কয়েকটি সুফিগল্প

অনুবাদ: ইমরুল হাসান

প্রকাশিত : জুলাই ১৭, ২০১৯

ফরিদউদ্দিন আত্তার ‘মানতিক-উত-তোয়ায়ের’ বইটা লিখছিলেন পার্শিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজে, ১১৭২ সালে। এই নামটা নেয়া হইছে, কোরানের আয়াত থিকা। ১৮৮৯ সালে মেবি এওয়ার্ড ফিল্টজেরাল্ড পয়লা ইংলিশে ট্রান্সলেশন করেন, বার্ড পার্লামেন্ট নামে। পরে দ্য স্পিচ অফ দ্য বার্ডস, কনফারেন্স অফ দ্য বার্ডস নামে আরো অনেকগুলা অনুবাদ হইছে। বাংলায় আমার জানামতে, ২০০৮ সালে করা আবদুল জলীলের অনুবাদটা অ্যাভেইলেবল। আগে আর পরে আরো অনুবাদ থাকতে পারে বইটার, বাংলাতেও। আমি যেই ইংলিশ ভার্সনটা ফলো করছি সেইটা Garcin De Tassy-র ফরাসি থিকা C.S.Nott এর করা অনুবাদ। ১৯৫৪ সালে পয়লা ছাপা হইছিল, পরে ১৯৭১ সালে Shambala পাবলিকেশন্স থিকা ছাপানো হইছিল। অই অডিশনটার পিডিএফ ভার্সন পাওয়া যায়, অনলাইনে। বইয়ের কাহিনিটা হইলো, সব পাখি একলগে হয় তাদের যে রাজা, তাদেরকে দেখতে যাইবো বইলা। এক পাখি তাদেরকে লিড দেয়, রাজার খবর বলে। কিন্তু পরে দেখা যায়, সব পাখি যাইতে চায় না। একেকজন একেকটা প্রব্লেমের কথা কয়, আর হোপিপাখি তাদেরকে জবাব দেয়, নানান কাহিনি বইলা। —ইমরুল হাসান

হোপিপাখি প্রিন্সেস আর দরবেশের কাহিনিটা কইলো

এক রাজার চান্দের মতোন সুন্দর এক মেয়ে ছিল, যারে ভালোবাসতো সবাই। তাঁর ঘুম-ঘুম চোখ আর তাঁর মিষ্টি নেশা-নেশা প্রেজেন্সে প্রেম জাইগা উঠতো। কর্পূরের মতোন শাদা ছিল তাঁর মুখ, কস্তরী-কালো তাঁর চুল। তাঁর ঠোঁটের জেলাসি স্বচ্ছ পানি থিকা একটা মুক্তা শুকায়া নিতো, যখন চিনি গইলা যাইতো তার শরমে।

আল্লার কেরামতিতে এক দরবেশ একদিন দেখলো তারে, আর তার হাতের রুটি হাত থিকা বালিতে পইড়া গেলো। একটা আগুনের হলকার মতোন শে তার কাছ দিয়া গেলো, আর যখন শে যাইতেছিল, শে হাসতেছিল। আর তারে দেইখা দরবেশটা ধূলায় পইড়া গেলো, যেন জীবন ছাইড়া গেলো তারে। দিনে বা রাতে সে শান্তি পাইতো না আর, আর কানতো সবসময়। যখন সে তাঁর হাসির কথা ভাবতো তার চোখের পানি গড়ায়া পড়তো যেমনে একটা মেঘ থিকা বৃষ্টি ঝইড়া পড়ে। এই পাগলা প্রেম সাত বছর ধইরা চললো, তখন সে রাস্তার কুত্তাদের লগে থাকতো। তখন তাঁর পাইক পেয়ারদাররা তার এই অবস্থার একটা বিহিত করতে চাইলো। কিন্তু প্রিন্সেস তার লগে গোপনে বাতচিত করলো আর কইলো: ‘তোমার আর আমার মধ্যে ইন্টিমেট রিলেশন হওয়া কেমনে সম্ভব? এখনই চইলা যাও, তা নাইলে তোমারে খুন কইরা ফেলবে আমার লোকজন: আমার দরজায় আর দাঁড়ায়া থাইকো না, এখন উঠো আর চইলা যাও।‘

