কাজল শাহনেওয়াজ

কাজল শাহনেওয়াজ

কাজল শাহনেওয়াজের স্মৃতিগদ্য ‘১৯৭০’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২০, ২০২৫

১৯৭০ সালের কথা মনে আছে। প্রায় সারাবছরেই স্কুলটাইমে ৬ দফার সমর্থনে মিছিল হয়। তবে ক্লাস ছেড়ে মিছিলে যাবার বয়স তখনো হয় নাই। সরকারি চাকুরের ছেলে হওয়াতে আব্বার নিষেধ ছিল। শ্লোগান শুনি ‘জয় বাংলা’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’, ‘পিণ্ডি না ঢাকা/ঢাকা ঢাকা’, ‘তুমি কে আমি কে/বাঙ্গালী বাঙ্গালী’। নির্বাচন হবে, আলফাডাঙা নির্বাচনের জন্য গরম হয়ে গেছে।

একটা পোস্টার আসছে। তাতে লেখা, ‘সোনার বাঙলা শ্মশান কেন।’ পশ্চিম-পাকিস্তানের সাথে পূর্ব-পাকিস্তানের বিভিন্ন দামের তুলনা। দেখে গা জ্বলে যায়। আমাদের দেশে চাউলের মণ ৫০ টাকা, ওদের ২৫ টাকা। কী ভয়ংকর! সবাই এসব নিয়া বলাবলি করে।

প্রতিদিন স্কুল শুরুর আগে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়। ‘পাক সার জমিন সাত বাদ।’ আমরা আবছাভাবে অর্থ বুঝি। রেডিওতে বাংলা খবরের পরে উর্দু খবর। উর্দু বুঝি, আবার বুঝি না। খবরের শেষে বাজার দর। পাটের খবর থাকেই। তোষা আর দেশি জাতের। বিরক্তিকর! আমি খবরের সময় রেডিওর সাউন্ড কমাইয়া দেই। আব্বা প্রতিদিন সকাল ৬টায় বাংলা খবর শোনেন। তাতেই আমাদের ঘুম ভাঙে। উর্দু খবর কানে গেলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। রাগ করে চোখ মুছতে-মুছতে উঠি।

খবরে আরেকটা থাকে ‘শেখ সাহেবের খবর’। আগরতলা ষড়যন্ত্রের খবর। নির্বাচনের প্রস্তুতি চারদিকে। আব্বার অফিসের অ্যাসিস্ট্যান্ট নতুন ডাক শুরু করেছে। ‘বঙ্গবন্ধু’। ঢাকায় নাকি এই নাম দেয়া হৈছে। আব্বা বলেন, ‘তাই তো। শেখসাবই তো পূর্ব-পাকিস্তানের প্রকৃত বন্ধু। দেখবেন ওনার নেতৃত্বে দেশে কী হয়।’

এই সময় দেশের উপকূলে জলোচ্ছ্বাস হলো। কয়েক লাখ মানুষ নাকি মারা গেছে। কিস্তু সরকার কোনো রিলিফ দেয় নাই। সরকার নির্বাচন নিয়া ব্যস্ত। ভাসানী এর প্রতিবাদে নির্বাচন বয়কট করলেন। কানাঘুষা শুনি মাওলানা ভাসানী নাকি বলছেন, ‘ভোটের বাক্সে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। এই সময় নির্বাচন জনগণের সাথে তামাশা।’

মসজিদের সামনে একটু খোলা জায়গা। পাশেই থানা সদরের প্রধান রাস্তা। ফলে বেশ লোক চলাচল। মনে আছে, বইয়ের নেশায় ৭০ সালের শেষের দিকে কোনো এক সন্ধ্যায় সেখানে লোক জমায়েত হচ্ছে দেখে বসে থাকি। একের পর এক মৌলভি সাহেবরা ভাষণ দিচ্ছিলেন। সামনে একটা টেবিলে কিছু বই রাখা। আমার ধারণা হলো, মিটিং শেষে বইগুলি সবাইরে দেয়া হবে।

