কলকাতার কত রঙ্গ এবং বাবু সংস্কৃতি

পর্ব ২

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : জুন ১৪, ২০২১

বাবু সম্পর্ক চমৎকার সব কথা লিখেছেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। বাবু মাত্রেই ধনী কিন্তু ধনী হলেই বাবু হয় না। রামদুলাল সরকারের টাকা ছিল কিন্তু বাবু হননি। তিনি অতি দরিদ্র থেকে বাংলার শ্রেষ্ঠ ধনী হয়েছিলেন। খুবসাধারণ জীবন যাপন করতেন। রামদুলাল দুবেলা নিরামিষ খেতেন। দুপুর বেলা ভাত দুধ আর দু-একটি মিঠাই আর রাতে আটার রুটি। খুব সাধারণ পোষাক পড়তেন। নিজের ছেলের বিয়েতে তিনি শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কয়েকদিনের জন্য একজন প্রহরীকে নিয়োগ দেন। সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যেস্ত রামদুলাল সাধারণ বেশে বিবাহ সংক্রান্ত কাজ দেখাশুনা করতে গিয়ে কাজ শেষে পুনরায় গৃহে প্রবেশ করতে চাইলে প্রহরীটি রামদুলালকে চিনতে না পেরে পথরোধ করে। কারণ ধনী লোকদের জীবন যাপন এতো সাধারণ হতে পারে প্রহরীটি ভাবতেই পারেনি। সাধাসিধা জীবনযাত্রায় অভ্যেস্ত মানুষ ‘বাবু’ হতে পারে না। রামদুলালের মতো বাংলার সবচেয়ে ধনী মানুষটিকে তাই তাঁর বাড়ির ভাড়াটে প্রহরী বাবু বলে চিনতে পারলো না।

বাবু হতে গেলে কুকুরের বিয়েতে লাখ টাকা খরচ করা, চার ঘোড়ার গাড়ি চড়ে ভেঁপু বাজিয়ে স্নান করতে যাওয়া, দু-একটি রাঁড় রাখা, রক্ষিতাদের দালান কোটা করে দেওয়া, পায়রা ওড়ানো, বিদ্যাসুন্দরের আসর বসানো, শনিবারের রাতে বাঈ বেশ্যা নিয়ে আসর বসানো ইত্যাদি করতে হয়। বহু বাবু পাল্লা দিয়ে লোক দেখানো এসব করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন। মোট কথা বাবু শুধু ভোগ করতে চান না, খ্যাতি চান; সকলের সাথে টাকা ওড়ানোর প্রতিযোগিতা করে সবার উপরে থাকতে চান। কলকাতার বিখ্যাত আট বাবু ছিলেন এর মধ্যে অগ্রগণ্য। কলকাতার আটবাবুর মধ্যে ছিলেন নীলমনি হালদার, রামতনু দত্ত, গোকুল চন্দ্র মিত্র, রাজা রাজকৃষ্ণ, কালীপ্রসন্ন সিংহের পূর্বপুরুষ ছাতু সিংহ, দর্পনারায়ণ ঠাকুর, রাজা সুখময় রায় এবং চোরাবাগান মিত্র বংশের এক বাবু; এঁরাই ছিলেন আটবাবু। পরবর্তীকালে নামডাক সম্পন্ন আরো বাবু এসছিলেন কিন্তু উপরে উল্লিখিত আটবাবুই হলেন ‘কলিকাতার প্রথম বাবু’।

