গাবোর সাথে বারানকিয়ায়

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : জুলাই ০৭, ২০১৯

আরাকাতাকার বাড়িটা বিক্রি করতে ব্যর্থ হয়ে মা আর ছেলে ফিরতি ট্রেন ধরার জন্য নির্দয় গরমের মধ্যে অপেক্ষা করতে করতে গাবোর চোখে কেবল ভাসছিল কলা কোম্পানির নিষিদ্ধ নগরের ধ্বংসস্তূপ, তার লাল টালির ছাদ-হারানো পুরনো প্রাসাদ, আগাছার মাঝখানে শুকিয়ে যাওয়া পামগাছ, আর হাঁটার রাস্তার শেষপ্রান্তে জরাগ্রস্ত কাঠবাদাম গাছটা। মা যদিও বলল, আমরা আরেকদিন আসব, হাতে বেশি সময় নিয়ে। কিন্তু তারা দুজনেই তখন জানত যে আর কখনো তারা যাবে না সেই শহরে।

বারানকিয়ায় ফিরে কাফে হাপিতে বিকেলবেলা দন রামোনকে তার নির্দিষ্ট টেবিলেই পেয়ে গিয়েছিল গাবো। বারানকিয়ায় দন রামোন সেই বিরল মানুষ যার নাম তখন ছাপা হয়েছিল স্প্যানিশ কবি-সাহিত্যিকদের এনসাইক্লোপেডিয়ায়। আরাকাতাকায় যাওয়ার জন্য দন রামোনের কাছ থেকে ৬ পেসো হাওলাত করেছিল গাবো। টাকাটা ফেরত দেবার জন্যই তার এখানে আসা। টাকাটা মানিব্যাগে ভরতে ভরতে একটু লজ্জা মেশানো কণ্ঠে দন রামোন বললেন, ‘টাকাটা আমি নিচ্ছি এমন এক অতি-গরিব যুবকের স্মৃতি হিসাবে, যে তাগাদা দেওয়ার আগেই ধার শোধ করে দিতে পারে।’

সেই সময়টাতেই আমি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ বগলে নিয়ে সেখানে হাজির। আমার একটু করুণাই হলো একথা জেনে যে, গাবো বিভূতিভূষণের নামই শোনেনি। সে তখন ‘হারানো প্রজন্মের’ যত লেখা স্প্যানিসে পেয়েছে, পড়ে শেষ করে ফেলেছে। গোগ্রাসে গিলছে উইলিয়াম ফকনারের লেখা। আমি তাকে বিভূতিভূষণ পাঠ করা কেন দরকার জানানে চাইছিলাম। কিন্তু গাবো আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল যে তার মাথায় এখন উপন্যাস এসেছে। অবিলম্বে সে সেটা শুরু করতে চায়। এল হেরালদো-র অফিসের দিকে ছুটল সে। তার পেটের মধ্যে মধ্যে এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা যেন কামড়াচ্ছে তাকে। প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে মায়ের কথাটা দিয়ে উপন্যাস লিখতে শুরু করল সে, ‘আমি তোমাকে বলতে এসেছি, দয়া করে আমার সাথে চলো, বাড়িটা বিক্রি করতে হবে।’

আমাকে সে পরিষ্কার জানিয়ে দিল যে কোনোভাবে তাকে বিরক্ত করা চলবে না। সে সকাল দশটার মধ্যে অন্তত এক মিটার লিখে ফেলতে চায়। আমি অবাক হয়েছিলাম। এক পৃষ্টা নয়, এক ফর্মা নয়, এক মিটার! এক মিটার লেখা হয় কীভাবে? এটা আবার লেখার কোন ধরনের মাপ? পরে অবশ্য জেনেছিলাম যে, টাইপ রাইটারে কাটা রোলের লম্বালম্বি টুকরা ঢুকিয়ে লিখত তখন পত্রিকা অফিসের লোকেরা। সেই রোল ছিল ৫ মিটার লম্বা। প্রধান সম্পাদক শব্দ বা ক্যারেকটার বা ফর্মা অনুযায়ী মাপ না দিয়ে বলতেন ‘অমুক বিষয়টা নিয়ে একটা দেড় মিটার লেখা লিখে ফেলো’।

