ক্যামেলিয়া রওনাকের গল্প ‘যে তরীতে তুমি নেই’

প্রকাশিত : আগস্ট ২৯, ২০২৪

পুরো শহরটা ঘুমিয়ে গেছে। বাতাসে পাতার খসখসে শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। আকাশে নিভু নিভু তারাগুলো রাত প্রহরী হয়ে শহরটাকে পাহারা দিচ্ছে। রাতের এই নিকষ আঁধারে এক ধরনের মাদকতা আছে। চুম্বকের মতো কাছে টানে। কখন যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে যায়, বুঝতে পারি না। সামনে একটা জোনাক উড়তে উড়তে এলো। কোথা থেকে যেন আরেকটা জোনাক এসে এই জোনাকটাকে ধাক্কা দিলো। ধাক্কা খেয়ে জোনাকটা অন্য দিকে চলে যাচ্ছে। এই জোনাকটাও উড়ে চলে যাচ্ছে সাথে। আচ্ছা, জোনাকটা কি রাগ ভাঙাচ্ছে একজন আরেকজনের? জোনাক বর রাগ করেছে। জোনাকি বউ ধাক্কা দিয়ে রাগ ভাঙাচ্ছে। রাগ শেষে দুজন একসাথে উড়ে যায় নিঃশব্দ নগরীর বুকে।

রাত প্রায় মধ্যপ্রহর। আমার কোনো তাড়া নেই। হয়তো এজন্য ঘুম আসছে না। তাড়া নেই দেখে আমার ঘুম আসছে না, নাকি আমার স্বপ্ন নেই দেখে ঘুম আসে না? যে স্বপ্ন দেখার জন্য বিভোর হয়ে ঘুমাবো, সেই স্বপ্নই আমার নেই।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠলাম অনেক শব্দে। আমার রুমে কাজিনরা এসেছে। সকাল বেলা সবাই কারণ ছাড়া আসার কথা নয়। তারপর তৃধা আর নিহি আঁতেল। দুনিয়াতে বান্দা দুজনকে পাঠানো হয়েছে মনে হয় শুধু পড়ার জন্য। তৃধা মামার মেয়ে আর নিহি খালার মেয়ে । কী এমন কারণ হলো যার জন্য আঁতেল রানিরা আঁতেল রাজ্য ছেড়ে সকাল সকাল এই বাসায়!

এই টুপ ওঠ। ঘুমিয়ে তো চেহারাখানা কুমড়া বানিয়ে ফেলবি। কথাগুলো বলে এক প্রকার সুরসুরি দিতে লাগলো তৃধা।
বরপক্ষ এসে দেখবে কনে ঘুমাচ্ছে। হবু বউ নাইট ড্রেস পরে আছে। হাসতে হাসতে বললো নিহি।
তা মন্দ বলিস নি রে নিহি। নাইট ড্রেসে কিন্তু আকর্ষণীয় লাগছে টুপকে। হবু দুলাভাই এ অবস্থায় দেখলে কবুল এখানেই  বলে দিবে সাথে সাথে।

মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে ওদের কথাগুলো। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। কিসের দুলাভাই, কার দুলাভাই!

আচ্ছা তোদের হয়েছেটা কি? সাতসকালে মতলব ছাড়া আসিসনি, সেটা বুঝেছি। কিন্তু কারণটা কি? কোন দুলাভাই নাইট ড্রেসে আমাকে দেখবে?
তোর দুলাভাই না, তোর হবু বর। আমাদের দুলাভাই। কানের কাছে এক প্রকার চেঁচিয়ে কথাগুলো বলল তৃধা। ওদের কথা শুনে আমার হেঁচকি ওঠার পালা। আমার বিয়ে, আর আমিই জানি না!

কি রে, তবধা খেয়ে গেলি নাকি বিয়ের কথা শুনে? খোঁচা দিয়ে বলল নিহি।
গতকাল রাতে সবাই এইটা নিয়ে কথা বলছিল। ব্যাপারটা হুট করেই হয়ে যায়। ছেলের মা তোকে দেখেই পছন্দ করছে। কই দেখছে জানি না। তারা আজকে তোকে দেখতে আসবে। ছেলে সম্বন্ধে শুধু এতটুকু জানি, সে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। নাম হলো...

তোর লেকচার থামা।
ঝাড়ি খেয়ে তৃধা চুপ করে গেল। কথাটা শেষ করতে পারল না। কিছুদিন পর অনার্স ফাইনাল আমার। এভাবে হুট করে এমন কিছু মাথায় ঢুকছে না। বাবা-মার ওপর কখনো কোনো কিছু বলিনি। কিন্তু এখন কি বলবো বুঝতে পারছি না।

এত ভাবছিস কেন? তোর ভালো না লাগলে জানিয়ে দিস। খালু, খালা তোকে কিছুই বলবে না। কাঁধে হাত রেখে পাশে বসে কথাটা বলল নিহি।

কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারিনি বাবাকে। বাবার উচ্ছ্বাস দেখে কিছুই আর বলতে পারলাম না। চুপ করে দেখে যাচ্ছি সব। একটু পর ফুপু বাসায় এলো। আমার এক ফুপু, কোনো চাচা নেই। কাছে এসে গালটা টেনে দিল ফুপু। কি গো মেয়ে, আজকে যে তোকে দেখতে আসবে। সেই পিচ্চি মা তুই আর নেই। বড় হয়ে গেছিস। হি হি হি।

ফুপুকে আমি খুব পছন্দ করি। এত বড় হয়েছি তারপরেও ছোটবেলার মতো এখন আমার গালটা টেনে দেয় দেখা হলেই। কথায় কথায় হাসে। আমার ফুপু খুব সরল। সরল বলেই হয়তো তার জীবনটা এত জটিল। ফুপা ফুপুকে ছেড়ে দিয়েছেন অনেক আগেই। ফুপু এক ছেলেকে নিয়ে দাদার রেখে যাওয়া বাড়িতে থাকেন। সহজ সরল মানুষদের জীবন এত জটিল কেন?

আছরের আজানের পর মা আমার রুমে এসে কাঁচা হলুদ রংয়ের একটা শাড়ি দিয়ে গেল। শাড়ির ভাঁজ এখনো খোলা হয়নি। আজকেই কেনা হয়েছে। নতুন শাড়ি। মা সারাদিন ব্যস্ত ছিল। তাহলে শাড়িটা কিনল কে? তৃধা,নিহি জোর করেও কোনো প্রসাধনী দেয়াতে পারেনি।

টুপ, আজকের দিনেও তোর বুড়ি ঢংয়ে না থাকলে চলে না? রেগে কথাগুলো বলল নিহি।
নতুন শাড়ি পরেছি। শাড়ির সাথে ম্যাচ করে নতুন হলুদ চুড়ি পরেছি। চুলে খোপা করেছি। মাথায় সুন্দর করে ঘোমটা দিয়েছি। এই বেশি করে ফেলেছি। কথাগুলো শুনে তৃধা ড্যাবড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
হলুদ শাড়ির ঘোমটায় তোকে বউ বউ লাগছে রে টুপ। নিহির কথা শুনে লজ্জা পেলাম।

সন্ধ্যার একটু পর ঘর ভর্তি করে মানুষজন এলো। তৃধা, নিহি আমাকে একা রেখে সেদিকে গেল। অনেকক্ষণ ধরে একা বসে আছি। আমার ঘরের চার্জারের প্লাগটা সকাল থেকে কাজ করছে না। মোবাইলের চার্জও প্রায় শেষের দিকে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরোতে গিয়ে খেলাম মাথায় জোরে ধাক্কা! ধাক্কা খেয়ে মাথা ধরে বসে পড়লাম। ঝিমঝিম লাগছিল মাথা। সামনে তাকিয়ে দেখি, একটা ছেলে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে মাথা ডলছে নিজের!
আপনি কে? এভাবে না বলে আমার ঘরে ঢুকেছেন কেন?
ঘরে ঢুকেছি বলে মাথায় ধাক্কা মেরে এভাবে শোধ নেবেন!
মাথায় ধাক্কা দিয়েছি মানে! আপনিই তো আমার রুমে ঢুকে আমার মাথায় ধাক্কা দিয়েছেন।
এই যে মিস, আমার এত ঠেকা পড়েনি যে আপনার ঘরে ঢুকে আপনার মাথায় মাথা দিয়ে ধাক্কা দিব। আমি ওয়াশরুমের জন্য এখানে এসেছিলাম।
আমার রুম পাবলিক টয়লেট আপনাকে কে বলল?

চিৎকার শুনে ঘরের লোকজন সব আমার রুমে চলে এলো। দুজনকে মাথায় হাত দিয়ে রেগে কথা বলতে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
ঝগড়া করছিস কেন? বাবা জিজ্ঞেস করল।
দেখো না বাবা। এই লোক আমার রুমকে পাবলিক টয়লেট ভেবে এসেছে।
পাবলিক টয়লেট! বাবা অবাক হয়ে গেলেন।
আমি মোটেই পাবলিক টয়লেট বলিনি। আপনি পাবলিক টয়লেট বলেছেন। আমি শুধু শার্টটা ওয়াশ করতে এসেছি। শার্টে পিচ্চি শরবত ফেলে দিয়েছে।
ওয়াশরুম এই বাসায় আরো দুইটা আছে এবং সেগুলো সামনে।  সামনের গুলো রেখে ভেতরে এসেছেন আমার রুমে!
আসলে ওনার কোনো দোষ নেই। আমরাই এদিকে দেখিয়ে দেই। পেছন থেকে কাঁচুমাচু মুখ করে কথাগুলো বলল নিহি।

এতক্ষণে বুঝলাম নিহির কল্যাণে ছেলেটি আমার রুমকে পাবলিক টয়লেট ভেবে বসেছেন! কিছুক্ষণ পর সেই পাবলিক টয়লেট ভাবা ছেলেটির সাথে আংটি বদল হলো। আমার বাম হাতের অনামিকা আঙুলে সে যখন আংটি পরাচ্ছিল আড়চোখে তার দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম। কেমন যেন রাগে ফোস ফোঁস ফোঁস করছেন। ভাবখানা এমন যে হাত নয়, গোবর ধরেছেন।

