গাজী কামরুল হাসানের গল্প ‘ক্যাকটাসের কাঁটা’

শেষ পর্ব

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৩, ২০২১

ক্লাস শেষে হৈচৈ করতে করতে সবাই রুম থেকে বার হয়ে যায়। সবাই খুশি। কারণ পরের ক্লাসটা হবে না। বার হওয়ার জন্য বই আর রেজিস্টার খাতাটা হাতে নিলেন সবিতা। তার চোখ আবার শাহানার দিকে চলে যায়। মেয়েটা এখনও করিডোরের দিকে তাকিয়ে আছে। সবিতা একটু একটু করে শাহানার দিকে এগিয়ে যান। মেয়েটার পাশে বসে আস্তে আস্তে জিগ্যেস করলেন, মা, তোমার কি হয়েছে?

হঠাৎ সম্বিৎ ফেরে শাহানার। কতদিন হয়ে গেছে মা বলে কেউ তাকে ডাকেনি। চোখ ফেটে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো অশ্রু আসছে। সবিতার কোলে ঝাপিয়ে পড়ে অঝরে কাঁদতে শুরু করে শাহানা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সবিতা নিজের চোখে আসা জল মুছে ফেললেন।

শনিবার। ছুটির দিন। বারোটার সময় কাকলী আপার বাসায় ওয়ান ডিশ পার্টি। কেউ আসুক আর না আসুক, শাহানাকে যেতেই হবে। অবশ্য অফিসের সবারই দাওয়াত ছিল। কিন্তু পুরুষ কলিগরা একজন একজন করে নাই হয়ে গেছে। শেষপর্যন্ত আছে সে ছাড়া আর চারজন ফিমেল কলিগ। বাকি দুজন আসতে পারবে না। একজনের শ্বশুরবাড়িতে আজ একটা দাওয়াত আছে। আর আরেকজনের বাচ্চাদের পরীক্ষা চলছে। শাহানা ডিশ হিসাবে বিফ চপ তৈরি করছে। কয়েকটা চপ রিনাদের জন্য রেখে বাদবাকিগুলো নতুন কেনা বড় একটা হটপটে রেখে দিল।

সাড়ে ১১টার দিকে শাহানা তার হোস্টেল থেকে বার হয়ে গেল। কাকলি আপার বাসা বেশি দূরে না। শাহানার হোস্টেল থেকে রিকশায় পঁচিশ কী ত্রিশ টাকা ভাড়া লাগে। আপার বাসার সামনে নেমে অবাক হয়ে যায় শাহানা। উত্তরার পাসপোর্ট অফিসের কাছে অনেকটা জমি নিয়ে মডার্ন ডিজাইনে বানানো ডুপ্লেক্স বাড়ি। বাড়ির সামনে বাগান। শূন্য থেকে শুরু করে আপারা দুজন মিলে কতকিছু করে ফেলেছেন। শাহানা বাড়ির ভিতরে ঢুকল। ছবির মতো সুন্দর করে সাজানো। বাড়ির ড্রয়িংরুমটাও খুব সুন্দর।

শাহানা এসে পড়েছ?
জ্বি আপা।
বসো। বাকিরা কখন আসে, কে জানে! বাঙালির সময়, বারোটা আবার দুইটা না হয়ে গেলে হয়। দেখো, কী চালটাই না দিলাম! ওয়ান ডিশ পার্টি। মেইল কলিগরা ডিসক্রিমিনেশনের কথা মুখেও আনতে পারবে না। হা...হা...হা। সাপও মরল লাঠিও ভাঙল না। বুঝছ শাহানা, আমার পলিটিক্স করা উচিত ছিল। এতদিনে উপমন্ত্রী-টন্ত্রী হয়ে যেতে পারতাম।

দুইতলা থেকে বিশ-বাইশ বছরের একটা ছেলে বেরিয়ে আপার সামনে এসে দাঁড়ায়, চাচি, আমি গেলাম। একটা টিউশনি আছে।
শেষ করে চলে আসিস। দুপুরে কিন্তু এখানে খাবি।
আচ্ছা।
ছেলেটা চলে গেলে আপা শাহানার দিকে তাকিয়ে হাসলেন, শাহেদের কাজিনের ছেলে। অনেক ব্রাইট আর সেরকম ভদ্র। মুরুব্বিদের চোখে চোখ রেখে কথাও বলে না। মাটির দিকে তাকিয়ে বলে। বুয়েটের সিভিলে চান্স পেয়েছিল। কিন্তু কম্পিউটার নিয়ে পড়ার অনেক ইচ্ছা। সেজন্য আইইউটির সিএসইতে ভর্তি হয়েছে।

ভালো তো।
গাজীপুরের হোস্টেলে থাকে। কি না কি খেয়ে থাকে, কে জানে! তাই মাঝেমাঝে আমার কাছে এনে রাখি। টয়া আর সাকিবটাকে একটু পড়াশুনাও দেখাতে পারে। দুটোই স্কলাস্টিকায় পড়ছে। মেয়েটা আসছেবার ও লেভেল দেবে আর ছেলেটা পড়ে স্ট্যান্ডার্ড ফোরে। আমি আর তোমার ভাইতো একটুও সময় দিতে পারি না। দেখেছ, টয়ার সাথে তোমাকে দেখা করাতেই ভুলে গেছি। সাকিব সাতসকালে ব্যাট-প্যাড নিয়ে বার হয়ে গেছে। সন্ধার আগে আর ওর দেখা পাওয়া যাবে না। টয়া... এই টয়া... রুম থেকে একটু বার হ দেখি...
আসুক না আস্তে ধীরে...
এই মেয়েটাকে নিয়ে হয়েছে মুশকিল। আগে ঠিকই ছিল। হঠাৎ করে এত ইন্ট্রোভার্ট হয়ে গেল। কারও সাথে মেশে না। কথাও বলে না। রাতে ঘুমায় কখন কে জানে... চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। কী যে করি ওকে নিয়ে!

টয়ারুম থেকে বার হয়ে পাশের একটা সোফায় জড়সড় হয়ে বসল। তারপর মোটামুটি অনিচ্ছা নিয়ে শাহানার দিকে একবার তাকায়। মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে শাহানা মনের মধ্যে একটা হোঁচট খেল। বারবার মনে হতে থাকে, চোখদুটা তার কত পরিচিত। কতদিন দেখেছে সে...আয়নার সামনে...

লেখক পরিচিতি: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর বর্তমানে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতি বিভাগে প্রভাষক হিশেবে কর্মরত।