জার সহ্য হলো না। তিনি ভাবতে লাগলেন, পাকিস্থান চলে যাওয়াই উচিত কাজ হবে। এভাবে মিথ্যে অপবাদ নিয়ে বাঁচা যায়! হতাশ হয়ে একদিন বাড়িতে তালা দিয়ে স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে পাকিস্থানের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। কিন্তু যাওয়ার রাস্তায় পথ আটকে দিল একটি মিছিল। শান্তি ও সৌহার্দ্যের দাবিতে আগ্রায় সকল মানুষের বাঁচার মিছিল। বেকারদের চাকরির দাবিতে মিছিল। রুটি, কাপড় আর ঘরের দাবিতে মিছিল। সে মিছিলে উড়ছে লালঝাণ্ডা। সমবেত জনতার ধ্বনি উঠছে, ইনকিলাব জিন্দাবাদ, হাল্লা বোল। মানুষের অধিকারের দাবিতে সেই মিছিলে হিন্দু-মুসলিম-শিখ সব বন্ধুরা পা মিলিয়েছে। এই দৃশ্য দেখে উৎফুল্ল চিত্তে বাবার কাছে টাঙ্গা থেকে নেমে পড়ার অনুমতি চায় ছোট ছেলে সিকন্দর। ছেলের স্বাধীন চিন্তায় গর্ব ভরা চোখে আশার আলো খুঁজে পান সেলিম মির্জা। এটাই যেন তিনি খুঁজছিলেন। ছেলের সাথে নেমে পড়েন নিজেও। মনে মনে বলেন, আর ব্যক্তিগত নয়, শুধু একা একা বাঁচায় তার বিরক্ত ধরে গেছে। এবার সমবেতভাবে লড়তে হবে সবাইকে। কারণ যে অন্ধকারময় ঝড় এখানে আছে, তা ওখানেও আছে। এরপর বেগম জামিলার হাতে বাড়ির চাবি তুলে দিয়ে টাঙ্গাওয়ালাকে ফিরে যেতে বললেন তিনি। তারপর সবার উপরে মানুষ সত্য আবেগে মিশে গেলেন লালঝাণ্ডার মিছিলে। সে মিছিল এগিয়ে চলল নতুন ভারতবর্ষ গড়ার লক্ষ্যে।

সিনেমায় পরিচালক সথ্যু সেলিম মির্জার পরিবারকে ভারতবর্ষের বোধের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন। সাম্প্রদায়িকতা বারবার ভারতবর্ষকে বিষাক্ত করেছে ঠিকই কিন্তু শ্রম ও শুভবুদ্ধিতে সে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। হাওয়া বহুত গরম মিয়াঁ, বহুত গরম, এর উত্তরে সামান্য জলের আশা দেখিয়ে যায় সেলিম মির্জার প্রত্যয়ী মানবিক সমাজমনস্ক দেশপ্রেমিক ভূমিকা। তিনি শত ঝঞ্ঝার মাঝেও অবিচল থেকে প্রমাণ করেছেন ভারতভূমি তার প্রাণ। পরিবারের আপনজনের চেয়েও আপন তার কাছে। ভারতের মাটি তারও মাটি। তাকে ছেড়ে কোথায় যাবেন তিনি! আজকের ভারতবর্ষে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের দাপাদাপির ভয়াল সময়েও সিনেমাটি প্রত্যেক ভারতীয়ের ও ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের জন্য এক অসাধারণ আশাব্যঞ্জক প্রাসঙ্গিকতা বহন করছে। অসাধারণ এই চলচিত্রটি সৃষ্টির জন্য আমরা সত্যই ঋণী পরিচালক এম এস এস সথ্যু ও লেখিকা ইসমত চুঘতাইয়ের কাছে। চলচ্চিত্রের শেষের কথায়— Those who view the strom from afar, see no difference between here and there. To join in and to become part of it, This is the call of the time here and there