মিটিংয়ের সামনে অল্প কিছু লোক ছিল। ওটা ছিল একটা নির্বাচনী জমায়েত। মনে হয়, দলটার নাম নেজামে ইসলামী। সামনে ইলেকশন। লোক জমায়েতের পিছন দিকে, ভিড়ের বাইরে একটু দূরে একটা টেবিলে বসে থানা থেকে আসা একজন পুলিশ বসে-বসে কী যেন লিখছে। আমিও পাশে বসে থাকি।

মৌলভি সাহেবদের কথা আর শেষ হয় না। অস্থির হয়ে বসে আছি, কথাবার্তার কিছুই বুঝি না। কখন শেষ হবে, সেই চিন্তা। এশার নামাজের আগে তাড়াতাড়ি মিটিং শেষ হলো। ওমা, দেখি মাইকে বলছে, বইগুলি কিনতে হবে। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। ছিঃ ছিঃ, নেজামে ইসলাম না কী যেন দল… এরা এত খারাপ। বই না পাবার দুঃখে বাসায় ফিরে আসি।

তোড়েজোড়ে নির্বাচনের কাজ চলতেছে। আব্বা একটা সেন্টারের প্রিজাইডিং অফিসার হবেন। থানার আওয়ামী লীগের নেতারা আব্বার কাছে আসেন। নানারকম বুদ্ধি পরামর্শ করেন। একচেটিয়া নৌকায় ভোট পড়বে আশা করা যায়। তবুও প্রস্তুতি চলতে থাকে নিশ্চিত জয় যাতে হয়। আব্বার হোয়াটনট টেবিলে কাজের জন‌্য যাবতীয় সব রাখার ব‌্যবস্থা। অনেকগুলি ড্রয়ার, উপ্রের তাকে কলম, সিলপ্যাড, পেন্সিল, রাবার, ছুরি, কেঁচি। টেবিলে পিনকুশন, পেপার ওয়েট। দিস্তা কাগজ সমান ভাঁজ করার জন্য গোল একটা কাঠের রুলার। কালির দোয়াত, পেন হোল্ডারে তিন রঙের তিনটা নিবের কলম। ছোট্ট কয়েকটা গর্ত, সেখানে কালি ঢালতে হয়।

অফিসে এলাকার নেজামে ইসলামী দল, মুসলিম লীগের লোকও আসে। তারাও ইলেকশন করবে মনে হয়। তবে তাদের দলে খুব একটা সমর্থক নাই। আমি আব্বার চেয়ারের পাশে দাঁড়াইয়া এইসব শুনি। কিছু বুঝি, কিছু বুঝি না। তারা চলে গেলে আব্বা নিজেই আমারে বলেন। অফিসার মহলে আব্বার একটা প্রভাব আছে। আওয়ামী লীগের নেতারা বলেন, ‘ডা. সাহেব, সবাইরে বলে দেন ইলেকশনের দিন কী করতে হবে। এবার আমাদের জয় হতেই হবে। কোনো রিস্ক নেওয়া যাবে না। সব ভোট নৌকা মার্কায় চাই।’

ইলেকশনে তুমুল বিজয় হলো নৌকার। সবাই খুশিতে আত্মহারা। সবখানেই বলাবলি হচ্ছিল, এবার পশ্চিম-পাকিস্তানিরা কী করবে? এবার শেখ সাহেব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন। দেশে আর জুলুম থাকবে না। চাউলের দাম কমবে, কাগজের দাম পশ্চিম-পাকিস্তানের সমান হবে! পূর্ব-পাকিস্তান আর শ্মশান থাকবে না।

ইলেকশন শেষে আব্বার অফিসভর্তি ভোটের বাড়তি সরঞ্জাম। আমি কয়েকটা গালা সংগ্রহ করি। মোমবাতির আগুনে সামান‌্য তাপ দিলেই গালা গলে যায়। ব‌্যালট পেপারের বান্ডিল মোটা সূতা দিয়া বেন্ধে তাতে গালা লাগায়ে সিল মারা হয়, যাতে কেউ খুলতে না পারে। খুললেই বোঝা যাবে। সরকারি নিয়ম! আমি গাল‌া সংগ্রহ করে রাখি আমার গবেষণাগারের জন্য। তারপর মিছামিছি গোপন রত্নরাজি— কখনো কুড়ায়ে পাওয়া মার্বেল বা স্ক্রু-বল্টু কাগজে পেঁচায়ে গালা-সিল করে রাখি। খামোখাই। কেউ জানে না আমার এসব কাণ্ডের কথা।

