গাজী কামরুল হাসানের গল্প ‘ক্যাকটাসের কাঁটা’
পর্ব ৪
প্রকাশিত : অক্টোবর ১২, ২০২১
বিকেল গড়িয়ে এখন সন্ধ্যা। কলেজ থেকে ফিরে কিছু মুখে দিয়ে একটু ঘুমিয়ে নিয়েছে শাহানা। শুক্র-শনিবারের আগে বৃহস্পতিবার ১৬ ডিসেম্বর। তিন দিনের ছুটি। আজকে রাত থেকে পার্টি শুরু। সারারাত সিনেমা আর জয়ার ফোন দিয়ে উল্টাপাল্টা নাম্বারে কল করে ফাজলামি করা। আর তারপর সারাদিন লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমানো। তিন তিনটা দিন... মজাই মজা...
সন্ধ্যার পর শাহানা বসার ঘরে আসে। মা লতিফা বেগম সোফায় আধশোয়া হয়ে সিনেমা দেখছে। আর রাহেলা মেঝেতে বসে মায়ের পা চাপছে। চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে শাহানা মায়ের দিকে তাকালো, জয়ার বাসায় গেলাম। রাতে ওখানে থাকব।
হু।
টিভির শব্দে আম্মা কিছু শুনতে পেল বলে মনে হলো না শাহানার। এবার একটু জোর গলায় বলে ওঠে, মা শুনছ? কি বলছি...
শুনছি তো বললাম। একটা কথা কতবার বলা লাগে? সকাল থেকে গাধার মতো খাটার পর একটু বিশ্রাম নিতে বসছি। তাও একফোঁটা শান্তি দিবি না। তোর বকর বকরের জ্বালায় ভালো করে শুনতেও পারছি না। যা তো...
আচ্ছা।
শোন, ডাইনিং টেবিলে সাঝের পিঠা বানানো আছে। একটা বাটিতে ভরে জয়ার জন্য নিয়ে যাস। ভুলিস না যেন।
তুমি বানিয়েছ, নাকি রাহেলা?
তাতে তোর কি? লাট সাহেবের বেটি হয়েছিস? আমার কাজের কৈফিয়ত তোকে দিতে হবে। এইখান থেকে যা বলছি... কিছু বলি না দেখে সাহস অনেক বেশি হয়ে গেছে!
আচ্ছা গেলাম।
শাহানা জয়াদের বাড়ির তিনতলায় উঠে কলিং বেল বাজাল। অল্প কিছুক্ষণ পর বড়চাচা দরজা খুললে সে সালাম দিয়ে ভিতরে ঢুকে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে পিঠার বাটিটা রেখে দেয়।
চাচা জয়া কোথায়?
তোমার চাচি আর শেফালিকে নিয়ে টেইলারের দোকানে গেছে। জয়ার রুমে গিয়ে বসো। পনেরো-বিশ মিনিটের মধ্যে চলে আসার কথা।
আচ্ছা।
শাহানা মনে মনে বেশ খুশি। নিজের ইচ্ছামতো কিছুক্ষণ রিমোট চালানো যাবে। রুমে গিয়ে সে লাইটটা জ্বালিয়ে দিল। জয়ার রুমটা বাড়ির উত্তর দিকে। সবগুলো জানালা বন্ধ তারপরও ঠাণ্ডায় জমে যাওয়ার মতো অবস্থা। ডিভিডি প্লেয়ারে একটা হিন্দি গানের ডিভিডি চালিয়ে দেয়। আর টেবিলে খুলে রাখা একটা গল্পের বই হাতে নিয়ে বিছানায় শুয়ে বইটা পড়তে থাকে।
শাহানার হঠাৎ খেয়াল হয়, ডিভিভি প্লেয়ারে চলতে থাকা হিন্দি গানটা বন্ধ হয়ে আছে। বই থেকে চোখ সরিয়ে দেখতে পেল তার ঠিক সামনে বড়চাচা দাঁড়ানো। সে তাড়াতাড়ি করে বিছানায় উঠে বসলো।
চাচা, কিছু বলবেন?
জয়ার আম্মা ফোন করে বলল, ছোট ভাইয়ের বাসায় যাচ্ছে। কালকে পরশু দুইদিন সেখানেই থাকবে। জয়ার ছুটি আছে। তিন-চারদিন পরে আসবে।
শাহানা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ঘরের বাইরে যাওয়ার দরজার দিকে তাকিয়ে দেখতে পায়, ভিতর থেকে দরজার ছিটকানি লাগানো। অবাক হয়ে শাহানা চাচার দিকে তাকিয়ে থাকল।
আমি তাহলে বাসায় যাই চাচা।
এত তাড়াহুড়া কিসের? কাছে এসো...
খপ করে তার হাত ধরে ফেলেন শাহাবুদ্দিন সরকার। তারপর অন্য হাতে ডিভিডি প্লেয়ারের হিন্দি গানটা আবার ছেড়ে দেন। ভয়ে কুঁকড়ে যায় শাহানা। চিৎকার করা তো দূরের কথা; গলা থেকে শব্দ বার করতে ভুলে যায় সে।
কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আছে শাহানা। কতক্ষণ আগে যে তিনতলা থেকে নেমে বাসার দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে, নিজেও জানে না। কাউকে বলে কোনো লাভ হবে না। কেউ বিশ্বাস করবে না। হঠাৎ দরজা খুলে রাহেলা বের হলো।
খালাম্মা, দরজাডা দিয়া দেন। আমি যামু... দরজার সামনে অন্ধকারে দাঁড়াইয়া আছেন ক্যান আফা? জয়া আফার বাসাথন চইল্যা আইলেন যে?
রাহেলার কোনো কথা শাহানা যেন শুনতে পেল না। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে সে। লতিফা বেগম শাহানার দিকে অবাক হয়ে তাকালেন। ঘরের অল্প আলোতেও দেখা যাচ্ছে চুলগুলো এলোমেলো। চোখও কেমন জানি...
কি রে? জয়ার সাথে ঝগড়া করে এসেছিস? রাহেলা, তুই যা।
আইচ্ছা। কাইল কিন্তু আমু না। পোলারে টীকা দিতে নেবার লাগব। গোশত আর তরকারি পাক কইরা ফ্রিজে রাখছি।
আচ্ছা।
রাহেলামাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বের হয়ে গেল।
কিরে, ঠায় দাঁড়িয়ে আছিস যে? আয়, ভিতরে ঢোক।
কি হয়েছে মেয়েটার? লতিফা বেগমএকটু নরম গলায় বললেন, ঘরে আয়। ভিতরে আয় বলছি। লতিফা বেগম মেয়ের হাত ধরলেন। হঠাৎ শিউরে উঠল শাহানা। ভয়ে চিৎকার করে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে।
এবার অনেক ভয় পেয়ে গেলেন লতিফা বেগম। কী করবেন ঠিক বুঝতে পারছেন না। সুমনের বাবা রংপুরে, সুমনও বাসায় নেই। একা কি করবেন। কি হয়েছে? মেয়েতো কিছুই বলছে না!
-শাহানা, কি হয়েছে রে? ঘরের ভিতরে ঢোক।
যন্ত্রের মতো ঘরের ঢোকে শাহানা। অন্য কোনোদিকে না তাকিয়ে আস্তে আস্তে বাথরুমের ভিতর চলে গেল। তারপর শাওয়ারের পানি ছেড়ে বাথরুমের মেঝেতে বসে পড়ে।
হড়বড় করে শাহানা অনেকখানি বমি করে ফেলল। ভিতর থেকে সবকিছু বার হয়ে আসতে চাচ্ছে। লতিফা বেগমের চোখে-মুখে দিশেহারা ভাব চলে এসেছে। আতঙ্কে তিনি হাত পা নাড়াতে পারছেন না। ডাইনিং টেবিলটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বাথরুমের খোলা দরজা দিয়ে অপলক চোখে মেয়েকে দেখতে থাকলেন।
বেশ কিছুক্ষণ পর শাওয়ার বন্ধ করে লতিফা বেগম মেয়েকে মেঝে থেকে টেনে তুলে রুমে নিয়ে যান। বিছানায় বসিয়ে একটা তোয়ালে দিয়ে শাহানার মাথা আস্তে আস্তে মুছে দিতে থাকলেন, কি হয়েছে শাহানা?
শাহানা মাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল, ওই লোকটা... মা... ওই লোকটা... মা...
কে... কি করেছে?
বড়চাচা... ওই লোকটা... আমাকে জোর করে... মা... কথা শেষ করে শাহানা আবার জোরে জোরে কাঁদতে শুরু করে। সব শুনে লতিফা বেগমের মাথা ঘুরে উঠল। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। দুচোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করলেন। চলবে