গজেন্দ্রকুমার মিত্রর গল্প ‘জ্যোতিষী’
প্রকাশিত : নভেম্বর ১১, ২০২৪
লেখক, প্রকাশক ও অনুবাদক গজেন্দ্রকুমার মিত্রের আজ জন্মদিন। ১৯০৮ সালের ১১ নভেম্বর কলকাতায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার লেখা ‘জ্যোতিষী’ গল্পটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
লম্বা একহারা চেহারা, খাঁড়ার মত নাক, প্রশস্ত; এমনকি টাক বার করাও বলা চলে, এমন উঁচু কপাল আর তার মধ্যে ছোট ছোট উজ্জ্বল চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, সবটা জড়িয়ে বরদাচরণ জ্যোতির্বিনোদ মশাইয়ের চেহারাটা সুশ্রী না হলেও অসাধারণ ছিল বৈকি। তেমনি কি তাঁর কণ্ঠস্বর! মক্কেলদের সঙ্গে কথা কইতে কইতে যখন তাঁর চড়া এবং তীব্র কণ্ঠস্বর বিদ্রুপের হাসিতে ফেটে পড়ত, তখন মনে হত যেন একটা শান্ত, স্নিগ্ধ স্তব্ধতাকে কেটে কেটে নিজের প্রচণ্ডতার বেগে কোন্ সুদূরে পৌঁছে গেল নিমেষে। সুতরাং প্রথম যারা আসত তাঁর কাছে, তারা তাঁর চেহারা, চাহনি, বুদ্ধি ও কণ্ঠস্বরের এই উজ্জ্বল তীক্ষ্ণতায় অভিভূত হয়ে পড়ত। সে মোহের সঙ্গে ভয় মিশানো থাকলেও পরিণামে শ্রদ্ধারই সঞ্চার করত মনে মনে।
এই অসাধারণ এবং তীক্ষ্ণ হবারই চেষ্টা করেছেন তিনি আজীবন। সে চেষ্টাকে তপস্যা বলাই উচিত।
প্রথমেই তিনি সাবধান করে দিতেন মক্কেলদের ঐ যারা মিষ্টি কথা বলে—একবারে চাঁদ হাতে তুলে দেয়, আমি তাদের দলে নই। মিছে করে বানিয়ে বলতে পারব না যে, পরের সম্পত্তি হঠাৎ হাতে পড়বে কিম্বা অপুত্রকের ছেলে হবে। ওতে আমার ঘৃণা বোধ হয়।
তারপর মুহূর্ত কয়েক মাত্র থেমে, স্তম্ভিত মক্কেলকে একটুও সামলাবার অবকাশ না দিয়ে তিনি আবার বলে উঠতেন, ‘বুঝেছেন? গোঁজামিল দিতে আমি পারব না। হাতে যদি খারাপ লেখা থাকে ত মুখের ওপরই বলে দেব। সেটা সইতে পারবেন? অপ্রিয় সত্য? তা যদি না পারেন, তবে সরে পড়ুন।’
তারপর বাকি সকলের দিকে স্থির সুতীব্র কণ্ঠস্বরকে আরও চড়িয়ে বলতেন, ‘সেই জ্যোতিষীর গল্প জানেন ত, একজনের হাত দেখে বলে দিয়েছিল যে, তোমার একটা বড় রকমের লাভ হবে আর সামান্য কিছু লোকসান। তারপর সে লোকটা কী লাভ হবে ভাবতে ভাবতে পথ হাঁটছে, পড়ে গেলে এক খানায়। হাত বাড়িয়ে যেমন নিজেকে সামলাতে যাবে, মুঠো করে ধরলে এক ব্যাঙ, এধারে পা’টি গেল ভেঙে। সে ত কোন মতে বাড়ি ফিরে এত, তারপর জ্যোতিষীকে ডেকে বলল, দৈবজ্ঞিঠাকুর, এ কি? লাভের মধ্যে ব্যাঙ, আর অপচয়ের মধ্যে একবারে পা’টা! এই কি আপনার মোটা লাভ আর সামান্য লোকসান?…..জ্যোতিষী তখন তাকে বুঝিয়ে দিলে যে, তা কেন? খানায় যখন পড়েছ, তখন মাথাটাও তো ফাটতে পারত, তাহলে মারাই যেতে একেবারে। এ তবু পা ভেঙেছে, খুঁড়িয়ে চলতে পারবে অন্তত। জীবনটা যে বেঁচে গেল—এ কি কম লাভ?’
এই বলে প্রচণ্ডভাবে আর একবার হেসে উঠতেন। সে হাসির সামনে বিহ্বল, ভয়চকিত মক্কেলদের মাথা আপনিই নুয়ে আসত।
তারপর হয়ত খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই মক্কেলের শিথিল ও ঘর্মসিক্ত হাতখানা টেনে নিয়ে নিজের চোখের সামনে মেলে ধরতেন। মিনিট খানেক ধারালো ছুরির মত তাঁর চোখের চাহনি সেই হতভাগ্যের কররেখার ওপর বুলিয়ে শুধু একবার বলতেন, ‘হু’, কিম্বা একটা অস্পষ্ট এবং অস্ফুট শব্দ করতেন, তারপর হঠাৎ গম্ভীর মুখে বাঁ-হাতে পাশ থেকে লেন্সটা নিয়ে ভাল কের হাতখানা দেখতেন পুঙ্খানুপুঙ্খ করে। এ সবটাই তাঁর চিরন্তন অভ্যাস—বরং স্বভাব বলাই উচিত।
এটা প্রথমে তিনি হিসেব করতেন, মক্কেলকে অভিভূত করাবার জন্যই। এখন আর চেষ্টা করতে হয় না, অভ্যাস তার নিজের কাজ করে যায়।
তিনি জানতেন যে, এই আকস্মিক গাম্ভীর্যে মক্কেলদের বুকের স্পন্দন প্রায় থেমে আসে। তাঁর পরের নির্ঘাত কোন বাণীর জন্য সে মনে মনে প্রস্তুত হয়।
এরপর হাত খানা নামিয়ে রেখে গম্ভীর স্থির দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ মক্কেলের মুখের দিকে চেয়ে বলতেন, ‘শুনবেন আপনার ভাগ্যের কথা? ঠিক ঠিক শুনতে চান?’
সম্মতি যে আসত, তা বলাই বাহুল্য। তখন তিনি গলা নামিয়ে বলতেন, ‘আমার এমনি অদৃষ্ট, ভাল হাত কি একটাও আসে না। শনি বিরূপ আপনার ওপর—আমি কি করব বলুন। এই সামনের এক বছরের মধ্যে আপনার অনেকগুলি দুর্ঘটনা ঘটবে, একান্ত প্রিয়জনের মৃত্যু, অর্থনাশ, স্বাস্থ্যহানি। আর কত বলব বলুন!’
