কোটা সংস্কার ও দূরপ্রাসঙ্গিক কিছু কথা
আফজাল সুযনপ্রকাশিত : এপ্রিল ১৩, ২০১৮
কোটা সংস্কার আন্দোলন এখন দেশের প্রধান আলোচ্য বিষয়গুলোর একটি। আন্দোলনকারীরা মূলত ছাত্র এবং চাকরিপ্রত্যাশী বেকার। আন্দোলনের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে, দেশে সরকারি চাকরিতে নানা ধরণের মোট ৫৬% প্রাধিকার কোটা বিদ্যমান। এতে সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্র মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছে। কোটাধারী অযোগ্যরা ঢুকে যাচ্ছে। আরো মেধাবীরা যেন সরকারি চাকরিতে ঢুকতে পারে, তার জন্য কোটার সংস্কার প্রয়োজন। এই সংস্কারের দাবি নিয়েই আন্দোলন।
এই ৫৬% কোটার মধ্যে ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা, ১০% নারী কোটা, ১০% জেলা কোটা, ৫% উপজাতি কোটা এবং ১% প্রতিবন্ধী কোটা। যারা কোটা সংস্কারের কথা বলছে, তাদের সাথে কথা বললে বুঝা যায়, তারা মূলত ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটার সংস্কার চাচ্ছে। অন্য কোটার ক্ষেত্রে তারা অস্পষ্ট কথা বলে। তাদের ভাষ্যমতে, দেশের ২-৩% লোকের জন্য ৫৬% কোটা, আর বাকি ৯৭-৯৮% লোকের জন্য ৪৪% কোটা। কথাটা পিলে চমকে যাওয়ার মতো। কিন্তু বিষয়টা কি আসলেই সেরকম কিছু? সত্যিই কি ২-৩% লোকের জন্য ৫৬% কোটা?
বিদ্যমান ৫৬% কোটার মধ্যে ১০% হচ্ছে নারী কোটা। সর্বশেষ আদমশুমারির তথ্য মতে, দেশে নারী ও পুরুষের অনুপাত হচ্ছে ১০০:১০০.৩। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক অর্ধেক। তাহলে দেখা যাচ্ছে, দেশের প্রায় ৫০% লোকের জন্য ১০% কোটা রয়েছে। আবার জেলা কোটা আছে ১০%, যার মধ্যে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য বড় শহর ও অন্যান্য জেলা শহর এর অন্তর্ভুক্ত। এই কোটা বলতে গেলে প্রায় সমগ্র দেশকেই কাভার করে ফেলে। এছাড়া ৫% উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা গোটা পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা কাভার করে। এভাবে দেখা যায়, দেশের প্রত্যেক নাগরিকই কোনও না কোনও কোটার অন্তর্ভুক্ত।
এই কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রধান স্লোগান হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই। এই স্লোগান আমাদের আশান্বিত করে। কিন্তু এত দেশপ্রেমিক হঠাৎ করে কোত্থেকে উদয় হলো, প্রশ্নটা হয়তো নানা কারণের তোলা যায়। আমরা দেখে এসেছি, এদেশের জন্মলগ্ন থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রকট বৈষম্য বিরাজ করে আছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশে লোকসংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে সাত কোটি। যুদ্ধের স্বীকৃত সকল ফর্মেটে মোট কতজন অংশগ্রহণ করেছিল? চার কোটি? উত্তর, না। দুই কোটি? উত্তর, না। পঞ্চাশ লাখ? না, তাও না। এর প্রকৃত সংখ্যাটা আমাদের মাথা নিচু করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট বলেই মনে হয়।
তারপর দেখি যুদ্ধক্ষেত্রের কথা, একদিকে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত প্রশিক্ষিত সৈন্যদল আর অন্যদিকে লাঠিসোটা, তীরধনুক, দা, কুড়াল কিংবা বড়জোর থ্রি নট থ্রি রাইফেল, যার গুলি বের হতেও পারে নাও পারে, নিয়ে প্রায় যুদ্ধঅশিক্ষিত গৃহস্থালির দল। এটা কি বৈষম্য ছিল না? এই প্রকট বৈষম্য নিয়েই দেশ স্বাধীন হয়। অনেক স্বপ্ন, আশা নিয়ে ঘরে ফেরে মুক্তিযোদ্ধারা। ভেবেছিল, সকল শহিদ পরিবারের দায়িত্ব নেবে তাদের জীবন দিয়ে আনা এই রাষ্ট্র। মুক্তিযোদ্ধারা বীরের সম্মান পাবে দেশের সর্বত্র।
বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরলেন। হাত দিলেন দেশের কাজে। কিছু করে ওঠার আগেই শহিদ হয়ে গেলেন সপরিবারে। ক্ষমতায় চড়ে বসলো ষড়যন্ত্রকারী রাষ্ট্রদ্রোহীরা। রাষ্ট্রে তখন পূর্ণোদ্যমে শুরু হয়েছে রাজাকার, আলবদর, আল-শামসদের পুনর্বাসন, ক্ষমতায়ন। অন্যদিকে শুরু হলো মুক্তিযোদ্ধাদের খুন, গুম, জখম, লাঞ্ছনা, নিপীড়ন। কারণ যার ডাকে তারা জীবন বাজি রেখে দেশ আনলো তার হত্যার বদলা শুধু তারাই নিতে পারে।
আদর্শের সাথে আপোস না করা, অস্ত্র জমা দেয়া মুক্তিযোদ্ধারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আত্মগোপন করছে তখন। ‘মুক্তিযোদ্ধা’ পরিচয়টাই এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের জন্য। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি তো অলীক স্বপ্ন! এসব বৈষম্য ছিল না? তারা বলে, মুক্তিযোদ্ধারা এমন বৈষম্যের জন্য যুদ্ধ করেনি। কথাটা খুবই সত্যি। সকল প্রকার বৈষম্যের বিরুদ্ধেই তো ছিল তাদের যুদ্ধ। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা তো নিশ্চয়ই রাজাকারদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় দেখতে চায়নি। মন্ত্রিত্বে দেখতে চায়নি। তাদের গাড়িতে রক্ত দিয়ে কেনা লাল-সবুজের পতাকাটা উড়তে দেখতে চায়নি। দেশদ্রোহীদের পদাঘাত চায়নি। রাজাকার, নব্য রাজাকারদের হাতে লাঞ্ছিত হতে চায়নি। এসবই দেখতে হয়েছে, পেতে হয়েছে, আপনার জীবদ্দশাতেই।
কেন? এত এত বৈষম্যের সময় কোথায় ছিলেন আপনি বা আপনার পূর্বপুরুষগণ? কেন কোথাও এতসব বৈষম্যের বিরুদ্ধে আপনাদের দেখা যায়নি? কারণ এতসব বৈষম্যের কোথাও আপনার একটি পয়সাও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল না। কিঞ্চিৎ স্বার্থও বিঘ্নিত হয়নি। আপনারা এখন রাজপথে নেমেছেন ‘বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযোদ্ধাদের চাওয়া’ পূরণ করতে। খুবই চমৎকার ব্যাপার! তা, আপনারা কোন চাওয়াটা পূরণ করতে নেমেছেন? যেটাতে আপনাদের স্বার্থ জড়িত! অতুলনীয়! এতকাল বৈষম্যের পর রাষ্ট্র যখন স্বীকৃতি স্বরূপ, কৃতজ্ঞতা স্বরূপ মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু দিতে চেয়েছে আপনারা তখন তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখলেন এতে হয়তো আপনার স্বার্থও কিছুটা বিঘ্নিত হচ্ছে। অমনি রাস্তায় নেমে পড়লেন! দেশপ্রেম, মুজিবপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধপ্রেমের কী অপূর্ব নিদর্শন! আপনারা বলছেন, কোটার কারণে অযোগ্যরা সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে।
বিসিএসের নিয়োগ প্রক্রিয়াটাই উদাহরণ হিসেবে দেখি। প্রতি নিয়োগে ক্যাডার নেয়া হয় গড়ে দুই হাজার। আর এর জন্য পরীক্ষা দেয় ৩.৫-৪ লক্ষ চাকরিপ্রার্থী। এদের মধ্য থেকে বাংলাদেশের রাজধানী কী, জাতীয় ফল কী, রাম-সাম-যদু-মধু দিয়ে বাদ দেয়া হয় ৯৪-৯৬% প্রার্থীকে। নেয়া হয় ৪-৬% প্রার্থী, কোনোপ্রকার কোটার প্রয়োগ ছাড়াই। যারা আপাত মেধাবী! তারপর আরেকবার এইসব আপাত মেধাবীদের ছাঁকা হয় লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে, কোনও কোটাপ্রয়োগ ছাড়া। এবারে মেধাবীদের সংখ্যাটা আরো কমে আসে। তারপর মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে চূড়ান্ত নিয়োগ হয়। নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়াতে শুধু এখানে এসে কোটার প্রয়োগ করা হয়। তাও লিখিত পরীক্ষায় ভালো নম্বর না পেলে কোটা তেমন কাজে আসে না।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধার উত্তরপ্রজন্ম