যাহোক, গাবো লিখতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে আমি তাকে বিরক্ত করার মতো আর কোনো শব্দই করিনি। আমি নিঃশব্দে পড়তে শুরু করেছিলাম পথের পাঁচালী। গাবোকে এই বই থেকে সবচেয়ে উজ্জ্বল অংশটুকু শোনাতে হবে। ‘এক একদিন এই সময় অপুর ঘুম ভাঙিয়া যাইত। সেই দেবী যেন আসিয়াছেন। গ্রাম নিশুত হইয়া গেলে অনেক রাত্রে, তিনি বনে বনে ফুল ফুটাইয়া বেড়ান। বিহঙ্গশিশুদের দেখাশুনা করেন। জ্যোৎস্না রাত্রের শেষ প্রহরে ছোট্ট ছোট্ট মৌমাছিদের চাকগুাল বুনো ভাঁওরা, নটকান, পুঁয়ো ফুলের মিষ্ট মধূতে ভরাইয়া দেন। তিনি জানেন কোন ঝোপের কোণে বাসকফুলের মাথা লুকাইয়া আছে, নিভৃত বনের মধ্যে ছাতিম ফুলের দল কোথায় গাছের ছায়ায় শুইয়া, ইছামতীর কোন বাঁকে সবুজ শ্যাওলার ফাঁকে ফাঁকে নীল পাপড়ি কলমীফুলের দল ভিড় পাকাইয়া তুলিয়াছে।’

এই অনুভূতিগুলোর সাথে পরিচয় না ঘটলে গাবোর হয়তো খামতি থেকে যাবে! কিন্তু আমার অস্তিত্ব যে ভুলেই গেছে সে। মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে লিখছে। লেখার ঘোর ভাঙল আলফনসো ঘরে এসে ঢোকাতে। কয়েকটা কথা বিনিময়ের পরে গাবো উঠে পড়ল টাইপ রাইটার ছেড়ে। আর আলফনসো বসল ‘ডিকশনারি অফ দি রয়্যাল একাডেমি অফ দি ল্যাঙ্গুয়েজ’-এর সর্বশেষ সংস্করণ খুলে। একটা ইংরেজি অভিধানে ঘটনাক্রমে একটা ভুল খুঁজে পেয়েছিল আলফনসো। সেই ভুলটা চিহ্নিত করে, এবং সঠিক শব্দটা কী হবে, সেটা জানিয়ে চিঠি লিখেছিল সে প্রকাশককে। প্রকাশক একটা আন্তরিক চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল যে ভুলটা তারা স্বীকার করছে এবং আলফনসো যেন তার সহযোগিতা অব্যাহত রাখে। এই কাজের জন্য কোনো সম্মানী দেওয়া হয়নি তাকে। তবে গাবো এবং অন্য বন্ধুরা আরফানসোর গর্বে গর্বিত হয়ে বলত, ‘আমাদের কলাম্বিয়ানদের কাছে ইংল্যান্ড অন্তত একটা সাহায্যের জন্য ঋণী।’