তারপরও যদি সেই মাটির সঙ্গে-মিশে-যাওয়া মক্কেলের কথা কইবার মত কোন শক্তি থাকত, তবে অনুরোধ করত, তা এর কোন প্রতিকার নেই? গ্রহপূজা বা শান্তি স্বস্ত্যয়ন-টস্ত্যয়ন।’
আবার চড়া সুরে বেজে উঠত বরদা জ্যোতিষীর গলা৷ —‘না মশাই, ওসব কথা আমার কাছে বলবেন না। তাহলে যান ঐসব বুজরুকদের কাছে, যারা বোকা বুঝিয়ে আপনাকে আড়াই শ’ টাকার নবগ্রহ কবচ গছাবে কিম্বা যজ্ঞ করার জন্যে দেড়শ টাকার ফর্দ দেবে। ওটি আমার দ্বারা হবে না। কত হাজার মাইল দূরে বসে যেসব গ্রহ এমন করে মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন, যার সুস্পষ্ট নির্দেশ আপনার হাতের চামড়ায় আঁকা রয়েছে, তাঁদের হারিয়ে দেবেন কবচ পরে কিম্বা আগুনে একটু ভেজাল ঘি ঢেলে। অতই সহজ? আপনারা তা লেখাপড়া শিখেছেন, আপনাদের কমনসেনস্ কি বলে?’
‘তা হলে কি কোন উপায় নেই? ভগ্ন, স্খলিত কণ্ঠস্বরে নিরুপায়ের একান্ত কাতরোক্তি ফুটে ওঠে।
‘ঈশ্বরকে ডাকুন। যদি দীক্ষা হয়ে থাকে ত ইস্টদেবকে ধ্যান করে প্রত্যহ একমনে দশ হাজার কিংবা লক্ষ নাম জপ করুন। জপাৎ সিদ্ধ, জপাৎ সিদ্ধি, জপাৎ সিদ্ধিৰ্নসংশয়! ….দীক্ষা না হয়ে থাকলে তাঁর যে নাম আপনার প্রিয় মনে হয়। সেই নাম জপ করে যান। জপতে জপতে ইচ্ছাশক্তি জগবে—একমাত্র সেই ইচ্ছাশক্তি বা পুরুষকারই দৈবকে লঙ্ঘন করতে পারে। হয় বৈকি, কত স্বল্পায়ু লোককে দীর্ঘদিন বাঁচতে দেখলুম। নিজের কর্মফলে দৈবকেও প্ৰতিহত করা যায়!’
কিন্তু এ ব্যবস্থায় অধিকাংশ মক্কেলেরই মন উঠত না। অনেকেই বুঝত না এসব কথা। কোনমতে ওঁর দক্ষিণাটা দিয়ে সরে পড়ত। তাদের সে অপস্রিয়মাণ মূর্তির দিকে চেয়ে বরদার কণ্ঠস্বর আবার তীক্ষ্ণ হাসিতে চারিদিক আচ্ছন্ন করে ফেলত। তিনি বাকি সকলকে শুনিয়ে বলতেন, ‘চলল আহাম্মুকটা ছুটে…এখনই কোন বুজরুককে দুশ আড়াইশ’ টাকা না দেওয়া পর্যন্ত ওর শান্তি নেই।’
দু একজন, যাঁরা ওঁর অপেক্ষাকৃত অন্তরঙ্গ তাঁরা হয়ত বলতেন, ‘তা। আপনি জেনেশুনে এ টাকাটা হাতছাড়া করলেন কেন? ওঁরা যখন খরচ করবেই—?
‘না না,’ যেন শিউরে উঠে বলতেন জ্যোতিষী, ‘ওতে আমার সত্যিই ঘূণাবোধ হয়। জানি যা দুর্লঙ্ঘ্য যা কিছুতে নিবারণ করতে পারব না—তার জন্য হাত পেতে টাকা নেব, প্ৰবঞ্চনা করে— সে আমার সইবে না। …তা ছাড়া ভগবানের ইচ্ছেয় আমার তা ঠিক চলে যাচ্ছে।’ এখানে তাঁর কণ্ঠস্বরে আবার বিদ্রুপের আভাস জাগত, মজা হচ্ছে এই—‘যেখানে যত বুজরুকের কাছেই যাক—একবার করে আমার কাছেও আসবে ঠিক, জানে যে এখানে সত্যি কথা পাবে। যা কিছু অমঙ্গল, যা কিছু আশঙ্কার, যা কিছু ভয়াবহ—ওরা জানে যে আমার চোখেই পড়বে ঠিক!’
বলতে বলতে তাঁর উজ্জ্বল চোখ আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠত—অজানা কী একটা উত্তেজনায় যেন হাঁপাতে থাকতেন। তারপর হয়ত উঠে খড়ম পায়ে দিয়ে সংকীর্ণপরিসর ঘরের মেঝেতে পায়চারি শুরু করতেন—সে সময় তাঁর চোখ দুটো হয়ে উঠত লাল। খানিকটা পরে কেমন যেন চাপা হিংস্র গলায় বলে উঠতেন, ‘জানি। অথচ প্ৰতিকার করতে পারি না—দেখতে পাই, তবু ঠেকাতে পারি না, এই জন্যই ত ওকে বলে নিয়তি!… তার চেয়ে অদৃষ্ট অ-দৃষ্ট থাকাই বোধহয় ভাল ছিল!’
যাঁরা তাঁর পরিচিত, তাঁরা ওঁর এই ভাবটা জানতেন, আর বোধহয় কারণটাও—তাই আর ঘাঁটাতে সাহস করতেন না, কথাটা চেপে যেতেন।
হ্যাঁ, কারণটাও অনেকেই জানতেন বৈ কি!
