চন্দ্রবিন্দু
শাহরুখ পিকলুপ্রকাশিত : মে ২৩, ২০১৯
বজলুর রশিদ আর হাকিম খান ছেলেবেলা থেকে বন্ধু। দুজনেই ঢাকাইয়া, কুট্টি ভাষায় তাদের কথোপকথন, গাল ছাড়া যেন মাকেও ডাকে না। বজলু অর্থাৎ বজলা ধোলাই খালে মোটরপার্টসের ব্যবসা করে, করিৎকর্মা বটে, যার গাড়ির চুরি যাওয়া মাল তার কাছেই বেচে দিতে পারে, শুধু কিছু কমিশান— বেশি চায় কিন্তু কমেই মেনে যায়, দাম কমায় কারণ ‘ইমান’ আছে না, আল্লাহ সব দেখে। নাস্তিক সে তো নয়, তওবা আসতাগফেরুল্লাহ!
হাকিম বাপের ‘আল-কুদ্দছ বিরিয়ানি এন্ড সুইটস’-এ বসে। সাইনবোর্ডে বিরিয়ানি লেখা থাকলেও মালিক, কর্মচারি, খদ্দের সকলেই বলে বিরানি। কাচ্চি বা চিকেন, যার যা রোচে, অবশ্য পকেটের ‘দৌড়’ বুঝে, নইলে আধাপচা মাছ সঙ্গে বিভিন্ন ভর্তা আর এক গাদা আঁচার দিয়ে ডাল-ভাত। পরের শ্রেণির সংখ্যাই বেশি। ক্যাশের চকচকে টেবিল যেন হাকিমের ‘রাজ-দরবার’। সেখানে মাছিটিও বসতে পারে না ক্ষণিক বিশ্রামের তরে, ঠপাশ! মোড়ানো পত্রিকা দিয়ে সে ওটার জান কবজ করে, নিমেষে। কাগজের খবর সব তো বস্তাপচা, পুরোনো, একঘেঁয়ে, টিভিতে আগেই সব পাওয়া যায়। অন্তত একটা কাজে লাগুক দশটা টাকার এই খামোখা অথচ ‘জরুরি’ ব্যয়। কিন্তু খাদ্যদ্রব্যের মাঝে যে মাছি ঘোরে তা আল্লাহ’র হাওলা বা কাস্টমারের কপাল। এই হোটেলের রান্নাঘর নিয়ে একটা বিরাট উপন্যাস লেখা সম্ভব। যাক্, হবে অন্য কোনো দিন। এখন আমরা বজলাকে দেখি বরং।
এখানেই এক প্লেট কাচ্চি মেরে, তার শেষে একটা পান্তুয়া মুখগহবরে চালান দিয়ে রোজ রাতে বজলু ঢেঁকুর তুলে বাড়ি ফেরে। বাড়ি তার যুগিনগরের ছাপরায়। খাওয়া শেষে নিউজপ্রিন্টের বিলের বুক চিড়ে ‘বজলু’ নামটা লেখে, তাতে অনুস্বাক্ষর দেয় হাকিম খাঁন। মাসশেষে যা খুশি কিছু দিয়ে দেয় হাকিমের ক্যাশে। বন্ধুদের মাঝে কিসের আবার হিসেব!
হাকিমের ‘আল-কুদ্দুছের’ পাশের ডেরায় একদিন ফিরে এলো ঝন্টু মিয়ার হঠাৎ বিধবা কন্যা মনু। মাত্র বিশ ছুঁয়েছে বাকয়টা দিন মোটে বাকি। চুলবুলে যুবতী মেয়ে সে, যৌবন সারাদেহে যেন খরস্রোতা নদী ব্লাউজ মানে না প্রকৃতির ‘কুদরত’। পথে চললেই ঝলক ঝলক নৃত্য, বক্ষে আর কোনো দ্বিতীয়‘বন্ধনী’ থাকে না তার। চোখ দুটোতে রিরংসার ইঙ্গিত। বজলু-হাকিমের ছবিতে দ্যাখা সেই বাচ্চাকালের শর্বরী। শর্বরী মানে রাত হলেও সত্তর দশকে বেড়ে ওঠা ছেলেপুলেদের কাছে সে সূর্যের থেকেও প্রখর। কি না ড্যান্স দিতো ছবিতে! মনুকে তারা শর্বরী নামেই ডাকা শুরু করলো। তাকে দেখে বজলা আর হাকিমের দণ্ড আর ঘরে থাকতে চায় না। ‘মাল’ বিশেষণটা পুরো নারিন্দায় ছড়িয়ে পড়লো, নিমেষে। পুরুষ মাথা খরচ করে যতই ভাবুক উদিয়মান ‘দণ্ডের’ কাছে পৃথিবীর নিয়ম একটাই। বুঝেছেন তো। বিস্তারে আর গেলাম না।
‘হালার মাগীর ঠমক দেখছস!’ বলে বজলা, ‘মন চায়...’