তারপর থেকে আলফনসোর অভ্যেস হয়ে গেছে ভুল বের করার জন্য সময় পেলেই স্প্যানিশ, ইংরেজি অথবা ফরাসি অভিধান নিয়ে বসে পড়া। এখন অবশ্য তারা নতুন একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করতে যাচ্ছে ক্রনিকা নামে। সম্পাদক হিসাবে পত্রিকার মূলকাজ আলফনসোকেই করতে হবে। সে একটু পরেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয় লেখার কাজে। বেলা বারোটার মধ্যে গরম অসহ্য হয়ে উঠল। দুটো ছোট্ট জানালা দিয়ে যেটুকু আলো আসছিল, সেটুকু আচ্ছন্ন হয়ে গেছে দুজনের একের পর এক সিগারেটের ধোঁয়ায়। বাতাস চলাচল প্রায় নেই ঘরটার মধ্যে। গাবো ছায়ার নিচে নব্বই ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করার জন্মগত ক্ষমতা পেয়েছে। আর আলফানসো নিজের কাজ করতে করতেই গরম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একের পর এক খুলে ফেলছে একটা একটা করে পরনের কাপড়-টাই, সার্ট, আন্ডারসার্ট। এই কাপড়-চোপর খুলে ফেলার দুটো সুবিধা ভোগ করত আলফানসো। একটা তো গরম কমা। অন্যটা হচ্ছে, সে ঘেমে ভিজে গেলেও কাপড়গুলো থাকত ছিমছাম পরিপাটি। ঘর থেকে বেরুনোর সময় সে যখন কাপড়গুলো পরবে, তখন তাকে দেখাবে সকালের মতোই ফিটফাট। লিনেনের সার্ট ধবধবে ধোয়া, টাই সুন্দর করে বাঁধা এবং মাথার চুল পরিপাটিভাবে আঁচড়ানো।
আলফনসো চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই এল সিনেমার নায়কের মতো দেখতে তখনকার কলাম্বিয়ার শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী আলেহান্দ্রে ওবরেগন। সে একটা কাগজ নিয়ে মাত্র ছয়টি রেখায় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে লড়িয়ে ষাঁড়ের ছবি এঁকে আলফনসোর জন্য একটা বার্তা লিখে আবার দড়াম করে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।

গাবো তখনো নিজের নতুন উপন্যাসের শুরুটা নিয়ে মগ্ন। রাতে আবার আমরা ওবরেগনের দেখা পেলাম এক অখ্যাত সরাইখানায়। গাবো লেখায় মগ্ন থাকার কারণে তার সাথে দুপুরে কথা বলতে না পারায় নিজের ওপর খুব বিরক্ত বোধ করছিল। সে মাফ চাইতে গিয়েছিল ওবরেগনের কাছে। চিত্রশিল্পী পাত্তাই দিল না গাবোর কথায়। সে তখন একটা গুবরে পোকার তামাসা দেখায় ব্যস্ত। মানুষ কী না পারে! একলোক একটা গুবরে পোকাকে ট্রেনিং দিয়ে প্রায় সার্কাসের শিল্পী বানিয়ে ফেলেছে। পোকাটা মালিকের ইশারায় একটা টেবিলের ওপর দুই পায়ে ভর দিয়ে নাচছে। মালিক আরেক রকম ইশারা করার সাথে সাথে গুবরে পোকাটা তার পাখা দুই দিকে ছড়িয়ে দিয়ে শিস দিয়ে সুরেলা গান গেয়ে শোনাতে লাগল। আর দর্শকরা যখন হাততারিতে ফেটে পড়েছে, পোকাটা তখন মাথা নুইয়ে ঘুরে ঘরে সবাইকে সালাম জানাল।

আহা এমন একটা গুবরে পোকা! পোকাটার মালিকের মুখ তখন সাফল্যের হাসিতে উদ্ভাসিত। মানুষ তাকে বাহবা দিচ্ছে।
হঠাৎ-ই ওবরেগন ভিড় ঠেলে গিয়ে দাঁড়াল সেই টেবিলটার সামনে। তারপর কোনো নোটিশ না দিয়ে দুই আঙুলে পোকাটা তুলে মুখের মধ্যে পুরে চিবোতে শুরু করল কচমচ শব্দে।

দুই.
গাবোদের ছয়জনের দলকে লোকে ‘বারানকিয়া গ্রুপ’ বলে ডাকতে শুরু করেছে। পত্রিকা এবং লেখালেখির জগতের অন্য লোকেরা তাদের ওপর যেমন বিরক্ত, তাদের নিয়ে তেমনই আবার একটু ভীতও। ওরা নাকি ইনডিসপেনসিবল। কে যে কখন কী করবে তা কেউ বলতে পারে না। এই একটা মিলের জন্যেই অন্যেরা বলে, ওই ছয়জনের বাপ নাকি একটাই।
আমি কিন্তু ওদের মধ্যে খারাপ কিছু দেখিনি। বরং প্রত্যেকের প্রতিভা দেখে মুগ্ধই হয়েছি।
আলফনসো ফুয়েনমেয়র তখন আটাশ বছরের এক অসাধারণ লেখক আর সাংবাদিক। এল হেরালদো পত্রিকায় ‘উইন্ড অফ দি ডে’ নামে প্রতি সপ্তাহের কলাম লিখছে সে। অবশ্য ছদ্মনামে। চারটি ভাষা অনর্গল বলতে এবং পড়তে পারে সে।