রেডিওতে শুনি চকোরি সিনেমার একটা গান। গায়কের নাম, আহমদ রুশদি। উনি যখন গানের লাইনটা গান, ‘প্যায়ার কি ওয়াদা ক্যায়া হুয়া’ তখন একটা ঘণ্টা বাজে। আমি এই শব্দটা নিয়া চিন্তায় পড়ে যাই। এইটা কী মন্দিরে বাজতেছে নাকি গির্জায়? ইলেকশনে বিজয়ের পর আমি যেন সেই ঘণ্টার শব্দ শুনি। চারদিকে বাজতেছে বিজয় ঘণ্টা!

রেডিওতে বেদারউদ্দিন আহমেদ গান গান, ‘পূবাল হাওয়া….’। আমরা কান পেতে থাকি, কখন সেই লম্বা টানটা দেন। দমবন্ধ কৈরা অপেক্ষা করি। কত বড় বুকভরা লম্বা সুরে এই দেশাত্মবোধক গানটা উনি গান, যে, সব মানুষের দরদ যেন উপচায়া পড়তেছে এই গানে। দম আর শেষ হয় না, চলতেই থাকে!

সারাদিনই রেডিও শোনা হয়। রেডিওতেই খবরাখবর, রেডিওতেই মনোরঞ্জন! রেডিও মানেই বিজ্ঞাপন-তরঙ্গ। গানের ফাঁকে সুরে-সুরে বিজ্ঞাপন। এখানে তো সিনেমা হল নাই, রেডিওর গান শুনেই সিনেমার কল্পনা করতো সবাই। হঠাৎ করেই মনে হয় একদিন শুনলাম:

তোমারই জীবনে এলো কি আজ
নতুন কোনো অভিসার
আমি এসেছি জেনে কি
তোমার মনে কি
ফাগুন খুলে দিলো দ্বার।

শিল্পীর নাম নাজমা জামান। দারুণ লাগলো তার গাওয়া। আমি যেন একটা নতুন সুর শুনতে পেলাম। কাউরে বলি না, কিন্তু এরপর যখনই তার গান বাজায়, আমি কান পেতে শুনি। মনে হলো, আমি যেন তার গানের ভক্ত হয়ে গেলাম। রেডিওতেই বললো, এগুলি নাকি ‘জিংগা শিল্পী গোষ্ঠির গান।

তালাশ সিনেমার গান ফেরদৌসী বেগমের গাওয়া ‘মাই নে কাহা সালাম আলাইকুম’ গানটার নাটকীয় ভাব টানে আমারে, তবে তা ছিল গোপন ভালো লাগা।

মনোরঞ্জন বলতে বাংলাদেশ বেতারই সম্বল। বিজ্ঞাপন তরঙ্গে সিনেমার গান। সৈনিক ভাইদের জন্য ‘দুর্বার’ অনুষ্ঠান গভীর রাতে। বছরের নির্দিষ্ট কিছু দিন রেডিওতে প্রচার করে বিশেষ কিছু। যেমন: পল্লীকবি জসীম উদ্‌দীনের লেখা নাটক ‘বেদের মেয়ে’। সেই নাটকে ‘ও বাবু সেলাম বারে বার’ গান খুব জনপ্রিয়। দুর্গাপূজার মহালয়ার ভোররাতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ‘চণ্ডিপাঠ’, রোজার ইফতারির সময় হামদা ও নাত— ‘এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি খোদা তোমার মেহেরবানি।’ তবে সবচেয়ে আনন্দ লাগে যখন শেষ রমজানের সন্ধ্যায় বাজে, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। সবাই বুঝে যাই, ঢাকায় চাঁদ দেখা গেছে, কালকে ঈদ।