বেচারা দরবেশ উত্তর দিল: ‘যেইদিন আমি তোমার প্রেমে পড়ছি জীবনের থিকা আমি হাত ধুইয়া নিছি। এইরকম আরো হাজার হাজার জীবন আমি সদকা দিছি তোমার সুন্দরের কাছে। এখন যখন তোমার লোকেরা আমারে অন্যায়ভাবে খুন করার লাইগা আসতেছে আমার একটা সহজ প্রশ্নের উত্তর দাও তো। যেইদিন তুমি আমার মরণের কারণ হইছিলা, কেন তুমি আমার দিকে তাকায়া হাসছিলা?’ ‘আরে বোকা,’ শে কইলো. ‘যখন আমি দেখলাম যে তুমি নিজেরে হিউমিলেট করতে যাইতেছো, তখন আমি করুণা কইরা হাসছি। করুণা কইরা হাসার পারমিশন আমার আছে, মকারি কইরা না।‘ এইটা বইলা, একটা ধোঁয়ার ঝাঁটার মতো শে ভ্যানিশড হয়া গেলো, দরবেশরে পতিত রাইখা।

কঞ্জুস

এক নেশাখোর এক বাক্স সোনাদান লুকায়া রাখলো, আর তার কয়দিন পরেই মইরা গেলো। এক বছর পরে পোলা একটা খোয়াবে তার বাপেরে দেখলো যে, সে একটা ইন্দুর হয়া গেছে, তার দুই চোখ কান্দার পানিতে ভরা। যেইখানে সোনাদানা লুকানো আছিলো ইন্দুরটা অইখান দিয়া সামনে পিছনে দৌড়াইতেছিল। তার পোলা তারে জিগাইলো: ‘এইখানে কি করতেছো তুমি?’ বাপে জবাব দিলো: ‘এইখানে আমি কিছু সোনাদানা লুকায়া রাখছিলাম আর দেখতে আসছি কেউ এইটা খুঁইজা পাইছে কিনা।’ ‘তুমি ইন্দুর হয়া গেছো কেন?’ পোলায় জিগাইলো। বাপে কইলো: ‘টাকা-পয়সার মহব্বতের লাইগা যেই মানুষের আত্মা সবকিছু ছাইড়া দেয় সে এই এইরকম হয়া যায়। পুত রে, আমার কথা শোন, আর যা তুই দেখছোস তা থিকা প্রফিট কর। সোনাদানার প্রতি মোহ ছাইড়া দে তুই।’

মাহমুদ আর আয়াজ

শয়তানের চোখ আয়াজরে দুর্দশায় ফেলছিল, আর তারে সুলতান মাহমুদের দরবার ছাড়তে হইছিল। হতাশায় পইড়া সে খুবই মন-মরা হয়া গেছিলো আর তার বিছনায় শুইয়া সে কান্তেছিলো। মাহমুদ যখন এইটা শুনলেন, উনি তার এক খাদেমরে কইলেন: ‘আয়াজের কাছে যাও আর বলো, “আমি জানি তুমি দুঃখে আছো, কিন্তু আমারও একই অবস্থা। যদিও আমার শরীর তোমার থিকা দূরে, আমার আত্মা কাছে আছে তোমার। শোনো, যেই তুমি আমারে ভালোবাসো, আমি তো তোমার থিকা একটা মোমেন্টের লাইগাও দূরে নাই। শয়তানের চোখ আসলেই বাজেভাবে কষ্ট দিছে, যে সুন্দর, তারে।”‘ উনি তার খাদেমরে আরো কইলেন: ‘এখনই যাও, আগুনের মতোন যাও, বন্যার পানির মতোন যাও, বাজ-পড়ার আগে আলোর মতোন যাও!’

খাদেম বাতাসের মতোন বাইর হয়া গেলো আর আয়াজের কাছে পৌঁছাইল। কিন্তু সে দেখল সুলতান অলরেডি সেইখানে আছেন, তার দাসের কাছে বইসা আছেন। কাঁপতে কাঁপতে সে নিজে নিজে কইলো: ‘কি দুর্ভাগ্য আমার, রাজার কাজটা করতে পারলাম না; কোন সন্দেহ নাই আজকে আমারে খুন কইরা ফেলবে।’ তখন সে রাজারে কইলো: ‘আমি আপনার কাছে কসম কাইটা বলতেছি, আমি একটা মোমেন্টও বইসা থাকি নাই, দাঁড়াই নাই; কেমনে তাইলে রাজা আমার আগে এইখানে চইলা আসলেন? রাজা কি আমারে বিশ্বাস করেন? যদি কোনভাবে গাফিলতি কইরা থাকি আমার ভুল আমি স্বীকার করতেছি।’

‘তোমার দোষ নাই, মিয়া,’ মাহমুদ কইলেন,’তুমি কেমনে আমার মতোন ট্রাভেল করতে পারবা? আমি তো আসছি একটা গোপন পথে। যখন আমি আয়াজের খবর নেয়ার লাইগা বলতেছিলাম আমার আত্মা তো তখনই চইলা আসছে তার কাছে।’

