কুমুদরঞ্জন মল্লিকের কবিতা ‘অগ্রদানীর ছেলে’

প্রকাশিত : মার্চ ০১, ২০২১

কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের আজ জন্মদিন। ১৮৮৩ সালের ১ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার কোগ্রামে (বর্তমানে কুমুদগ্রাম) মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিশেবে তার লেখা ‘অগ্রদানীর ছেলে’ কবিতাটি পুনর্মুদণ করা হলো:

এক.
চুন-বালি-খসা কঙ্কালসার জঞ্জাল ভরা বাড়ী,
ঘন জঙ্গলে ঘেরা চারিধার, দেখিলে চিনিতে পারি।
সর্বদা তার রুদ্ধ দুয়ার, কেহ নাই মনে হয়
দেয় ধূম আর ক্ষীণ আলোটুকু বসতির পরিচয়,
বালক পুত্র লয়ে হোতা থাকে কৃপণ অগ্রদানী
পত্নী তাহার দু’বছর আগে ধরা ত্যাজিয়াছে জানি।
এমনি পাষাণ যখন তখন চলে যায় কাজ পেলে,
বিজন কুটীরে দশ বছরের ছেলেকে একাকী ফেলে।
স্নিগ্ধকান্তি ছেলেটি তাহার স্নেহ-মমতায় মাখা
যেন লৌহের স্তম্ভের গায় কনক-কুসুম আঁকা।
পুত্র এমনি পিতার বাধ্য যাবে না বাহিরে আর...
রহে জীবন্ত মণি-মরকত রুধি’ ভাণ্ডার-দ্বার।

দুই.
পিতা চলে গেলে একাকী বালক দেখে আনমনে বসি,
গাছে থলো থলো আমগুলি যেন পড়িবারে চায় খসি।
দেখে গাছ ভরে ফলিয়া রয়েছে শ্যাম নারিকেল-কাদি,
স্নেহের সলিল তৃষিতের লাগি’ রাখিয়াছে যেন বাঁধি,
অশ্বথ গাছে নব কিশলয়-অরুণাভ কচিপাতা,
কবে ছায়া দান করিতে পারিবে তারি লাগি ব্যকুলতা।
দেখিয়া দেখিয়া ভরে ওঠে আহা ছোট বালকের বুক,
ভাবে মনে মনে অজ্ঞাতে যেন দানের কতই সুখ।
সন্ধ্যায় পিতা ডাকে নাম ধরি, যেমন দুয়ারে আসি
ত্বরিতে বালক খুলি দেয় দ্বার মুখেতে ধরে না হাসি।
পরদিন গৃহে রাখি তনয়েরে পিতা চলে যায় প্রাতে,
বৎসর যেন সুখস্মৃতি রাখে পুরানো পাঁজির পাতে।

তিন.
বালক বিকালে চেয়ে চেয়ে দেখে সুনীল আকাশখান,
দেখে সে কেমন মূমূর্ষু রবি করে হিরণ্য দান।
সন্ধ্যায় দেখে ধনী সুধাকর রজতে ডুবায় ধরা,
দেখে নীরদের দানসাগরেতে কতই বিনয় ভরা।
দেখিয়া দেখিয়া কী এক ব্যথায়, ভরে উঠে তার বুক,
ভাবে মনে মনে নওয়া চেয়ে হায় দেওয়ায় বৃহৎ সুখ।
বহুদিন পর কৃপণ জনক মরণ আগত স্মরি,
শিয়রে কাছে ডাকিয়া তনয়ে বলিল সোহাগ করি,
সত্যই বাছা দানে বহুসুখ, তবে করে আজি তাই
যুগ সঞ্চিত বিপুল অর্থ আজ আমি দিয়ে যাই।
এত কৃপণতা এত হে কষ্ট সকলি সফল লাগে
তব চাঁদ মুখ হয় নাকো ম্লান যেন দারিদ্র্য-দাগে।

চার.
পিতার বিয়োগ অমিত অর্থ আসিল যুবার করে,
নিরজনে তারে প্রকৃতি গড়েছে ঘন অনুরাগ ভরে।
সে বছর হলো অন্ন-অভাব এ সারা বাংলা জুড়ি
আহার অভাবে পলে পলে মরে ছেলে মেয়ে বুড়াবুড়ী।
অনশন-ক্ষীণ তনয়ের মুখ চাহিয়া মরিল মাতা,
বড় বড় হায় জমিদার-ঘরে দু’বেলা পড়ে না পাতা।
তখন দয়ালু, স্বভাব দুলাল অগ্রদানীর ছেলে
দুহাতে তাহার ভাণ্ডার দিন গরিবের তরে ঢেলে।
খুলি দিল শত অন্নসত্র প্রচুর পান্থশালা
আপনি খাইল গরিবের সনে একসাথে পাতি থালা;
কষ্টার্জিত অর্থ পিতার দীন হীনে দিল বাঁটি
চতুর যাহারা বলিল, এ বেটা একেবারে হলো মাটি।

পাঁচ.
শুনি সংবাদ নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়,
চাহিলেন ডাকি উপাধি-ভূষণে ভূষিত করিতে তায়।
নিষেধ করিল বিনয়ে যুবক জুড়িয়া যুগল পাণি
পরের দানেতে আমরা পালিত পতিত অগ্রদানী।
আমরা নিলাম সমাজের দান, জানি তা সবার আগে
সার্থক হবে আজি যদি তাহা ভূখারীর কাজে লাগে।
আসল হইতে নামিয়া তখন কোলাকুলি করি রাজা,
বলেন, ‘জীবন ধন্য আমার, সার্থক তুমি প্রজা।
চৌদ্দ পুরুষ আগে দান লয়ে পতিত যদিই হলে
ব্রাহ্মণ চেয়ে ব্রাহ্মণ তুমি আজি এ দানের ফলে।
আজ হতে তুমি দানীর অগ্র, নহ হে অগ্রদানী
কপিলের শাপ ঘুচাইলে তুমি প্রেমের বন্যা আনি।