হেরমান ভার্গাস সন্ধ্যার কাগজ এল নাসিওনেল এ নিয়মিত কলাম লেখে, আর করে প্রায় নির্দয় সাহিত্য সমালোচনা। আমাদের সজনীকান্ত দাসের মতো। আর অত বই সে কখন যে পড়ার সময় বের করে, তা আল্লাই মালুম। তাকে কখনো কেউ গাড়ি চালাতে দেয় না। কারণ সবারই ভয়, গাড়ি চালাতে চালাতে সে নিশ্চয়ই বই পড়তে শুরু করবে, আর নির্ঘাৎ অ্যাকসিডেন্টে মরতে হবে সবাইকে।
ওরা আবার অদ্ভুতভাবে একজন আরেকজনের থেকে আলাদা।
আলফনসো: একজন কট্টর লিবারেল।
হেরম্যাান: এক অনিচ্ছুক মুক্তচিন্তক।
আলভারো: একজন স্বৈরাচারী নৈরাজ্যবাদী।
গাব্রিয়েল মার্কেজ: এক অবিশ্বাস্য কমিউনিস্ট, এবং সম্ভাব্য আত্মহত্যাকারী।

এরা কেউ বোধহয় প্রেম-ট্রেম করে না। শুক্রবার রাত থেকে হল্লা শুরু করে, চলে রবিবারের রাত পর্যন্ত। শনিবার মাঝরাতে দলে যোগ দিল এক অচেনা লোক। তার পরনে ব্যালে টাইটস, টেনিস শু, একটা বেসবল ক্যাপ, আর হাতে হালকা যন্ত্রপাতির একটা পোটলা। আমাকে নতুন দেখে সে কিছুক্ষণ ভুঁরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। কিন্তু আমি যে তাকে চিনতে পারছি না, সেটা সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে রাজি না। জিজ্ঞেস করল, পত্রিকায় আমার ছবি দ্যাখোনি?
সে কি কোনো সেলিব্রেটি? কিন্তু আমি তো কলাম্বিয়ার সব সেলিব্রেটিকে চিনি না। সবে বারানকিয়ায় এসেছি গাবোর কাছ থেকে সাহিত্যের জীবন ধার নেব বলে। মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, না। সত্যিই দেখিনি।
একটু যেন আশ্বস্ত হলো সে।
গাবো আমাকে জানাল যে এই লোকটা পেশাদার চোর। একবার এক বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল। বাড়ির লোকেরা তাকে কোনো মারধোর করেনি, থানা-পুলিশ কিচ্ছু করেনি। শুধু তার ফটো তুলে পত্রিকায় ছাপিয়ে দিয়েছিল। এর ফলে বেশ কিছুদিন হুমকির মুখে পড়েছিল লোকটার পেশা। গাবোরা অবশ্য পত্রিকায় ছদ্মনামে চিঠি লিখে সেই বাড়িঅলার চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করেছিল একটা মানুষের পেটে এমনভাবে লাথি মারার জন্যে। তো, সে এখন আবার নিজের পেশায় ফিরে গেছে। কিন্তু নতুন কাউকে দেখলেই সে ভয় পায়।

মাঝরাতের পরে সে বেরিয়ে পড়ল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাচ্ছ?
ডিউটিতে।
একটামাত্র শব্দ উচ্চারণ করেই সে চলে গেল।
অনেক আগে থেকেই কাফের সামনে দিয়ে চলাফেরা শুরু করেছে শহরের নিয়মিত বেশ্যা এবং তাদের খদ্দেররা। ওরা কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না আমাদের দলটার দিকে। আমার রীতিমতো অপমানিত মনে হচ্ছে নিজেকে। রাত এগারোটার দিকে একটা অপূর্ব সুন্দরী বেশ্যাকে দেখে আমি হাত ইশারায় না ডেকে পারলাম না। মেয়েটা বিরক্ত ভঙ্গিতে আমাদের দিকে তাকাল। মনে হচ্ছিল সে-ও চলে যাবে আমাদের পাশ কাটিয়ে। কিন্তু কী মনে করে সে এগিয়ে এল আমাদের টেবিলের কাছে। আলফনসো আর আলভারোর দিকে তাকাল তীব্র বিরক্তির দৃষ্টিতে। তড়বড় করে আমাকে বলল যে, ওরা দুইজন একবার গিয়েছিল তার ঘরে। তারপর সারারাত দুইজন বিতর্ক করেছে। বিতর্কের বিষয়, কোন ফুটবল প্লেয়ার এখন সবচেয়ে ভালো খেলছে। ভোর পর্যন্ত ওরা তর্কই করেছে। বেচারা মেয়েটাকে সেই রাতটা কাটাতে হয়েছে কোনো উপার্জন ছাড়াই। এই পর্যন্ত বলে সে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আরেকবার চিৎকার করে বলল, ‘তোমরা শালারা যতখানি চ্যাঁচাও, ততখানি যৌনকর্ম করলে আমরা বেশ্যামাগিরা সোনা-মেশানো পানি দিয়ে গোসল করতে পারতাম।’

তিন-চার ঘণ্টা পরে ‘ডিউটি’ থেকে ফিরে এল চোরটা। কয়েকটা সস্তা গয়না বের করে এগিয়ে দিল দলের লেখকদের দিকে। মুখে বলল, ‘তোমাদের মেয়েমানুষদের দিয়ো।’
তারপর সে পকেট থেকে সদ্য লেখা একটা প্রেমের কবিতা বের করে পড়তে শুরু করল তীব্র আবেগ দিয়ে।

তিন.
গাবো যেন আমার কথা ভুলেই গেছে। আমি যে লেখকজীবন লাভ করার শিক্ষা নিতে তার কাছে এসেছি, সে ব্যাপারটা তার মনেও আছে কি না সন্দেহ। ইংরেজ কোনো গুরু হলে এলিয়টের মতো হয়তো বলে দিত, ছোকরা কবি হবার চেষ্টা করো না খবরদার, বরং কবিতা লেখার চেষ্টা করো।
কবি না হয়ে কবিতা লেখা যায়!
গাবো নিশ্চয়ই এমন কথা বলবে না। কিন্তু কিছুই যে বলছে না!
অবশ্য বেচারা বলবেই বা কখন!
সারারাত সে লেখে কাফে রোমা-র এককোণের টেবিলে বসে। যে দুটো পত্রিকায় কাজ করে, তা থেকে এত কম বেতন পায় যে, নিজের জন্যে আলাদা একটা ঘর ভাড়া নেবার সাহস পর্যন্ত করে উঠতে পারে না। খিধে পেলে খায় সেই একই খাবার। ঘন গরম চকোলেট আর স্প্যানিশ শুয়োরের মাংসের স্যান্ডউইচ। ভোরের আলো ফুটলে কাফে রোমা থেকে বেরিয়ে আসে। বলিভারের তীরে ফুর ভরা গাছগুলোর তলায় কিছুক্সণ পায়চারি করে। তারপর বেলা নয়টা বাজলেই পত্রিকা অফিসের নিউজ রুমে ঢুকে আবার লিখতে শুরু করে। অফিস ফাঁকা থাকলে নিউজপ্রিন্ট বিছিয়ে ঘুমিয়ে নেয় কিছুক্ষণ।
এই ভাবে কি দিনের পর দিন চলা যায়?
আমার প্রশ্নটা শুনে কিছুক্ষণ আমার চোখের দিকে একটানা তাকিয়ে রইল গাবো।
আমি ভয় পাচ্ছিলাম। আমাকে এখনই ধমক মেরে ভাগিয়ে না দেয়।

