গোপন সত্যি

শেষ পর্ব

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৬, ২০১৯

কী করে যে এমনটা ঘটল, বলতে পারব না। কোনো অসুখ-বিসুখ নেই। অসম্ভব কষ্ট পেয়েছিলাম। বলতে কি, জীবনের সবচে বড় আঘাতটা আমি সেদিন পাই। প্রথম বাবা হওয়ার আনন্দ যে এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাবে, তা ভাবতে পারিনি। আসমা নির্বিকার মুখে বসে রইল। তবে সেদিন সন্ধেয় বারান্দায় বসে বাথরুমের ভেতর অনেকক্ষণ ধরে গুনগুন করে কান্নার শব্দ পেলাম। অন্ধকারের দিকে চেয়ে আমার চোখও ঝাপসা হয়ে এলো। এরপর থেকেই আসমার সঙ্গে আমার রাতের যোগাযোগটা আস্তে আস্তে কমে এলো। তবে একেবারে বন্ধ হলো না ব্যাপারটা। ভীষণ রকম ক্লান্তি এলে অথবা মাঝরাতের দিকে নিজেকে হঠাৎ একা নিঃসঙ্গ মনে হলে পাশ ফিরে তাকে বুকে টেনে নিই। এভাবে বছর দুয়েকের মাথায় আমাদের দ্বিতীয় বাচ্চাটা এলো। ছেলেটা আগের বাচ্চাটার মতো দেখতে অত সুন্দর না হলেও একেবারে মন্দ ছিল না।
 
ভদ্রলোক থামলেন। নিশ্বাস নিলেন বুক ভরে। গম্ভীর গলায় বললেন, এখান থেকেই আমার গল্পটার শুরু। আবার শেষও ধরতে পারেন। গল্পের মূল ঘটনা এবার বলব। আপনি হয়তো অস্বস্তি বোধ করতে পারেন। তবে আমার অনুরোধ, এ পর্বটুকু একটু মনোযোগ দিয়ে শুনুন। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়ে গেছে। আসমা রান্নাঘরে টুকিটাকি হাতের কাজগুলো সারছে। দুপুরের ভাতঘুমের আশায় একটা বই হাতে বিছানায় এসে চিৎ হয়েছি আমি। পাশে আমার আট মাসের শিশু পুত্র। এতটুকু পুতুলের মতো নিঃসাড় হয়ে ঘুমোচ্ছে। তার নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি। ঝুঁকে তার কপালে একটা চুমু দিয়ে বইটা মেললাম। কখন পড়তে আরম্ভ করেছি খেয়াল নেই। হঠাৎ শুনতে পেলাম, কে যেন বলছে, কী পড়ছ আব্বু?

চমকে উঠলাম। কে ডাকল? ঘরে তো কেউ নেই? রান্নাঘর থেকে থালাবাসনের টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে। এছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। নির্জন দুপুর। বাইরে ঝাঁ ঝাঁ করছে রোদ। দূরে কোথায় যেন কর্কশ গলায় কেউ গান গেয়ে উঠল। আমি ভাইজান, ভূতপ্রেতে মোটেও বিশ্বাস করি না। তবে আব্বু বলে কে ডাকতে পারে আমাকে? ব্যাপারটা ভারি গোলমেলে মনে হলো। হয়তো আমার মনের ভুল। আমি নিশ্চিত হলাম, অবশ্যই আমার মনের ভুল। এ যুক্তি দাঁড় করিয়ে মনটাকে শক্ত করলাম। প্রথমে বিষয়টাকে গুরুত্ব দিলাম না। এরকম উদ্ভট কোনো কিছুতে গুরুত্ব দেয়া যায় না। বইয়ে মন দিলাম।
ভয় পেয়েছো আব্বু?

এবার ভাইজান চরমভাবে আঁতকে ওঠার অবস্থা আমার। অবিশ্বাসের কিছুই আর বাকি রইল না। পষ্ট দেখলাম, আমার শিশুপুত্র স্থিরচোখে চেয়ে আছে আমার দিকে। এরকম বিস্ময়কর চোখ এর আগে কখনো দেখিনি। বয়স্কদের মতো পরিষ্কার ভারি গলায় সে বলছে, কথা বলছ না কেন? ভয় পেয়েছ আব্বু?

থাসম্ভব ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাপারটা ভাবতে লাগলাম। যদিও মাথা ঠাণ্ডা রেখে কিছু ভাবা সে মুহূর্তে খুবই শক্ত ছিল। কথাগুলো কি আমার শিশুপুত্রই বলছে, নাকি আমার অবচেতন মন? নিজেকে বোঝাতে লাগলাম, শিশুরা কখনো কথা বলতে পারে না। এ রকম উদাহরণ কেউ কোনো দিন দিতে পারবে না। কোনো যুক্তি নেই এর, আর যুক্তি ছাড়া সবকিছুই বাস্তবতাবিরোধী। একথা কাউকে বললে নিশ্চয়ই পাগল ভাববে আমাকে। কিন্তু কতদিন আর এভাবে নিজের সঙ্গে মিথ্যে বোঝাপড়া করা যায়!