সাতদিন পর বিয়ের তারিখ ঠিক হলো। কেনাকাটা আয়োজনে সবাই ব্যস্ত। আমার সাথে কথা বলার সময়টুকু কারো নেই। চুপচাপ সব দেখে যাচ্ছি। দেখে যাচ্ছি সবার আনন্দের সাথে ব্যস্ততা। আর মাঝেমধ্যে পাবলিক টয়লেটের কথা মনে পড়লে হাসি পায়। সবাই বলতো আমি নাকি বেরসিক। এই ছেলেটা তো দেখছি আমাকেও হারিয়ে দিবে বেরসিক তালিকায়। সেই যে সেদিন গেল আংটি পরিয়ে। তারপর একটাবারের জন্যেও আর ফোন দিলো না। আচ্ছা পাবলিক টয়লেট কি মাথায় ধাক্কাটার জন্য এখনো আমার উপর রেগে আছে!

দেখুন আপনাকে বিয়ে করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না। শুধুমাত্র মায়ের কারণে বিয়েটা করতে বাধ্য হই। একজনের সাথে অনেকদিন ধরে সম্পর্ক। নির্লিপ্তভাবে কথাগুলো বলল সামনে দাঁড়ানো শেরওয়ানি পরা মানুষটা।

আপনি তো আচ্ছা বেরসিক মানুষ! বাসর রাতে বিয়ে করা বউকে কেউ নিজের প্রেমিকার কথা বলে? পালিয়ে তো যাচ্ছি না। আগামীকাল সকালে কি বলা যেত না?
কবুল বললেই বুঝি বিয়ে হয়!
তা কি করলে বিয়ে হয় বলুন। শুনি আপনার কাছে বিয়ের সংজ্ঞা।
আমি এখন আপনার সাথে বিয়ের সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করবো! যত্তসব অসহ্য!
সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করলে মন্দ হতো না। দুজনে গল্প করে কাটাতাম দুজনের জীবনের প্রথম রাত।

কথাটা শুনে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। রাগে হনহনিয়ে হেঁটে বারান্দার দিকে হাঁটা ধরল।
ও হ্যালো, আপনার নামটাইতো জানা হলো না। নাকি নামটাও প্রেমিকার জন্যে সুরক্ষিত করে রেখেছেন?
বারান্দায় গিয়ে ওপাশ থেকে যখন দরজাটা বন্ধ করতে নিলো তখন বললাম, নাম না বললে পাবলিক টয়লেট বলে ডাকা শুরু করবো সবার সামনে। কথাটা বলেই সাথে সাথে চোখটা বন্ধ করে ফেললাম। বুকের মধ্যে হাতুটি পেটানোর শব্দ শুরু হলো। দরজাটা জোরে বন্ধ করার শব্দের অপেক্ষা করতে লাগলাম।
অর্ক।

কথাটা শুনে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলাম। ভেবেছিলাম বলবে না। আমার দৃষ্টি উপেক্ষা করে মুখের ওপর ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে দিল বাইরে থেকে।

কবুল বলার সময় গুষ্ঠিশুদ্ধ সবার নাম বলার সময় ওর নামও শুনেছিলাম। কিন্তু এখন ওর নিজের মুখে নামটা শুনতে ইচ্ছে হলো। বন্ধ দরজাটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। খুব গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল। বাইরে জ্যোৎস্না পসরা সাজিয়ে বসেছে। জানালা গলে সেই জ্যোৎস্না খাটে এসে পড়ছে। খাটের চারদিকে সাজানো রজনীগন্ধা আর সাদা জারবেরার মালাকে জ্যোৎস্নায় অদ্ভুত সুন্দর লাগছে।

অর্কের ফোনটা অনেকক্ষণ ধরে বাজছে। শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রুমে এসে দেখি ও নেই। ওয়াশরুমে গেছে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি Trisha। এই নামে একটা মেয়ে ফোন দিয়েছে অনেকবার। ফোনটা চার্জে দেয়া ছিল। সারারাত সম্ভবত ফোনটা বন্ধ ছিল, তাই সকাল হতে না হতেই ফোনের বন্যা বসিয়ে দিয়েছে। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো অর্ক। ফোনটা নিয়ে ওর মুখের সামনে ধরলাম।

সারারাত ফোন বন্ধ পেয়ে আপনার প্রেমিকা ছটফট করছিল। সকালবেলা খোলা পেয়েই ফোনের বন্যা বসিয়ে দিয়েছে। বাসর রাতের গল্প শুনতে নিশ্চয়ই উদগ্রীব হয়ে আছে। একবার ভাবলাম বাসর রাতের কাহিনি রসিয়ে রসিয়ে বলি। পরে ভাবলাম থাক। আপনার মুখ থেকে শুনলেই বরং বেশি তৃপ্তি পাবেন।
আপনার মাথার কয়টা স্ক্রু ঢিলা? অর্ক আমার দিকে রাগত দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।
কয়টা স্ক্রু ঢিলা, কয়টা স্ক্রু টাইট, কোনটা কোন দিকে কত ডিগ্রি কোণে লাগানো আছে সব জেনে যাবেন। মাত্রতো একটা রাত পার হলো। এত তাড়া কিসের।