কিন্তু উল্টো সে মাথা ঝাঁকাল সম্মতির ভঙ্গিতে। মুখে বলল, ঠিকই বলেছ তুমি। চলো, একটা মোটামুটি ভালো আস্তানা জোগাড় করতে হবে।
আমি মুখ বাঁকাই। ভালো আস্তানা কি আর নতুন লেখকের ভাগ্যে জোটে? গাবো যদি জানত আমাদের আরেক বড় লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। যামিনী রায় তাকে বলেছিলেন, শবসাধনা করতে হলে শ্মশানেই থাকতে হবে। অতএব তারাশঙ্কর এলেন কোলকাতায়। কোথায় না থেকেছেন! কোথায় না লিখেছেন! বউবাজারের মেসে বাঈজিদের পাশের ঘরে পর্যন্ত। আমি প্রায় মুখস্ত শুনাই তারাশঙ্করের কথা, ‘আমাদের মেসের গায়ে সিঁড়ি; তার ওধারে দুটি ঘরে থাকত দুটি বাঈজি। লখনউ কি এলাহাবাদ তাদের দেশ। এটি ছোটবোন। বয়স আঠারো কি উনিশ। সন্ধ্যায় সাজসজ্জা করে বারান্দায় একপাক। তারপর আসত মলমলের পাগড়ি, আদ্দির পাঞ্জাবি, হিরের বোতাম, হিরের আংটি পরা শেঠের দল। ও-দিকে ঘরে তবলা বাঁধা হতো; চাকর ঘন ঘন উঠত নামত, পান পানীয় ইত্যাদি আনয়ন করত, খুসবাইয়ের গন্ধ ছুটত। গান শুরু হতো, শুনু যা শুনু যা পিয়া...’

গাবো চোখ বড় বড় করে শুনছিল আমার কথা। কিছু একটা পাওয়ার আনন্দে চিকচিক করছে চোখ। আমার পিঠে জোর চাপর মেরে বলল, দি আইডিয়া! ভালো আস্তানা। ভালো আস্তানা।

ট্যাক্সিঅলাদের সাথেও ভালো খাতির ওদের গ্রুপের সবার। এক ট্যাক্সিঅলাই ভালো আস্তানার খোঁজ দিল। ক্যাথেড্রাল থেকে এক ব্লক দূরের একটা অস্থায়ী হোটেল। এই হোটেলে দেড় পেসোর বিনিময়ে একা বা সঙ্গিনী বেশ্যাকে নিয়ে রাত কাটানো যায়।

কাউন্টারে দেড় পেসো জমা দিয়ে ছয় নম্বর রুমের চাবিটা পেল গাবো। ঘরে ঢুকে বন্ধ করে দিল দরজা। বারান্দায় চাপা পদশব্দ, এক পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে চাপা গুঞ্জন, আরেক পাশের ঘর থেকে অনবড়ত ভেসে আসছে জংধরা স্প্রিংয়ের পীড়িত ক্যাঁচক্যাচ শব্দ। গাবো বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে আরামের শব্দ করল, আহা এরকম শান্তিপূর্ণ জায়গাতে কতদিন থাকিনি!

আমার অবস্থা সহ্যের অতীত। আর টিকে থাকা সম্ভব নয়। অথচ গাবো তখন দিব্যি মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করেছে উইলিয়াম আইরিশের বই।
আমি একটু চেঁচিয়েই বললাম, আমি যাচ্ছি। আমি চলে যাচ্ছি।
গাবো বই সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসল, ভায়া কন্দিওস! বিদায় বন্ধু!
দুঃখে আমার চোখে তখন পানি চলে এসেছে। কান্নাজমানো গলায় বললাম, কিন্তু আমাকে তো তুমি কিছুই দিলে না! বললে না কিছুই। আমি লেখক হবো কীভাবে? একটা টিপস অন্তত দাও!
গাবো একটুও না ভেবে স্তোত্রের মতো উচ্চারণ করল কবি রিলকে-র বচন, “যদি তুমি ভাবো যে তুমি না লিখে বাঁচতে সক্ষম, তাহলে লিখো না।”