আরেক দিনের ঘটনা। সকালে অফিসে যাওয়ার আগদিয়ে চশমাটা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না। আসমা তখন রান্নাঘরে। হাজার খোঁজাখুঁজি করেও লাভ হলো না। কিন্তু চশমাটা পাওয়া দরকার। চশমা ছাড়া অফিসে কাগজপত্র দেখব কি করে? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে চিরুনি চালাতে চালাতে শুনলাম, বাড়িতে তোমার চশমা নেই আব্বু। অফিসে তোমার টেবিলে ফেলে এসেছো কাল।

আমি হতবাক। আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? করুণ চোখে চেয়ে রইলাম ছেলেটার দিকে। কী ঘটছে এসব? আমার বুকের ভেতরটা অবশ হয়ে এলো। একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল আমার পিঠের ওপর দিয়ে। আমার রক্তের সন্তানকে নিজের কাছেই অচেনা অজানা মনে হতে লাগল। আবার ভয়ও হতে লাগল। বিস্ময়-বিহ্বল চোখে চেয়ে রইলাম। প্রায়ই ঘটতে লাগল এরকম ঘটনা। সময় নেই অসময় নেই, আমার পুত্রটি নানা রকম বিচিত্র টাইপের কথাবার্তা বলে ভড়কে দিতে লাগল আমাকে। অসহ্যের চরম সীমায় পৌঁছে গেলাম। তবে একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম, অন্য কেউ থাকলে এরকম ঘটে না। কাউক সে কিছু বলে না। আমিই কেবল এই ভৌতিক ঘটনার সাক্ষি। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনের নিয়মিত যাতায়াত। তারা কখনো এরকম বিব্রতকর অবস্থার ভেতর পড়েনি। আসমাও নয়। শুধু আমাকেই পুত্রটি তার কথা বলার মানুষ হিসেবে বেছে নিয়েছে।

বদরুল আলম থামলেন। বাইরে শেষবিকেলের ম্লান আলো নাচানাচি করছে। ভূতগ্রস্থের মতো অনেকক্ষণ ঠায় বসে রইলেন তিনি। তারপর বললেন, এ ঘটনা যাকেই বলছি সে-ই অবিশ্বাসে ঠোঁট উল্টিয়ে বলেছে, যত্তসব গাঁজাখুরি গল্প। পাগল টাগল হয়ে গেলেন নাকি ইঞ্জিনিয়ার সাহেব? আসমাকে বললে সে বড় বড় চোখ করে চেয়ে থাকে। মুখে কিছু বলে না। সপ্তাহখানেক আগে বিল্লাহ সাহেবের কাছ থেকে কথা প্রসঙ্গে আপনার কথা শুনলাম। মনোবিজ্ঞানের ওপর নাকি আপনার কিছু গবেষণা আছে। ভাবলাম, আপনার সঙ্গে একবার দেখা করে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করি। যদি আপনি কোনো ব্যাখা দিতে পারেন।

ভদ্রলোকের কথাবার্তা শুনে বেশ একটা গোলমেলে অবস্থায় পড়ে গেলাম। কী করে সম্ভব এটা? কেউ কোনোদিন শুনেছে এরকম ঘটনা? পুরো ব্যাপারটা মাথার ভেতর জট পাকিয়ে গেল আমার। অলৌকিক কোনো কিছুতেই বিশ্বাস করি না। পৃথিবীতে যা কিছু ঘটুক না কেন, প্রতৃতি নিজের অজান্তেই তার একটা না একটা প্রমাণ রেখে যায়। কিন্তু এ ঘটনার কী প্রমাণ থাকতে পারে! ঠিক বুঝতে পারলাম না।

একটু বসুন, বলেই বাথরুমে চলে এলাম। এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। চোখ বন্ধ করে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। পানির ছিটা দিলাম চোখমুখে। মুখের চামড়া এতক্ষণ টানটান হয়ে ছিল। ঠাণ্ডা পানির ছোঁয়া পেয়ে বেশ একটা সতেজ ভাব ফিরে এলো। চোখ খুললাম আস্তে আস্তে। মাথাটা বেশ হালকা হালকা লাগছে। আয়নায় নিজের মুখ দেখতে লাগলাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কোনো কারণ ছাড়াই পানি দিয়ে আয়নায় লিখলাম, আসমা। ফিরে এসে দেখি ভদ্রলোক জানলার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে চেয়ে আছেন। ভারি অসহায় দেখতে তার এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকা। পায়ের শব্দে ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন, ভাইজান, চলি তাহলে। সন্ধে হয়ে আসছে।