আমার হাত থেকে টান মেরে ফোনটা নিয়ে গেল। নার্সারির বাচ্চার হাত থেকে চকলেট কেড়ে নিলে যেমন রাগ করে ওর রাগটাও ঠিক তেমনি। আপনার সোফায় ঘুমাতে অসুবিধে হবে? আমি সোফায় ঘুমাতে পারি না। আপনি সোফায় ঘুমালে ভাল হয়। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চুল বেনি করছিলাম। অর্ক রুমে ছিল না। রুমে ঢুকেই এই কথা বলল।

আমি খাটে শুলে কি আপনাকে রেপ করবো? বেনী করতে করতে নির্লিপ্তভাবে জবার দিলাম।
আপনি কোন চালের ভাত খেয়ে বড় হয়েছেন? কথার কি নকশা! বিরক্ত স্বরে বলল অর্ক।

অতীত জেনে কি করবেন? এখন থেকে আমরা একই চালের ভাত খাব। আপনি চাইলে আমরা একই প্লেটেও খাব। বেনী বাঁধা শেষে চুলটা পেছন দিকে ছুড়ে দিলাম।

আপনার সাথে কথা বলাই দায়! স্বয়ং পাগলও আপনার সাথে কথা বলবে না। কথাগুলো বলে হাতের বালিশটা জোরে ছুড়ে মারল বিছানায়।
আমার কথায় আপনি পাগল হলেই চলবে। কথাটা শুনে প্রথমে অবাক এবং পরে রেগে গিয়ে সুইচ অফ করে শুয়ে পড়লো অর্ক। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। অন্ধকারে যখন চোখটা সয়ে এলো, ফ্লোরে ওড়না বিছিয়ে বালিশ নিয়ে শুয়ে পড়লাম। সোফায় ঘুমাতে পারি না। পাশ ফিরতে গিয়ে দেখা যাবে নিচে পড়ে গেছি।

এতদিন আমাকে নিয়ে সবার বাসায় যাওয়া এড়িয়ে যেতে পারলেও আজকে উপায় নেই ওর। ওর বড় চাচা সবাইকে যেতে বলেছেন। অর্কর ভাব দেখে বুঝলাম ও ওর চাচাকে খুব ভয় পায়। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও গলায় বেঁধে যাওয়া কাঁটার মত বিরক্ত হয়ে আমাকে সাথে নিয়ে ওর যেতে হবে। সবাই যখন তৈরি হয়ে ড্রইংরুমে এলো বের হবার জন্য তখন পেট চিৎকার দিয়ে বসে পড়লাম। শাশুড়ি, ননাস সবাই ছুটে এলো। আমার হঠাৎ শরীর খারাপ দেখে কেউ আর ও বাসায় যেতে চাইল না। এক প্রকার জোর করে সবাইকে ও বাড়িতে পাঠালাম। অর্ক দাঁড়িয়ে দেখছিল। কি করবে বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। সবাই বেরিয়ে গেলে ও ছাদে চলে গেল।

ধরুন কফি। ভয় নেই কফিটা মন্দ বানাই না আমি। অর্ক ছাদের গাছগুলোয় পানি দিচ্ছিল। কথা শুনে ঘুরে দাঁড়াল।
আপনি অসুস্থ! এসব কেনো করতে গেলেন? হাত বাড়িয়ে কফির মগ নিতে নিতে বলল। এই প্রথম অর্ক আমার সাথে ঠাণ্ডা শান্তভাবে কথা বলছে। ওর কণ্ঠটা সুন্দর। এক ধরনের মাদকতা আছে কাছে টানবার। ও কি জানে ওর কন্ঠটা এতটা সুন্দর?
কে বলল আপনাকে আমি অসুস্থ?
আপনি অসুস্থ নন!
উহু। দিব্যি সুস্থ আমি। কফির মগে চুমুক দিয়ে বললাম।

তাহলে তখন যে পেট ধরে বললেন ব্যথা?
না বললে তো আপনাকে বাংলার পাঁচের মত মুখ করে আমাকে সাথে নিয়ে যেত হতো। অন্যবারের মতো এবারের যাওয়াটাও ক্যান্সেল করতে পারবেন ভেবেছিলাম। কিন্তু পারলেন না দেখে কোমর বেঁধে আমাকেই মাঠে নামতে হলো।
কথাগুলো শুনে কিছুটা লজ্জা পেল ও। কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল, বাহ! ভালোই তো বুঝে ফেলেছেন দেখছি।
তাই? তাহলে আপনাকে বুঝতে যাই এবার?

কফির মগে চুমুক দিতে গিয়েও কথাটা শুনে চুমুক দিল না। আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি নির্লিপ্তভাবে ওর দিকে তাকালাম। এমন সময় ওর ফোনটা বেজে উঠলো। কফির মগটা একপাশে রেখে ফোনটা নিয়ে অন্যদিকে চলে গেল। মগের কফিটা শেষ হয়নি তখনো। আকাশের দিকে তাকালাম। আকাশটা শুভ্র নীলাম্বরী সেজেছে। এক গুচ্ছ মেঘ মাঝে মাঝে ভেসে যাচ্ছে। একটা শুকনো পাতা উড়ে গেলো। পাতাটার সাথে কোথাও কি আমার মিল আছে?

মেয়েটা ঠিক অদ্ভুত নয় কিন্তু কেমন যেন! কখনো অবাক হয়ে যাই, কখনো বা খুব বিরক্ত লাগে। বিরক্ত লাগলেও কেনো জানি মন্দ লাগছে না। গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে কথাগুলো আপন মনে ভাবছিল অর্ক। কয়েকবার ফোন রিং হয়ে কেটে গেল। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো তৃষা ফোন দিয়েছে। কয়েকবার রিং হতেই ফোনটা ধরল তৃষা।
এতবার ফোন দিলাম ধরলে না যে?
খেয়াল করিনি। গাড়ি ড্রাইভ করছিলাম।
বাহ! আজকাল বেখেয়ালের তালিকায় আমি চলে এসেছি।

ঝগড়ার দিকে যাওয়ার এখন ইচ্ছে নেই অর্কের। তাই প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিল। যদিও তৃষা কথাটা ভুল বলেনি। আজকাল প্রায়ই টুপের কথা মনে পড়ে ওর।তেমন কোনো কিছু ভাবনা না থাকলেও তারপরেও ভাবনা আসে।
তৃষা বাসার নিচে নামো।
কেন!
আমি তোমার বাসার কাছাকাছি।
সত্যি!
হুম।এসো তাড়াতাড়ি।

তৃষার বাসার সামনে কিছুক্ষণ পর এসে গাড়ি থামাল অর্ক। গাঢ় মেরুন রংয়ের শাড়ির সাথে খোঁপা করে লাল আর হলুদ জারবেরা ফুল গুজে দিল। হাত ভর্তি সোনালি রংয়ের চুড়ি। গাড়িতে এসে অর্কের পাশে বসল তৃষা। অর্ক ড্রাইভ করছে আর তৃষা কথা বলেই যাচ্ছে। সেই কথা অর্কের কান স্পর্শ করছে না।

ভার্সিটি থেকে বাসায় এসে দেখি তৃধা এসেছে। সবাই কি নিয়ে যেনো কথা বলছে। রুমে এসে দেখি অর্কও চলে এসেছে। আমাকে দেখে তৃধা জড়িয়ে ধরল, তোর জন্য গিফট আছে। কথাটা বলেই চোখ ইশারা করল। গিফটের সাথে চোখ ইশারার কি সম্পর্ক, বুঝলাম না।
কি গিফট?
হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিল। খামটা দেখে বুঝা যাচ্ছে না ভেতরে কি। এক পাশ ছিড়ে দেখি দুটো টিকিট!
তোর মধুচন্দ্রিমার জন্য। আমার কানের কাছে মুখ এনে চিৎকার করে বলল তৃধা।

অর্ক ল্যাপটপে কি যেনো করছিল। কথাগুলো শুনে ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকাল। অর্কের বড় বোন আসল একটু পর।
তোমাদের সারপ্রাইজ দেবার জন্য আগে থেকে কিছু জানানো হয়নি। উনি বলল।
আপু আমি যেতে পারব না। আমার পরীক্ষা সামনে। কথাটা শুনে আপু, তৃধা অবাক হয়ে গেল।
তোমাদের বিয়ের ছয় মাস পেরিয়ে গেল। এখনো যদি না যাও তবে কবে আর যাবে? হাহাকার নিয়ে বললেন উনি।
এখন ভাগ্যে নেই তাই যাওয়া হবেনা। পরেরটা এখন কিভাবে বলি।

তৃধা আর উনি এরপর আর কিছু বললেন না। রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আপনি মিথ্যা বলেছেন, তাই না? পেছন থেকে অর্ক কথাটা বলল। ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে দিলাম। এর উত্তর আমার কাছে নেই।

কলিংবেলের শব্দ শুনে দরজা খুলতে গেলাম। বাসায় কেউ নেই। শ্বশুর  শাশুড়ি হাসপাতালে গেছেন। বাসায় শুধু আমি আর অর্ক। অর্ক ওর রুমে। দরজা খুলে দেখি একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আগে কখনো না দেখলেও চিনতে অসুবিধে হয়নি তৃষাকে। ভেতরে আসল।
অর্ক কোথায়? ওর ফোন বন্ধ কেন?
ও একটু অসুস্থ। ফোনটা চুরি হয়ে গেছে ওর।
কি হয়েছে ওর? উদ্বিগ্নতা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো তৃষা।
তেমন কিছু নয়। আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্য জ্বর ঠান্ডা।
আমি ওর কাছে যাব। কথা বলেই যেতে গিয়েও ফিরে এলো আবার আমার কাছে তৃষা।

তুমি কি অর্ককে তুমি করে বলো? তৃষার কথাটা শুনে প্রচণ্ড হাসি পেল আমার। আমি হাসিনি। হাসলে বেচারি কষ্ট পাবে, মন খারাপ করবে।
তুই, তুমি, আপনিতে কিছু যায় আসে না। কথাটা বলে কিচেনের দিকে পা বাড়ালাম। এই মেয়ে অহেতুক কথা বাড়াবে।

ইদানীং অর্ক বেশি ভাবছে টুপকে নিয়ে। কখনো ইচ্ছাকৃত, কখনো বা অজান্তে। ভাবতে গিয়েও মনে হচ্ছে অর্কের, তৃষার প্রতি কোনো অন্যায় হচ্ছে নাকি। তৃষার সাথে সাত বছরের সম্পর্ক। কমিটমেন্টে বাধা ও তৃষার কাছে। কমিটমেন্টের ভাবনা কেনো এলো? কোথাও কি কোনো জায়গায় সুরে টান পড়েছে! সুরেই যদি টান পড়ে কমিটমেন্ট নামক শিকল দিয়ে কি সেটা ধরে রাখা সম্ভব? এসব ভাবতে ভাবতে অর্ক গাড়ি চালিয়ে বাসায় চলে এলো। রুমে ঢুকে দেখল টুপ কাপড় ভাঁজ করছে। ফ্রেস হবার জন্য ওয়াশরুমে গেল অর্ক। বের হয়ে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়াল। ড্রেসিংটেবিলের আয়নার ডানপাশে লাগানো ছোট্ট একটা কাল টিপ। টিপটার দিকে তাকিয়ে রইল। খুব ইচ্ছে করছিল টিপটা নিজ হাতে টুপের কপালে পরিয়ে দিতে। আয়না থেকে নিজ হাতে টিপটা নিল। আয়নায় দেখল পেছনে টুপ এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে খাবারের ট্রে।
"তোমার প্রিয় পায়েস, সেমাই পিঠা, ক্ষীর নিজ হাতে বানিয়ে দিয়ে গেছে তৃষা।" কথাগুলো বলে ট্রেটা অর্কের সামনে নিল টুপ।

অর্ক ধাক্কা দিয়ে খাবারের ট্রেটা ফেলে দিল। টুপ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল অর্কের দিকে। টুপের ডান হাতটা ধরে পেছন দিকে জোরে উল্টে ধরে নিজের বুকের কাছে শক্ত করে ধরল। টুপের ঘাড়ে অর্কের তপ্ত নিঃশ্বাস পড়ছে।
তোমার সাহস কিভাবে হয় আমাকে নিয়ে তামাশা করার? হাতটা শক্ত করে ধরে রেখে প্রচণ্ড রেগে কথাগুলো বলল অর্ক।

অর্কের কথা শুনে টুপ অবাক হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, কি তামাশা করলাম?
খুব পার তুমি সেটা দেখিয়ে বেড়াচ্ছ। নিজে যেচে তৃষার ফোন দাও আমাকে! তৃষার সাথে আমার সমস্যার সমাধান করে দাও! তৃষার রান্না করা খাবার নিজ হাতে আমার সামনে নিয়ে এসেছো!

অর্ক হাতটা এখনো শক্ত করে ধরে রেখেছে। টুপ খুব ব্যথা পাওয়ার পরেও হেসে দিল অর্কের এই কথা শুনে।
আপনিতো এটাই চেয়েছেন, তাহলে আমি পারব না কেনো এসব করতে? আমার সহ্য শক্তি কতটা সেটা দেখতে যাবেন না। তীরের ছোঁয়া পাবেন না।

প্রচণ্ড ব্যথায় টুপের চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে। মেয়েটা তারপরেও হেসে কথাগুলো বলছে। অর্ক এক সময় প্রচণ্ড বিরক্ত নিয়ে টুপের হাতটা ছেড়ে দিল।

বাসার সবাই গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গেছে। ভার্সিটি খোলা, তাই আমার যাওয়া হলো না। অন্য দিন বিকালের দিকেই অর্ক বাসায় চলে আসে। কিন্তু আজকে এত রাত হলেও এখনো বাসায় আসছে না। ফোনটাও বন্ধ! কিছুক্ষণ পর কলিংবেলের শব্দে দরজা খুলে দেখি অর্ককে একজন ধরে আছে। অর্ক কেমন যেনো টলছে!

