গাজী কামরুল হাসানের গল্প ‘ক্যাকটাসের কাঁটা’
পর্ব ২
প্রকাশিত : অক্টোবর ১০, ২০২১
সাড়ে ছয়টার ওপর বাজে। কোথায় সকালটা লেপমুড়ি দিয়ে কাটিয়ে দেবে, তা না, এই ঠাণ্ডার মধ্যে ক্লাস ধরার জন্য দৌড়াও। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানা ছেড়ে উঠল শাহানা। ৮টার আগে কলেজে ঢুকতে হবে। দুই মিনিটও দেরি হলে সবিতা আপা কাঁচা খেয়ে ফেলবেন। পাঁচটার জায়গায় বিশটা নতুন ইংলিশ ওয়ার্ড খোঁজো, মুখস্ত করো আর তারসাথে দুই দুইটা করে সেন্টেন্স... খালি খালি একগাদা সময় নষ্ট। কী হবে তার এত পড়াশোনা করে!
বসার ঘরে শাহানা মাকে দেখতে পায়। সকাল থেকে মায়ের টিভি দেখা শুরু হয়ে গেছে। এখন এক চ্যানেল তো রাতের বেলা অন্য চ্যানেল। একটার পর একটা সিরিয়াল। মায়ের জন্য ঘরে বসে কোনোকিছু দেখা দায়। জয়াদের বাসায় গিয়ে দেখতে হয়। মনে মনে জয়াকে অনেক হিংসা হয় শাহানার। মোবাইল ফোন, নিজের ঘরে ক্যাবেল বসানো টিভি, ডিভিডি প্লেয়ার, এসি; সব আছে জয়ার। লাইফটা পুরা সেট। বরও ঠিক হয়ে আছে। আর তার কপালটাই পোড়া। নিজের বাসায় ইচ্ছামতো দুই মিনিট টিভি দেখার ভাগ্য যে কবে হবে; কে জানে!
মা, কলেজে গেলাম।
নাস্তা করেছিস? রাহেলা... ওই রাহেলা?
খাব না এখন। ক্লাসের ফাঁকে খেয়ে নেব নে। ভাইয়া কবে আসবে?
রাতে বলল, আরও চার-পাঁচ দিন থাকবে।
ইস, কী মজা! বন্ধুদের নিয়ে..
বিয়ের পর তুইও যাবি জামাইয়ের সাথে। বেশি ভ্যাজভ্যাজ করিস না তো। সুমন সবে ডিগ্রি পরীক্ষা শেষ করেছে। এখনই তো ঘুরবে। কয়েকদিন পরেই তোর বড় চাচার ব্যবসায় বসতে হবে। কত দায়িত্ব নিতে হবে, বুঝিস?
হু।
শোন, জয়ার সাথে কথায় কথায় তর্ক শুরু করবি না তো। বুঝছিস?
মহারানির মতো সালাম করব। কম তো না, রাজত্বের সাথে রাজকন্যা...
