গুজবের ফায়দা, প্রিয়া গং এবং কিছু কথা

হাসান আজারকাত

প্রকাশিত : জুলাই ২৭, ২০১৯

ইস্যু ও টয়লেট টিস্যু এই দুইয়ের সবচেয়ে বড় মিল হলো, এদের যত টানা যায় ততই রোল হতে থাকে, আবার চাইলে মাঝখানে ধরে টান দিয়ে ব্যবহার করে ফ্ল্যাশ টিপে গর্তে ঢুকানো যায়। কয়েকদিনের হট ইস্যুগুলো প্রায় মেয়াদোত্তীর্ণ। নতুন ইস্যুর সন্ধান চলছে। এই অবস্থায় আমি কয়েকদিনের পুরোনো ইস্যুগুলো নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।

প্রথমত, কল্লাকাটা বা ছেলেধরার ব্যপারটা নিয়ে আসছি। পদ্মা সেতু প্রজেক্টে কর্মরত চীনা কর্মকর্তা প্রজেক্টের জন্য বললেন, আরো মাথা চাই। একটা নিউজ পোর্টাল ক্লিক পাওয়ার আশায় নিউজ করলো পদ্মা সেতুর জন্য অনেক মাথা লাগবে। নিউজ দেখে শিক্ষিত ও অশিক্ষিত মূর্খ পাঠকেরা বুঝল, পদ্মা সেতুর জন্য মানুষের কল্লা লাগবে। ভেরিভাই না করে তারা নিউজ ভাইরাল করলো। সাথে সাথে একটা মহল বিভিন্ন দেশের কল্লা কাটার ভিডিও ভাইরাল করে বাংলাদেশের ঘটনা বলে চালিয়ে দিয়ে আতংকের পরিবেশ সৃষ্ট করলো। এরই মাঝে নেত্রকোনায় এক ছেলের ব্যাগে একটি শিশুর মাথা পাওয়া গেল। ব্যস! আর কী লাগে! ছেলেটাকে গণধোলাই দিয়ে মেরে ফেলা হলো। ছেলেটাকে মেরে ফেলার ফলে সত্যটিও জানা যায়নি কেন একটা বাচ্চার মাথা তার ব্যাগে। যার ফলে গুজবটি আরো পাকাপোক্ত হলো। আর এই গুজবটি প্রতিষ্ঠিত করতে সবচেয়ে উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করেছে ফেসবুক।

নেত্রকোনার ঘটনাটা আমলে নিয়ে আইনশৃঙ্খলার কর্তাব্যক্তিরা চাইলেই গুজবটা সেখানে থামাতে পারতেন। কিন্তু একটা বিশেষ মহলের তাতে অসুবিধা হতো। তাই ঘটনা সেখানে থামেনি। আতংক জিইয়ে রাখাটা দরকার। কেন দরকার বলছি একটু পর। এরপরের ঘটনা রাজধানী বাড্ডার। রাজধানীতে কোনো ঘটনা যদি না ঘটে দেশের সমস্ত মানুষ ও মিডিয়া এনগেজ হবে কিভাবে? অতঃপর রেণু নামক এক অভিভাবককে পিটিয়ে খুন! ফলাফল ঘটনাটি তীব্র আকারে ভাইরাল। সবাই এই ঘটনায় এনগেজ। একটি বিশেষ মহলের জন্য আর কী লাগে! গুজবের ফায়দাটা এবার পুরোপুরিভাবে কাজে লাগানো যায়!

২৭ হাজার কোটি টাকা রাতারাতি গায়েব করে দিল! টাকাগুলো গায়েবের সময় প্রশাসন এবার মিডিয়ায় এসে গুজব থামানোর গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিজেদের নিয়োজিত করলো। তৎসময়ে আরো কয়েকজন গণপিটুনির শিকার হলো। এভাবেই একদিকের জল অন্যদিকে গড়ায়। ২৭ হাজার কোটি টাকা গায়েবের ইস্যুটা নিয়ে পাবলিক আরো একটা কারণে মাথা ঘামাতে পারছে না। তার কারণ প্রিয়া সাহা ও ব্যারিস্টার সুমন। নতুন ইস্যু। এইবার এই ইস্যু নিয়ে কিছু কথা বলি।

বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষ কখনোই মৌলবাদী ছিল না। আমাদের দেশ ও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদেরকে মৌলবাদী বানানো হচ্ছে। জনগণের ভেতরে মৌলবাদী বীজ বপন করা হচ্ছে। ভারতের বাবরি মসজিদকে কেন্দ্র করে যখন হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় তখনি এদেশে তসলিমা নাসরিন, হুমায়ুন আজাদদের সৃষ্টি হয়। ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে আঘাত করে তারা এদেশের মুসলমানদের উস্কে এবং বিশ্ব মিডিয়ার নজর ভারতের হিন্দু জঙ্গিদের থেকে সরিয়ে বাংলাদেশের হুজুর গোষ্ঠীদের উপর লক করার চেষ্টা করা হয় এবং তসলিমাকে কাজে লাগিয়ে তারা সফল হয়। এতপর নাস্তিক্যবাদের নামে মুসলিমবিদ্বেষ ছড়ানোর ব্র্যান্ড এম্বাসেডরে পরিণত হয় তসলিমা নাসরিন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের হেয় করার মিশন চালিয়ে যায় সে। সবচেয়ে মজার ব্যাপারটি হলো, সর্বশেষ ভারতীয় নির্বাচনে তসলিমা উগ্র হিন্দুত্ববাদী মোদীর পক্ষে প্রচারণা চালান। তো, এই তসলিমারই জাতবোন হিসেবে কয়েকদিন আগে আবির্ভূত হলেন প্রিয়া সাহা। তিনি আলোচনায় আসেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশ ও মুসলমানদের নামে মিথ্যাচার করে। তার আলোচিত মিথ্যাচারটি ছিল বাংলাদেশ থেকে নাকি তিন কোটি ৭০ লক্ষ হিন্দু গুম এবং এর পেছনে মুসলিম ফান্ডামেন্টালিস্ট ও সরকার জড়িত।

এই মিথ্যাচার ও গুজবের পর ব্যারিস্টার সুমন নামক এক লোকের আবির্ভব ঘটে। সে প্রিয়া সাহার নামে রাষ্ট্রদোহিতার মামলা করে এবং আদালত তা সাথে সাথে খারিজ করে দেয়। এরপর একটা মহল সুমনকে হেয় করার কাজে নেমে পড়ে। সেই মহলটি হলো প্রিয়া সাহা, পীযূষ, খুশি কবির ও সুপ্রীতি ধরদের সাঙ্গপাঙ্গরা। এই মহলটির কাজই হলো, এদেশকে একটি জঙ্গিবাদী দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিষ্ঠিত করা এবং তারা ছোট ছোট পদক্ষেপে কোনো প্রকার বাধাবিপত্তি ছাড়াই এগিয়ে যাচ্ছে। তারা সংখ্যায় খুবই কম। কিন্তু বিশাল ও শক্তিশালী একটা ব্যাকআপ তাদের আছে। এই ব্যাকআপ কারা? সরকার কি অবগত নয়? আমি এবং আমার মতো অনেকেই বিশ্বাস করে না যে, প্রিয়া সাহাদের চক্রান্তের ব্যাপারে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা অবগত নয়। সর্বশেষ প্রিয়া সাহাজে ইসরাইলি একটি বৈঠকে দেখতে পাওয়া যায়। আরেকটি চমকপ্রদ তথ্য হলো, প্রিয়া সাহা যে সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক তারা নিজেরাও জানে না প্রিয়া সাহা সেখানে কিভাবে গেল? প্রিয়া সাহা সরকারিভাবে সেখানে যায়নি, বেসরকারিভাবে গেছে। কিন্তু ট্রাম্পের সেই কনফারেন্সে সে কিভাবে উপস্থিত হয়েছে, কে সাহায্য করেছে সেটা জানাটা জরুরি। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের নিরাপত্তা ও দেশের স্বার্বভৌমত্বের প্রশ্ন এখানে সরাসরিভাবে জড়িত।
 
এবার আসি সরকারের ভূমিকা নিয়ে। শহীদুল আলমের কথা মনে আছে? নিরাপদ সড়ক চাই ইস্যুতে আল জাজিরাকে সত্য তথ্য দেয়ার ফলে তাকে গ্রেফতার করে কি নির্যাতনই না করা হয়েছিল! অথচ প্রিয়া সাহার এই মিথ্যাচারের পরেও সরকার তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়নি! কেন? কাকে ভয় পাচ্ছে সরকার? ঘটনা ঘটানোর পর মাসুম চেহারা নিয়ে ভিক্টিম সেজে লাইভে এসেছিল প্রিয়া সাহা। এবং তিন কোটি ৭০ লক্ষ এই সংখ্যাটির যে হাস্যকর ব্যাখ্যা সে দিয়েছে তা শুনে আমার চোখ আর কান ছানাবড়া হয়েছে। প্রিয়া সিন্ডিকেটের চক্রান্ত থামানো না গেলে দেশ ও দেশের মানুষ আরো ভয়াবহ সংকটে পড়বে।

দেশের অধিকাংশ মানুষ মূর্খ ও বর্বর। কানকে মাগে ওড়না কই, পর্দার জন্য ধর্ষণ হইসে, মাল্লুদের পিটানো দরকার, গণধোলাইয়ের বদলে গণধোলাই, খুনের বদলে খুন এই ধরনের উগ্র মন্তব্য করা মূর্খ জনগণে আমাদের দেশ ভরা। এবং শুদ্ধ ভাষায় দাম্ভিকতা দেখানো স্ট্যান্ডার্ড সিটিজেনরা এদেরকে ট্রল করে তাদের আরো উস্কে দেয়। আমিও মাঝে মাঝে তাদের গালাগাল করি। এইসব মানুষদের উগ্র ও বর্বর করার পেছনে দায়ী কে বা কারা আমরা কখনো গভীরে ভেবে দেখেছি? আজ কেন একটা ছেলে তার বান্ধবীকে চটপটি খাইয়ে ফাজলামো, হাসিঠাট্টার বদলে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে ধর্ষণ করছে? কেন গুজবে মানুষ মারা যাচ্ছে? কেন সাম্প্রদায়িকতা জিইয়ে রেখে বিশেষ মহলকে দেশবিরোধী চক্রান্ত করার সুবিধা দেয়া হচ্ছে? কেন ভারতীয় আগ্রাসনের বিরোধিতাকে উগ্র জাতীয়তাবাদ নামে চিহ্নিত করা হচ্ছে? গভীরভাবে চিন্তা করে আমরা কি কখনো উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি?

আমরা সিস্টেমের দোষ দেই এবং সিস্টেমটাকেই মূল অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে থাকি। এটা মারাত্মক ভুল। সিস্টেম বানায় যারা এবং সিস্টেমটা জিইয়ে রেখে চালায় যারা তাদেরকেই মূল অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা জরুরি। সিস্টেমের দিকে আঙুল তুললে সিস্টেমের চালকেরা আড়াল হয়ে পড়ে। সরাসরি সিস্টেমের চালকদের দিকে আঙুল তোলার সাহস আনতে হবে। উগ্র, বর্বর মন্তব্য করা জনগণ উৎপাদন করে সরকারগুলোই। তারা সকলস্তরের জনগণের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করে নাই। শিক্ষার অভাবে তারা গুজব ভাইরাল করে, উগ্র মন্তব্য আর আমরা উপরতলায় বসে তাদের নিয়ে মজা করি, গালাগাল করি। অর্থাৎ আমাদেরও প্রকৃত শিক্ষা নিশ্চিত হয়নি।

কোচিং-স্কুলে শিক্ষকদের পড়ানোর চাইতেও বেশি ছাত্রীদের দিকে নজর থাকে, পাশের বাসার ভাবীদের দিকে বেত্তমিজ দিল মানে না মানে না গান শোনা উঠতি বয়সী যুবক-তরুণদের বিশেষ নজর থাকে, ধর্ষিতাদের রক্তে দেশ সয়লাব হয়। অর্থাৎ আমাদের জন্য গুণগত মানের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়নি। মেয়ের বিবাহের সময় পাত্রের কীরকম টাকা পয়সা আছে, অকল্পনীয় দেনমোহর নির্ধারণ, যৌতুক, টাকা ও জমির জন্য নির্যাতন, খুন, রাহাজানি অহরহ ঘটে। বেকাররা মাদক ব্যবসায় জড়ায়। অর্থাৎ আমাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়নি। অন্ধকার গলিতে ছিনতাইকারি দেখলে যতটা না আতংকিত হই তারচেয়েও বেশি আতংকিত হই পুলিশ দেখলে। কারণ ছিনতাইকারী হয়তো মোবাইল আর মানিব্যাগ নিয়ে ছেড়ে দেবে কিন্তু পুলিশ যদি পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে মোটা অংকের টাকা দাবি করে বসে! সেইসাথে বিচারব্যবস্থা অচল। আইন আছে, প্রয়োগ নেই। সিংহভাগ অপরাধেরই ন্যায্য বিচার হয় না। অর্থাৎ, আমাদের নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়নি।

খাবারে ভেজাল, সিন্ডিকেট দিয়ে মূল্যবৃদ্ধি, পুষ্টির ঘাটতি। অর্থাৎ আমাদের খাদ্য নিরাপত্তাও নিশ্চিত হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে কেন নিশ্চিত করা হয়নি? কারণ আমরা যাতে শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়াতে না পারি। যাতে জনগণকে একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে শোষণ করার সুবিধা ভোগ করা যায়, লুটপাট জারি রাখা যায়। জনগণের এইসব মৌলিক নিরাপত্তা কার নিশ্চিত করার কথা? উত্তর, সরকারের। সুতরাং, দেশের ভেতর ঘটা অধিকাংশ অপরাধসমূহের জন্য অপরাধীর পাশাপাশি আর কে দায়ী? উত্তর, অবশ্যই সিস্টেম নয়। এই সিস্টেম যারা তৈরি করেছে এবং জিইয়ে রেখে সিস্টেমটাকে চালাচ্ছে, তারা।

সংকটগুলো উত্তরণের উপায়? অবশ্যই গণতান্ত্রিক সংবিধান নয়। সিস্টেমটাকে টিকিয়ে রাখা গোষ্ঠীসমূহকে উৎখাত করা। এরপর সিস্টেমে হাত দেয়া। কারা করবে? ঈশপের গল্পসমূহের মাঝে উত্তর নিহিত। 

 

লেখক: কবি ও কলামিস্ট