কিছু কথা না বললেই নয়

মারিয়া সালাম

প্রকাশিত : জুলাই ২৮, ২০১৮

এই মুহূর্তে বাঙালি ব্যস্ত পাকিস্তানের ইলেকশন নিয়ে। এ অবস্থায় রাজশাহীর ভোটের মতো লোকাল সাবজেক্ট নিয়ে আলাপ কতটা ঠিক হবে বুঝছি না l তবুও সম্প্রতি রাজশাহী ঘুরে যখন এলাম, কিছু কথা না বললেই নয়।

বলা দরকার, রাজশাহী ছেড়েছি বহু বছর। ১৪-১৫ বছরে খুব বেশি হলে ১৪-১৫ বার ওখানে গেছি। থেকেছি বড়জোর ২৫-৩০ দিন। আমরা যারা ঢাকায় থাকি, তাদের জন্য রাজশাহী স্বর্গতুল্য। সুন্দর ছিমছাম শহর। ট্রাফিক জ্যাম নেই। জলাবদ্ধতা নেই, ফ্রেস এয়ার। একারণে রাজশাহীতেও যে নানা ঝামেলা থাকতে পারে, নগরবাসীর যে হাজারো চাওয়া পাওয়ার হিসাব থাকতে পারে, আমার জানা ছিল না। এবার ভোটের আগে গিয়ে বেশ ক`টি আলোচনা সভা আর বিভিন্ন আড্ডায় বসে নগরবাসীর চাওয়া পাওয়ার হিসেবটা মিলিয়ে নিতে পারলাম। জানলাম নতুন জনপ্রতিনিধিদের কাছে তাদের ঠিক কী কী দাবি আছে।

নগরবাসীর দাবি:
এক. নাগরিক হিসেবে একজন মানুষ ঠিক কী কী সুবিধে ভোগ করবে এবং কী কী কর্তব্য পালন করবে, সে বিষয়ে সবাইকে প্রথমেই সচেতন করে তুলতে হবে। এরজন্য নগরপিতাকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
দুই. নগর সরকার গঠন করতে হবে, যাতে করে মেয়র অন্য কারো মুখাপেক্ষী না হয়েই নগরের উন্নয়নে যথাসময়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেন।
তিন. সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহিতার আওতায় এনে, প্রকৃত আয়-ব্যয়ের হিসেব জনগণের কাছে যথাসময়ে প্রকাশ করতে হবে। এছাড়া স্থাপন করতে হবে ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের জন্য স্থায়ী অফিস।
চার. নগরে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ থাকতে হবে, সেটা যে কোনো আকারেই হতে পারে। টেনিস, ব্যাডমিন্টন, হ্যান্ডবলসহ যেসব খেলাতে বড় মাঠের দরকার নেই, সেসব খেলার জন্য নগরের মাঝে মাঝে ছোট ছোট মাঠ থাকতে পারে। আর ক্রিকেট, ফুটবল বা হকি খেলার জন্য থাকবে বড় মাঠ। ইনডোর গেমের জন্য এলাকাভিত্তিক ক্লাব আর উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
পাঁচ. নগরে আন্তর্জাতিক মানের হোটেল ও রেস্তোরাঁ বানাতে হবে, যাতে করে বিদেশি খেলোয়াড়দের থাকার সুব্যবস্থা থাকে। স্টেডিয়ামগুলোকে নতুনভাবে সাজিয়ে তুলতে হবে, যাতে করে যে কোনো বড় খেলা এখানে আয়োজন করা যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যোগ্য লোককেই কেবল ক্রীড়া বিষয়ক কমিটিগুলোতে সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করতে হবে। দলকানা কিম্বা চাটুকার কাউকে নয়।
ছয়. রাজশাহীকে শিক্ষানগরী বললেও প্রকৃত অর্থে শিক্ষাব্যবস্থার কোনো উন্নয়ন এখানে হচ্ছে না। শিক্ষার মান দিনে দিনে পরে যাচ্ছে। তাই প্রকৃত অর্থে একটি শিক্ষানগরী হতে হলে যা যা উপাদান থাকা দরকার, সবকিছুর ব্যবস্থা করতে হবে।
সাত. পরিবেশের উন্নয়নের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। নতুন করে পুকুর খনন করতে হবে আর আরো বেশি বনায়ন করতে হবে।
আট. বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সুপেয় পানির ব্যবস্থা, দুষিত পানি শোধনের ব্যবস্থা, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, নাগরিকদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে নানা পরিকল্পনা নিতে হবে।
নয়. সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে এবং নাগরিকদের মতবিনিময়ের জন্য ক্লাব, পাঠাগারসহ বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগ কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে।
দশ. মার্কেটগুলোতে পর্যাপ্ত গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা আর নগরীর বিভিন্ন স্থানে পরিচ্ছন্ন টয়লেট স্থাপন করতে হবে।

