ঘরে ঘরে এখন প্যারানয়েড মানুষ
হেলাল মহিউদ্দিনপ্রকাশিত : জুলাই ৩১, ২০১৯
ছেলেধরা সন্দেহে হত্যাগুলো শুধুই মব (উন্মত্ত জনতা) আচরণ নয়, মানুষের প্যারান্যয়া বা গভীর ভীতি-আতংকগ্রস্ততার প্রকাশ। সাপ যেরকম প্যারানয়েড। তার হুটহাট ছোবল আসলে নিজে আক্রান্ত হচ্ছে আশংকায় ভয়-আতংকজনিত আত্মরক্ষার অস্থির প্রতিক্রিয়া মাত্র।
বাংলাদেশে ঘরে ঘরে এখন প্যারানয়েড মানুষ। একজনের ভয় অন্যজনের মধ্যে সংক্রামক ব্যধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। কারণ একটি চেইন রিঅ্যাকশন। পারস্পরিক আস্থাহীনতা (ট্রাস্টলেসনেস) ও নিরাপত্তাহীনতাবোধ (সেন্স অব ইন্সিকিউরিটি) বাড়াচ্ছে। ফলে প্রত্যেকের মধ্যেই মাত্রাতিরিক্ত নিরাপত্তা-সতর্কতা (ওভার-প্রোটেকটিভনেস) বাড়ছে।
কাউকেই আস্থায় নিতে না পারা শুধুই বিপদ-বিপদ ভাবা, সাবধান-সাবধান ভীতিতে ভোগা বাড়াচ্ছে। প্রতিক্রিয়ায় নিজের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে অন্য কেউই করবে না, রাষ্ট্র-পুলিশও না— এই অনুভূতি দ্রুত বাড়ছে। ফলাফল একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী এখন প্যারানয়েড।
প্যারানয়েড মানুষ অ্যাতোটাই আতংকগ্রস্ত যে, ‘আইন হাতে তুলে নেবেন না’ সতর্কতাবাণীটি তার কাছে অর্থহীন। ‘রাষ্ট্র নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষায় সক্ষম’ বিশ্বাসটি ভেংগে পড়লে নাগরিক প্যারানয়েড হতে বাধ্য।
১৯৭৫ সালে সাউদার্ণ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ড্যানিয়েল গ্লেস্যার ‘স্ট্রাটেজিক ক্রিমিন্যাল জাস্টিস প্ল্যানিং’ শিরোনামে একটি অসাধারণ অপরাধ গবেষণাগ্রন্থ লিখেন। বইটিতে এই ধরণের গুজববাহিত হত্যাকাণ্ডকে ‘মব জাস্টিস’ বা ‘মব ক্রাইম’ বলা বন্ধ করে ‘প্যারানয়েড গ্রুপ ভায়োলেন্স’ বিবেচনা করার যৌক্তিক পরামর্শ দিয়েছিলেন। রাষ্ট্র জননিরাপত্তায় ব্যর্থ হলেই যে ‘প্যারানয়েড গ্রুপ ভায়োলেন্স’ বাড়ে সেইসবও বলে গেছেন। পৃথিবীর প্রায় সব জনকল্যাণমুখি দেশই তার সুপরামর্শটি আমলে নিয়েছে। ফলে ‘প্যারানয়েড গ্রুপ ভায়োলেন্স’ সেইসব দেশ হতে তিরোহিত হয়েছে।
ধরা পড়া চোর-ডাকাত-ছিনতাইকারীদের পুলিশের হাতে দিলে পুলিশ ঘুষ খেয়ে ছেড়ে দেবে আশংকায় জনগণ নিজেরাই তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলে। এক্ষেত্রেও ‘প্যারানয়েড গ্রুপ মানসিকতা’ একই রকম। ‘গুজব’ বড় বিষয় নয়; যাকে ছেলেধরা ভাবা হয়ে গেছে সে অপরাধী এবং পুলিশে দিলে ছেড়ে দেবে ‘প্যানিক’ এবং ভাবনা হতেই পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়।
‘প্যারানয়েডলি ভায়োলেন্ট’ একজনের ছবি জুম করে তাকে ধরে এনে খুনি প্রমাণ করে ফাঁসি দিয়ে দিলে অবিচার তো হবেই, এইরকম ভায়োলেন্স বাড়তেই থাকবে এবং কিছুদিন পরপর ফিরে ফিরে আসবে। আইনের শাসন এবং সুবিচারের দাবি তোলা হোক, কাউকে ফাঁসি দিয়ে দেবার দাবি-দাওয়ার নিষ্ঠুরতা বন্ধ হোক।