ঘুরে আসা যাক মেঘালয়ের ঝরনা-বিলাস
ছাড়পত্র ডেস্কপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৪
আসছে গরমকাল। প্রচণ্ড গরমে পরিকল্পনা করা যেতে পারে মেঘালয়ের ঝরনা বিলাসে। সকালে রাস্তায় বের হলে কড়া রোদের চমকে ওঠা চাদরের নিচে তাল মিলিয়ে চলতে হচ্ছে আপনাকে। অনেকদিনের জমানো ছুটিটা যদি এবার নেওয়া যায় তাহলে কোথায়? দেশের ভেতরে তো যাওয়া যেতেই পারে। কিন্তু এখন দেখতে ইচ্ছে করবে ঝরনা। অসংখ্য ঝরনা। চপল পায়ে ধেয়ে যাওয়া ঝরনা। তবেই মিলবে শান্তি।
সমুদ্র নয়, পাহাড় নয় চাই ঝরনা। সে সুযোগ হাতেই আছে। ভেবে দেখুন, যাওয়া যায় মেঘালয়। বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি প্রদেশ। এ রাজ্যের উত্তর ও পূর্ব দিকে আসাম রাজ্য এবং দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে বাংলাদেশ। মেঘালয় উত্তর-পূর্ব ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোর অন্যতম। শিলং হচ্ছে তার রাজধানী। শিলংকে বলা হয় প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৯০৮ ফুট উচ্চতায় শিলংয়ের অবস্থান। গত বছরের আগস্টে প্রায় ৩ রাত ৪ দিন কাটানোর একটা ছোট গল্প আপনাদের জন্য! এখন থেকে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে আগস্টের নাগাদ ব্যবস্থাটা হয়েই যাবে। অর্থাৎ সব প্রস্তুতি দ্রুত শেষ করে ফেলা যায়।
প্রচণ্ড গরমে ধুকতে থাকা এই সময়টা সহ্য করে একদম শেষ সময়টায় শান্তির একটা আভাস নিয়ে আসতে পারেন ঐ আগস্টে। যাত্রার পথটাও করে নিন দ্রুত ও সহজ। সোজা চলে যান সিলেট। সেখান থেকে তামা-বিল বর্ডারে পৌঁছে ট্যাক্সটা পরিশোধ করে নেবেন। বর্ডারে কাজ শেষ হলে মেঘালয়ের প্রবেশপথ ডাউল বাজার। বাজারে বসে দুই দেশের সীমান্তের মধ্যকার সমন্বয়ের পরিবেশটা আপনায় অদ্ভুত এক অনুভূতি জোগাবে। ঘুরে-টুরে একটা ছোট মারুতি ভাড়া করে নিন। এই গাড়িটি আপনায় ডাউকির সব স্পট ঘুরিয়ে দেখাবে। গাড়িতে চড়ার পর ঝুলন্ত ব্রিজের সফর। ব্রিজটির নাম উমগ্রেট। উমগ্রেট দিয়ে সোজা মেঘালয়ে পৌঁছে গেলেন। হ্যাঁ, এতটাই সহজ।
শুরু হলো আপনার যাত্রা। প্রথমেই আপনার গন্তব্য উমিক্রেন ফলস। যদি ভাগ্য ভালো হয় আর বৃষ্টি পড়ে তাহলে এই ঝরনার আসল চেহারা দেখতে পারেন। উমিক্রেন ফলস থেকে এগিয়ে যাবেন মাওলাইনং গ্রামের দিকে। যাওয়ার পথে রাস্তায় চোখে পড়বে অনিন্যসুন্দর এক ঝরনা। এর নাম বোরহিল ফলস। ঝরনার ঠিক নিচেই একটি ব্রিজ। ব্রিজের নিচ দিয়ে এই পানি বাংলাদেশের বিছানাকান্দিতে পৌঁছায়।
মাওলাইনং গ্রামে গেলে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারবেন না। এত গোছানো ও সুন্দর এক গ্রাম। বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে পরিষ্কার গ্রাম মাওলাইনং। ঠিক এর পাশেই রয়েছে লিভিং রুট ব্রিজ। প্রথম থেকেই এই গ্রামের লোকেরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে খুবই সচেতন। এই গ্রামে রাস্তার কোণে কোণে রয়েছে বাম্বু ক্যাপের মতো দেখতে ডাস্টবিন। যা এই গ্রামের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শুধু যে গ্রামটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন তা কিন্তু নয়, গ্রামের মানুষের ও পোশাক-পরিচ্ছদ বাড়িঘর সবকিছু একদম ঝকঝকে তকতকে। এই গ্রামে ট্যুরিস্টরা যেসব নোংরা ফেলে তা পরিষ্কারের জন্য তাদের কাছ থেকেই ডোনেশান নেওয়া হয়।
গ্রামটির সৌন্দর্য উপভোগ করে থেমে থাকার তো সুযোগ নেই। যেতে হবে রুট লিভিং ব্রিজে। মূল রাস্তা থেকে সিঁড়ি বেয়ে বেশ খানিকটা নিচে নামতে হয় এই ব্রিজ দেখতে। লিভিং রুট ব্রিজের নিচ দিয়েও বয়ে গেছে নাম না-জানা একটি ঝরনার প্রবাহ! সিঁড়ি ধরে বেশকিছু দূর ট্রেকিং করে নামার পরই চোখ আটকে যাবে আশ্চর্য এই সেতুতে। এখানকার এন্ট্রি ফি ৪০ রুপি। গ্রামের পাহাড়ি নদী থাইলংয়ের ওপরে প্রাকৃতিকভাবে গাছের শেকড়ে তৈরি সাঁকোটি দেখতে প্রতিদিনই ভিড় জমান অসংখ্য পর্যটক। বিশাল দুটি গাছের শেকড় জড়াজড়ি করে আছে ঝিরির ওপরে। একটু একটু করে বেড়ে প্রাকৃতিক সেতু তৈরি করেছে গাছ দুটি। সেই সেতুর ওপর দিয়ে অনায়াসে পার হয়ে যেতে পারবেন।
এভাবে ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা নেমে আসতে পারে। তাই বলে থেমে যাবেন? রওয়ানা দিন চেরাপুঞ্জির দিকে। ডাউকি পার হয়ে পাহাড়ি পথ ধরে শুরু হবে যাত্রা। জনমানবহীন এই রাস্তা দেখে ভয় লাগতেই পারে। তবে চারদিকে পাহাড়ের সাজ আপনায় মুগ্ধও করবে। মনে রাখবেন, চেরাপুঞ্জিতে আগে থেকেই স্টের ব্যবস্থা করতে হবে। এখানে ঠাণ্ডা অনেক। তাই ঠাণ্ডা জামাও রাখতে হবে। রাতে থেকে সকালে একবার বাইরে তাকান। পাহাড় দেখা যায়। আকাশে মেঘের ভেলা একের পর এক ভেসে চলে দূরে। তালিকায় প্রথমে ছিল নোয়াকালিকাই ফলস। সোহরা থেকে প্রায় ২ ঘণ্টার কাছাকাছি সময়ে আপনি পৌঁছে যাবেন গন্তব্যে।
ভ্রমণের সময় অবশ্য অদ্ভুত এক অনুভূতি গ্রাস করবে আপনাকে। মনে হবে জমজমাট একটি শহর হুট করে ভূতুড়ে শহরে পরিণত হয়েছে। এখানে সেখানে পরিত্যক্ত কারখানা এবং ঘরবাড়িগুলো অনেক পুরনো। নোয়াকালিকাই ফলসটি মেইন ভিউ পয়েন্ট থেকে অনেক নিচে। সব সময় মেঘ দিয়ে আচ্ছন্ন থাকে, খুব পরিষ্কার ভিউ পেতে ভাগ্যের সহায়তা প্রয়োজন। প্রায় ১ ঘণ্টার অপেক্ষার পর কিছু সময়ের জন্য সুন্দরভাবে দেখা পাবেন এই সুন্দর ঝরনাটির। এরপর আবার মেঘের চাদরে ঢাকা পড়ে যায়। পরবর্তী গন্তব্যের জন্য আবার সোহরা শহরে ফিরে আসতে হবে। পথে পাহাড়ের সারির দেখা মিলবে, এই রাস্তা তুলনামূলক খারাপ। তাই ভেবেচিন্তে ভালো গাড়ি নেবেন।
প্রথমে আসবে ডেমথেম ফলস। এখানে পাহাড়ে পা ঝুলিয়ে বসে মেঘের সঙ্গে ঝরনা দেখার অনুভূতি নেওয়া যায় অনায়াসে। ডেমথেমের পালা শেষ যাত্রা শুরু ওয়াশিয়া ডং ঝরনার দিকে। এই ঝরনাটির বিশেষ দিক থেকে ৩ ধাপ হয়ে পানি সমতলে মিলিত হয়েছে। রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা পাহাড়ি পথ ট্রাকিং করে নিচে আসতে হবে ঝরনাটি দেখতে। পাহাড়ি পথ। বাঁশের সিঁড়িসহ গাছের গুঁড়ির সিঁড়ি দিয়ে নেমে আপনাকে এই ঝরনা পর্যন্ত আসতে হবে। এই ঝরনার পানিতে ঝাপ দিয়ে গোসলও করে নিতে পারেন। স্বচ্ছ পানি বরফের মতো ঠাণ্ডা। ঝরনার এই সারির যাত্রা শেষ হবে ঠিক সেভেন সিস্টার্স ঝরনায়।
সন্ধ্যার ঠিক আগমুহূর্তে সোহরা শহরের সেভেন সিস্টার্স ফলসের ভিউ পয়েন্টে সন্ধ্যার আগেভাগে যেতে হবে কিন্তু। সূর্যাস্ত এখানে এত সুন্দর! এটি আপনি চেরাপুঞ্জি ইকো পার্ক হিসেবেও ধরতে পারেন, এখানে মৌসুমি কেইভ নামে একটা গুহা থাকলেও সময় অভাবে সেটি দেখা হয়নি। চেরাপুঞ্জিতে আরও কিছু স্পট রয়েছে। যেমন- ডাবল ডেকার রুট ব্রিজ, রেইনবো ফলস, ওকাবা ফলসসহ আরও কিছু। কিন্তু আমাদের রুট প্ল্যান অন্য হওয়ায় এগুলোতে আমরা যেতে পারিনি। ঝরনাবিলাসেই দুদিনের ভ্রমণ শেষ হতে পারে যদি না আবার শিলং শহরে যান। সে আরেক গল্প। তবে মেঘালয়ের মেঘরাজ্যের ভেতর লুকিয়ে থাকা বৈচিত্র্যময় ঝরনা আপনায় অন্তত দীর্ঘ তাপদাহের কষ্ট ভোলাবেই।