নারী ইস্যু:
মজার বিষয় হলো, যেটা আমি প্রায় বলে থাকি, রাজশাহীতে লিঙ্গ বৈষম্য আসলে আমার চোখে খুব কম পড়েছে, বা আমি যে কম্যুনিটির অংশ সেখানে নারীরা খুব কম বৈষম্যের শিকার। আর আমি দেখেছি, প্রায় প্রতিটি পরিবারেই নারীরা খুব প্রভাবশালী। আমার নানির মা, নানি, আমার মা, আমি, আমরাই পরিবারের সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। এরকম হয়তো বেশিরভাগ পরিবারের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। তাই আলাদা করে নারীদের বিষয়ে আমাকে একটা আলোচনায় কথা বলতে বলাতে আমি বেশ ভাবনায় পড়ে যাই। কারণ আমি সেভাবে আলাদা করে ভাবিনি কোনোদিন। সবাই হয়তো আমার মতো করে ভেবেছে। তাই পরিচ্ছন্ন পাব্লিক টয়লেট ছাড়া কোনো বক্তাই নারীদের আলাদা কোনো সমস্যার কথা বলতে পারেনি। তা’বলে এটা বলছি না যে, ওখানে নারী নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটছে না, বা কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমান অংশীদার। সেসব আছে, তবে ওগুলো সামাজিক আন্দোলনের আকারে দেখা হয়। মেয়রের একার দায়িত্বের মধ্যে নয়।

তবুও আমি সকল মেয়র প্রার্থীকেই বলেছিলাম, রাজশাহীর মেয়েরা কোনো অংশেই পিছিয়ে নেই। তবে তাদের সাহস আর আত্মবিশ্বাস বাড়াতে যেন তারা বিশেষ কোনো কর্মসূচি হাতে নেন। আর মেয়েরা যেন নিজের অধিকার বিষয়ে আরো সচেতন হয়। সে ব্যাপারে কিছু কর্মশালার আয়োজন করা হোক।

মেয়র প্রার্থীদের কথা:
প্রত্যেক প্রার্থী তাদের নিজ নিজ ইস্তেহার ঘোষণা করেছেন। সে অনুযায়ী নাগরিকরা আসলে যা যা চান, তার বেশিরভাগ দাবিই তারা বাস্তবায়ন করবেন বলে বলছেন। তবে সেজন্য তাদের যথাযথ ক্ষমতায়ন দরকার বলে চারজনই মনে করেন। তারাও নগর সরকার চান এবং একজন মন্ত্রীর সমান মর্যাদা চান।

বিএনপি নেতাকর্মীদের অভিযোগ:
বেশ ক`জন বিএনপির নেতাকর্মীর সাথে কথা হলো সম্প্রতি তাদের মিছিলে ঘটে যাওয়া ককটেল হামলার বিষয়ে। তারা সবাই দাবি করছেন, ঘটনাটা পূর্বপরিকল্পিত এবং তাদের নেতাকর্মীদের ভোটের আগে আটকে রাখতেই মিথ্যা মামলায় জেলে ঢুকানো হচ্ছে। আমি বেশ ক`টি থানার ওসি আর তদন্ত কর্মকর্তার সাথেও কথা বললাম। পুলিশ বলছে, যাদের আটক বা গ্রেফতার করা হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ আছে।

ব্যক্তিগত মতামত:
কেউ কেউ আমাকে অভিযোগের সুরেই বলেছেন, আপনারা সাংবাদিকরা অনেক বিমাতাসুলভ আচরণ করছেন। সবক্ষেত্রে বলতে পারছি না, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখলাম, আমরা বড় দুই দলের বাইরের প্রার্থীদের যথাযথ সম্মানটুকুও দিতে ব্যর্থ। সে যাক। লিটন ভাই আর বুলবুল ভাই দুজনেই যোগ্য প্রার্থী। উনারা এর আগেও মেয়র হিসেবে কাজ করেছেন। ভালো ব্যক্তি হিসেবেও অনেক সুনাম রয়েছে উনাদের। সবচেয়ে প্রশংসার বিষয় হলো, উনারা দারুণ একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন। এরকম একটা অস্থির রাজনৈতিক সময়ে এরকম সহঅবস্থানই আমরা দেখতে চাই। জাতীয় পার্টির প্রার্থী হাবিবুর রহমান ভাই একজন আপোষহীন ব্যক্তি আর মুরাদ ভাইয়ের অসীম ধৈর্য ও প্রতিকূল পরিবেশও মাথা ঠাণ্ডা রেখে বিনয়ের সাথে কথা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টা আমার ভালো লেগেছে।

রাজশাহীবাসী পরিবেশগতভাবেই শান্তিপ্রিয়। আমরা অযথা ঝামেলা তেমন পছন্দ করি না। সেদিক থেকে বড় কোনো সহিংসতা বা কারচুপি হবে না, সেটাই আশা করছি। যিনিই মেয়র হোক না কেন, অন্যেরা তাকে সাহায্য করবেন বলেই জানিয়েছেন প্রত্যেকে। আশা করি সেরকম সৌহার্দ্যপূর্ণ একটি পরিবেশই থাকবে আমাদের প্রিয় নগরে। জানি, ‘নগরপিতা’ বলা হলেও মেয়রদের ক্ষমতা সীমিত। তাই আগামীর মেয়রের কাছে আরেকটা দাবি থাকবে, মেয়রের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে উনি আরো সোচ্চার হবেন।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী