কাজী নুসরাত শরমীন
কাজী নুসরাত শরমীনের ৬ কবিতা
প্রকাশিত : জুন ০৮, ২০২১
ঈশ্বর এক শীর্ণ কৃষক
চোখের কিনারে তরতর জঙ্গম নদী,
তীর ধরে আকাশের তারা গুনি
স্বচ্ছ পূর্ণিমার রাতে দাঁড় হাতে ডুবসাঁতারে দেখা মেলে লক্ষ্মীবিলাসী নাও
মৃতদের ফিসফাস চারপাশে
মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে ক্লান্ত নর্তকি ইন্দ্রপুরীর সভাশেষে
সংখ্যা পূর্ণ হয়নি এখনো বোঝা যায় আলাপে-বিস্তারে,
ভীষণ ক্লান্ত যমদূত মারিকাল পার হতে হতে
মাছি ভনভন অর্ধস্ফুট ভ্রুণ পাশেই পড়ে থাকে, আস্তিন গুটিয়ে বসে মুখভার।
রুদালি সংগীত ভাসে আকাশে আকাশে অনৃতভাষী রাজ-রাজড়ার ।
প্রথাবিরুদ্ধ তেতেপোড়া ভূমিপুত্র আমি
পাড়েই দিগন্তবিস্তৃত ফসলি জমি।
রাক্ষুসে সূর্যটা বগলদাবা করে
ধীর লয়ে হেঁটে চলি। আমার ঈশ্বর এক শীর্ণ কৃষক, অন্নপুষ্ট হাতে কর্ষিত মাটির।
আমার কোনো মৃত্যুভয় নেই।
দাঁড় হাতে ডুবসাঁতারে পার হয়ে আসি এক আয়ুষ্কাল।
সভ্যতার সূর্যাস্তে
আজ বাকোয়াজ ক্ষমতা ও বুটের আওয়াজ।
সভ্যতার সূর্যাস্তে,
মতমোড়লের ক্লান্ত আঙুল
গুনছে শবের সংখ্যা।
ফুসফুস দখলে নিলো কোভিড উনিশ,
বাতাসে ঋণের বোঝা, খোলাপির দোষে দুষ্ট
মানুষ, মৃত সব জামানতে রাখা নদী।
হাতে হাত নেই, সমাজচ্যুত মানুষেরা
নিক্ষিপ্ত কোয়রেন্টাইনে।
তবু শ্রমিক বোঝে না লকডাউনের মানে,
করোনার চেয়ে ক্ষুধার জ্বালাই ভারি।
দুর্যোগই শাসকের পরীক্ষা, দৃঢ়তায় পাশ
মড়ক চেনে না রাজা-প্রজা,
আজ বাকোয়াজ ক্ষমতা ও বুটের আওয়াজ।
ছায়াসঙ্গ
মৃত্যু আমার আপন ছায়া
তার সাথে একঘরে থাকি
আড়ি করি রোজ,
সেও শোধ নেয়
আমার পথেরা বড় অকালেই
মরে যায়, ঝরে যায়।
রোজ মরে কত অযুত নিযুত মায়া
বিশ্বাসেরা হৃষ্টপুষ্ট প্রেমে মৃত্যুর নামগান করে
ইনায় বিনায়,
আশ্চর্য আলোর সকাল দেখবো বলে
অক্লেশে মেনেছি যে ঘুটঘুটে আঁধার,
আলো ফুটতেই দেখি, এ তো মৃত্যুর ছল!
ভোরের আশায়
যে অন্ধকারে ডুবেছে দিনমণি,
সে মগ্নতায় মৃত্যু হয়েছে তার.....
যে আমার ধ্বংস কামনা করে
যে আমার ধ্বংস কামনা করে,
সেখানেই কৃতজ্ঞতা অশেষ। নত হয়ে থাকি তার কাছে
ব্যাধের মতো নিষ্পলক, পায়ে পায়ে হাঁটি।
ক্ষত কত-শত মৃদু হেসে বুকে হনিয়ে চলি ।
যা কিছু অর্জন, সেই তো দাবিদার,
তারে আঁকড়ে ধরে রাখি, ঘুরে দাঁড়াবার মন্ত্রে।
পরম বন্ধু আমার,
যে আমার ধ্বংস কামনা করে।
রক্তিম লালশাক ও অন্যান্য
ঘাসের ডগায় জীবনবিন্দু মিইয়ে যাওয়ার আগে, চিকচিকে ধারালো সময় ছুটলো রকেট গতিতে। দুর্ঘটনায় এবড়োখেবড়ো মুখ আর রক্তের ফিনকি দেখছে জড়ো হওয়া লোক, আর ঘাতক ড্রাইভার আপাত নিশ্চিত দূরত্বে লালশাকে মেখে নিচ্ছে ধোঁয়া ওঠা ভাত। কিছুই হয়নি যেন, গরম ভাতের সাথে গিলে ফেলে এবড়োখেবড়ো মুখ। এরপর সন্ধ্যায় হাটে যায়, কেরোসিন শিশিখানি দোলাতে দোলাতে। আলো জ্বালে ঘরে ফেরে, তীব্র শীতের রাতে আয়েশের বিড়ি খায় এরপর ঘুম, ভুলে যায় এবড়োখেবড়ো মুখ।
দূরে জীবন, অজস্র সাধ আর আলো নিয়ে বুকের ভেতর, চাপা পড়ে মাটির গভীরে। ঘাসের ডগায় জীবন মিইয়ে যায় সূর্য ওঠার আগেই, একবুক মাটিচাপা পরে স্লথ রাত্রির গভীর অন্ধকারে। আর প্রেসের সড়কে সাঁই সাঁই চলে যায় দুর্ঘটনার আগে `মর্মান্তিক` কালো অক্ষরের অলঙ্করণ।
প্রলাপ
ধ্রুপদী জোছনারা ঢেকে গেছে অমাবস্যার আঁধারে
বুঝি রাত পোহাবে না আর
নিষ্ঠুর নিস্তব্ধতা, টিনের চালে টুপটাপ শিশির নিশির।
ফুল, পাখি, সুখী জীব অথৈ ঘুমে নিদ্রাদেবীর কোলে।
দেবী, প্রসন্ন হও, কৃপা কর অধমেরে
এই গৃহে পদধূলি দাও-
স্মৃতিভ্রষ্ট হতে চাই আজ
কে আমি, নাম-ধাম, ফেলে আসা পথঘাট,
যন্ত্রণার খানাখন্দ
সবকিছু মুছে দাও।
বাইরে আঁধার, ভেতরেও
অন্ধকার ঘোচে না অন্ধকারে
যাপিত জীবনের সবটুকুক্ষণ
চক্কর কাটে মগজের অলিগলি শিরায় শিরায়।
এমন বিষাদময় রাত বড় ভয়ংকর
যেন হিমঘরে পড়ে আছি অসংখ্য শবের মাঝে আমিও একজন।
বোধের আড়াল থেকে ফণা তোলে কষ্টের অজগর,
ধ্রুপদী জোছনায় প্লাবিত চরাচর ঢেকে যায় অশুভ অমাবস্যায়।