সিরাজদৌলার বিরুদ্ধে পলাশির যুদ্ধে ইংরেজদের সাহায্য করার পুরস্কার হিসেবে নবকৃষ্ণ দেব পান প্রভুত ধনসম্পত্তি, জমি ও মহারাজা উপাধি। স্বল্পকালের মধ্যেই উত্তর কলকাতার শোভাবাজারে প্রাসাদোপম ভদ্রাসন ও দুর্গাপূজার উপযোগী বিশাল ঠাকুর দালান তৈরি করে দুর্গা পূজা আরম্ভ করে মহারাজ কৃষ্ণদেব। প্রধানত ক্লাইভ ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের আপ্যায়নের জন্যই নবকৃষ্ণের এই দুর্গাপূজার আয়োজন। ইংরেজদের খেতাবধারী মহারাজা নবকৃষ্ণ তাঁর এক বন্ধুকে লিখেছিলেন, ‘এবার পূজার সময় লর্ড ক্লাইভ আমার বাটিতে অনুগ্রহপূর্বক প্রতিমা দর্শন করিতে অসিবেন। তাঁহার সহিত কোম্পানির বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত থাকিবেন।’ নবকৃষ্ণের বাড়িতে ইংরেজ সাহেবরা দুর্গাপূজা দেখতে আসবে বলে সকাল থেকে চিৎপুরে রাস্তায় লোক চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল পুলিশ। দুর্গোৎসব তখন ধনীদের টাকা উড়াবার, নিজের প্রচার ও বিলাসিতা করবার জায়গা হয়ে দাঁড়ালো। এই পূজাকে কেন্দ্র করে কলকাতার নব্য ধনীদের বিপুল অর্থব্যয় ও আমোদপ্রমোদের রাস্তা দেখায় নবকৃষ্ণ। এরপর থেকেই দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে মুদ্রিত নিমন্ত্রণপত্র পাঠানো, বাঈজীদের নাচের আসর বসানো, মদ্যপানসহ ইংরেজী খানার প্রচলন শুরু হয়।

দ্বারকানাথ ও অন্যান্যরা তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন। সন্দেহ নেই দ্বারকানাথ সেখানে অনেকটা ব্যতিক্রমীও ছিলেন। দুর্গোৎসব শেষপর্যন্ত ব্রিটিশ যুগের নয়া কলকাতা সংস্কৃতির একটা প্রধান অঙ্গ হয়ে উঠলো। শোভাবাজারের দুর্গাপুজো একদিকে যেমন কলকাতায় বাবু সংস্কৃতির জন্ম দেয়, তেমনি পাশাপাশি দুর্গাপূজাকে ধীরে ধীরে বাংলার সেরা উৎসবে পরিণত করতে সাহায্য করে। বিনয় ঘোষ জানান, এই সময় শুধু দুর্গোৎসবে কলকাতার ধনী বাঙালীরা যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে তাতে বর্তমান সময়ের তিনটি পঞ্চবার্ষিক শিল্প পরিকল্পনার ব্যয় সঙ্কুলান করা যায়। কলকাতায় বিত্তবান লোকের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে দুর্গাপূজার সংখ্যাও। এসব দুর্গাপূজার অধিকাংশেরই মূল উদ্দেশ্য ছিল বিত্ত ও প্রাচুর্য প্রদর্শন এবং পূজা উপলক্ষ্যে আমোদপ্রমোদের আয়োজন করে ইংরেজ রাজপুরুষদের তোষণ। শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজো শুরু হওয়ার সময়ে অথবা পরবর্তীকালে আঠারো শতকে কলকাতায় এই ধরনের যে দুর্গাপূজাগুলো আরম্ভ হয় তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, জোড়াসাঁকোর দাঁ বাড়ি ও দর্জিপাড়ার জয়রাম মিত্রের বাড়ি, দক্ষিণ কলকাতার চক্রবাড়িয়া সড়কের মিত্র বাড়ি, উত্তর কলকাতার বিডন স্ট্রিটের ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাড়ি, খিদিরপুরের ভূ-কৈলাশ রাজবাড়ি, মধ্য কলকাতার রানী রাসমণির বাড়ি।  

দুর্গাপূজা ছিল বাবুদের সবচেয়ে জমকালো উৎসব। সাহেবরাও এই উৎসবে যোগদান করার জন্য সবসময়ই আমন্ত্রিত হতেন এবং উৎসবের কর্তারাও নানারকম ফলমূল দিয়ে তাদের অভ্যর্থনা করতেন। উৎসবকালে প্রতি সন্ধ্যায় নাচগানের ব্যবস্থা করা হতো। দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে আয়োজিত আমোদপ্রমোদাদি অনুষ্ঠানে ইংরেজ রাজপুরুষ ও অভিজাত সাহেব মেমসাহেবদের অবাধ উপস্থিতি ঔপনিবেশিক স্বার্থের পরিপন্থি বিবেচনা করে ইংরেজ সরকার আঠারশো চল্লিশ সালে দশ নম্বরি আইন চালু করে ইংরেজদের দেশীয়দের পূজা-পার্বণে যাওয়া নিষিদ্ধ করে দেয়। কলকাতার ব্রিটিশ জমিদার ও ব্রিটিশের তৈরি দেশী তালুকদাররা আঠারো শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে দুর্গোৎসবের রূপ বদলে দিচ্ছিলো। বদলাবার প্রধান স্থান হলো ব্রিটিশদের নতুন রাজধানী কলকাতা শহর। দুর্গাপূজায় এলে এক বাবু আর এক বাবুর সাথে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়তেন। সেই কলকাতার এখন শ্রেষ্ঠ উৎসবে পরিণত হয়েছে দুর্গাপূজা।

ইংরেজদের চাকরি করে বা সেবা করে সেকালে ‘বাবু’রা নিজেদের সামাজিক অবস্থা ফিরিয়ে ছিল। ঠাকুর পরিবারের একাধিক সদস্য রীতিমতো ধনী হয়েছিলেন। রামমোহন রায়ও একসময়ে ইংরেজদের কেরানী ছিলেন। যারা সরাসরি ইংরেজদের কেরানী ছিলেন না কিন্তু নতুন কলকাতায় কেরানীর কাজ করতে আরম্ভ করে, তারাও বিলক্ষণ তাদের আর্থিক অবস্থা উন্নত করতে পেরেছিলেন। কোম্পানীর মুন্শীদের তখন সবচেয়ে কম বেতন ছিল পঁচিশ টাকা। আর ইংরেজী জানা বাবু হলে তারচেয়ে অনেক বেশি। সেকালে এই অর্থ দিয়ে অল্পকালের মধ্যে ধনী হওয়া শক্ত ছিল না। ইংরেজী বিদ্যা দিয়ে উপার্জনের এমন প্রশস্ত রাস্তা দেখে কলকাতায় তখন ইংরেজী শেখার হুজুগ তৈরি হয়েছিল। ইংরেজদের বর্ণনায় দেখা যায়, দেশীয়দের মধ্যে ইংরেজী শেখার উন্মাদনা ছিল এতোই প্রবল যে রাস্তায় রাস্তায় তারা ইংরেজদের পিছু নিতো। এমনকি চলতি পথে তারা ইংরেজদের পালকির দরজাগুলো খুলে ফেলতো এবং করুণ কাকুতি ভরা দৃষ্টিতে ইংরেজী শেখানোর জন্য এমন অনুনয় করতো যে পাষাণ-হৃদয়ও গলে যায়। কাতর বিলাপের সুরে তারা নিজেদের অজ্ঞানতা ব্যক্ত করতো। তাদের চাই ইংরেজী পাঠ বা ইংরেজী বিদ্যা।

ইংরেজদের সেবা করার ব্যাপারে চালবাজ এবং চালাক-চতুর বাঙালীদের মধ্যে ধুম পড়ে গেল। জাতিতে যাঁরা ব্রাহ্মণ ছিলেন তাঁদের কেউ কেউ ম্লেচ্ছ ইংরেজদের অধীনে দিনভর কাজ বিষয়কর্ম সম্পাদন করে বিকেলে কার্যালয় থেকে বাড়ি ফিরে স্বদেশীদের মধ্যে ব্রাহ্মণের গৌরব ও আধিপত্য রক্ষা উদ্দেশ্যে স্নানাহ্নিক করতো এবং এভাবে দোষমুক্ত হয়ে ‘দিবসের অষ্টমভাগে’ খাদ্যাদি গ্রহণ করতো।  যাঁরা ইংরেজদের শাসক হিসেবে আবিষ্কার করে নিজেদের জীবনকে ইংরেজদের সান্নিধ্যে আলোকিত করবেন বলে প্রত্যাশা করেছিলেন, তারা ইংরেজদের একান্ত সান্নিধ্যে ব্যক্তিগত বাসনায় জনসমষ্টি থেকে হলেন বিচ্ছিন্ন, অনন্বিত। বিনয় ঘোষ লিখেছিলেন, ’ব্রিটিশ আমলের নতুন জমিদার, তালুকদার ও পত্তনিদার এবং হঠাৎ গজিয়ে-ওঠা বিত্তবান ‘জেণ্টুরা’ কলকাতা শহরে বা আশেপাশে গ্রামাঞ্চলে নতুন যে জোয়ার আনার চেষ্টা করেছিলো সেটা আসলে স্বাভাবিক জোয়ার নয়, অস্বাভাবিক একটা বন্যা, একটা তরঙ্গোচ্ছ্বাস, পাঁক ও আবর্জনাই ছিল তার মধ্যে বেশি। উচ্ছ্বাসের বুদবুদ মিলিয়ে যাবার পর সেই আবর্জনার তলানি জমতে খুব বেশি সময় লাগেনি।’

সত্যিকার অর্থে সেদিনের কলকাতা নিয়ে বর্তমানে লেখার অন্যতম সমস্যা হলো, সেকালের বহু বাংলা শব্দ আজ হারিয়ে গেছে আর ব্যবহার হয় না। হুতোম প্যাচার নক্শা-র একজায়গায় ‘মিথ্যেবাদী বব্বলের জাত’ কথাটা আছে। বব্বলে বা বাব্লে বা বাব্বুলিয়া শব্দের অর্থ হলো যারা আদালতে মিথ্যা সাক্ষী দেয়। শুধু সাক্ষী দেওয়াই নয়, বনেদী সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাড়ি বাড়ি গিয়ে এরা শরিকদের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে মামলা করার উস্কানি দিতো। ভাইয়ে ভাইয়ে গৃহ-বিবাদ লাগাতে এরা ছিল অদ্বিতীয়। মামলা লাগিয়ে সাক্ষী সেজে এরা বেশ দু-পয়সা কামিয়ে নিতো।  কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখছেন, ’দাললের কখনও অব্যাহতি নাই। দালাল সকালে না খেয়েই বেরিয়েছে। হাতে কাজ কিছু নাই, অথচ যে রকমে হোক্ না, চোটাখোর বেণের ঘরে ও টাকাওয়ালা বাবুদের বাড়ীতে একবার যেতেই হবে। ‘কার বাড়ী বিক্রী হবে,” “কার বাগানের দরকার,” “কে টাকা ধার করবে,” তারই খবর রাখা দালালের প্রধান কাজ, অনেক চোটাখোর বেণে ও ব্যাভার-বেণে সহুরে বাবু দালাল চাকর রেখে থাকেন; দালালেরা শিকার ধ’রে আনে, বাবুরা আড়ে গেলেন।’

হুতোম প্যাঁচার নক্সায় মন্তব্য করা হচ্ছে, ‘দালালের কাজটা ভাল, “নেপো মারে দইয়ের মতন” এতে বিলক্ষণ গুড় আছে। অনেক ভদ্রলোক ছেলেকে গাড়ী-ঘোড়ায় চ’ড়ে দালালী কত্তে দেখা যায়; অনেক ‘রেস্তহীন মুচ্ছুদি’ চার বার ‘ইন্সলভেন্ট’ নিয়ে এখন দালালী ধরেছেন। অনেক পদ্মলোচন দালালীর দৌলতে “কলাগেছে থাম” ফেঁদে ফেল্লেন। এঁরা বর্ণচোরা আর এঁদের চেনা ভার, না পারেন, হেন কর্ম্মই নাই।’  অনেক পাড়াগেঁয়ে জমিদার ও রাজারা মধ্যে মধ্যে কলিকাতায় পদার্পণ ক’রে থাকেন। এঁদের অনেকেরই ঘাগিগোচের পাল্লায় পড়ে শেষে সর্ব্বস্বান্ত হয়ে বাড়ী যেতে হয়। পাড়াগেঁয়ে দুই এক জন জমিদার প্রায় বারো মাস এইখানেই কাটান; দুপুরবেলা ফেটিং গাড়ী চড়া, গলায় মুক্তোর মালা; দেখলেই চেনা যায়, ইনি একজন বনগাঁর শিয়াল রাজা, বুদ্ধিতে কাশ্মিরী গাধার বেহদ্দ; বিদ্যায় মূর্ত্তিমান মা। বিসর্জন, বারোইয়ারি, খ্যামটা-নাচ আর ঝুমুরের প্রধান ভক্ত। পাড়াগেঁয়ে এই সব বড় মানুষ সহরে এলেই প্রথমে দালালের পাল্লায় পড়েন। ধনী বাবুটির হয়ে দালাল বাড়ী ভাড়া করা, খ্যামটা নাচের বায়না করা প্রভৃতি রকমওয়ারি কাজের ভার পান; দালালরা বাবুদের কলিকাতা সহরের নানান জায়গা দেখিয়ে বেড়ান; সেই সাথে দুই এক নামজাদা বেশ্যার বাড়ী। ঝোপ বুঝে কোপ ফেলতে পারলে দালালের বাবুর কাছে বিলক্ষণ প্রতিপত্তি হয়ে পড়ে। কিছুকাল বড় আমোদ যায়, শেষে বাবু টাকার টানাটানিতে বা কর্ম্মান্তরে দেশে গেলে দালালটির ততদিনে ভাগ্য খুলে যায়। চলবে