বরদা জ্যোতিষীর ইতিহাস এ অঞ্চলে অনেকেই জানেন।
জ্যোতিষী উনি ছিলেন না—প্রথম বয়সে বি-এ ফেল করে এক ইস্কুলে ঢুকেছিলেন অঙ্কের মাস্টার হয়ে। ছোট সংসার, মা আর ছেলে—ছোট্ট একটু বাড়িও ছিল মাথা গোঁজবার মত। তাই অভাব হয়নি, পঁয়ত্ৰিশ টাকা মাইনেতে সংসার চালিয়েও অনেক শখ মেটাতে পারতেন। এই সব শখের মধ্যে প্ৰধান ছিল পুরোনো বই কেনা। বেশী দামের পুরোনো বই কেনা সম্ভব নয়, তাই সারা বিকেল আর সন্ধ্যেটা ঘুরতেন পুরোনো বইয়ের বাজারে, হাঁটকে হাঁটকে একটা দুটো ছেঁড়া, জীর্ণ কীটদষ্ট বই সংগ্রহ করে আনতেন। নিরীহ রোগা চেহারার এই ছোকরাটিকে বইওয়ালারা কৃপার দৃষ্টিতেই দেখত, তাই তারা সারাক্ষণ ধরে বই ঘাঁটলেও কিছু বলত না। তা ছাড়া লোকটি কিনতেন যত বাজে আর অকেজো বই (তাদের মতে)—তাই তারা সস্তা করেও দিত অনেক সময়ে। মা অনুযোগ করতেন, বন্ধুরা ঠাট্টা-তামাসা করত, কিন্তু এ নেশা তাঁর কাটত না কিছুতেই—বিয়ে থা করে সংসারী হওয়া কিংবা আর একবার চেষ্টা করে বি-এ পাস করার সম্ভাবনা হয়ে পড়তে লাগল সুদূরপরাহত।
এমনি করে বই ঘাঁটতে ঘাঁটতেই হঠাৎ বরদা পেয়ে যান খানদুই ফলিত জ্যোতিষের বই—প্রাচীন পুঁথি, খবর নিয়ে জানলেন যে, এ বই দুটি খুব বিখ্যাত এবং অধুনা দুষ্প্রাপ্য। পুঁথির আকারে ছিল বই দুখানা, বিবৰ্ণ নাগরী লিপিতে ছাপা—একেবারেই বাজে বই মনে করে দোকানদার মাত্র আনা ছয়েক পয়সাতে বই দুখানা দিয়েছিল।
ব্যস, এইবার লাগল তাঁর নতুন এক নেশা। প্রায় গলে-যাওয়া পুঁথির পাতা থেকে অতিকষ্টে উদ্ধার করে করে তিনি লিপিগুলো আর একটা খাতায় নকল করলেন। অর্থ বোঝবার অসুবিধে হচ্ছে দেখে আবার সংস্কৃত পড়তে শুরু করলেন নতুন করে। নতুন করে ব্যাকরণ ও অভিধান খুলে বসলেন। যেমন করে হোক এর পাঠ উদ্ধার করতে হবেই—এর সম্পূর্ণ অর্থ উদ্ধার করা চাইই।
ক্ৰমে ক্ৰমে আয়ত্ত করেও ফেললেন সবটা। এ যেন এক নতুন দৃষ্টি খুলে গেল ওঁর। পুঁথির শ্লোকের বর্ণনার সঙ্গে নিজের ও মায়ের কররেখা মিলিয়ে মিলিয়ে চিনতে শিখলেন, কোন রেখার কি অমোঘ নির্দেশ তাও ধীরে ধীরে বুঝতে পারলেন।
কিন্তু তবু ঠিক বিশ্বাস হয়নি। ছেলেবেলা থেকে অনেককে তিনিও হাত দেখিয়েছেন। তার কোনটা মিলেছে, কোনটা মেলেনি। ওঁর বিশ্বাস ছিল এগুলো অল্পবিস্তর আঁধারেই ঢিল ছোঁড়া হয়—যেটা লাগে দৈবাৎ। কিন্তু এবার শুরু করলেন নিজেই বন্ধুবান্ধবদের হাত দেখতে। একে একে বহুলোকের হাত দেখলেন তিনি, বিনা পয়সায় সোধে সোধেই। আর সেই তাঁর প্রথম চমক লাগল। জ্যোতিষশাস্ত্র এমন শক্তিশালী—হিসাব এমন নির্ভুল তাঁর! যা বলেন তাই যেন মিলে যায়, দৈববাণীর মত তাঁর কররেখাবিচার সত্য হয়, যেন নির্ভুল অঙ্কের মত হিসাব করা সব ব্যাপারটা।
ফলে নেশা আরও বাড়ল। এদিক-ওদিক খুঁজে আরও দু-একটা বই বার করলেন। ছুটলেন কাশীতে—গুধুড়ি বাজার থেকে পুরোনো জ্যোতিষের বই সংগ্রহ করলেন, লুধিয়ানাতে গেলেন মাসিক শতকরা দুটাকা সুদে টাকা ধার করে। সেখানে কোন পাঞ্জাবী জ্যোতিষীর কাছে ভৃগুসংহিতার সম্পূর্ণ পুঁথি আছে, তাই দেখবার জন্য। দুশোটি টাকা প্ৰণামী দিয়ে তবে তা একবার নাড়াচাড়া করবার অধিকার পেয়েছিলেন।
এইসব করার ফলে ইস্কুলের চাকরিও বোঁটা শুকিয়ে খসে পড়বার মত হয়েছিল, তিনি নিজেই এবার সেই সামান্য যোগসূত্রটি ছিঁড়ে দিলেন, এই বাড়িরই বাইরে সাইনবোর্ড লাগিয়ে বসে গেলেন পেশাদার জ্যোতিষী রূপে। নবদ্বীপে পাঁচটি টাকা দিয়ে জ্যোতির্বিনোদ উপাধি তার আগেই আনানো ছিল।
কিন্তু শখ করে হাত দেখানো এক জিনিস আর টাকা খরচ করে দেখানো আর এক৷ যে-সব বন্ধুবান্ধবরা এতদিন উৎসাহসহকারে ঘিরে থাকত। তারা সরে পড়ল। তা ছাড়া তাদের কাজ তা হয়েই গিয়েছিল। এখন মক্কেল আর আসে না। দিনের পর দিন কাটে—রাত্রির পর রাত্রি। পাশে লেন্সখানা রেখে টেবিল ল্যাম্পের আলোকে ঝুকে পড়ে দীর্ঘ রাত্রি পর্যন্ত বরদা জ্যোতিষী পড়াশুনা করেন। সে পড়াশুনোয় ব্যাঘাত ঘটে না একটুও। এধারে বাড়িটিও বাঁধা পড়ল। মা অনুযোগ করে করে হাল ছেড়ে দিলেন—এ আবার কি শখ বাপু! যা হয় একটা চাকরি-বাকরি দেখে নে। মাথা গোঁজবার এ স্থানটুকুও গেলে দাঁড়াবি কোথায়?’