রাবেয়ার গল্প

রাবেয়া, যদিও একজন নারী, ছিলেন পুরুষদের মাথার মুকুট। একবার উনি কাবায় হজ্জ্ব করতে যাওয়ার লাইগা আট বছর সময় পার করলেন, মাটিতে উনার দৈর্ঘ্য মাপতে মাপতে উনি গেছিলেন। শেষমেশ যখন উনি পবিত্র ঘরের দরোজায় পৌঁছাইলেন, উনি ভাবলেন: ‘এখন, শেষমেশ, আমি আমার কাজটা করতে পারলাম।’ হজ্জ্বের দিন, যখন উনি কাবা’তে যাইতে নিছেন, উনার নারীত্ব উনারে ছাইড়া গেলো। তখন রাবেয়া উনার আগের পায়ের ছাপগুলা খোঁজ কইরা দেখলেন আর কইলেন: ‘হে খোদা, গৌরবের মালিক, আট বছর ধইরা আমি রাস্তাটারে আমার শরীর দিয়া মাইপা আসছি, আর এখন, যখন প্রতীক্ষার-দিনটা আসলো আমার দোয়ার জবাব দেয়ার, তুমি আমার পথে কাঁটা বিছায়া দিলা!’

এই ঘটনার মর্ম বুঝতে হইলে রাবেয়ার মতোন একজন খোদা-ভক্তরে খুঁইজা বাইর করাটা জরুরি। যতোক্ষণ তুমি এই দুনিয়ার গভীর সাগরে ভাসতে থাকবা, এর ঢেউগুলা তোমারে প্রতিটা ধাক্কায় তোমারে নিয়া আসবে আর দূরে সরায়া দিবে। কোন সময় তুমি কাবার ভিতরে ঢুকতে পারবা, আবার কোন সময় একটা প্যাগোডার ভিতরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়বা। যদি তুমি এই দুনিয়ার অ্যাটাচমেন্টগুলা ছাড়াইতে পারো তুমি শান্তি পাবা; কিন্তু যদি তুমি অ্যাটাচড থাকো তোমার মাথা একটা কারখানার জাঁতাকল হয়া থাকবো। একটা মোমেন্টের লাইগাও তুমি সুস্থির হইতে পারবা না; একটা মাছির উইড়া যাওয়াও তোমারে তছনছ কইরা ফেলবে তখন।

শিবলীর কাহিনি

একবার শিবলী বাগদাদ থিকা লাপাত্তা হয়া গেলেন, কেউ জানে না কই গেছেন উনি। শেষে এক হিজড়াদের ঘরে তারে পাওয়া গেলো, ভিজা চোখ আর শুকনা ঠোঁট নিয়া বইসা আছেন উনি অদ্ভুত প্রাণীগুলার লগে। উনার ফ্রেন্ড কইলো: ‘এইটা তো এমন কোন জায়গা না যেইখানে তোমার মতোন পবিত্র রহস্যময়তার একজন স্টুডেন্ট বইসা থাকতে পারে।‘ উনি উত্তর দিলেন: “এই মানুষগুলা, ধর্মমতে, বেটামানুষও না, বেটিমানুষও না। আমি অদের মতোই। আমি জড়তার ভিতর ডুইবা গেছি, আর আমার পুরুষত্ব হইতেছে একটা কলঙ্ক। যদি তুমি প্রশংসা-করা আর দোষ-দেয়া’রে ইউজ করো বিভেদ তৈরি করার লাইগা, তুমি তো আইডলগুলা বানাইতেছো। যখন তুমি একশোটা আইডল তোমার জোব্বার ভিতর লুকায়া রাখো, কেন তুমি মাইনষের সামনে সুফি হিসাবে নিজেরে দেখাও?“

সক্রেতিস তার সাগরেদেরকে কইলেন

যখন সক্রেতিসের মরার সময় হইছে, তখন তার এক সাগরেদ তারে কইলো: ‘ওস্তাদ, যখন আমরা আপনারে গোসল করাইবো আর কাফন পিন্দাইবো, আপনারে তখন আমরা কই কবর দিবো?’ সক্রেতিস কইলেন: ‘যদি তুমি আমারে খুঁইজা পাও, প্রিয় সাগরেদ, তোমার যেইখানে ইচ্ছা আমারে কবর দিও, আর গুড নাইট! এই এতোদিনের লম্বা জীবনে আমি নিজেরে খুঁইজা পাই নাই, তুমি কেমনে আমারে মরার পরে খুঁইজা পাবা? এখন পর্যন্ত আমি এইরকমভাবে বাঁইচা ছিলাম যাতে আমি খালি জানি যে, ‘আমার’ বইলা যে জ্ঞান, তার একটা চুলও স্পষ্ট না।’

