গাজী কামরুল হাসানের গল্প ‘ক্যাকটাসের কাঁটা’
পর্ব ৬
প্রকাশিত : অক্টোবর ১৯, ২০২১
এত তাড়াহুড়া কিসের? কাছে এসো...
কোথায় যেন জোরে জোরে হিন্দি গান বাজছে। শাহানার ভিতরে ভয়ংকর কাঁপুনি ঢেউয়ের মতো আসতে থাকে। বারবার দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে। মুখে এসে পড়া চিৎকার হাত দিয়ে চেপে থামিয়ে শাহানা বাথরুমে ছুটে যায়। তারপর দরজা লাগিয়ে সে মেঝেতে বসে পড়ল। দুই হাত দিয়ে কান বন্ধ করে হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে।
কত তারিখ আজকে? শাহানা ঠিক করে জানে না। দিন আর রাত যেন একসাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে। হয়তো সাতদিন হয়েছে, হয়তো তিনদিন কিংবা একমাস। কে জানে! সে জানে না এ ক’দিনে কতবার স্নান করেছে। শুধু জানে, বারবার সাবান দিয়ে গোসল করতে করতে তার ত্বক কেমন জানি হয়ে গেছে। শরীরে জ্বালা করে। চামড়া ফেটে রক্ত বার হয়।
অবাক হয়ে রক্তের দিকে তাকিয়ে থাকে শাহানা। কী আশ্চর্য রকমের লাল রক্তের রঙ। মাঝে চোখের সামনে ভেসে ওঠে সবকিছু। ভয়ে কুকড়ে যায়। হাত-পা শক্ত হয়ে আসে। গলা থেকে একটা শব্দও বার হয় না। এত বাস্তব! কোনো কোনো রাতে অল্প একটু তন্দ্রার মত আসে। আবার সব চোখের সামনে চলে আসে। ভয়ে চিৎকার করে উঠে যায়। ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে।
কেউ তার কথা বিশ্বাস করেনি। তাকে বিশ্বাস করেনি। ওই লোকটাই সত্যি কথা বলেছে। মিরপুরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোয়ার্টারে খালার বাসায় তাকে আটকে রেখেছে। কাউকে কিছু যেন না জানাতে পারে। কোনো ঝামেলা না করতে পারে। যেন দোষ তার। মনে হয় তারই দোষ। কেন গিয়েছিল! হ্যাঁ ওই লোকটার কোনো দোষ নেই। না, মনে হয় না, আসলে তারই দোষ।
খট করে একটা শব্দ হয়। মাথা তুলে দেখল, মা ভাতের থালা নিয়ে এসেছে। যেমন, প্রতিবেলায় আসে। মাঝে মাঝে মা। আর মাঝে মাঝে খালা। খেয়ে বা লাভ কি! কিছুক্ষণ পরই বমি হয়ে যায়...। শাহানা ঘর থেকে পারলে বার হয় না। কখনও কখনও পাশের বারান্দায় দাঁড়িয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আটতলা থেকে দেখলে নীচের মানুষগুলোকে পিঁপড়ার মতো ছোট মনে হয়।
থালাটা খাটের পাশের ছোট টেবিলটায় রেখে লতিফা বেগম পাশের চেয়ারটায় বসলেন। শাহানা একটু অবাক হয়। এর আগে কখনও তো বসেনি... খাবারের থালাটা রেখেই চলে যেত। একটা চেয়ার নিয়ে খালাও মায়ের পাশে এসে বসলেন, অনেক হয়েছে! তোর অভিনয় এখন থামা।
নির্বাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে শাহানা।
আর কতদিন এখানে পড়ে থাকব? পনের দিনের বেশি হয়ে গেল। বাসা খান্দার হয়ে আছে। একা কতকিছু সামলাবে সুমন! কালই ফিরে যাব। ফোনে গাড়ি ভাড়া করতে বলেছি। তুইও চল না আমাদের সাথে?
আমি? হু...যাওয়া যায়... এখানে তো একাই আছি। আচ্ছা ঠিক আছে, আমিও যাই তোমাদের সাথে।
ঢং শেষ কর শাহানা। আর ভাল লাগে না... আমার হয়েছে মরণ...
আপা তুমি যাও তো...
লতিফা বেগমচেয়ার ছেড়ে উঠে ঘর থেকে বার হয়ে গেলেন।
দেখ শাহানা, যা হয়েছে সব ভুলে যা। কালকে নতুন বছরের প্রথম দিন। নতুন বছর নতুন করে শুরু কর। কলেজও তো অনেকদিন কামাই হয়ে গেল, তাই না?
খালা কথা শেষ করে উঠে চলে গেল। শাহানার মুখ ফুটে কোনো কথা বার হলো না। নতুন বছর...আঠারো দিন হয়ে গেছে... নতুন করে শুরু... চলবে