কাজী জহিরুল ইসলাম

কাজী জহিরুল ইসলাম

কাজী জহিরুল ইসলামের কলাম ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ’

প্রকাশিত : মার্চ ১৪, ২০২৫

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার কিছু অনুমানের কথা বলি। আমাদের একটা রাজনৈতিক ট্যাবু আছে, ভারতের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশ অচল। আওয়ামী লীগ তো ভারতেরই দল, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিও এই ট্যাবু বিশ্বাস করে। বাম রাজনৈতিক দলগুলোও রাষ্ট্রকে ইসলামমুক্ত রাখার জন্য ভারত-ঘেঁষা আচরণ করে থাকে। কিন্তু প্রকৃত সমাধান হচ্ছে, একোমোডেশন, বাঙালি মুসলমানের যে সংস্কৃতি এদেশে শত শত বছর ধরে গড়ে উঠেছে তা মেনে নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সামাজিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা এবং প্রকাশ্যে তা অনুমোদন করা।

ভারত বড় দেশ। তাদের অর্থনীতি বড়ো। কিন্তু ছোট প্রতিবেশী হিসেবে তাদের মুখাপেক্ষী হতেই হবে, এটা ঠিক নয়। একে একে নেপাল, ভূটান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ সকলেই ভারতের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তাদের কারো অবস্থাই তো আগের চেয়ে খারাপ নেই। ভারতের বিকল্প বড় প্রতিবেশী দেশ চায়না আছে। একটু দূরে গেলে আরও বহু বন্ধুরাষ্ট্র আছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিদেশনীতি ও ক্রমাগ্রসরমান অর্থনীতি প্রমাণ করে দিয়েছে, ভারতের বৈরী আচরণ মূলত আমাদের অর্থনীতিতে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারবে না।

বাংলাদেশ থেকে ভারত তাদের চতুর্থ সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতো (এখনো করে কিনা, জানি না)। ভারত থেকে উল্লেখ করার মত কোনো আয় বাংলাদেশ করে না। কাজেই ভারতকে আমাদের যতখানি দরকার, ভারতের বাংলাদেশকে দরকার তার চেয়ে অনেক বেশি। ভ্রান্ত ট্যাবু দিয়েই এই মুহূর্তের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপিকে, যারা সম্ভাব্য সরকার গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, কাবু করে ফেলেছে ভারত। বিএনপিকে ভারত বোঝাতে সক্ষম হয়েছে, তারা যাতে নির্বিঘ্নে সরকার গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারে সেজন্য সব রকম সহযোগিতা দেবে ভারত।

বিনিময়ে ভারতের প্রতিনিধি আওয়ামী লীগকে যেন নিষিদ্ধ না করা হয়, যাতে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে রাজনীতি করতে পারে। ভারতের ও আওয়ামী লীগের প্রত্যাশা, বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে লুটপাট করবে এবং অল্পদিনের মধ্যেই আগের মতো অজনপ্রিয় হয়ে উঠবে। সেই সুযোগে আওয়ামী লীগের রাজনীতি চাঙা হবে এবং পাঁচ বছর পর তারা আবার ক্ষমতায় আসবে। হাসিনা না হলেও হাসিনার পুত্র/কন্যাদের একজনকে ক্ষমতায় বসিয়ে ভারত আবার আগের মতো বাংলাদেশ লুণ্ঠন করবে।

এছাড়া ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে ভারত কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। কারণ ড. ইউনূসের মতো বিশ্ববরেণ্য ও খাঁটি দেশপ্রেমিকের জন্য তারা বাংলাদেশের নরম মাংসে কিছুতেই দাঁত বসাতে পারছে না। বিএনপি কেন চুপ্পুকে সরাতে রাজি হয়নি? এটিও ভারতের প্রেস্ক্রিপশন। চুপ্পুকে সরালে কে হতেন রাষ্ট্রপতি? সবচেয়ে পপুলার প্রস্তাব ছিল ড. ইউনূস। কাজেই সর্বোচ্চ সম্ভাবনা ছিল ড. ইউনূস রাষ্ট্রপতি হবেন এবং রাষ্ট্রপতির মেয়াদ যেহেতু পাঁচ বছর, একটা লম্বা সময়ের জন্য ভারত তাদের আধিপত্য হারাতো।

শেখ হাসিনা দিনরাত ড. ইউনূসের মত বিশ্ববরেণ্য একজন মানুষকে হেনস্থা করত। এটা কী শেখ হাসিনা নিজের সিদ্ধান্তে করত? না, এটিও ভারতেরই নির্দেশে করা হতো। কারণ, ড. ইউনূসকে যদি কোনোভাবে হাসিনা দেশের জন্য কাজে লাগাতে পারে তাহলে বাংলাদেশ আর ভারতের মুখাপেক্ষী থাকবে না। তাই ভারত চাইত হাসিনা যেন ইউনূসবিদ্বেষী হয়।

আওয়ামী লীগ মূলত বোকার স্বর্গে বাস করছে। ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ বিএনপির নেতাকর্মীদের খুন করেছে, গুম করেছে, জেল দিয়েছে, রাজপথে পিটিয়েছে, রাতের অন্ধকারে তুলে নিয়ে গেছে। এইসব বর্বরতার কথা তারা ভুলে গেছে, না ভুলে যাবে? খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে, তারেক রহমানকে প্রতিনিয়ত গালাগাল করেছে, এইসব কি বিএনপি ভুলে যাবে? প্রশ্নই ওঠে না।

বিএনপি ভারতের সঙ্গে এখন মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে ক্ষমতায় যাবে। ক্ষমতায় যাওয়ার পরেই তাদের প্রকৃত চেহারা বেরিয়ে আসবে। তারা আওয়ামী নৃশংসতায়ই আওয়ামী নিধন শুরু করবে। মনে আছে, ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে প্রথম দিনই দুই লক্ষ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীকে মেরে ফেলবে? তখন ভারত বাধা দিতে এলে বিএনপি ভারতকে বলবে, আওয়ামী লীগ ভারতকে যা দিয়েছে আমরাও তাই দেব, কিন্তু আওয়ামী লীগ নিশ্চিহ্ন করার বিষয়ে আপনারা নাক গলাবেন না। এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আওয়ামী লীগের রাজনীতি করা তো দূরের কথা, ‘আও’ শব্দ উচ্চারণ করারও কেউ থাকবে না বাংলাদেশে।

ভারত হলো একটি স্বার্থপর দেশ। ওরা ওদের দেশের স্বার্থে কানাডায় গিয়েও মানুষ খুন করে আসতে পারে। একটি প্রাচীন জাপাননি প্রবাদ মনে আছে, ‘খারাপ কথা বলবে না, খারাপ জিনিস দেখবে না, খারাপ কথা শুনবে না?’ মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, এই `খারাপ` যদি ভারতের জন্য ভালো হয় তবে তা করতে পারো। ওদের দেশপ্রেম সকল নীতি-নৈতিকতার ঊর্ধ্বে।

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও জাতিসংঘের আয়কর বিভাগের প্রধান