তমস চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য

তমস চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য

চলচ্চিত্রে ১৯৪৬-৪৭ এর সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও প্রতিরোধ

পর্ব ২

সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রকাশিত : জুলাই ১৯, ২০২০

মহল্লায় খুনোখুনি আর লুঠপাট মারাত্মক হয়ে উঠলে আতঙ্কিত নাথু পিঠে তার অসমর্থ মা ও সন্তানসম্ভবা স্ত্রী কামোকে নিয়ে ঘর ছেড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। এক জায়গায় এসে সন্তানসম্ভবা কামো অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। নিদারুণ অসহায়তায় চিৎকার করে সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকে নাথু চামার। তার চিৎকার শুনে রাস্তার পাশের জলাশয়ের অপর প্রান্তে থাকা হরনাম সিং তাকে দাঙ্গাকারী শত্রু ভেবে বন্দুক উঁচিয়ে ধরে। ঘটনা এগোতেই তাদের মধ্যে বাঁচার স্বার্থেই বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ছবির শেষ পর্যন্ত শিখধর্মী হরনামের স্ত্রী বানো বুকে করে আগলে রাখে দলিত কামোকে। এই দৃশ্যটিতে অনুভব করা যায় অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন কিভাবে ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে পরস্পর মিলিয়ে দেয়। পরিচালক দেখিয়ে দেন, প্রতিটি দাঙ্গার পরে মেহনতি মানুষের মনে চিরন্তন চলে আশা আত্মজবোধ আবারও বিকশিত হয়। আবারও তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বাঁচতে থাকে। অন্যদিকে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে বিদ্বেষ তৈরি করেই একদল পরশ্রমজীবী কিভাবে মানুষকে মানুষের শত্রুতে পরিণত করে। সিনেমায় সাম্প্রদায়িক উগ্রপন্থার হার হয় নাথু ও হরনামের মিলনে। যা বার্তা দেয় সামাজিক মানববন্ধনই চিরন্তন এবং সে বন্ধনে মানবসত্তাই শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়।

ছবির আরেক পর্বে `জাহুর বক্স` বিশ্বাস করেছিল, ধর্মীয় দাঙ্গাকারীরা তার কোনো ক্ষতি করবে না। কারণ তিনি শিক্ষিত এবং আপাত অর্থে এক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী। নিজের এলাকায় তার এই সুনাম, পরিচয়ই তাকে রক্ষা করবে। তাছাড়া তিনি সাহিত্যিক, কারোরই শত্রু হতে পারেন না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ভুল বিশ্বাস লালন করেছিলেন তিনি। তার ঘরেও আক্রমণ করে ধর্মান্ধ দাঙ্গাকারীরা। অসহায় সাহিত্যিক জাহুর বক্স দাঙ্গাকারীদের অনুরোধ করেন, তোমরা আমার সব নিয়ে যাও কিন্তু আমার বইগুলির কিছু করো না। এরপরেই জ্বলে ওঠে তার পড়ার ঘরের দরজার পর্দা, জ্বলতে থাকে কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’, প্রেমচন্দের ‘গোদান’, রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি`সহ তার বইয়ের আলমারি। পুড়তে থাকে সাহিত্যিক জাহুর বক্সের লেখা অসমাপ্ত রচনার পাণ্ডুলিপি। দৃশ্যটি দেখলে মনে হয়, বই নয় পুড়ছে মানুষের মানবিক বোধবুদ্ধি ও জ্ঞানচর্চার ইতিহাস। পোড়াচ্ছে একদল অসভ্য অমানুষ। এই দৃশ্য দেখলে মনে পড়ে ২০০২ এর গুজরাট দাঙ্গা। উন্মোচিত হয় ভারতে সাম্প্রদায়িক ব্রাহ্মণ্যবাদী ফ্যাসিবাদের ভয়ানক স্বরূপ। জাহুর বক্স সেই আধপোড়া বই, তার নিজের লেখা পাণ্ডুলিপি হাতে নিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। ভেঙে খানখান হয়ে যায় তার মানস। তখন কালি মাখা তার বিধ্বস্ত মূর্তি যেন প্রশ্ন করে বসে ভারতবর্ষকে, আমি মুসলিম, এই কি আমার অপরাধ? অনুচ্চারিত থেকেও দর্শক মননে অনুরণন রেখে যায় এই সংলাপ। এ প্রশ্ন যেন যুগকাল এক ঐতিহাসিক প্রশ্ন এই উপমহাদেশে।

পরের দৃশ্যেই দেখা যায়, এলাকার ব্যবসায়ী লালজি মন্দিরের ঘণ্টা গড়াবার কাজে প্রচুর অর্থ দান করেন। ঘণ্টা গড়িয়ে তিনি সমাজে একজন ক্ষমতাবান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চান। এখানে নিহালনি যেন দেখিয়ে দেন, মানবতা পুড়লেই ধর্মীয় ঘণ্টাধ্বনি আরও প্রবল কর্কশ শব্দে বেজে ওঠে। এ সত্যতাও ঐতিহাসিক। সিনেমায় দেখানো হয়, ভারতবর্ষের বুকে এমন হিংস্রতা ভরা রাজনৈতিক সামাজিক পরিস্থিতিগুলিতে একমাত্র কম্যুনিস্ট মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিরাই দাঙ্গা প্রতিরোধ ও মানুষে মানুষে মিলনের সেতু নির্মাণে অবিচল থেকে কাজ করে যায়। এই কাজের জন্য তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও এগিয়ে চলে। ছেচল্লিশের দাঙ্গাকালীন অবস্থায় কিংবা পরেও এ দেশের কম্যুনিস্ট শক্তি বারবার সাহসের সাথে, শাসকশ্রেণির তৈরি করা বিদ্বেষ অতিক্রম করে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে। এও এক সত্যই। `তমস` ছবিতে আরও উঠে এসেছে দাঙ্গার সময়ে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসক এক ম্যাজিস্ট্রেটের ভূমিকার কথা। মহল্লায় দাঙ্গা পরিস্থিতিতে দেশের প্রতিষ্ঠিত দল কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ ওই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে কার্ফুর দাবি জানালেও তিনি তা না করে দাঙ্গাকে ছড়িয়ে পড়তে দেয়ার সুযোগ করে দেন। কারণ বিভেদ বাড়লেই সাম্রাজ্যবাদের সুবিধা। সামন্ত ও বুর্জোয়াদের মুনাফার অধিক সুযোগ। তাই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলেই প্রশাসন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মতো দলগুলি একদিকে ব্রিটিশ সরকারকে কার্ফুর দাবি জানায়, অন্যদিকে জনগণকে শান্তির দাবি করে। কিন্তু দাঙ্গা আটকানোয় তারা কোনো সক্রিয় ভূমিকা ইচ্ছাকৃতভাবেই নেয় না। ঠিক যেমন আমরা ২০২০ এর দিল্লি দাঙ্গার সময় দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থেকে শান্তির প্রার্থনা করতে দেখেছি। তাই চলচ্চিত্রে দেখা যায়, দাঙ্গার পর সরকারি মদতে এলাকায় এলাকায় `শান্তি কমিটি` তৈরি হলে দাঙ্গায় পরোক্ষ উস্কানিদাতারা তাতে জায়গা করে নেয় সরকার ও রাজনৈতিক মদতেই। শাসকশ্রেণির প্রথামাফিক `শান্তি কমিটি` তৈরিও যে এক প্রহসন, সে দিকটিও অসাধারণভাবে চিত্রিত হয়েছে নিহালনির এই নির্মাণে।

`তমস` ছবির সর্বাধিক সাফল্য এখানেই যে, এই ছবি ভারতের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিভিন্ন গ্রুপগুলির ন্যাক্কারজনক ভূমিকার সঠিক বিশ্লেষণ করে নির্মোহভাবে তুলে ধরেছে। আর্যসমাজ, আরএসএস, কংগ্রেস, মুসলিম লিগ প্রভৃতি শাসক শ্রেণির দলগুলির আদর্শগত ভণ্ডামি ও ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা কিভাবে ভারতীয় সমাজকে খণ্ডবিখণ্ড ও কুৎসিত করে তুলেছে ও তুলছে, তা নিহালানি অসীম দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। এ যেন আধুনিক ইতিহাসের এক নিষ্ঠুর বাস্তব সত্য। যেমন একটি দৃশ্যে দেখা যায়, হিন্দু মৌলবাদী সংগঠন আরএসএসে (Rastriya Sayamsebak Sangh) যোগ দিয়েছে নরম প্রকৃতির কিশোর রণবীর। তার দীক্ষা হবে মুরগি কেটে। এই কাজে তার সরল কিশোর মন কিছুতেই সায় দেয় না। তখন আরএসএস নেতা তাকে প্ররোচনা দেয় এই বলে, যদি একটা পাখি কাটতে না পারো মানুষ কাটবে কী করে! কিশোর রণবীর কিছুক্ষণ  ইতস্তত করে, তারপর মনে কষ্ট নিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে মুরগিটি কেটে ফেলে। কাটা ছটফট করা মুরগির রক্তে তার হাত মুখ পোশাক ভরে যায়। চলচিত্রের পরবর্তী পর্বে দেখা যায়, হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদীদের প্ররোচনায় সেই রণবীর এক দরিদ্র মুসলিম ফেরিঅলাকে ভোজালি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করছে। এ দৃশ্য কার্যত দর্শককে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিপীড়িত মানুষ শুধু ষড়যন্ত্রে প্ররোচিতই হয় না, বরং তারায় সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। প্রাণও হারায় সেই অসহায় নিপীড়িত খেটে খাওয়া মানুষই। কারণ জীবনে নিজে চলা ও সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে তার শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য শ্রম দেয়া ছাড়া আর কোনো ভূমিকা থাকে না। থাকে না কোনো নিজস্ব মতামত বা পরিচয়য়। পরিচালক দেখিয়েছেন, মানবসত্তার বিকাশ শাসকের চক্রান্তে যেন এভাবেই থমকে থেকে যায়, বিকৃত হয় বারেবারে। ডিরেক্টর নিহালনি এখানে সমাজে সাম্প্রদায়িকীকরণ ও তার ফলাফলের শ্রেণিগত দিকটি তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, একটি ধর্মীয় হিংসা কিভাবে সমাজের দরিদ্র সর্বহারা মেহনতি অংশেরই জীবন যাপন ও মানসিকতার ক্ষতি করে।

তমসে সাহানি ও নিহালনি যেন একত্রে তাদের সৃষ্টিতে দেশবাসীর মনে উঠে আসা প্রশ্নগুলির সমাধান খুঁজেছেন। দেশভাগের সময়ের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য কারা দায়ী ছিল? এর পিছনে কাদের ষড়যন্ত্র ছিল? আক্রান্ত কারা? কারা এর ফলে লাভবান হয়েছিল? ইত্যাদি। লেখক ও পরিচালক ৪৭ এর দেশভাগকে শুধুমাত্র ভূ-রাজনৈতিক বিভাজনের অবরোহণবাদী Reductive সমীকরণে না ফেলে সাহানি ও নিহালনি একে মানবতাবাদী সংবেদনশীলতার দৃষ্টিতে ধরতে চেয়েছেন। ১৯৪৭ এর ক্ষমতা-হস্তান্তর ও দেশভাগের পর যে দাঙ্গা হয়েছিল তাতে মাত্র কয়েকদিনেই এতক কোটি ২০ লাখ মানুষ তৎক্ষণাৎ বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত হয়েছিল। প্রায় ১০ লাখ মানুষ দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছিল। ধর্ষিতা হয়েছিল ২ লাখ নারী। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া এই ঐতিহাসিক মানবিক বিপর্যয়টির কথা পাঠ্য-ইতিহাসে জায়গা পায়নি বললেই চলে। অথবা যে যার মতো করে সে পাঠ পড়িয়েছে, বিকৃত হয়েছে ইতিহাস। সাহানি ও নিহালনি যেন নির্মমভাবে ইতিহাসের নিরিখে সেই মানবিক সংবেদনশীলতার বিপর্যয় এবং তারপর তার উথানের ঘটনাকে ভারতবর্ষের মাটিতে পাশাপাশি চিত্রায়িত করে এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন যে, ইতিহাসের সত্যকে মেনে নিয়ে আমাদের তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। বিবিধের মাঝে মিলনের মহান সূত্রগুলির উপরই গুরুত্ব দিয়েই আগামীকালে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের।

১৯৪৬-৪৭ সালের ক্ষমতা-হস্তান্তর ও দেশভাগের পটভূমিতে `তমস` উপন্যাসের কাহিনির বিস্তার। ভারত-উপমহাদেশের ইতিহাসে এই সময়টি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু `তমস` নিছক ইতিহাস বর্ণনা নয় বরং সেই ঐতিহাসিক সময়ের অভ্যন্তরে যে নির্মম সত্য লুকিয়ে রয়েছে তাকেই তুলে এনেছেন হিন্দি রচনাকার ভীষ্ম সাহানি। রচনার এত বছর পরে আজ আমরা একবিংশ শতাব্দীতে এসেও দেখতে পাচ্ছি, এ রচনা এখনো সমান সত্য। আর সে সত্যকেই চলচ্চিত্রে সার্থকভাবে উপস্থাপনা করেছেন পরিচালক গোবিন্দ নিহালনি। চলবে