বদরুল সাহেব, আপনার কথা আমার মনে থাকবে। আমি ভেবে দেখব।
জি ভাইজান, ভেবে দেখবেন।
আপনার পুত্রটি এখন কেমন আছে?
সে বেঁচে নেই। প্রথমটার মতো এ বাচ্চাটারও মৃত্যুর কোনো কারণ নেই।
কিছু বলতে পারলাম না। কোনো কথাই বের হলো না আমার গলা দিয়ে। পুরো ঘটনার ভেতর অদ্ভুত একটা যোগসূত্র রয়েছে। তা যে ঠিক কি, ধরতে পারছি না। পরে হয়তো পারব। মাথা এখন কাজ করছে না। আচ্ছা ভাই, আপনার প্রথম বাচ্চাটার মধ্যেও কি এরকম কোনো ব্যাপার লক্ষ্য করেছেন?
জি করেছি। একটা ব্যাপার আমাকে বেশ ভাবনায় ফেলে দিয়েছিল, জন্মের পর সব বাচ্চাই কাঁদে। কিন্তু সে পৃথিবীর প্রথম আলো দ্যাখে গম্ভীর মুখ নিয়ে। এ গাম্ভীর্য মৃত্যুর আগপর্যন্ত ছিল। সে কখনো কাঁদেনি। দুধ না দিলেও টুঁ শব্দটি করত না। কথা বলতে বলতে ভদ্রলোক মাথা নিচু করে ফেললেন।
অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, তিনি কাঁদছেন। সম্ভবত তার মৃত বাচ্চাটার কান্না তিনি এখানে এ মুহূর্তে কেঁদে দিচ্ছেন। রুমাল বের করে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, খুবই কষ্ট ভাইজান, খুবই কষ্ট!

আমি তাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলাম। যাওয়ার আগে বললেন, গতমাসে মারা গেছে আসমা। বাথরুমে মরে পড়ে ছিল শক্ত হয়ে। বাথরুম প্রিয় ছিল তার। একটু থেমে উদাসভাবে চেয়ে থেকে বললেন, তিনজনই অস্বাভাবিকভাবে... হয়তো আমারও... কিছুই মিলছে না ঠিকঠাক...।
এই ঘটনার কিছুদিন পর একটা হলুদ রঙা খাম এসে পৌঁছালো আমার হাতে। ঝিনাইদহ থেকে দুলাভাই লিখেছেন।

স্নেহাস্পদেষু,
ভালোবাসা নিও। আমি জানতে পারলাম, ইঞ্জিনিয়ার বদরুল আলম সাহেব তোমার ওখানে নাকি গিয়েছিলেন। তার কথা কি তুমি বিশ্বাস করেছ? বিশ্বাস করার কোনো কারণ কিন্তু নেই। কেননা ভদ্রলোক যা বলছেন তা নিতান্তই অসম্ভব। আশা করি, তুমিও তা বুঝতে পেরেছো। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকেই তার মানসিক সমস্যা দ্যাখা দিয়েছে। জনে জনে অতিশয় আজগুবি সব কথাবার্তা বলে বেড়াচ্ছেন। যার মাথামুণ্ডু কেউই বুঝতে পারছে না। সকলেই জানে যে, আসমা মারা গেছে। কিন্তু তিনি বলে বেড়াচ্ছেন আসমা মারা যায়নি। রাতে তাদের দুজনের কথা হয়। রাতে ছাড়া তাকে দেখা যায় না। গ্রামের দু’চারজনও নাকি আসমাকে রাতে বারান্দায় রাতে বসে থাকতে দেখেছে। ব্যাপারটা নিয়ে এলাকায় একটা হুজুগের মতো সৃষ্টি হয়েছে। এসব গুজব সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। যুক্তি ছাড়া। সুতরাং বদরুল সাহেবের কথা ধর্তব্যের ভেতর না আনাই বুদ্ধিমানের কাজ।
আমি, তোমার আপা এবং বাচ্চারা ভালো আছি সবাই। সময় করে বেড়াতে চলে এসো। গ্রামে দেখার অনেক কিছুই আছে। তোমরা শহরের মানুষ তা অনেক সময় বুঝতেও পারো না।

কল্যাণ কামনায়
আরেফ বিল্লাহ
মনোহরপুর, ঝিদাইদহ।

চিঠিটা কোলের ওপর রেখে বারান্দায় অনেকক্ষণ বসে রইলাম আমি। দুলাভাই পুরো ব্যাপারটাকে ধর্তব্যের ভেতর না আনার জন্য উপদেশ দিয়েছেন। কিন্তু আর কেউ না জানুক, অন্তত আমি তো জানি, সৈয়দ আহমদ বদরুল আলম জনে জনে যা বলে বেড়াচ্ছেন তা কতখানি সত্যি। এ সত্যি কেবল নিজের ভেতরই গোপন রাখা যায়, কাউকে বলা যায় না কখনো।