ভাবী আমি অর্কের বন্ধু। আমাদের আজকে একটা পার্টি ছিল। বোঝেনইতো ফ্রেন্ডরা সব এক সাথে হলে একটু আকটু খাওয়া হয় আর কি। অর্ক এসব খায় ন। আমরা আজকে জোর করে খাইয়ে দিয়েছি। বেচারা সামলাতে পারেনি। অভ্যাস নেই তো।
বুঝলাম আপনার কথা। ভেতরে আসুন।
অনেক রাত হয়ে গেছে। আজ আর আসব না। আপনি ওকে ভেতরে নিয়ে যান।
অর্ককে ধরে রুমে নিয়ে এলাম। বিছানায় শোয়াতে গিয়ে তাল সামলাতে না পেরে ওর উপর পড়ে গেলাম। উঠে ওকে বালিশে ঠিকভাবে শুইয়ে দিলাম। যখন খাট থেকে নেমে আসতে নিলাম তখন পেছন থেকে ওড়না ধরে জোরে টান দিল। তাল সামলাতে না পেরে ওর বুকের উপর পড়ে গেলাম! ওড়নার টানে গলায় ব্যথা পেয়েছি। আমার শরীর থেকে ওড়নাটা এক টানে হাতে নিয়ে খাটের পাশে ছুড়ে ফেলল। দুহাত দিয়ে আমার গালটা ধরে নিচে ফেলল। ওর দৃষ্টিতে এক ধরনের ঘোর। চোখে মাদকতা জড়ানো। সেই মাদকতা উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু এই মাদকতাতো আমার জন্য নয়। তোমার চেতন মন কখনো আমাকে চায়নি অর্ক। চেতন মন যখন চায়নি তাহলে কিভাবে আজ তোমার অবচেতন মনের পুজা গ্রহণ করি? নেশা কেটে গেলে কেটে যাবে ঘোর। কেটে যাবো আমিও।

একজন মেয়ে একজন ছেলের শারীরিক শক্তির কাছে পারে না। কিন্তু আমি পেরেছি। হয়তো নিজের মধ্যে নেই এখন ও তাই ওকে সরাতে পেরেছি। অর্ককে সরিয়ে খাট থেকে যখন নামতে যাবো তখন দিল গা ভর্তি বমি করে! নিজের কাপড় সবটা নষ্ট করে ফেলল বমি করে! হায়রে কপাল আমার! এই রাতদুপুরে এখন মদের বমি পরিষ্কার করব! ইচ্ছা করছে বাথরুমে নিয়ে ঘাড়টা ধরে পানিতে চুবাই।

ওড়নাটা শক্ত করে নাকে বাধলাম। কি বিশ্রী মদের বমির গন্ধ। শার্টটা খুলে খাটের নিচে রাখলাম। বুকে ধান ক্ষেতের মত পশম। বুকটা মোছানোর সময় ইচ্ছে হচ্ছিল এত রাতে বমি করার জন্য পশমগুলো ধরে জোরে টান দেই। সারা ওয়ারড্রব খুঁজে, রুম খুঁজে আবিষ্কার করলাম ঘরে কোনো লুঙ্গি নেই! এখন একে ছোট বাচ্চাদের মতো এক পা ধরে ধরে ট্রাউজার পরাব! বারান্দা থেকে নিজের একটা পেটিকোট আনলাম। ওড়না দিয়ে শক্ত করে চোখটা বাধলাম। ওর কাপড় পাল্টাতে পাল্টাতে রাত প্রায় দেড়টা বেজে গেল। ফ্রেস হয়ে ঘুমাতে আসলাম। বাসায় যেহেতু কেউ নেই তাই আজ আর ফ্লোরে শুবো না। অন্যরুমে গিয়ে ঘুমাবো।

সকালে অর্কের ঘুম ভাঙ্গল পানির শব্দে। ঘুম থেকে উঠে নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে ছোটখাটো ভূমিকম্প হয়ে গেল ওর। গায়ে লাল গেঞ্জি পরনে সবুজ পেটিকোট। খুব ছোটবেলায় সুন্নাতে খৎনা হবার পর কখনো লুঙ্গি পরেছিল কিনা আর মনে করতে পারল না। টুপ তো কখনো এত সকালে গোসল করে না! তাহলে আজকে কেনো করেছে?

তোয়ালে দিয়ে চুল পেঁচিয়ে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে এলো টুপ। বের হয়ে দেখে অর্ক ঘুম ভেঙ্গে খাটের উপর বসে আছে থমথমে ফ্যাকাসে মুখ করে।
আমার কাপড় চেঞ্জ করেছে কে?
আমি ছাড়া রাতদুপুরে কার ঠেকা পরছে যে আপনার কাপড় চেঞ্জ করবে? কথা বলার সময় রাগ দেখালেও মিটিমিটি হাসছে টুপ।
কি! হাহাকার নিয়ে বলল অর্ক।
হুম। বড় বড় করে চোখ খুলে রেখেছিলাম তখন। কথাটা বলে খিলখিল করে হাসতে লাগল টুপ।
এত সকালে গোসল আজ!
ফরজ গোসল দিয়েছি তাই।
কি!
আপনি কি জানেন যে আপনি একটা গাধা?
কি?
কি শুরু করলেন তখন থেকে কি কি? আজ সারাদিন ব্যস্ত থাকব। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। তাই ভাবলাম গোসল করেই বেরোই।

কিছু কাগজ বাকি ছিল। সব কাগজপত্র রেডি করতে করতে অনেকটা দিন সময় লাগল। কাগজপত্র যখন সব তৈরি হয়ে গেল, নিজে সবগুলো কাগজে সাইন করে দিল।  একটা চিঠি আর কাগজগুলো খামে ভরে অর্কের খাটের পাশে টি-টেবিলে রেখে ট্রলি নিয়ে বেরিয়ে গেল। পরনে সাদা জমিনের কাল পাড়ের সুতির শাড়ি।