রাস্তাঘাটে হাটে-বাজারে যখন তখন শোনা যায় রেডিও থেকে ভেসে আসা গানের সুর। নিজের অজান্তেই এভাবে রবীন্দ্র সঙ্গীতের দিকে টান তৈরি হয়ে যায় আমার। সিনেমার গানে চেষ্টা নাই, তবে নিজের অজান্তেই কোনো-কোনো গান ভালো লেগে য়ায়। একবার শীতের সন্ধ্যায় গাছ থেকে সদ্যচুয়ানো খেজুর রস খেতে-খেতে শুনেছিলাম মাইকে ভেসে আসছে ‘নিঝুম সন্ধ্যায় শান্ত পাখিরা’ গানটা। মনটা আমার হুহু করে উঠেছিল। মনে হৈছিল, কী যেন নাই জীবনে! তখন অবশ্য বইভর্তি একটা লাইব্রেরির অভাব ছিল আমার জীবনে। গানটা আমার মনে পাঠাগারহীনতার বিষাদের সাথে মিলেমিশে গেছিল।

খেজুরের রস নিয়া আমরা একটা খেলা খেলি। মাঝারি উচ্চতার মাথায় হাঁড়ি। নিচে দাঁড়ায়ে কে আগে গাছ থেকে পড়া রস ধরতে পারে জিহ্বায়— সেই প্রতিযোগিতা। খুব কঠিন কাজ, ঠিকমতো সই করতে হয়। মিস হবার চান্স বেশি।

খেজুর গাছে শুধু রসই হয় না, কোনো-কোনো গাছে ফুল হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসে কান্দিভরা হলুদ ফল তলা থেকেই দেখা যায়। কিন্তু কাঁচা ফলই পেড়ে আনা হয়। এই বিষয়ে দিঘলীর কোনো অভিজ্ঞতা আমাদের ছিল না। গাছি আব্বারে শিখায়ে দিলেন, লবণপানি ছিটায়ে কেমনে পাকাতে হয়! সত্যি-সত্যি আব্বা একবার সন্ধ্যায় এককান্দি বাত্তি খেজুরে লবণপানি ছিটায়ে রেখে দিলেন। পরদিন সকালে দেখি, সব পেকে গেছে। বিস্ময়ে আমরা খুব খুশি। এক রাত্রেই কাঁচা খেজুর সব পেকে কমলা লাল। ঘুরে-ঘুরে ছিঁড়ি আর খাই আর লবণপানির ভোজবাজির কথা ভাবি।

বিকালে খেজুর গাছের পাশে ফাঁকা জায়গায় দৌড়াদৌড়ি খেলি। পায়ের নিচে হাফচষা এবড়ো থেবড়ো। আগাছা আর ঘাস। প্রেমকাঁটা। ছোট-ছোট ঘাসে আকশি কাঁটা। কাউরে বোকা বানাতে আছে প্রেমকাঁটার গান। মুখে দুইগোছা রেখে বলি, ‘গান শুনবি?; সে রাজি হলে তার মুখে দুইদিকে টান দিলে মুখ ভরে যায় প্রেমকাঁটায়! ভারি বোকা বানানোর খেলা।

এরমধ্যে একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটলো। ফুপুর সাথে একদিন বেড়াতে গিয়া আমাদের প্যান্টে খুব বেশি প্রেমকাঁটা লাগলো। এতে মা খুব রেগে গিয়ে তাকে বলে, ‘তুই এত বাড়ছস ক্যা? ওগো দিকে নজর না-দিয়া কোন নাগরের দিকে চাইয়া থাকস মাগি? বাসায় আহুক, তর মিয়া ভাইরে বইলা আজকে তরে মাইর খাওয়ামু।’ মার কথায় ফুপু খুব কষ্ট পান। রাগ কৈরা সেই রাতে ভাতও খান না। মাও রাগ করে থাকে। আসলে আরেক ঘটনা ছিল। আব্বার অফিসের অ্যাসিসট্যান্ট ইদ্রিস সাহেবকে নাকি ফুফুর সাথে একদিন কথা বলতে দেখা গেছে। মা সেই ঘটনাকেই ব্যবহার করেছে। আব্বা শেষপর্যন্ত তাকে বেজগাঁও পাঠাইয়া দেবেন, বলেন। আমরা ভাইয়েরা কানতে থাকি। আমাদের প্রেমজাল কাটাইয়া শে চলে যাবে, ভাবতে পারতেছিলাম না।
তারপর একদিন ফুপু সত্যি-সত্যি আমাদের ছেড়ে চলে যান।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক