অরঙ্করণ: পাপিয়া জেরিন
কলঘর
পাপিয়া জেরিনপ্রকাশিত : এপ্রিল ১৯, ২০১৮
তিনপায়া একটা কাঠের টুলে ফজু মিয়া বইসা। এক হাতে সইষ্যার তেলের শিশি আর অন্য হাতের আঙ্গুল একবার কানের ফুটায়, আরেকবার নাকে আবার আরেকবার নাভিতে গোল গোল ঘুরাইতাছে। ভাঙা টুলে ব্যালেন্স রাইখা কাজগুলি করা খুব কঠিন। বিলকিস তাকায়া দেহে তারে। ভোর রাইতে এই বেডারে স্বপ্নে দেখছে সে। আসলেই ফজু মিয়ার ঘাড়ে ভেড়ার মতো পাকাইন্যা লোম, যেইগুলা বিলকিস স্বপ্নে টাইন্যা ছিঁড়তেছিল। বিলকিস চোখ সরায়া সোজা হাঁটা দেয়। তার হাতে সময় আছে আধঘণ্টা। বিসিক থেকা বাইর হইয়া পুলিশলাইনে আইতেই দশমিনিট লাইগা যায়। এরপর আইয়া একটা গোসল দেয় সে। আরামে গোসল দেওনের মতো এইডাই একটা সময়।
পাশে ফজু মিয়ার দোতালায় কতগুলি ব্যাচেলার ভাড়া থাকে। ছেমড়াগুলি জাউড়ার হাফেজ, দোতালার বারিন্দা দিয়া গোসলখানার দিকে তাকায়া মুখ দিয়া নানান শব্দ করে। নার্গিসের মায়রে একশো বার কওয়া হইছে, যাতে কইরা সে কলঘরের উপরে দুইটা টিন দিয়া দেয়। টিন না দিলেও একটা বাতিল কাপড় দিয়া তিরপল টাঙায়া দিলেও পারে। কিছু কইতে গেলেই নার্গিসের মা ফোঁশ কইরা ওঠে। কয়, হ, তোমাগো কতকিছু কইরা দেওন লাগবো। আঠারশো টেকায় এইহানে ফলাল কইরা দিমু। টিন লাগায়া দিমু, হেরপর কইবা চোক্ষে দেহি না, ঝাড়বাত্তি লাগায়া দেও।
বিলকিস গামছা সাবান নিয়া কলঘরে যায়। দোতালার বারিন্দায় কেউ নাই। কামিজ টান দিয়া খুললেও শেমিজ খুলতে গিয়াও খুলে না। এইসময় ফজু মিয়ার ম্যাছে কেউ থাকে না, থাকলে ফজু মিয়াই। কিন্তু সে কোনোদিন কলঘরের দিকে ফিরাও চায় না। রাইতে কুলসুম আর পরীর থেকা ছেমড়াগুলির কিত্তিকলাপের নমুনা শোনোন যায়। এক রিপ্রেজেন্টিভ লুঙ্গি তুইলা খারাপ ইঙ্গিত করছে, কইলো। ফজু মিয়া সেই ছেড়ারে গাইল্যাইয়া ম্যাছ ছাড়নের নোটিশ দিছে।
বিলকিস শেমিজের ভিতরে হাত ঢুকায়া ব্রা খুলে। দিনভর কামের পর যদি কচলায়া গোসল করন না যায়, তাইলে কেমন লাগে! কাপড় শরীলে রাইখ্যা গোসল হয়? কিন্তু দোতালার জানলাগুলি মেলা, কপাটের চিপা দিয়া যদি কেউ চাইয়া থাকে!না, ফজু মিয়া এতোডা বদমাইশ না। বিলকিস ঝপঝপায়া পানি ঢালে। আধঘণ্টার মইধ্যে খাইয়া আবার শোরুমের ডিউটিতে যাইতে হইবো। কাউন্টারে শাহিদা আপা থাকনে এই সুযোগটা নিতে পারছে বিলকিস। আট মাস আগে ব্র্যাকে জয়েন করছিল সে, কাম সকাল নয়টা থেকা পাঁচটা। টানা আটঘণ্টা খালি সেলাই। তখন গোসল করতে হইতো হয় সেই সক্কালে নাইলে সন্ধ্যায়। ভাইগ্য ভালো, শাহিদা আপার নজরে পড়ছিলো সে।
তোমার নাম বিলকিস? বাড়ি কই?
জ্বী আপা, বিলকিস। বাড়ি তো ঘিওর। তয় এইখানে পুলিশলাইনে ব্র্যাকের মাইয়াগো লগে একটা ম্যাছ কইরা থাকি।
তোমার বেতন তো চাইর হাজার। এক কাজ করো। শোরুমের ডিউটিতে আসো, এইখানে ছুটি পাইবা ছয়টায়।
আপা, আমি লাঞ্চ আওয়ারে আধঘণ্টার ছুটি পাইলে উপকার হয়।
শোনো বিলকিস, ম্যানেজার স্যার খবর পাইলে আর উপায় থাকবো না।
আপা, আমার ঠাণ্ডার দোষ।এই সুযুগটা দেন। রাস্তা পার হইলেই পুলিশলাইন। আমি যামু আর আসমু।
শোনো তাইলে, আধঘণ্টার বেশি এক মিনিটও না।
বিলকিস আধমিনিটও দেরি করে না।আপার কথা মতো পরিষ্কার ইস্তারি করা কাপড় পইরা টিপটপ হইয়া অফিসে যায়। বেতন অন্য মাইয়াগো চাইতে একহাজার বেশি। তয় মায়রে বলছে চাইর হাজার। বাড়িতে দুই হাজার পাঠায়া নার্গিসের মায়রে দিতে হয় আঠারশো। পাঁচ হাজার বেতনের কথা মায় জানলে খবর আছে। একটা অফিসে গেলে যে ভালো পোশাক আশাক পরন লাগে, সেইডা মারে বুঝাইবো কে? একসেট থ্রিপিছ্ ইস্তারী করাইতেই নেয় আট টেকা, এইডা তারে কইতে গেলেই প্রথমে নবাবের বেডি কইয়া গাইল দিবো, পরে কইবো আচোদা কথা।
ফজু মিয়ার কপাল ফুইলা একটা আলুর মতো উঠছে। বাইরে ছেড়িরা সমানে গাইল্যাইতাছে। চকিতে শুয়া মনে মনে হিসাবের সময় আইসা ইটের চাক্কাডা কপালে আইয়া লাগলো। বারিন্দায় হারুন আর বিল্লাল দাঁত কেলাইতাছে। শ্যামলীর বকাবাজি আর নাচনকোঁদনে হেরা মজা লইতাছে উল্টা।
ওই বান্দির পুতেরা, তগোরে তর মায়ের জায়গা দিয়া ভইরা দিমু। কলঘরের দিকে চাইয়া কী দ্যাহস?
ওই ফৌজ্জা বান্দির পুত, বাইর হ কইলাম!
ফজু মিয়া কপালের আলু চাপ দিয়া ধইরা বারিন্দায় আইসা হারুন আর বিল্লালরে গাইল দেয় কয়ডা। সকালে শান্তিমতো ঘুমানের কায়দা নাই, আল্লার তিরিশডা দিন কাউ কাউ। আজকা ছেমড়িগুলি চাকায়া কপালডার এই দশা করলো। এই নার্গিসের মা একটা খচ্চর বেডি। ছাপরা বানায়া কতডি জুয়ান ছেড়ি ভাড়া দিয়া থুইছে। এক্কেরে উদাইম্যা কলঘর, ভাঙা টিনের বেড়া। এই বারিন্দায় খাড়াইলে পষ্ট দেহা যায় সব।
হেয় নিজেও ভুলে দুইচাইরবার দেইখ্যা, আর অরা তো জুয়ান পোলা। বিয়ার দুই বছরের মাথায় বউ মরছে তার, বিয়াশাদি আর করে নাই সে। তয় এইডা ঠিক, মাইয়া লোকের লিগা আর কুনো মায়ামহব্বত আর তার দিলে নাইগা। একবছর আগে লেংটা শাহীর মাজারে কাকলীর লগে ভাব হইছিলো, কাকলী আইছিলো সিরাজগঞ্জ থেকা। মুর্শিদী গানের কী গলা আছিলো মাগীর। পিরীত কইরা ধরা খাইলো এই বয়সে, মাগী ফজু মিয়ার সব টেকা লইয়া উধাও। সেই কাকলী তারে জড়ায়া ধইরা `মনো রে...` কইয়া টান দিতো, আর কইতো, ও বুইড়া, তনুরার মাঝে মনুরার খেলা দেখবা?
আপসোস সেই খেলা আর দেখতে পারে নাই সে। ভালোই হইছে, বেঈমানের জাত এগুলি।
বারিন্দা থিকা ফজু মিয়া শ্যামলীরে থামতে কয়, ছেমড়ি উডানে ভিজা শরীলে খাড়ায়া কুদতাছে আর চাক্কা মারতাছে এইদিকে। পারভেজের কম্পিউটারে আইসা ঢিল পড়ছে, ছেড়া বেক্কল হইয়া বইয়া রইছে। এই ম্যাছের সবচে ভদ্র পোলা পারভেজ, তয় অর মাথা ঠিক নাই। পত্যেক শুক্কুরবার সে কম্পিউটারে ছবি ছাড়ে, ব্যাকতেরে ডাইকা নেয়। সেই ছবির আগামাথা কিছুই নাই। ফজুমিয়া কয়বার কইছে, সাপের ছবি হইলে সে দেখতে রাজি। এই পোলা একদিনও একটা সাপের ছবি দেহাইলো তো না-ই, উল্টা ইচ্ছাধারী নাগিন নিয়া উল্টাপাল্টা কয়।
ফজু ভাই, এই যে আপনে সাপের ছবি দেখেন, এইডা যৌনবিকৃতি।
কিয়ের বিকৃতি?
ফজু ভাই, কিছু মনে নিয়েন না। আমাদের বাসায় একটা কামলা, নাম রুহুল, সে রাত হইলে বউ রাইখা গোয়ালে ঢুকতো। সুযোগ মতো বরকীরে...। আপনেও কিন্তু একই জিনিস। আপনে বরকীর বদলে সাপ!
পারভেজ, সারাদিন পড়তে পড়তে তোমার মাথা ফট্টিনাইন হইয়া গেছে গা।
না ভাইজান, এই যে সাপের সিনেমা, এইখানে সাপের জায়গায় বরকী ফিট কইরা ভাইবা দেখেন। ধরেন পূর্ণিমারাইতে সেই বরকীটা সুন্দরী মাইয়া হইয়া যায়।
চুপ্ থাক্ ছাগল।
পারভেজ আসলেই ছাগল। সারাদিন মোডা মোডা বই, রাস্তায় গেলে পোস্টার, পুরান পেপার, পইড়া থাকা ঠোঙ্গাও পড়ে। কিন্তু, ভাড়াডা এক তারিখে দেয়, এইডা ঠিক থাকলেই হইলো। ফজু মিয়ার ভাড়া পাওন দিয়া কথা।
পারভেজ, কম্পিউটার ভাংছে?
না, ভাই। তবে ভাংতে পারতো।
তইলে মাথায় হাত দিয়া রাখছো ক্যা?
ফজু ভাই, প্রবাবিলিটি নিয়া ভাবতাছি। কতো ডিগ্রী এ্যাঙ্গেলে ঢিলটা আসলে ভাংতে পারতো।
ধুর ছেড়া!
ফজু মিয়া তাড়াতাড়ি নীচে নামে।কপালডা টাটাইতাছে। গলির মোড়ের দোকানে ফ্রিজে বরফ থাকনের কথা।
হীরার দোকানে পাঁচশ টাকার নোট হাতে নিয়া দাঁড়ায়া আছে বিলকিস, ভাংতি নাই। ফজু মিয়া কপালে ভিজা গামছা চাপ দিয়া ধইরা হেইলা দুইলা এইদিকেই আইতাছে।
আপনের কপালে লাগছে? দেহি দেহি! আপনেও কলঘরে চুকি মাইরা দেহেন নি, ফজু ভাই?
ও হীরা, একটা দুইটাইক্যা আইসক্রিম দে -- কয় ফজু মিয়া। বিলকিসের কথা শুইনা শরমে পইড়া যায় সে।সেলাই কামের সবগুলান মাইয়ার থেকা বিলকিস অন্য পদের। ফজু মিয়ারে সে আড়ে আড়ে দেহে, কিন্তু কথা কয়না। আইজই সাইধা কথা কইতাছে। ফজুমিয়া হা কইরা বিলকিসরে দেহে, বাম গালে একটা খয়ারী মাশা। এমন একখান মাশা আছিলো দাদীর পিডে। ছোডোকালে সেই মাশা চুইতে চুইতে ঘুমাইয়া পড়তো ফজু মিয়া।
ভর দুফুর। ফজুর হাতপাও নিশপিশ করতাছে । দেড়টা বাজে, এই টাইমে বিলকিস কলঘরে ঢুকে। মাইয়াডা ছোবা দিয়া ডইলা শইলে এত্তা ফেনা তুলে। পুরাডা কাপড় খুলেনা। তারপরেও ফজু মিয়া আন্দাজ করতে পারে। চোখ মুইঞ্জা সব দেখতে পায় সে। কপাটের চিপায় খাড়ায়া কাঁপতে থাকে, একটা সময় আর টিকতে পারেনা-- চকিতে আইয়া পড়ে।
বিলকিসের চিন্তা করতে করতে তার কানের লতি ইস্তক গরম হয়া যায়। জানে, কাজটা খারাপ হইতাছে। তার বয়স হইছে ছিচল্লিস। এতোদিন তো মনেরে লাগাম দিতে পারছে, এহন পারতাছেনা কেন কেডা জানে!শইলের কোনো অঙ্গই তার কথা শুনেনা।এই যে হাত, এই হাতটাও বেঈমান হইয়া উঠতাছে দিনকে দিন।
বিলকিসের মনডা খচখচ করতাছে। কই গেল লোকটা! বিলকিসের মাথা ঠিক আছিলোনা সেইদিন, সারা শরীলের জোর খাটায়া একটা চটকানা লাগাইছিলো ফজু মিয়ারে। কীই বা করনের আছিলো তার। এমন একটা বেডা যদি ফুচকি মাইরা গোসল করা দেহে, কেমনডা লাগে! ফজুরে তো ভালোই মনে হইছিলো, বউমরা সাদাসিদা।
বিলকিস গামছা নিয়া কলঘরে ঢুকে, দোতালায় চাইয়া দেহে একবার। জানালাগুলি বন্ধ। এইসুম ম্যাছে কেউ থাকে না। ইচ্ছা করলেই সে এহন উদাম হয়া গোসল করতে পারে, কিন্তু মন চায় না।ফজু মিয়ার লেগা মনডা টাটায়। মাথায়, শরীলে সাবান না দিয়াই পানি ঢালে। ঘরে আইসা কোনোমতে জামা পাল্টায়া রওনা দেয় অফিসে। মনে একটা কথাই ঘুরপাক খায়, কই গেলো মানুষটা!
এক সপ্তা পরের ঘটনা। ফজু মিয়া গলির রাস্তায় বহা। আজকা নতুন একটা লাল টুলে বইয়া নাভিতে, পিডে তেল মালিশ করতাছে। বিলকিসের বুক চিলিক দিয়া উডে।
কই গেছিলেনগা আপনে? কথা কন। কই গেছিলেন? আমার ভুল হইছে, আমার হাত লাড়া ঠিক হয় নাই।
আরে, বিলকিস এমন করতাছো কে? চোখ মোছো।গজাইরা গেছিলাম, ক্যান পারভেজ কিছু কয় নাই?আমার দাদী মরছে, মাডি দিয়া আইলাম বেডিরে। একশ পাঁচ বছর হায়াত পাইলো বুড়ি।
বিলকিস নিজেরে সামলায়া সামনের দিকে আউগায়। পিছন পিছন ফজু মিয়া ছায়ার মতো আইতে থাকে।
কলঘরে ঢুইকাই বিলকিস দোতালায় চাইয়া দেহে একবার। হ, ফজু মিয়া খাড়ায়া। বিলকিস একটানে কামিজ খুলে। ব্রা খুইলা বেড়ার উপর ঝুলায়া দিয়া, মগে মগে পানি ঢালতে থাকে শরীলে। কতোকাল পর এইরম উদাম হইলো সে। মন চাইতাছে ফজু মিয়ারে ডাইকা পিঠখান মাজায়া লইতে।আরো কত্তাকিছু ভাবতে গিয়া কুড়কুড়ায়া হাইসা উঠে বিলকিস!