কাপড়ের গয়নায় পৃথ্বীষার বাজিমাত ..............................ছবি: সংগৃহীত
কাপড়ের গয়নায় পৃথ্বীষার বাজিমাত
মুমিতুল মিম্মাপ্রকাশিত : মার্চ ২৮, ২০২৪
টেনটেরালি। চট্টগ্রামের এই আঞ্চলিক শব্দের অর্থ ফড়িং। সাত বছর আগে জীবন ও জীবিকাকে রংতুলির ছোঁয়ায় আপন করে নিতে উদ্যোক্তা পৃথ্বীষা খুলেছিলেন তার রঙিন দোকান। টেনটেরালি নামে সেই দোকানে পাওয়া যেত বাহারি নকশার কাপড়ের গয়না। পরিবেশবান্ধব গয়না তৈরির পথে হেঁটে যেতে ফি বছর সেই দোকানে যুক্ত হয়েছে শাড়ি-টপ-কামিজসহ আরও অনেক কিছু। রঙের ভুবনে পৃথ্বীষা বৈদ্যের পথচলা নিয়ে লিখেছেন মুমিতুল মিম্মা
শুরুর গল্প
ছোটবেলায় দিদা-ঠাকুরমা, মা-মাসিদের করা কাপড়ে, কাঁথায় তোলা ফোঁড় দেখে হাতের কাজের প্রতি এক ধরনের গভীর টান তৈরি হয় পৃথ্বীষার। বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে নিজের পোশাক নকশা করা শুরু করেন। কাপড়ে সুতোর কাজের হাতেখড়িও তখনই। রান স্টিচ দিতে না পারায় কান্নাকাটি করার মুহূর্তগুলো মনে করে এখনও হেসে ওঠেন তিনি। কিন্তু মন খারাপের মুহূর্তগুলোতেও চেষ্টা থামিয়ে দেননি। দিনের পর দিন চেষ্টা করে গেছেন। বিভিন্ন সময়ে গজ কাপড় কিনে এনে সুতোর কাজ করেছেন নিজের জন্য। সেসব দেখে বন্ধুদের অনেকেই আবদার করে বসতো। কিন্তু তখনও পৃথ্বীষা উদ্যোক্তা হওয়ার কথা ভাবনাতেও আনেননি।
কিছুই না জেনে নতুন উদ্যোগ নেওয়ার ঝক্কি নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু বন্ধু-বান্ধবের আবদার ফেলতে পারেননি। তাদের জন্য নিয়মিত পোশাক তৈরির কাজ করে যাচ্ছিলেন। কেবল পোশাক নয়, তৈরি করছিলেন গয়না ও ব্যাগ। পরে ২০১৭ সালে বোনের অনুরোধ রাখতে ফেসবুকে একটি পেজ খোলেন। নাম দেন টেনটেরালি। এভাবেই হুট করে যাত্রা শুরু করে পৃথ্বীষা বৈদ্যের উদ্যোগ। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে নয়, মানুষের সঙ্গে নিজের তৈরি পণ্যের ভালো লাগা ভাগ করতে চেয়েছিলেন তিনি। ধীরে ধীরে মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন পৃথ্বীষা।
চাওয়া আর কাজের সম্মিলন
পৃথ্বীষা বলেন, যখন শুরু করেছিলাম তখনও বুঝতে পারিনি উদ্যোক্তা হব। ছোট থেকে চারুকলায় পড়ার ইচ্ছা থাকলেও মা-বাবা যেহেতু চাননি চারুকলায় পড়ি, তাই অনার্স করি অর্থনীতিতে। কিন্তু অর্থনীতি আমার আসলে কখনোই ভালো লাগেনি। তখন বুঝেছিলাম ভালো লাগে না এমন কোনো কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই অন্যকিছু হতে চাইনি কখনো। তখন যা বানাতে ভালো লাগত তা বানাতাম। এভাবেই ভালো লাগার কাজ করতে করতেই উদ্যোক্তা হয়ে গেলাম।
এ বছর মার্চে টেনটেরালি সাত বছর পাড়ি দিল। বাংলাদেশের অনলাইন উদ্যোক্তাদের কোথাও একটা নিজস্ব ঘর না থাকলে কেউ গ্রহণ করতে চান না অনেক ক্ষেত্রে। সেসবও যুক্ত হয়েছে পৃথ্বীষার ঝুলিতে। ঢাকায় যাত্রার শোরুমে টেনটেরালির গয়নার একটা ডিসপ্লে কর্নার আছে। টেনটেরালিতে গয়না, শাড়ি, আনস্টিচড কাপড়, রেডিওয়্যার নিয়ে কাজ করা হয়। সব পণ্যের নকশাতেই হাতের কাজকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। যেমন ব্লকের কাজ, হ্যান্ডপেইন্টের নকশা, হ্যান্ডস্টিচ।
পরিবেশবান্ধব গয়না
গয়নার ক্ষেত্রে পৃথ্বীষা কাপড়ের তৈরি গয়না নিয়ে বেশি কাজ করেন। যেকোনো তৈরি পোশাক বানাতে গেলেই কিন্তু প্রচুর টুকরো কাপড় থেকে যায়। বিভিন্ন জায়গা থেকে এই টুকরো কাপড় সংগ্রহ করে গয়না বানান তিনি। সুই-সুতোর কাজ, বিভিন্ন ধরনের পুঁতি, রুদ্রাক্ষ দিয়ে এই গয়নাগুলো নকশা করা হয়। এই গয়নাগুলো যতটা সম্ভব পরিবেশবান্ধব উপকরণে তৈরি করার চেষ্টা করেন। এই কাপড়ের টুকরোগুলো পুনর্ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানো যায়। ফলে পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব কিছুটা কমে।
কাপড়ের তৈরি এই গয়নাগুলো পরেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন গ্রাহকরা। গয়না নকশায় প্রাধান্য পায় বিভিন্ন ফ্লোরাল ও ফোক মোটিফ। একটু ব্যতিক্রমী নকশার গয়নাও হয়, আবার ওজনেও হালকা। এসবের পাশাপাশি কাঠ, তামা, পিতল এসব দিয়েও গয়না বানাচ্ছেন পৃথ্বীষা।
উদ্যোক্তা হওয়ার ঝক্কি
বাংলাদেশে একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়। নারী বলেই সম্মুখীন হতে হয় ভিন্ন ধরনের বৈষম্যের। তার পরেও আমাদের নারী উদ্যোক্তারা নিজেদের প্রতিভায় রচনা করেন ভিন্নরকম পণ্যের গল্প। টেনটেরালির স্বত্বাধিকারী ও ডিজাইনার হিসেবে পৃথ্বীষা বৈদ্যের যেমন রয়েছে পছন্দমতো কাজের স্বাধীনতা তেমনি একহাতে সব কাজ সামাল দিতে হয় বলে রয়েছে কাজের চাপ। পণ্য ডিজাইন থেকে শুরু করে তার ম্যাটেরিয়াল সোর্সিং, পণ্য তৈরি, প্যাকেজিং এমনকি অনেক সময় পণ্য ডেলিভারির কাজটিও করতে হয় নিজেকেই। দিনের পর দিন শতভাগ ঝুঁকি নিয়ে পৃথ্বীষারা এতজনের কাজ একা করার পরেও শিকার হয় বৈষম্যের। আশপাশের মানুষ এই কাজকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন না। আবার বিদেশি পণ্যের প্রতি আগ্রহী ক্রেতারা অনেক সময় উদ্যোক্তাদের পণ্যকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। পৃথ্বীষা জানান, খুব ধীরগতিতে হলেও ক্রেতাদের মনোভাব বদলাচ্ছে। অনেকেই যেকোনো উৎসবে-পূজা-পার্বণে বেছে নিচ্ছেন দেশি উদ্যোক্তাদের পণ্য। দিনশেষে হাজার ঝামেলার পরেও নিজেকে সামলে নিতে পারি একমাত্র উৎসাহী ক্রেতাদের জন্যই। ক্রেতারা যখন পণ্য নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রসংসা করেন-দিনশেষে নিজের সব পরিশ্রম সার্থক মনে হয়।