চলচ্চিত্রে ১৯৪৬-৪৭ এর সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও প্রতিরোধ
পর্ব ১
সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়প্রকাশিত : জুলাই ১৮, ২০২০
গোবিন্দ নিহালনির তমস
ভীষ্ম সাহানির `তমস` উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। ১৯৭৬ সালে উপন্যাসটির জন্য সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার পান সাহানি। এই উপন্যাসের সাথে ভীষ্ম সাহানির আরও দুটি ছোটগল্প `সারদারনি` ও `জাহুর বক্স`কে মিলিয়ে চিত্রনাট্যের রূপ দেন চলচ্চিত্র পরিচালক গোবিন্দ নিহালনি। ১৯৮৮ সালে তৈরি হয় পাঁচ ঘণ্টার সিরিয়াল মুভি `তমস`।
ছবির একটি দৃশ্যে এক মুসলমান নিরীহ স্কুল শিক্ষককে শিখ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকারীদের হাত থেকে বাঁচান এক শিখ নারী। ধর্মীয় ভেদ ভুলে গুরুদোয়ারায় আশ্রয় দেন ওই আতঙ্কিত মুসলমান শিক্ষককে। তরবারি হাতে সর্দারনীর বেপরোয়া সাহসী মনোভাবের বিপরীতে আসাধারণভাবে চিত্রিত হন মৃত্যুভয়ে অসহায় আতঙ্কগ্রস্থ অথচ শান্ত-স্বভাবের সেই শিক্ষকটি। পরিচালক দেখিয়ে দেন, এই অসহায়তা আসলে ভারতবর্ষে বসবাসকারী সমস্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অসহায়তা। যা তথাকথিত স্বাধীনতার পরই এক অলিখিত উপায়ে নির্মাণ করা হয়েছে।
এই দৃশ্যে একদিকে চিত্রিত হয়েছে এক অক্ষর জ্ঞানহীন নারীর স্বতঃস্ফূর্ত সাহসের উজ্জ্বল দীপ্তিভরা কঠিন মুখ, অন্যদিকে চিত্রিত হয়েছে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত-সমাজের অসহায় আত্মসমর্পণ, নিরাপত্তাহীনতা ও অক্ষমতার ভয়ার্ত ছবি। যে ছবি ভারতবর্ষের ধর্মীয় সম্প্রদায়গত সামাজিক বিভাজনের এক নিষ্ঠুর বাস্তব। আর সে বাস্তবেই এক প্রৌঢ়া নারীর একার মানবিক প্রতিরোধের সামনে দলবেঁধে দাঁড়ানো খুনি-দাঙ্গাকারী দুষ্কৃতির দল মানসিক পরাজয়ে পিছু হঠতে বাধ্য হয়। প্রমাণ হয়, ধর্মীয় আফিমে বুঁদ হলেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকারীরা আসলেই দুর্বল প্রকৃতির প্রাণী। সাহসী বিবেকের প্রতিরোধের সামনে তাদের মিথ্যে `বীরত্ব` কর্পূরের মতোই উবে যায়। পরিচালক যেন দেখিয়ে দেন, ভারতবর্ষের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ দাঙ্গা-হিংসা চায় না। বরং তাকে প্রতিরোধের মাধ্যমে চিরতরে নির্মূল করতে চায়।
`তমস` এর আরও একটি দৃশ্যে, দোকানদার হরনাম সিংহের ছোট চায়ের দোকান লুঠ হয়। এই খবর পেয়ে বাঁচার তাগিদে তিনি ও তার স্ত্রী বানো বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান। আশ্রয় খুঁজে পান এক পরিচিত মুসলিম বাড়িতে। কিছুক্ষণ পরে তারা দেখেন, সেই বাড়ির মালকিন রাজোর স্বামী হন্তদন্ত হয়ে একটা বাকসো নিয়ে বাড়িতে ঢোকে। হরনাম বাকসোটি দেখে চিনতে পারেন এবং বাকসোটি তার বলে দাবি করেন। রাজোর ছেলে উগ্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকারী। বাড়িতে এসে সে হরনামকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। কিন্তু বাড়ির মালকিন তার মা রাজো দৃঢ়চিত্তে ছেলেকে বাধা দেন ও তাকে নিরস্ত্র করেন। তার নিজের বাড়িতে আশ্রয়প্রার্থী দম্পতির নিরাপত্তার অভাব বুঝে হরনাম ও বানোকে বাড়ি থেকে লুকিয়ে বের করে লণ্ঠন দেখিয়ে রাস্তা এগিয়ে দেন। সে সময় তিনি হরনামকে বলেন, ওই বাকসে কিছু গয়না ছিল, পথে তোমাদের কাজে লাগবে।
জীবনের চরম অসহায় সময়ে নিজের লুঠ হওয়া গয়না লুণ্ঠনকারীর স্ত্রীর কাছ থেকে ফেরত পেয়ে আবেগে আপ্লুত হন হরনাম। ধর্মীয় মাদকে মত্ত দাঙ্গাকারী ছেলে ও স্বামীর বিপরীতে মায়ের (রাজো) বিদ্বেষহীন নির্লোভ সাহসী সংগ্রামী মানবিক চেতনা এক অসাধারণ বৈপরীত্যের ছবির মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে। সমাজে টিকে থাকা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের মধ্যেও এক মানবপ্রেমের শক্তিশালী সক্ষম অস্তিত্বকে চিত্রিত করে নিহালনি দেখিয়ে দেন, শেষপর্যন্ত মানুষে মানুষে প্রেমই সত্য। সাহসী রাজো সেখানে হয়ে ওঠে মানবতার মূর্ত প্রতীক।
`তমস` ছবির মূল চরিত্র দরিদ্র দলিত নাথু চামার। মাত্র পাঁচ টাকার লোভে, উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু দালাল চৌধুরীর ষড়যন্ত্রে সে শুয়োর মেরে ফেলে দিয়ে আসে মসজিদে। এরপরেই মন্দিরের সামনে পড়ে থাকতে দেখা যায় কাটা গরু। কিছুদিন আগে থেকেই চলতে থাকা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার পরিস্থিতিতে শুয়োর-গরু ঘটনা ধিকিধিকি জ্বলা ভয়াল আগুনে যেন ঘি ঢেলে দেয়। শুরু হয় হাড় হিম করা এক দাঙ্গা। চলতে থাকে এক ধর্মের উগ্রবাদীর অপর ধর্মের নিরীহ সাধারণ মানুষের ঘর লুঠ, ধর্ষণ আর হত্যা। সমাজের এই রক্তাক্ত অস্থির ভয়াবহতা দেখে নিজের করা অপরাধের জন্য বিবেক দংশনে নাথু চামার নিজেকেই দোষী মনে করে। নিজের প্রতি লজ্জায় সে তার জীবন-সঙ্গিনী কামোকে জানায়, তার জন্যই এই খুনোখুনি দাঙ্গা শুরু হয়েছে। সে-ই এই হত্যালীলার জন্য দায়ী। এই কথা শুনে তার স্ত্রী কামো তাকে এই বলে সান্ত্বনা দেয়, নাথু যদি দালাল চৌধুরীর কথায় ওই কাজ না করতো তাহলে টাকার লোভে ওই কাজ অন্য কেউ করতো। এবং এই দাঙ্গাও বাঁধত। কারণ সে রকম এক পরিস্থিতি আগে থেকেই তৈরি ছিল।
ফিল্মের এই অংশে কামোর ব্যাখ্যার মাধ্যমে পরিচালক নিহালনি নাথু চামারকে `আর্য বর্ণের` দ্বারা ব্যবহৃত হওয়া এক নিরপরাধী হিসেবেই দেখিয়েছেন। কারণ দরিদ্র `অনার্য বর্ণীয়` নাথুর মনে কোনোদিন অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি কোনো বিদ্বেষ ছিল না বা আজও নেই। কিন্তু এক উচ্চবর্ণের সামন্ত তার আর্থিক অভাবের সুযোগকে কাজে লাগিয়েছে। ভারতবর্ষে সবকটি দাঙ্গার ইতিহাস ঘাঁটলে এই একই বাস্তবতার ছবি উঠে আসবে। যেখানে অসহায় দরিদ্র দলিত, আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া আদিবাসী মানুষদের এভাবেই হিন্দুত্ববাদী শাসকশ্রেণি প্রায় একই উপায়ে ব্যবহার করে থাকে। তাই নাথুর স্ত্রী কামোর বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর, যে কোনো সচেতন মানুষের বক্তব্য হিসেবে এই সিনেমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শ্রমজীবী নাথুর মানবিকসত্তা পরিচালক এঁকেছেন তার অপরাধবোধে যন্ত্রণা পাওয়ার তীব্র বেদনায় মধ্যে। চলবে