সূর্যের খোঁজে থাকা বাদুড়টা

এক রাতে এক বাদুড়রে বলতে শোনা গেল: ‘এইটা কেমন যে একটা মোমেন্টের লাইগাও আমি সূর্যরে দেখতে পামু না? সারাজীবন ধইরা আমি নিরাশ ছিলাম, কারণ একবারের লাইগাও আমি তার লগে মিশতে পারুম না। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর আমি চোখ বন্ধ কইরা এইখানে সেইখানে উড়ছি, আর আজকে এইখানে আসছি আমি!’ একজন চিন্তাশীল কইলো: ‘অহংকার তোমারে জড়ায়া ধইরা রাখছে, আর আরো হাজার বছর তোমারে ঘুরা লাগবো। তোমার মতোন একজন কেমনে সূর্যরে খুঁইজা পাইবো? একটা পিঁপড়া কি চান্দে পৌঁছাইতে পারে?’ ‘তারপরেও,’ বাদুড়টা কইলো, ‘আমি ট্রাই করতেই থাকবো।’ আর এইরকম কইরা আরো কয়েক বছর পার হইলো, বাদুড়টা খোঁজ করতেই লাগলো ততোক্ষণ পর্যন্ত যখন তার আর না ছিল শক্তি, না ছিল ডানা। যেহেতু শে তখনো সূর্যরে খুঁইজা পাইলো না, শে কইলো: ‘হয়তো আমি সূর্যরে পার হয়া চইলা আসছি।’ একটা জ্ঞানী পাখি এইটা শুইনা কইলো: ‘তুমি একটা স্বপ্নের ভিতরে আছো; তুমি গোল হয়া ঘুরতেছিলা, আর এক কদমও আগাও নাই; আর তোমার গরিমার কারণে তুমি কইতেছো যে তুমি সূর্যরে পার হয়া চইলা গেছো!’ এইটা শুইনা বাদুড়টা খুবই চোট পাইলো, তাঁর না-পারাটারে শে বুঝতে পারলো, নিজের কাছে শে নত হইলো, কইলো: ‘তুমি একটা পাখিরে পাইছো যার আছে ভেতরে দেখার শক্তি, আর কোথাও যাইও না তুমি।’

আরেকজন বেকুব

সুফি, আল্লার রাস্তার এক পাগল’রে বাচ্চা-পোলাপানেরা পাথর ছুঁইড়া যন্ত্রণা দিতেছিল। শেষে সে এক বিল্ডিংয়ের কোণায় গিয়া আশ্রয় নিলো। কিন্তু অই সময় শিলাবৃষ্টি শুরু হইলো আর খোলা আকাশ থিকা শিল পড়তে শুরু করলো তার মাথার উপ্রে। যেহেতু বাড়িটা অন্ধকার ছিল, সে ভাবছিল পোলাপাইনগুলাই ঢিল ছুঁড়তেছে, এই কারণে মানুষটা শিলগুলারে নুড়ি ভাইবা হাতে নিলো আর জিহ্বা বাইর কইরা পোলাপাইনরে ভ্যাঙ্গাইতে লাগলো। সাথে সাথেই সে বুঝতে পারলো যে, নুড়িগুলা আসলে শিল, আর সে সরি হইলো আর দোয়া করলো: ‘হে আল্লা, যেহেতু ঘরটা আন্ধার ছিল আমি আমার জিভ দিয়া গুনাহ কইরা ফেলছি।’ যদি আপনি বুঝতে পারেন তাদের ইরাদাগুলা যারা আন্ধারে আছে, সন্দেহ নাই, আপনি পারবেন, মাফ কইরা দিতে অদেরকে।

দরবেশ, যার সুন্দর দাড়ি ছিলো

মুসার আমলে এক দরবেশ আছিলো যে সারা দিন রাইত নামাজ-কালামের ভিতরে থাকতো, তারপরও রহমতের জিনিসের লাইগা কোন ফিলিংসের জায়গা সে পাইতো না। তার অনেক সুন্দর দাড়ি আছিলো, আর মাঝে-মধ্যেই নামাজ-কালাম পড়ার সময় সে থাইমা যাইতো আর আঁচড়ানো শুরু করতো। একদিন, মুসারে দেইখা, সে তার কাছে গেলো আর কইলো: “ও সিনাই পাহাড়ের বাদশা, আল্লারে জিগাইও, তোমার দোহাই লাগে, আমারে কইও কেন আমি না পাই রহমতের শান্তি আর না পাই কোন সমাধি।”