‘কি কছ বে, কাচ্চির বিল দিছোস? কত আর ফোকোটে খাবিরে বজলা?’ বিলে হাকিমের নাম দেখে চমকে উঠলো বজলু, প্রো: হাকিম খান!
‘কিবে হাকিম, খানের লগে চান্দ সাঁটাইলি কবেত্থন? খান!’
‘ওটাই আমার অখনকার নাম। মন্ত্রীর লাহান। মাল ফালা, নইলে বাকিতে কাচ্চি বন।’
‘কচ কি, মাঙ্গের পুত! তুই কি মন্ত্রী হইছস নিরে?’
‘ধর তাই। প’সা দিবি, ডেইলিরকার তয় খাবি। নাইলে খাওন বন’।
‘অ, বুচ্ছি। আমি শর্বরীরে দিলে পাই কইয়া তোর পিত্তি জ্বলে! তুই শর্বরীরে করবার চাস কইলেই হয়। আমি কিন্তু হুনছি, বেটির ব্যরাম আছে, লক্ষীবাজারের ফজলে কইছে। ফজলরে চিনছস তো?’
‘বাইর হ, তোর মায়রে চুদি, জুতা দিয়া মাইরা খোমা ঝুলাইয়া দিমু। তুই বালের কথা কচ ক্যালা!’
‘দেখিস তুই, মাঙ্গের পো’, চিৎকার করে বেরিয়ে গেল বজলু।
বজলা বহুদিন আর হাকিমের দোকানে ঢোকেনি, কাচ্চি খায়নি। মনু অর্থাৎ সেই বজলা-হাকিমের শর্বরীর বিয়ে হলো মোহাম্মদ আলী খানের সঙ্গে যে কিনা কয়েক কোটি খরচ করে মধ্যপ্রাচ্যে পালিয়ে গেছিল। এক সময়ে সে পুরান ঢাকার টপ মাস্তান ছিল, ফেন্সিডিল আর ঘুমের ইনজেকশানের ব্যবসায় থেকে আয়-উন্নতি, তখনো ইয়াবা হানা দেয়নি। তাছাড়া বেশ কয়েকটা খুনের আসামি সে। দেশে ফিরেছে ঝোব্বা-ঝাব্বি লাগিয়ে, হাজী সাহেব, মাথায় টুপি, দাড়ি-চুলে মেহদির লাল-কমলা রঙ। নতুন একটা নিকাহ্ করেছে, ‘চয়েস’ হয়েছে মনুকে। আগের বউ তার দুই বাচ্চা নিয়ে কোথায় গেছে সে জানে না, জানার ইচ্ছাও নেই।
মনু ইতোমধ্যে শুধু নারিন্দা এলাকায় না, ঢাকা শহরেই ফেমাস। সিনেমায় নায়িকার সখী হয়ে ড্যান্স দেয়, রাত-বিরাতে পাঁচ তারা হোটেলে ‘খ্যাপ’ মারে। নতুন নাম নিয়েছে মান্দাকিনি। মান্দাকিনি কেন তা মনু জানে না কিন্তু এক প্রযোজক তার চেহারা দেখে এককা্লের বোম্বাইয়ের নায়িকার নামটা ওকে ধরিয়ে দিয়েছে, তাদের চেহারায় ও শরীরের গড়নে নাকি মিল আছে। সে বহু আগেই বজলু-হাকিম ক্লাশ থেকে আরো উপর লেভেলে বিচরণ শুরু করেছে। তবে যে রোগে তার স্বামী অকালে মরেছে, সেই রোগ যে তার দেহেও আছে তার উপস্থিতি সেই প্রযোজকই টের পায়, তাকে চিকিৎসা-ওষুধ দিয়ে সারিয়ে তোলে। প্রতিদানে মান্দাকিনির ইনকামের উপর তার একটা ভাগ ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’। তবে মোহাম্মদ আলী খান মাস্তানের শাদীর ইচ্ছায় বাগড়া দেয়ার সাহস আর তার হয়নি।
প্রায় বছরের উপর ফারাক দিয়ে বজলু হাকিমের দোকানে এলো একদিন, কাচ্চি খেলো। কাউন্টারে বসা হাকিমের ছেলে মুকিম। অকালে শয্যাশায়ী এখন হাকিম, সিফিলিসের চিকিৎসা ঠিক সময়ে নেয়নি বলে তা মস্তিষ্ক গুবলেট করে দিয়েছে, বেশিদিন আর নেই সে। হাকিমের শারীরিক দৈন্যদশার কিছু খবর সে পেয়েছিল কিন্তু এতটা খারাপ তা সে জানতো না। সেই ঝগড়ার জেদটা পুষেছে বহুদিন। হাকিমের ছেলেই বিল পাঠালো। স্বাক্ষর তাতে, মুকিম খাঁন, ম্যানেঞ্জার। ম্যানেজার লিখতে শেখেনি সে কিন্তু চন্দ্রবিন্দুর মোহে সে ঠিকই পড়েছে।