অর্ক বাসায় এসে দেখে টুপ বাসায় নেই। কোথায় গেছে কেউ জানে না। ফোনটাও বন্ধ। অর্কের টেনশন হতে লাগল! রুম থেকে বের হবার সময় চোখ পড়ল খাটের পাশে টি-টেবিলের উপর। একটা খাম আর খামের নিচে ভাঁজ করা একটা কাগজ। খাম খুলে কাগজগুলো বের করে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল! ডিভোর্স পেপার। ভাঁজ করা কাগজটা একটা চিঠি। ডিভোর্স পেপার দেখে এতটাই অবাক হলো যে একটু আগের টেনশনটা ভুলে গেল। অর্ক চিঠিটা খুলে পড়তে লাগল।

চিঠির শুরুতে প্রিয়জনের জন্য তুলে রাখা শব্দে মানুষ সাজায়। কিন্তু তোমার জন্য কি আমার কোন শব্দ তোলা ছিল? কখনো কি জানতে চেয়েছো কি সেই শব্দ? কি অর্থ ই বা সেই শব্দের? তোমাকে কখনো তুমি করে বলিনি। কিন্তু আজ খুব তুমি বলতে ইচ্ছে করছে। সম্পর্ক থাকাকালীন কখনো কোনোদিন তুমি সম্বোধন ছিল না আমাদের। সম্বোধনহীন সম্পর্ক ছিল আমাদের! কি অদ্ভুত, তাই না?

আশেপাশের সবাই যখন চুটিয়ে প্রেম করে বেড়াত, তখন আমার ভাবনায় একজন তুমি ছিল। সেই তুমির জন্য অপেক্ষায় ছিল অজস্র প্রহর। আমার সেই তুমির দেখা পেয়েছিলাম সেই ধাক্কায়! আমার জগৎ যখন তুমিময় ছিল তখন তুমি সেই রাতে জানিয়ে ছিলে তোমার তুমির কথা! আমি খুব চুপচাপ একটা মেয়ে। সবাই আমাকে বোবা বলতো। কিন্তু সেদিন আমার কি হয়েছিল জানি না। আমি খুব কথা বলতে শুরু করলাম।

তোমার সাথে এই অল্প সময়ে যত কথা বলেছি তা সারা জীবনেও বলিনি। তোমার সাথে কথা বলতে খুব ভাল লাগতো। হাঁসফাঁস করতাম তোমার সাথে কথা বলার জন্য। বুঝতে পারছিলাম আমি প্রেমে পড়ে যাচ্ছি। আমার তুমির জায়গাটা তুমি নিয়ে নিয়েছো। তোমাকে একটা গল্প বলছি। একলোক একটা বিড়াল অনেকদিন ধরে পুষতো। একদিন হঠাৎ লোকটার বাসায় একটা কবুতর উড়ে এলো।  কবুতরের প্রতি লোকটার মায়া হলো। এটা দেখে বিড়ালটা হিংসা করে একদিন কবুতরকে মেরে ফেলল। যেহেতু বিড়ালটা লোকটার প্রিয় ছিল তাই কিছু বলেনি বিড়ালকে। কিন্তু অল্প সময়ে আসা কবুতরের প্রতিও লোকটার মায়া জন্মে যায়।  কবুতরের মত আমি। হঠাৎ এসেছি। তুমি আস্তে আস্তে আমার মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছো। আমাকে বলা সেই রাতের কথাগুলো আমি ভুলিনি। তাই মায়ার মোহতে জড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে হলো না আমার।

একসময় আমার ইচ্ছে ছিল বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবো। তাইতো স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি সব জায়গায় আমি টপার ছিলাম। কিন্তু এখন আর ইচ্ছা নেই। জ্ঞানের আলোতে প্রজ্বলিত যারা তাদের আর কি আলোকিত করব? বরং যাদের আধারে প্রদীপ নেই, শিখা হয়ে তাদেরই না হয় প্রজ্বলিত করি। বিরাটনগর হাই স্কুলে আমার চাকরি হয়ে গেছে। আর কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে না। বলবো না ভাল থেকো। ভাল থেকো বলা না বলায় কারো ভাল থাকা নির্ভর করে না। খুব চেয়েছিলাম জনম জনম তোমার তরে কাঁদতে। কিন্তু সেই জনমের স্রষ্টা তুমি হতে পারোনি। তবুও আমি জনম ভরে কাঁদব তোমার জন্য।

অর্ক ছুটতে ছুটতে রেলস্টেশন এলো। ট্রেনের বগি নড়া শুরু করে দিয়েছে খানিক আগেই। ঝাপসা দৃষ্টিতে অর্ক তাকিয়ে রইল ছুটে চলা ট্রেনের দিকে। ট্রেন আপন গতিতে বয়ে চলছে। ট্রেনের দুই প্রান্তে দুই দিকে দুজন মানুষ নিঃশব্দে হেঁটে যাচ্ছে।