পরেরবার মুসা যখন সিনাই পাহাড়ে গেল, উনি আল্লার লগে দরবেশরে নিয়া কথা কইলেন আর আল্লা অখুশি’র একটা টোনে কইলেন: ‘যদিও এই দরবেশ আমার সাথে মিলতে চায়, কিন্তু সে তো সবসময় তার লম্বা দাড়ির কথা ভাবে।’ মুসা যখন নাইমা আসলেন তখন সুফিরে এই কথা কইলেন, আল্লা যা বলছিলেন। এই কথা শুইনা সে তার দাড়ি ছিঁড়তে শুরু করলো, ফোঁপাইয়া ফোঁপাইয়া কানতে লাগল। জিবরাইল তখন মুসার কাছে আসলো আর কইলো: ‘এখনো তো তোমার সুফি তার দাড়ির কথাই ভাবতেছে। যখন নামাজ-কালাম পড়ে সে তো এইটা ছাড়া আর কিছুই ভাবে না, আর যদিও সে ছিঁইড়া ফেলছে, সে তো আরো বেশি এটাচড এইটার দিকে।”

শোনো, যে তুমি ভাবতেছো যে তোমার দাড়ি নিয়া তুমি আর প্রি-অকুপাইড নাই, তুমি দুঃখের সাগরে ডুইবা আছো। যখন তুমি ডিটাচড হইতে পারবা তখন তুমি সাগরটা পার হইবার একটা অধিকার পাবা। কিন্তু যদি তুমি তোমার দাড়ির মধ্যে ডুইবা থাকো, তোমার বাইর হইতে অসুবিধা হইবো।

ইউসুফ আর জুলেখা

যখন জুলেখা খুব ক্ষমতা আর সম্মানের উঁচা জায়গাতে ছিল, শে ইউসুফরে জেলে পাঠাইছিল, আর তাঁর এক দাসরে কইলো পঞ্চাশটা বেতের বাড়ি মারার লাইগা। ‘জোরে জোরে মারবা,’ শে কইলো, ‘যাতে আমি তার কান্দা শুনতে পাই।’ কিন্তু এই ভালো মানুষটা ইউসুফরে মারতে চায় নাই, তো সে একটা জন্তুর চামড়া নিলো, আর কইলো: ‘যখন আমি বাড়ি দিবো, তুমি চিল্লায়া উঠবা।’ জুলেখা যখন চিল্লানি শুনলো শে জেলখানায় ঢুকলো আর কইলো: ‘তুমি তো অরে আস্তে মারতেছো, জোরে মারো।’ তখন দাসটা ইউসুফরে কইলো, ‘ও সূর্যের তেজ! যদি জুলেখা তোমারে পরীক্ষা করে আর দেখে কোন দাগ নাই, শে আমারে ভয়ানক শাস্তি দিবো। এখন, তোমার জামাটা খোলো আর মনটারে শক্ত করো আর বাড়িগুলা সহ্য করো। যদি তুমি বাড়ি খায়া চিল্লাও শে তোমার দাগগুলা এতোটা খেয়াল করবো না।’ ইউসুফ তার জামাটা খুললো, বেতটা পড়লো, আর কান্দার আওয়াজ বেহেশত তক পৌঁছাইলো। যখন জুলেখা এইটা শুনলো শে চইলা গেলো আর কইলো: ‘এইটা ঠিকাছে, এই কান্দাগুলা তাদের এফেক্টটা বানাইতে পারছে। এর আগে, অর গোঙানিগুলা কিছুই ছিল না; এখন, এইগুলা খুবই রিয়েল।’

মজনু’র কাহিনি

এক আল্লা-ভক্ত লোক দেখলো মজনু রাস্তার মাটি টালতেছে আর কইলো: ‘মজনু, তুমি কি খুঁজতেছো?’ ‘আমি লায়লারে খুঁজতেছি’ সে কইলো। লোকটা জিগাইলো : ‘তুমি ভাবতেছো এইখানে তুমি লায়লারে খুঁইজা পাবা?’ ‘আমি সব জায়গাতেই তারে খুঁজি,’ মজনু কইলো, ‘এই আশাতে যে কোথাও না কোথাও তারে তো পাবো আমি।’

ইউসুফ হামদানি

ইউসুফ সামদানি উনার টাইমে একজন নামজাদা মানুষ ছিলেন, একজন দ্রষ্টা, যিনি দুনিয়াগুলার সিক্রেটস জানতেন। উনি বলছেন: ‘এই সবকিছু, যা দেখা যায়, সবচে উঁচাতে বা গভীরে – প্রতিটা কণাই আসলে আরেকজন ইয়াকুব যে ইউসুফের খবর চাইতেছে, যারে সে হারায়া ফেলছে।’

স্পিরিচুয়াল রাস্তায় ইশক আর হোপ দুইটাই দরকারি। যদি তোমার এই দুইটা না থাকে তাইলে তালাশ করাটা ছাইড়া দেয়া উচিত। মানুষের ছবর করার ট্রাই করা উচিত। কিন্তু একজন দিওয়ানা কি ছবর করতে পারে? ছবর করো আর আশার সাথে লাইগা থাকো যে তুমি কাউরে পাবা, যে তোমারে পথ দেখাইবো। নিজেরে নিজের ভিতরে রাখো আর দেইখো, বাইরের দুনিয়া যাতে তোমারে ক্যাপচার কইরা না ফেলে।

রাবেয়ার একটা কথা

একজন মানুষ দোয়া করতেছিল: ‘ও খোদা, একটা দরজা খুইলা দাও যাতে আমি তোমার কাছে আসতে পারি।’ রাবেয়া, তার কথা শুইনা, কইলেন: ‘ আরে বেকুব! দরজাটা কি বন্ধ নাকি?’

এক সাগরেদরে বলা এক ওস্তাদের কথা

এক সাগরেদ তার ওস্তাদের কাছে পুরান একটা কোশ্চেনের জবাব দাবি করলো। ওস্তাদ কইলো : ‘আগে তোমার মুখ ধুইয়া আসো। মুখোশের সুগন্ধির স্মেল কি পচানির দুর্গন্ধ থিকা পাওয়া সম্ভব ? আমি মাতাল লোকদের কাছে জ্ঞান বিলাই না।

প্রিন্সেস, যে তাঁর দাসের প্রেমে পড়ছিল

এক দেশে ছিল এক রাজা, যার রাজত্ব যতদূর পর্যন্ত দেখা যায় তার চাইতে বেশিদূর পর্যন্ত ছড়ানো ছিল, তার ছিল এক মেয়ে, যে ছিল চান্দের মতোন সুন্দর। তাঁর সৌন্দর্য্যের সামনে পরীরাও শরম পাইতো। তাঁর টোল পড়া গাল ইউসুফের কুয়ার কথা মনে করাইতো, আর তাঁর চুলের গোছা শয়ে শয়ে দিল’রে জখম কইরা ফেলতো। তাঁর ভ্রুগুলা ছিল জোড়া তীর, আর যখনশে তাঁর তীরগুলা ছাইড়া দিতো তারা তাঁর মহিমা কীর্তন করতো। তাঁর চোখগুলা, নার্সিসাসের মতোন ঢিলেঢালা, জ্ঞানীদের পথের দিকে তার চোখের কাঁটাগুলা ছুঁইড়া দিত। তাঁর মুখ ছিল সূর্যের মতোন যখন এইটা চান্দের ভার্জিনিটি কাইড়া নিছিলো। ফেরেশতা জিবরাইল তার চোখের পানি ধইরা রাখতে পারতো না তার মুখের মনি মুক্তা দেইখা। তাঁর ঠোঁটের একটা হাসি যে দেখতো তার সব পানি শুইষা নিতো, তারপরও সে অই ঠোঁটগুলার কাছেই খয়রাতি ভিক্ষা চাইতো। যে তাঁর থুতনির দিকে তাকাইতো তার মনে হইতো যেন তার মাথা বুদবুদ উঠা পানির বসন্তে ডুইবা আছে।

রাজার একটা দাসও ছিল, যে যুবক, এতোটাই হ্যান্ডসাম যার সামনে সুরুজ ফ্যাকাশে হয়া যাইতো আর চান্দের আলো কইমা যাইতো। যখন সে রাস্তা দিয়া হাঁইটা যাইতো আর বাজারে যাইতো মানুষ-জন থাইমা যাইতো তারে দেখার লাইগা।

একদিন হঠাৎ প্রিন্সেস এই দাসরে দেখলো, আর মুহূর্তের ভিতরে তাঁর হৃদয় তাঁর হাত থিকা ফসকায়া গেল। যুক্তি তারে ছাইড়া গেল আর প্রেম তাঁর দখল নিয়া নিল। তাঁর আত্মা, যা ছিল শিরিনের  মতোন মিষ্টি, তিতা হয়া গেল। সখীদের থিকা আলাদা হয়া শে আনমনা হয়া গেলো, আর আনমনা আর উদাস থাকতে থাকতে নিজে নিজে পুড়তে থাকলো শে। তখন শে তার দশজন সখীরে ডাকলো। অরা ছিল খুবই ভালো মিউজিশিয়ান আর থাইমা থাইমা পাইপগুলা দিয়া বাজাইতো; পাপিয়ার মতোন ছিল অদের গলার আওয়াজ, আর অদের গান, আত্মারে ভেদ কইরা যাইতো, দাউদের শোনার যোগ্য ছিল।  অদেরকে একসাথে কইরা শে তাঁর মনের অবস্থা কইলো, কইলো যে শে তাঁর মান, সম্মান, আর তাঁর জীবন এই যুবকের লাইগা কোরবান কইরা দিতে রাজি; যখন কেউ গভীর প্রেমে পড়ছে অই মানুষটা আর কোনকিছু করারই যোগ্য না। ‘কিন্তু,’ শে কইলো, ‘যদি আমি তারে আমার প্রেমের কথা কই, সন্দেহ নাই সে তো বেপরোয়া একটা কিছু কইরা বসবো। যদি এইটা ফাঁস হয়া যায় যে আমি এক দাসের লগে মিলিত হইছি তাইলে সে আর আমি দুইজনেই সাফার করবো। আর সে যদি আমার দখল না নেয়, আমি এই হারেমের পর্দার পিছনে কানতে কানতে মইরা যাবো। সবর করা নিয়া একশটা বই আমি পড়ছি আর আমি এখন এইটা ছাড়া আছি। কি করতাম আমি! আমারে একটা পথ খুঁইজা বাইর করতে হবে এই পাতলা সাইপ্রাসের প্রেমটা এনজয় করার, যাতে আমার শরীরের বাসনা আমার আত্মার বেহনচেনির সাথে মিলতে পারে  – আর এইটা এমনভাবে করা লাগবে যেন সে জানতে না পারে।‘

তখন মধুর-কণ্ঠী সখীরা কইলো: ‘মন খারাপ কইরো না। কেউ যাতে জানতে না পারে এইভাবে তারে এইভাবে তারে আজকে রাতে নিয়া আসবো আমরা, এমনকি সেও জানবো না কিছু।‘ এরপরেই ইয়াং মাইয়াদের একজন গোপনে দাসটার কাছে গেল আর যেন তার লগে দুষ্টামি করতেছে এমনভাবে কইলো, দুই গ্লাস মদ নিয়া আসার লাইগা। একটার ভিতরে শে একটা ড্রাগ মিশায়া দিল, ফন্দি কইরা তারে মদটা খাওয়াইয়া দিল। সাথে সাথে সে ঘুমায়া গেল, যাতে কইরা শে তাঁর প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করতে পারে, আর রূপালি বুকের যুবকের দুই দুনিয়ার কোন খবরই থাকলো না।

যখন রাত হইলো প্রিন্সেসের সখীরা আস্তে কইরা সেই জায়গায় গেল যেইখানে সে শুইয়া ছিল আর তারে একটা ডুলিতে কইরা প্রিন্সেসের কাছে নিয়া আসলো। তারপর অরা তারে একটা সোনার গদিতে বসাইলো আর তার মাথায় একটা মুক্তার মুকুট পরায়া দিল। মাঝ রাতে, তখনো কিছুটা ঘোরের মধ্যে থিকাই, সে তার চোখ খুললো আর দেখলো বেহেশতের মতোন একটা রাজপ্রাসাদ, আর তার চারপাশে সোনার সব গদি।  জায়গাটা দশটা বিশাল মোমবাতি দিয়া আলোকিত হয়া ছিল, যার থিকা অ্যাম্বারের গন্ধ বাইর হইতেছিল, আর বাটিগুলাতে চন্দনকাঠ পুড়তেছিল। সখীরা গান গাইতে শুরু করলো, কিন্তু এইরকম মধুর টানগুলাতে যুক্তি আত্মারে ছাইড়া যায়, আর আত্মা তার শরীররে।  তারপর মদের সূর্য মোমবাতিগুলার অালোর চারপাশে ঘুরতে থাকে। তার চারপাশের এই আনন্দ আর প্রিন্সেসের সৌন্দর্য্য দেইখা সে হতবিহ্বল হয়া গেল, যুবক তার হুঁশ হারায়া ফেলল। সে আসলে ছিল না ছিল এই দুনিয়ায়, না ছিল অন্য দুনিয়ায়। একটা হৃদয় যা প্রেমে মগ্ন, একটা শরীর যা কামনায় থরথর, এইসব আনন্দের ভিতরে সে একটা একসটাসি’র জায়গায় চইলা গেছিল। তার চোখ প্রিন্সেসের সৌন্দর্য্যে আর তার কান রিডের পাইপগুলার আওয়াজে বান্ধা পইড়া গেছিল। অ্যাম্বারের গন্ধে তার নক ভইরা উঠতেছিল আর তার মুখের ভিতর মদটা হয়া উঠতেছিল তরল আগুনের মতো। প্রিন্সেস তারে চুমা খাইলো, আর তার চোখ থিকা আনন্দের পানি বাইর হয়া পড়লো, প্রিন্সেসের চোখের পানিও তার চোখের পানির সাথে মিইশা গেল। অনেক সময় শে তার মুখে চুমা খাইলো, অনেক সময় তারা ছিল নোনতা রকমের; অনেক সময় শে তাঁর চুল এলায়া দিতেছিল, অনেক শে তাঁর নিজেরে তার চোখে হারায়া ফেলতেছিল। সে তাঁরে দখল কইরা নিল; আর এইভাবে তারা সময়টা পার করলো যতক্ষণ না পুবদিকে ভোর আইসা হাজির হইল। যখন সকালের পশ্চিমা বাতাস বইলো যুবক দাস বিষন্ন হয়া গেল; কিন্তু অরা তারে আবার ঘুম পাড়ায়া দিল আর তারে তার জায়গায় ফেরত নিয়া গেল।

যখন রূপালি বুকের সে নিজেরে দেখল, কোনকিছু না বুইঝাই, সে কান্দা শুরু করল। কেউ কইতেই পারে ব্যাপারটা তো শেষ হয়া গেছে, এখন অার কাইন্দা কি হবে। সে তার কাপড় ফাঁড়তে লাগল, চুল ছিঁড়তে লাগল আর মাথা মাটিতে ঠুকরাইতে লাগল।  তার লগে যারা ছিল তারা জিগাইল সে এমন ক্যান করতেছে, আর তার কি হইছে। সে কইলো:’আমি যা দেখছি তা তো বলা সম্ভব না, একটা স্বপ্ন ছাড়া আর কারো পক্ষে এইটা দেখা সম্ভব না, আমার সাথে যা হইছে, অন্য কারো সাথেই আগে এইরকম কিছু কখনোই ঘটে নাই। এর চাইতে অদ্ভুত রহস্য আর কিছুই ছিল না।‘

আরেকজন কইলো: ‘জাইগা উঠ, আর যেই একশটা ঘটনা ঘটছে তার থিকা অন্তঃত একটা আমাদেরকে কও।‘ সে জবাব দিল: ‘আমি তো একটা গোলমালের ভিতর ছিলাম কারণ যা আমি যা দেখছি সেইটা আরেকটা শরীরে ঘটছে। কোন কিছু না শুইনা আমি সবকিছু শুনছি, কোন কিছু না দেইখা আমি সবকিছু দেখছি।‘

আরেকজন কইলো: ‘তুমি কি তোমার আক্কেল হারায়া ফেলছো নাকি তুমি স্বপ্ন দেখতেছো?’ ‘আহা,’ সে কইলো, ‘আমি জানি না আমি মাতাল আছি নাকি সোবার। এর চাইতে আর বেশি ধাঁধাঁর আর কি হইতে পারে যেইটা খোলাসাও না, গোপনও না। যা আমি দেখছি সেইটা কখনোই ভুলতে পারবো না, যদিও আমি জানি না কোথায় ঘটছে এইটা।  পুরা একটা রাত ধইরা একটা সৌন্দর্য্য আমি দেখছি যার কোন তুলনা হয় না। শে কি আর কে তার কিছুই আমি জানি না। শুধুমাত্র ভালোবাসাটাই আছে, আর এইটাই সব। খালি আল্লা জানেন সত্যিটা।‘

হারানো চাবি

একজন সুফি শুনলেন যে একজন মানুষ চিল্লায়া কানতেছে: ‘কেউ কি একটা চাবি পাইছেন? আমার দরজাটা লকড আর আমি রাস্তার ধূলায় দাঁড়ায়া আছি। আমার দরজা যদি বন্ধ থাকে আমি কি করবো?’

সুফি তারে কইলো: ‘তুমি চিন্তা করতেছো কেন? এইটা যেহেতু তোমার দরজা, এইটা বন্ধ থাকলেও, এইটার কাছে থাকো। যদি তুমি ধৈর্য্য ধইরা থাকতে পারো, সন্দেহ নাই কেউ তোমার লাইগা দরজাটা খুইলা দিবো। তোমার অবস্থা তো আমার চে বেটার, আমার তো দরজাও নাই, চাবিও নাই। খোদা চাইলে আমি যাতে একটা দরজা খুঁইজা পাই, খোলা হোক আর বন্ধই হোক।’

মানুষ তো থাকে কল্পনার ভিতরে, একটা স্বপ্নে; জিনিসগুলা যেইরকম, কেউ তো অইরকমভাবে দেখতে পায় না। যে তোমারে জিগায়: ‘কি করবো আমি?’ তারে বলো: ‘সবসময় যা করছো, তা কইরো না; সবসময় যেইভাবে চলছো, অইভাবে চইলো না।’

যে বিহ্বলতার জমিনে পৌঁছাইছে একশোটা দুনিয়ার সমান দুঃখ নিয়া সে আছে। আমি তো বিমূঢ় হয়া আছি আর আউলায়া গেছি। কই যাবো আমি! খোদা জানে! কিন্তু, মনে রাইখো, মানুষের কান্দন রহমত নামায়া নিয়া আসতে পারে।