থাম! কথা শুনলে গাঁয়ে আগুন ধরে যায়। আমার হয়েছে যত জ্বালা। বাপটা অফিসের নাম করে জায়য়গায় অজায়গায় ঘুরে বেড়ায়... আমি বান্দির মতো দিনরাত ঘুরতে থাকি। শান্তিতে দুইদণ্ড বসতে পারি না... যা তো চোখের সামনে থেকে।
কথা না বাড়িয়ে বাসা থেকে বের হলো শাহানা। তাদের একতলা বাড়ির সামনের তিনতলা বাড়িটি জয়াদের। বাড়ির দুইটা ফ্লোর নিয়ে একটা ব্যাঙ্কের কুমিল্লা সদরের শাখা। বড়চাচা ফ্যামিলি নিয়ে তিনতলায় থাকেন। ফ্যামিলি বলতে এখন আছে তিনজন। চাচা-চাচি আর জয়া। ভার্সিটিতে পড়ার সময় জায়েদ ভাই চাচার সাথে বিশাল ঝগড়া করেছিল। তারপর বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। আর কোনোদিন ফেরত আসেনি। শাহানা তখন অনেক ছোট। ক্লাস থ্রিতে পড়ে। একবার কে জানি বলেছিল, সুইডেনে চলে গেছে। সত্যি কিনা কে জানে! বড়চাচা রেগেমেগে জায়েদ ভাইকে ত্যাজ্য করেছেন। এই বাড়ি, দুইটা তিনতলা মার্কেট, ডায়গনিস্টিক সেন্টার, দুই-তিনটা স’মিল আর চালের কল সবকিছু নাকি জয়ার নামে উইল করে দিয়েছেন শাহানার বড় চাচা শাহাবুদ্দিন সরকার।
শাহানা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে জয়ার বাসার সামনের কলিংবেল টিপে দাঁড়িয়ে ঘড়ি দেখতে থাকে। পৌনে ৮টা বেজে গেছে। পাঁচ কী ছয় মিনিট পর জয়াকে আসতে দেখে শাহানা একটা খালি রিকসা থামিয়ে উঠে বসল।
সরি...সরি... একটু লেট হয়ে গেল।
হয়েছে, তাড়াতাড়ি ওঠ। মামা, কলেজের দিকে একটু চালান তো...
রাতে বাসায় চলে আসিস। ফাটাফাটি কয়েকটা ডিভিডি আনিয়েছি। সবগুলা ব্রান্ডনিউ হিন্দি মুভি; সাথে নতুন ইংলিশ মুভিরও দুইটা ডিভিডি আছে। দারুণ একটা হোল নাইট হয়ে যাবে! কি বলিস?
দোকান থেকে দিয়ে গেল বুঝি?
হু। কিরে কিছু বলছিস না যে?
না ভাবছি।
এর মধ্যে ভাবাভাবির কি আছে?
ভাবছিলাম, ভাইয়াটা রাজকপাল নিয়ে এসেছে। তোর মতো একটা মেয়েকে পাওয়া ওর দশ জন্মের কপাল।
হিহিহি... কী যে বলিস না। আমাদের কপালে আজকে শনি আছে। সবিতা আপার খপ্পরে পড়লে আর রক্ষা নাই...। পাঁচটা ওয়ার্ড বার করতেই জান বার হয়ে যায়... বিশটা কই পাবো কে জানে!
লাইব্রেরিতে বসে বই আর ইংলিশ পত্রিকা ঝাড়তে হবে। দুরুদ শরিফ পড়। কোনোমতে বেঁচে যাই যেন আজকে।
বড়জোর আর দেড়বছর জ্বালাবে মহিলা। তারপর তো ইন্টারমিডিয়েট শেষ। দুজন এখানের কোনো একটা সাবজেক্টের ডিগ্রিতে ভর্তি হয়ে যাব। আর তোর জন্য একটা জামাই যোগাড় করে ফেলব... তারপর ফুর্তিই ফুর্তি... হা হা হা।
শাহানা আর জয়া ক্লাসরুমের বেঞ্চে বসা মাত্র সবিতা আপা একটা রোল কলের খাতা নিয়ে রুমে ঢুকলেন। ক্লাস পুরোপুরি চুপ। কলেজের সব ছাত্রছাত্রী সবিতা আপাকে বাঘের থেকেও বেশি ভয় পায়। কোনো কথা না বলে রোল কল করে ক্লাস শুরু করে দিলেন। শাহানা জয়ার দিকে তাকিয়ে একটু জোরে বলে ফেলল, সব দোষ ওই বেগম রোকেয়া মহিলার। ওনার জন্য আজ আমাদের এই দুর্দশা। কোথায় এই বয়সে ঘর সংসার...
জয়ার সাথে সাথে লিজা আর রত্না খিলখিল করে হেসে ওঠে। সবিতা আপা বোর্ডের দিক থেকে মুখ না ঘুরিয়ে হুংকার ছাড়লেন, সাইলেন্স। চলবে