কিন্তু বরদা জ্যোতিষী তাঁর নিজের ভাগ্য তখন দেখে নিয়েছেন।
এই ই তাঁর বৃত্তি। এই বৃত্তিতেই তাঁর জীবনধারণ করতে হবে। অর্থ ও যশও কিছু কিছু পাবেন তিনি।
বহুদিন ধৈর্য ধারণ করে থাকার পর একটি দুটি করে মক্কেল আসতে লাগল।
ক্ষুধার্ত বাঘ যেমন করে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার খাদ্যের ওপর তেমনি করেই বরদা ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এরাই তাঁর বড়শিতে গাঁথা টোপ, যেমন করে হোক এই টোপে মাছ ধরতে হবে।
ইতিমধ্যে বহু রাত্রি জেগে বরদা জ্যোতিষের একটা বিশেষ দিক আয়ত্ত করেছিলেন ইচ্ছে করেই। মিছে করে ভাল ভাল কথা সাজিয়ে সাজিয়ে বলে আর পাঁচজন জ্যোতিষী যেমন করে, হাত দেখে তেমন করে দেখতে গেলে পসার জমাতে বহু বিলম্ব—বুদ্ধিমান বরদা তা বুঝেছিলেন। তিনি সে চেষ্টা করেন নি । তিনি বিশেষ করে চিনতে শিখেছিলেন দুর্ভাগ্যের রেখাগুলি—জন্মকুণ্ডলীর অমঙ্গলকর অবস্থানগুলির অব্যর্থ ফলাফল আয়ত্ত করেছিলেন। তিনি জানতেন অধিকাংশ হাতেই ভালর চেয়ে খারাপ বেশি। খারাপ ফলই সত্য হয় এবং এগুলো অন্য জ্যোতিষী বলে না। তিনি এই অস্ত্রে মক্কেলদের ধরাশায়ী করবেন—অমঙ্গলের মন্ত্রে নিজের মঙ্গল ডেকে আনবেন।
আর করলেনও তাই।
তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি অভ্যাগতদের বুকের মধ্যে কেটে কেটে বসতে লাগল, তীক্ষ্ণতর কণ্ঠের অশুভকারী ভবিষ্যদ্বাণী কানের মধ্যে আগুনের মত জ্বলতে লাগল। কিন্তু তবু তারা আসতে লাগল। মক্কেলের সংখ্যা বাড়তেই লাগল দিন দিন। তার কারণ বরদার কথা কখনও মিথ্যা হয় না। দৈবের মত অমোঘ, মৃত্যুর মত ধ্রুব। প্রত্যেক মানুষের মনে একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আছে নিষ্ঠুর সত্য সম্বন্ধে। যাতে সে যন্ত্রণা পায়, তাই সেই আঘাত পেতেই বার বার এগিয়ে আসে। মুখে বলে, ‘আগে জানতে পারলে তবু সাবধান হওয়া যায়—এ এক রকম ভালই।’ যদিচ কোন সতর্কতাই কাজে আসে না। বরদার ভবিষ্যদ্বাণীকে কোন গ্রহযজ্ঞে বা কোন শান্তি-স্বস্ত্যয়নে এড়ানো যায় না। তবে নাকি মানুষ ঠিক নিজের অমঙ্গলে বিশ্বাস করে না, আশা করে শেষ মুহুর্তে কোন-না-কোন উপায়ে সেটা খণ্ডিত হয়ে যাবে। তাই তারা শুনে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে না, কিংবা আত্মহত্যা করে না। কারণ বরদার দয়ামায়া নেই—কোন সাংঘাতিক কথাই তাঁর মুখে এড়ায় না। মায়ের মুখের ওপর তার একমাত্র সন্তানের মৃত্যুর সম্ভাবনাটা তিনি অকম্পিত কণ্ঠেই শুনিয়ে দিতে পারেন।
কিন্তু অমঙ্গলটা নির্ভুলভাবে দেখা বরদা জ্যোতিষীর পেশা থেকে নেশায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
তাই পরের কররেখার ফলাফলের সঙ্গে নিজেরটাও দেখে নিয়েছিলেন আগেই।
দুটি সাংঘাতিক ফল। কঠিন, মৃত্যুঘাতী সে কথা।
কয়বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিচার করেছেন বরদা। কররেখায় বিশ্বাস হয়নি—জন্মকুণ্ডলী খুলে বসেছেন ঘন্টার পর ঘণ্টা। জন্ম সময় সম্বন্ধে সংশয় হয়েছে, গণনা করে বার করেছেন নিজের জন্মতারিখ ও ঘন্টা। ছুটে গিয়েছেন কাশীতে, গিয়েছেন কাশ্মীরে—ভৃগুসংহিতার সঙ্গে মিলিয়েছেন।
না, ভুল কোথাও নেই।
মাতৃঘাতী যোগ আছে তাঁর হাতে। আর যখন কোনমতেই এটাকে উড়িয়ে দেওয়া গেল না।—তখন তিনি মনস্থির করে ফেললেন। শাস্ত্ৰমতে যা সবচেয়ে কঠিন যজ্ঞ—তাই তিনি করবেন প্রথমটা এড়াবার জন্যে। আর দ্বিতীয়টা খুব সোজা, তিনি বিয়েই করবেন না। ইতিমধ্যে বয়েসও তা হয়ে গেছে প্ৰায় পঁয়ত্ৰিশ, কি দরকার ও ঝামেলা জড়বার?
তিনি তন্ত্রের পুঁথি খুলে বসলেন নিজেই। আছে স্ত্রীর কুলত্যাগিনী হওয়ার সংবাদ। ছুটে গেলেন বড় বড় পণ্ডিতদের কাছে, সব শ্লোকের সম্পূর্ণ অর্থ তাঁর ঠিক বোধগম্য হচ্ছে কিনা সেইটে মিলিয়ে নিতে। মস্ত্রের ঠিক ঠিক উচ্চারণ আয়ত্ত করার জন্য হিন্দুস্থানী পণ্ডিতদের কাছে গেলেন। কিন্তু তার আগে আর একটা উপায় চিন্তা করে মায়ের কাছে কথাটা পাড়লেন, মা তুমি তীর্থবাস করতে চেয়েছিলে, এখন যাবে? এখন ত যাহোক একটু সচ্ছল অবস্থা হয়েছে, কাশীতে গিয়ে থাকো না।’
মা আমতা-আমতা করে বললেন, ‘তা বটে—তীর্থে থাকতে কার না সাধ! তবে তোর একটা দেখা-শোনার লোক হল না। ঘর-সংসারই বা দেখে কে? তোকে ভাত-জল দেওয়া—‘
একটু অসহিষ্ণুভাবেই বলেন বরদা, সে ভাবনা আর কতকাল ভাববে মা? তুমি মরে গেলে কে আমাকে দেখবে?’
‘সে তখন আলাদা কথা। বেঁচে থাকতে না ভেবে কি করি বল?’
‘তাহলে তুমি যাবে না?’
‘তুই একটা বিয়ে কর ত যাই।’
‘সে আমি পারব না।’ দৃঢ়কণ্ঠে বলেন বরদা।
‘তাহলে আমিও যাব না।’
আরও পীড়াপীড়িতে আসল কথাটা বলে ফেলেন, ‘এই বুড়ো বয়সে শরীর ভেঙে আসছে, এখন একা কোন নির্বান্ধব পুরীতে থাকিব বল দেখি? বড় ভয় করে যে!’
‘বেশ সঙ্গে যদি লোক দিই?’ বরদা প্রশ্ন করেন।
‘কেন বল দেখি আমাকে তাড়াবার এত তাগিদ? আমি না বিদেয় হলে বুঝি বিয়ে করবিনি?
‘লোকই না-হয় দিলি! হঠাৎ যদি মরে যাই, এক ছেলে, একটু জলও পাব না?’
অগত্যা সে প্রস্তাব বন্ধ করতে হয়।
এই একমাত্র ক্ষেত্র, যেখানে আসল কথাটা বলা চলে না। বললেও মা বিশ্বাস করবেন না। ছেলের অসাধারণ মাতৃভক্তির কথা তিনি সকলকে গর্ব করে বলে বেড়ান।
সুতরাং শেষ পর্যন্ত যজ্ঞেই বসতে হয়। নিজে নিষ্ঠাপূর্বক সমস্ত আয়োজন করেন। ঘি তৈরি হয় গোরুর দুধ থেকে, সর জ্বাল দিয়ে। এতটুকু ত্রুটি কোথাও না থাকে এই প্ৰতিজ্ঞা। আগের দিন উপবাস করে থাকেন। পাঁজি দেখে সময় ঠিক করে যজ্ঞে বসেন। জ্ঞানত কোথাও কোন খুঁত রইল না। যজ্ঞের শেষে বিধিপূর্বক কবচ বেঁধে দিলেন মায়ের হাতে, কারণ বললেন, ‘তোমার একটা বড় ফাঁড়া আছে মা, শিগগিরই।’
মা বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘এই এত বড় যাগটা করলি কি তুই আমার জন্যে? হ্যাঁ? বলিস কি রে—কী পাগল রে তুই!’
‘কেন, পাগল কেন?’
‘আমি ত বুড়ো হয়েছি, না হয় মলুমই। তার জন্যে এত?’
‘সে তুমি বুঝবে না।’
কথাটা সেদিন এইখানেই চাপা পড়ল বটে, কিন্তু শেষ হল না।
মুখে ব্যাপারটা যতই তুচ্ছ বলে উড়িয়ে দিল, মায়ের মনের মধ্যে সেটা বহুদূরপ্রসারী হয়ে আশ্রয় নিলে। কয়েকদিন ধরেই কথাটা মনে মনে নাড়াচাড়া করে একদিন এসে বললেন, ‘বাবা, একটা কথা বলব তোকে, রাখবি?’
বরদা বললেন, ‘বিয়ের কথা ছাড়া যা বলবে তুমি, রাখব।’
মা বললেন, ‘এই ত? কথা দিচ্ছিস?’
বরদা ঘাড় নাড়লেন।
মা বললেন, ‘ফাঁড়ার কথা ত বাবা কিছু বলা যায় না—তাছাড়া এমনিই ত প্ৰায় ষাট বছর বয়স হল—কবে আছি, কবে নেই। তুই আমাকে নিয়ে একটু তীর্থ করিয়ে দে। তাছাড়া শুনেছি তীর্থস্নানে অনেক সময় গ্ৰহ-ফাঁড়া কাটে।’
জ্যোতিষী বিস্মিত হলেও মুখে সেটা প্ৰকাশ করলেন না। সময় নিকট হয়ে আসছে, এ কি তারই পূর্বাভাস?
খানিকটা চুপ করে থেকে বললেন, ‘যদি লোক দিই সঙ্গে?’
‘না সে হয় না। মরণের সময় তুমি কাছে থাকবে না। এ হতে পারে না। তোমাকে ছাড়া আর আমি থাকব না।’
‘বেশ তাই হবে।’
দেনার শেষ হাজার টাকা শোধ করবেন বলে জ্যোতিষী তৈরি হচ্ছিলেন, সেই টাকা সম্বল করেই দোরে তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। ভারতভূমিকে বামাবর্তে পরিক্রম করলেন তিনি। কলকাতা থেকে পুরী, সেখান থেকে সিংহাচল, গোদাবরী, পক্ষীতীর্থ, শ্ৰীরঙ্গম, রামেশ্বর হয়ে বোম্বের পথে নাসিক, পঞ্চবটী, প্ৰভাস, দ্বারকা, পুষ্কর সেরে মথুরা বৃন্দাবন হয়ে সোজা চলে গেলেন হরিদ্বার, সেখান থেকে কুরুক্ষেত্র, প্রয়াগ হয়ে কাশী এসে নামলেন। মাকে বললেন, ‘মোটামুটি তোমার সব সারা হয়ে গেল মা, বাকী শুধু রইল গয়া—যাবার পথে বাবার পিণ্ডটা দিয়ে ফিরব।’
‘তা যা হয়. করিস বাবা। এখন কাশীতে দুদিন বিশ্রাম কর। বাবা, হাঁপিয়ে উঠেছি।’
বরদাও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। প্ৰস্তাবটা তার ভাল লাগল। তাই, ধর্মশালাতে তিন দিনের বেশি থাকতে দেয় না বলে পাণ্ডার সহায়তায় গণেশমহল্লায় একটা বাড়িতে দৈনিক চার আনা ভাড়ায় ঘর ঠিক করলেন। বাঙালী ব্ৰাহ্মণ স্ত্রী-পুত্র নিয়ে থাকেন সে বাড়িতে—তিনিই ঘর ভাড়া দেন। সংসার চালাবার এই-ই একমাত্র অবলম্বন; তাঁর নিজের দুর্দান্ত হাঁপানি, কাজকর্ম কিছুই করতে পারেন না। এ-আয়েই বা কি হয়, শুধু কাশী জায়গা বলেই চলছে। ওধারে মেয়ে বিবাহযোগ্য হয়েছে, আঠারো পেরিয়ে যায়-যায়—বিয়ে দেবার কোন উপায় নেই, তিনি দেখতে পাচ্ছেন না! পয়সা নেই, কে আর নেবে তাঁর মেয়েকে? ইত্যাদি অনেক দুঃখের কথাই বললেন বাড়ি ভাড়া দেবার সময় ভদ্রলোক। বরদা কৌতুহলী হয়ে মেয়েটির দিকে তাকালেন, বেশ সুশ্ৰী মেয়েটি—যৌবনে ও স্বাস্থ্যে টলোমলো। ময়লা কাপড়ে ও নিরাভরণ অবস্থাতেও সে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মনে মনে স্থির করলেন। বরদা, অবসর সময়ে মেয়েটির হাত দেখবেন।
কিন্তু সে অবসর আর মিলল না। সেইদিনই মা গেলেন কেদারনাথ দর্শনে। কী মনে হল—বললেন, ‘এখানে স্নান করব বাবা একটু।’
‘সে কি, মা, এমন অসময়ে, সকালে ত স্নান করেছ।’
‘তা হোক বাবা, এসেছি—এখানে স্নান করব না!’
তিনি নামলেন জলে। দু-পা নেমেই কিন্তু বলে উঠলেন, ‘এ যে বড় পেছল রে, ও বাবা, ধর ধর আমাকে—’
‘তখন স্নানার্থী কম। অপারে কেউ হাত ধরবে, সে সম্ভাবনাও নেই। বরদা ব্যস্ত হয়ে জামা-কাপড়সুদ্ধ নেমে এলেন, কিন্তু তাড়াতাড়িতে তিনি সাবধান হননি—তাঁরও পা গেল পিছলে—সেই অবস্থাতে সামলাবার আগেই তিনি গিয়ে পড়লেন মার ওপর। হাত ধরার আর অবসর হল না, চোখ মেলাবার আগেই মা কোথায় তলিয়ে গেলেন।
তারপর চেচামেচি, হৈ-চৈ, যা হবার সবই হল। অনেক কষ্টে, বহু চেষ্টায় দেহ খুঁজে পাওয়া গেল, কিন্তু সে মৃতদেহ। বরদা কথা কইলেন না, কাঁদলেন না—চুপ করে একদিকে চেয়ে বসে রইলেন। শুধু দৃষ্টিটা তাঁর যেন আরও উগ্র, আরও ভয়ানক হয়ে উঠল।
যাই হোক—লোকজন ততক্ষণে বিস্তর এসে জড়ো হয়েছিল। খবর পেয়ে ওঁর নতুন বাড়িওয়ালাও এলেন, সঙ্গে তাঁর মেয়ে সারমা। সারমাই সাহস করে এগিয়ে এসে বললে, ‘উঠুন—এমন করে বসে থাকলে ত চলবে না—মায়ের শেষ কাজ, আপনাকেই তা করতে হবে। মায়ের ঋণ শোধ করুন।’
‘তা বটে।’
এতক্ষণে বরদা বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালেন চারিদিকে৷ উঠে দাঁড়াতে গেলেন, মাথাটা কেমন টলে উঠল—সরমা ভাগ্যে ওঁকে লক্ষ্য করছিল, তাড়াতাড়ি হাতটা ধরে ফেলাতে সে যাত্রা সামলে নিতে পারলেন। সারমাই হাত ধরে ওঁকে টেনে নিয়ে গেল মায়ের মৃতদেহের কাছে।
স্থানীয় লোকেদের সহৃদয়তায় পুলিশ-হাঙ্গামা আর হল না। শব দাহ করার অনুমতি পাওয়া গেল সহজেই। মণিকর্ণিকায় নিয়ে যাওয়ারও লোক মিলল। শেষ কাজ ভালভাবেই সুসম্পন্ন হয়ে গেল।
কিন্তু দাহ সেরে বাড়ি ফিরে বরদা যেন একেবারে ভেঙে পড়লেন। হাত-পা যেন তাঁর নয়—নিজের কোন ইচ্ছাশক্তিও নেই। বিহ্বল, জড় হয়ে পড়েছেন। সেই তীক্ষ্ণধী, কটুভাষী ভয়ঙ্কর জ্যোতিষীকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না তাঁর মধ্যে। তিনি শিশুর মত অসহায়, বৃদ্ধের মত পরনির্ভরশীল হয়ে উঠলেন।
এই সংকটমুহুর্তে সরমা তাঁর যা সেবা করলে—অসাধারণ। দেখা গেল, মেয়েটির শুধু রূপই নেই, গুণও আছে। সে একেবারে নিকট আত্মীয়ার মতই বরদার সব ভার নিজের হাতে তুলে নিলে। যেন বহুকালের পরিচয়, এইভাবে সে সমস্ত লজ্জা ও সঙ্কোচ কাটিয়ে ওঁর কাছে এসে দাঁড়াল। নিপুণা গৃহিণীর মতই সব দিকে তার নজর—জননীর মতই অতন্দ্র ও অস্খলিত তার সেবা। বরদা মুগ্ধ, কৃতজ্ঞ না হয়ে পারেন না—সব ভারই তিনি এই মেয়েটির ওপর তুলে দিয়ে যেন বাঁচলেন। দুপুরের হবিষ্যের যোগাড় করা, রাত্রের জলখাবার—শ্রাদ্ধের তিল বাছা, সব কাজই সহজে সারমার ওপর এসে পড়ল। বরদা নির্লিপ্ত উদাসীনতার সঙ্গে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলেন শুধু।
শ্ৰাদ্ধশান্তির পর বরদা বাড়ি ফেরবার জন্য প্ৰস্তুত হলেন। বিদায়ের পূর্বে সরমার বাবাকে প্ৰণাম করতে গিয়ে কথায় কথায় বললেন, ‘আপনাদের ঋণ আমার শোধ করার উপায় নেই—তবু যদি কিছু করবার থাকে ত বলুন। আপনাদের সামান্য কিছু উপকার করতে পারলে খুশি হব।’
ব্ৰাহ্মণ খানিকটা চুপ করে থেকে বললেন, ‘সত্যি সত্যিই উপকার করতে চান? করবেন?’
‘নিশ্চয়ই করব—অবশ্য সাধ্যে কুলোলে।’
‘কথা দিচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ!’
‘তাহলে আমার কন্যাটিকে আপনি গ্ৰহণ করুন—ও আপনার খুব অনুপযুক্ত হবে না।
‘সে কি!’ শিউরে চমকে ওঠেন বরদা।
‘ব্রাহ্মণের কন্যাদায়ের কাছে আর কি আছে বলুন! আপনিও ব্রাহ্মণ, ব্ৰাহ্মণের ব্ৰাহ্মণই গতি?’
‘কিন্তু বিবাহ আমি যে কখনই করব না স্থির করেছি।’
‘ও, স্থির করেছেন। সেটা কোন বাধা নয়। আপনি আমাকে কথা দিয়েছেন যে সম্ভব হলেই আপনি আমার অনুরোধ রাখবেন। এক্ষেত্রে অসম্ভব কোন বাধা নেই।’
‘আপনি সেসব কথা বুঝতে পারছেন না—সে হবার নয় কার্তিকবাবু।’ ব্যাকুল হয়ে বলেন বরদা জ্যোতিষী।
মধু-তিক্ত কণ্ঠে কীর্তিকবাবু বললেন, ‘হবার নয় যে তা ত জানিই। তাই ত চুপ করেই ছিলাম। দরিদ্রের কন্যাকে কে আর নিতে চাইবে বলুন! নেহাত আপনি কথাটা তুললেন বলেই তাই—‘
অভিমানের সুরই তাঁর কণ্ঠে।
বরদা একবার চোখ বুজে মাকে স্মরণ করার চেষ্টা করলেন। তাঁর মানসচক্ষুতে ফুটে উঠল নিজের কররেখার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত—কিন্তু সে মুহূর্তের জন্য সেসব ছবি মিলিয়ে একাকার হয়ে জ্বলজ্বল করতে লাগল, একটি যৌবনবিকশিত মুখের সরস পরিপূর্ণ ওষ্ঠাধর। বিচিত্র এক লাস্যভরা হাসি—এবং দীর্ঘ পক্ষ্মবেষ্টিত চোখের আবেশ-ভরা মদির চাহনি। সরমা! তাই ত বটে।
অস্ফুট কণ্ঠে বরদা জ্যোতিষী বললেন, ‘নিয়তি!’
কার্তিকবাবু ব্যগ্রভাবে প্রশ্ন করলেন, ‘কী বললেন!’
বরদা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে জবাব দিলেন, ‘তাই হবে। আপনাকে আমি কথাই দিলাম। তবে মাস ছয়েক অপেক্ষা করতে হবে। মাস ছয়েক পরে কাশীতে এসেই মায়ের সপিণ্ডকরণ সেরে নেব—সেই সময়েই বিবাহ হবে।’
‘আমার কিন্তু কিছু দেবার সম্পত্তি নেই—এক ভরি সোনাও বোধ হয় দিতে পারব না।’
‘দরকার নেই, আপনি রুলি দিয়েই বিয়ে দেবেন।’
বরদা জ্যোতিষীর মত চেহারার এবং বয়সের পাত্রকে সরমার মত মেয়ের হয়ত পছন্দ হবার কথা নয়, কিন্তু সরমা তবু আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতই স্বামীকে একান্ত মনে অবলম্বন করতে, ভালবাসতে চেয়েছিল। আশ্চর্য এই যে, বাধা এল বরদার কাছ থেকেই। কিসের সে বাধা—ওর এই আবেগময় আত্মনিবেদন গ্রহণ করতে কোথায় বরদার সঙ্কোচ, তা সরমা বুঝতে পারে না। ব্যথিত হয়, বিস্মিত হয়।
তবু বাধা আছে একটা কোথাও এটা ঠিক। আদালতে প্ৰমাণ করার মত তার কোন প্ৰত্যক্ষ তথ্য না থাকলেও সরমা সমস্ত অন্তর দিয়ে সেটা অনুভব করে। কোথায় একটা প্রাচীর আছে দুজনের মধ্যে, আর সে প্রাচীর দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে।
সরমা যখন আবেশে, আনন্দে, অত্যুগ্র কামনায় ওঁকে জড়িয়ে ধরতে যায়, তখন বেশ অনুভব করে যে, বরদা কেমন যেন শিটিয়ে ওঠেন, কঠিন হয়ে যান। ওর যৌবনপুষ্ট কমনীয় বাহু দিয়ে স্বামীর গলা জড়িয়ে নিজের ওষ্ঠাধর এগিয়ে নিয়ে গেলেও তাঁর চুম্বন করতে মনে থাকে না—বরং কেমন একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন ওর মুখের দিকে। নিজের বাসনা ধিকৃত হয়ে ফিরে আসে। রাত্রের রসালাপ জমে না—কথা কইলে উত্তর মেলে না, আপনমনেই কি ভাবতে থাকেন বরদা।
ক্রমশ সরমা অনুভব করে যে, তার সম্বন্ধে একটা সন্দিগ্ধ ভাব আছে বরদার মনে। যখন যেখানে যে কাজই থাক না কেন, মনে হয়, তাঁর একটা সজাগ চোখ আর কান ওকে অনুসরণ করছে সর্বদা। সোজাসুজি যখন তাকিয়ে থাকেন, তখনও সে দৃষ্টিতে রূপযৌবনের প্রশংসা ফুটে ওঠে না, ফোটে না তাতে লালসা—শুধু একটা সন্দেহ, একটি অবিশ্বাস, নির্ভরশীলতার অভাবই দেখতে পায়!
তবু সরমা বোঝে যে এটা স্ত্রী সম্বন্ধে স্বামীর ঠিক সাধারণ অবিশ্বাস বা সন্দেহ নয়—তাছাড়াও কিছু একটা। কী যেন ভাবেন ইনি সদাসর্বদা, আর সে তাকে কেন্দ্র করেই।
কিন্তু রাগ হয় ওর এইজন্য যে, এ সম্বন্ধে প্রশ্ন করেও বরদার কাছ থেকে কোন জবাব পাওয়া যায় না। কী ভাবেন, উনি কেন ভাবেন। কি মনে করেন ওকে—ওকে কি তাঁর বিশ্বাস হয় না? কেন হয় না? আরও কি, চান উনি ওর কাছ থেকে?
এসব প্রশ্নের কোন জবাবই মেলে না, শুধু সেই বিচিত্ৰ চাহনি মেলে স্থির হয়ে থাকেন বরদা। ওর অন্তরের সমস্ত আকুলতা যেন এক পাষাণপ্রাচীরে ঠেকে বৃথাই মাথা কুটে ফিরে আসে।
তবু কিছুদিন সে তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছিল। আদর না হোক, আদরের অভিনয়ও করেছিলেন। ক্রমশ সে সুখও চলে গেল—বরদার পসার বেড়েছে, বাইরের ডাক ও কাজ-দুই-ই বেশি। লোক যখন থাকে না, তখন থাকে ঠিকুজী বা কুষ্ঠী করার কাজ, তাও যখন থাকে না তখন টেবিল ল্যাম্পের আলোতে ঝুকে পড়ে পুঁথি আর খাতার পাতা ওল্টান; মাঝে মাঝে নিজের কররেখার দিকে তাকিয়ে থাকেন একদৃষ্টে। সারমার যৌবনের সুরা যত তাঁকে মাতাল করতে চায়, ওর রূপের আগুন তার দেহের পতঙ্গটাকে যত আকর্ষণ করে, ততই তিনি কঠিন হয়ে থাকতে চেষ্টা করেন, আর বারবার ব্যৰ্থ আগ্রহে পুঁথির পাতার মধ্যে সাস্তুনা খুঁজতে চেষ্টা করেন—যদি এখনও কোথাও তাঁর হিসাবের ভুল বার হয়, যদি এখনও মিথ্যা প্ৰতিপন্ন হয় তাঁর আশঙ্কা।
এমনি করে ভুল বোঝবার পাঁচিল ধীরে ধীরে দুর্লঙ্ঘ্য হয়ে ওঠে।
আশংকা ও সংশয় থেকে বীতরাগ, বীতরাগ থেকে বিদ্বেষ জন্মায় সরমার মনে। ও বিদ্রোহ করে স্বামীর এই অকারণ সন্দিগ্ধতার বিরুদ্ধে। ওর পরিপূর্ণ যৌবনের ডালি স্বামী ত দু’পায়ে করে সরিয়ে দিয়েছেন, যাতে তাঁর প্রয়োজন নেই, লোভ নেই—তার সম্বন্ধে এত সতর্কতা কেন, এত আগলাবার চেষ্টা কেন? সে কি করেছে? কার সঙ্গে মিশেছে, মিশবার লোকই বা কৈ? তবে এত সন্দেহ, এত আশঙ্কা কেন?
ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সরমা এক সময়ে। সে এর শোধ নেবেই। ঐ ত চেহারা ওঁর, যৌবনে ভাঁটা পড়েছে কবে, শীর্ণ রুক্ষ, বৃদ্ধ—ওঁর এত অহঙ্কার। ওঁকে বাড়িতে এনে এমন করে অবহেলা করবে? সে অকস্মাৎ শুরু করলে স্বামীকেই সম্পূর্ণ অবহেলা করতে। তাঁর খাওয়া-দাওয়ার খবর নেওয়া হয় না—দিনরাত নিজের প্রসাধন ও বেশভূষা নিয়েই থাকে। বাড়ির ছাদ থেকে ডেকে ডেকে আশে-পাশের বাড়ির সঙ্গে আলাপ জমায়—ফলে মধুলোভী ভৃঙ্গও দু-একজন পাড়ার চঞ্চল হয়ে ওঠে বৈকি!
নিয়তির এই ইঙ্গিত ক্ৰমে বরদাও দেখতে পান। তিনি আর একবার প্রস্তুত হন সংগ্রামের জন্য। কবচ তৈরি করে ধারণ করেন, স্ত্রীর বাহুমূলে বেঁধে দেন। নানা পাথরের আংটিতে তাঁর হাত ভরে যায়। এধারেও সতর্কতার শেষ নেই। ছাদে উচু করে পাঁচিল তুলে দিলেন। বাইরের লোকজনের সঙ্গে মেশা নিষিদ্ধ হল, কড়া পাহারা দিতে লাগলেন সর্বদা নিজেই। একদিন ঝিকে পাড়ায় একটি ছোকরার সঙ্গে গল্প করতে দেখে তাকে জবাব দিয়ে দিলেন তখনই। খুঁজে নিয়ে এলেন পুরোনো এক চাকরের সুপারিশে এক চাকরকে। নেহাতই বালক সে—সতেরো-আঠারো বছর বয়স হবে বড়জোর! তাকে নিভৃতে ডেকে বুঝিয়ে দেন যে, কড়া নজর রাখাই তার সর্বপ্রধান কর্তব্য।
নীরবে সব লক্ষ্য করে সরমা। কিন্তু কিছু বলে না, শুধু ওর চোখ দুটো হিংস্র হয়ে ওঠে। সাপের মত তা ক্রুর এবং অব্যৰ্থ। প্রতিহিংসার জন্য সেও প্রস্তুত হল। না, অপমানের উপযুক্ত জবাব সে দেবেই।
মনে মনে হেসে সে মনোযোগ দিলে চাকরীটির ওপরেই। আঠারো বছরের ছেলে, সে রূপের আগুনে নিমেষে ঝাঁপিয়ে পড়ল, সামান্যতম প্রয়াসের অপেক্ষামাত্র। কিন্তু এ প্রতিশোধেও মন উঠল না সরমার। যখন বিশ্বাস রইল না, রইল না ভালবাসা—কোন আশা নেই, আনন্দ নেই, তখন এ-খাঁচায় বন্ধ থাকবে কেন?…সে জানে, বিশাল পৃথিবীতে তার অন্তত অর্থের এবং সম্ভোগের বস্তুর অভাব হবে না—শুধু যা নেমে যাবার অপেক্ষা।…
ভাবার যা অপেক্ষা। প্রথম যেদিন অবসর মিলল, মানে যে সন্ধ্যায় মক্কেলের ভিড় বেশি দেখলে—ইঙ্গিতে চাকর খগেনকে ডেকে নিয়ে গেল ওপরের ঘরে, ওর নিকষ কৃষ্ণদেহ নিজের সুগৌর বাহুবেষ্টনে জড়িয়ে একেবারে বুকের কাছে টেনে নিয়ে এল, তারপর কাজলটানা চোখের মধ্য দিয়ে প্রবৃত্তি-মদির দৃষ্টি ওর দৃষ্টির ওপর নিবদ্ধ করে বললে, ‘এই, আমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবি?’
আবেগে উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে খগেন। সে শুধু বললে, ‘কোথায়?’
‘যেখানে হোক—খুব দূরদেশে কোথাও—এখানে আর থাকব না, শুধু তুই আর আমি কোথাও ঘর করব।’
এ যে অপ্রত্যাশিত সুখ আর সৌভাগ্য! খগেন ঠিক নিজের অদৃষ্টকে বিশ্বাস করতে পারে না। বলে, ‘কিন্তু বাবু যদি পুলিশে দেয়?’
‘আমি বলব, নিজের ইচ্ছায় চলে এসেছি। পুলিশ কি করবে?’
‘খাবে কি? আমার আয় ত এই, অন্য জায়গায় গেলে কি আয় বেশি হবে?’
‘এই ত গয়না রয়েছে আমার এত। কোথাও গিয়ে মুড়ি-বেগুনির দোকান দেব। আমি ভাজিব, আর তুই বেচাবি? কেমন?’
খগেনের চক্ষু লুব্ধ হয়ে ওঠে ভবিষ্যতের এ-ছবিতে। তবু বলে, ‘সে কষ্ট কি তুমি সইতে পারবে?’
‘খুব।’
‘বেশ চলো। কিন্তু আমার বড় ভয় করে।’
সাপের মত হিসহিস করে ওঠে সারমর কণ্ঠস্বর। সে বলে, ‘কিছু ভয় নেই—আমি আছি।’
‘বেশ, কবে যাবে বলে?;
‘কবে কি রে, এখনই।’
‘এখনই?’
‘হ্যাঁ—ও বাইরে ব্যস্ত আছে, চুপি চুপি এধারের দোর দিয়ে, ও গলি দিয়ে বেরিয়ে যাব—‘
‘কিন্তু জিনিসপত্র? কাপড়-চোপড়?’
‘কিছু দরকার নেই, তাতে দেরি হয়ে যাবে। লোকে সন্দেহ করবে। কিছু নগদ টাকা আছে আমার হাতে। সব কিনে নেব।’
মূঢ় পতঙ্গের বাধা দেবার আর শক্তি ছিল না। নিয়তির মত নিষ্ঠুর ঐ মেয়েটির ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করে সে সহজেই।
সরমারও আর তাঁর সইছে না। খগেনকে ওর প্রয়োজন ছিল না, প্রয়োজন থাকবেও না দুদিনের বেশি—এটা শুধু চরম প্রতিশোধ নেওয়া ওর স্বামীর ওপর।
ওর চোখ অদ্ভুত একটা আনন্দে জ্বলতে থাকে।
তখনই একবস্ত্ৰে খগেনের সঙ্গে সে গৃহত্যাগ করলে, ফেলে রেখে গেল শুধু বাঁ হাতে বাঁধা কবচখানা—
মক্কেলদের সঙ্গে কথা কইবার ফাঁকে ফাঁকে বরদা একটা কান পেতে রাখতেন ভেতর দিকে সর্বদাই। আজ যেন বড় বেশি নিস্তব্ধ ঠেকাল। কোনমতে সবাইকে বিদায় করে ভেতরে উঠে এলেন এক সময়ে।…
বাড়ির মধ্যে ঢুকতেই প্রথমে নজরে পড়ল সদর দোরটা খোলা হা-হা করছে। ছুটে ভেতরের উঠানে এসে দাঁড়ালেন। সারা বাড়িটা নিস্তব্ধ। চেঁচিয়ে ডাকলেন, ‘খগেন!’
সাড়া নেই।
ডাকতে গেলেন, ‘সরমা!’ গলা কেঁপে কেমন একটা বিকৃত স্বর বেরোল। ছুটে ওপরে এলেন, সব ঘর খোলা, সব খালি। কেউ নেই। কোথাও কেউ নেই।
একটা ঘর থেকে আর একটায়, ওপর থেকে নীচে বারকতক ছুটে বেড়ালেন—এক সময়ে পায়ে ঠেকল, কী একটা জিনিস। কুড়িয়ে নিয়ে দেখলেন। কবচটা।
এইবার হা-হা করে হেসে উঠলেন। অট্টহাসি। শূন্য বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে সে হাসি ঘুরে বেড়াতে লাগল।
সে হাসি পাগলের হাসি ঠিক নয়। কেমন যেন পৈশাচিক হাসি।
খুব খানিকটা হেসে নেবার পর বরদা নিজের হাতের কবচখানা টান মেরে ছিড়ে ফেলে দিলেন। আংটিগুলো খুলে নিয়ে নিজে হাতে, ড্রেনের মধ্যে ফেলে দিলেন। তারপর আবার একচোট হেসে উঠলেন। হা-হা, হা-হা!
এর পর বরদা আর একবার বিবাহ করেছেন। এও তাঁর কোষ্ঠীতে ছিল। এ স্ত্রীকে কারণে অকারণে নানারকম নির্যাতন করেন। জানেন যে এ কোথাও যাবে না। এবার তিনি নিশ্চিন্ত।
কিন্তু এর পর থেকেই মানুষের ভাগ্যের অন্ধকার দিক দেখার নেশা যেন তাঁর আরও বেড়ে গিয়েছে, সে ক্ষমতাও যেন দিন দিন মানুষের সাধারণ ক্ষমতাকে ছাড়িয়ে চলেছে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠকে তীক্ষ্ণতর করে নির্মম ও অব্যৰ্থ নিয়মিত অমোঘ নির্দেশকে তিনি অনায়াসে উদ্ঘাটিত করেন। হতচকিত, ভাগ্যতাড়িত হতভাগ্যদের পাংশু বিবৰ্ণ মুখের দিকে চেয়ে তিনি যেন কী এক অপূর্ব আনন্দ পান, কেমন এক রকম প্ৰতিহিংসার আনন্দ।
আর মাঝে মাঝে হেসে ওঠেন অস্বাভাবিক রকমের তীক্ষ্ণ আর তীব্ৰ বিদ্রুপের হাসি, সে হাসি যেন চারিদিকের স্তব্ধতাকে কেটে কেটে দূর থেকে দূরান্তরে বিস্তৃত হয়ে পড়ে।