আলোকচিত্রঃ এস এম শাহরুখ পিকলু

আলোকচিত্রঃ এস এম শাহরুখ পিকলু

কলকাতার এম্বাসেডর

এস এম শাহরুখ পিকলু

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৬, ২০১৮

কলকাতার ঐতিহ্যের শেষ নেই। সংস্কৃতিগত ঐতিহ্য তো আছেই সঙে আছে সারা শহরজুড়ে বিভিন্ন ল্যান্ডমার্ক, যেগুলোর নাম দুই বাংলার মানুষের মুখে মুখে শোনা গেছে, যাচ্ছে বছরের পর বছর, থাকবে চিরকাল। হাওড়ার ব্রিজ, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, রাইটার্স বিল্ডিং, বিশাল রাজভবন, ইডেন গার্ডেনস, আলীপুর চিড়িয়াখানা, বিড়লা প্ল্যানেটারিয়াম, ফোর্ট উইলিয়াম, একের পর এক অনেক পুরোনো চার্চ, আরো কত কত, ব`লে/লিখে তা শেষ হবে না।

 

আমার কলকাতায় আসা শুরু স্বাধীনতার পর, ১৯৭৪ সনে প্রথম, মাত্র নয়-দশ বছরের বালক, স্বাধীনতাযুদ্ধের অনেক ক্ষত ম`নে গেঁথে তখনও দগদগে হ`য়ে আছে। এরপর বেশ কয়েকবার এসেছি কিন্তু গত তিরিশ বছরে আর আসা হয়নি। এবারে এসে দেখলাম যে, কলকাতার বিখ্যাত এম্বাসেডর ট্যাক্সি সব ঝকঝকে হলুদ হ`য়ে গেছে। বাইরে ঝকঝক ক`রলেও এগুলো সেই আমার চিরচেনা এম্বাসেডরইই বটে- গাড়ির দরজা খুলতে নারাজ, আবার একবার খুললে বন্ধ হ`তে চায় না, জানালার কাচ উঠানো-নামানো তাও কম ঝক্কি না। ইঞ্জিন আগের মতই মুমূর্ষু রোগীর মতো শব্দ ক`রে, গিয়ার বক্স অনেকটা পোষা বেড়ালের মতো, কে কাকে পুষছে তা বোঝা দায়, ড্রাইভারের ক্রমাগত যুদ্ধ এই খামখেয়ালি গিয়ারকে আয়ত্তে আনতে, সে যুদ্ধে কোন নিশ্চিত বিজয়ী নেই কখনো।

 

এম্বাসেডর গাড়ির নির্মতা হিন্দুস্তান মটরস ২০১৪ সাল থেকে এই গাড়িগুলোর উৎপাদন বন্ধ ক`রে দিয়েছে। একদা `কিং অফ দ্য রোড` খ্যাত এম্বাসেডর সেই ১৯৫৮ সাল থেকে তৈরি হ`য়ে আসছিলো, মরিস অক্সফোর্ড সিরিজ থ্রি-এর আদলে ডিজাইন করা এই গাড়ি মরিস তথা সাহেবি `গন্ধ` ঝেড়ে নিজের নিজত্বেই ইতিহাসে স্থান ক`রে নিয়েছে। আমি এম্বাসেডর ট্যাক্সি ছাড়া কলকাতাকে কল্পনাই ক`রতে পারি না।

 

এবারে কলকাতায় প্রথম মেট্রো দেখলাম, সঙে সারি সারি বাস, আর নতুন গজিয়ে ওঠা উবার, আগের ট্রামও আছে। উবারের ড্রাইভারদের বেশ ডাঁট, তারা এম্বাসেডরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, কেমন যেন ঐ ট্যাক্সিগুলোকে অস্পৃশ্য ভাবে। ব্যাপারটা মূলত অর্থনৈতিক - রাস্তার অধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব, যার সঙে জড়িয়ে আছে দুই ধরনের যানেরই ভবিষ্যত, উন্নতি, অস্তিত্ব।

নানাজনের নানা মত। কথা ব`লে বিভিন্ন তথ্য পেলাম, সঠিকটা জানা নেই। কেউ কেউ বলে এখনও এক লাখ হলুদ এম্বাসেডর ট্যাক্সি চলছে, কেউ বলে আরো কম, পাঁচ হাজারও ব`লেছে একজন, যা মোটেই ঠিক নয়। তবে এম্বাসেডরের দিন ফুরিয়ে আসছে।

এখন c, d, e, f এই চার সিরিজের গাড়িগুলো চ`লছে। এক এক সিরিজে নাকি দশ হাজার গাড়ি থাকার কথা, তাতে চল্লিশ হাজার হ`য়ে যায়। কিন্তু সঠিক সংখ্যা বোধ হয় কারোর জানা নেই। তবে সারা কলকাতাজজুড়ে এই হলুদের ছড়াছড়ি এখনো।

 

ছবিতে যে ট্যাক্সিটা দেখছেন তা চালায় দীনেশ গুপ্ত, বয়স হবে মধ্য তিরিশ বা কিছু বেশি। তাকে নেমে আমার সাথে ছবি তুলতে বলেছিলাম কিন্তু সে নামেনি, পুলিশ তার গাড়িকে কেস দিয়ে দেবে। কলকাতার ট্যাক্সিচালকরা আইনের লম্বা হাতের ভয়ে সদা তটস্থ থাকে। তো তার গাড়িতে ইডেন গার্ডেনস পর্যন্ত আসতে আসতে কথা হচ্ছিলো। তাকে জিগ্যেস করলাম আর কতদিন, আয়ু, হলুদের? জানালো, কিছুটা বিমর্ষ হ`য়ে, ৭/৮ বছর। অন্য অনেকে ব`লেছে দশ/বারো। তা, দীনেশকে জিগ্যেস করলাম যে, গাড়ির পার্টস পেতে ঝামেলা হয় কিনা। হয়না ব`লে জানালো, তা ছাড়া দরকারে পুরোনো গাড়ি থেকে এটা ওটা খুলে লাগায়, অসুবিধা হয় না। আমি ভাবলাম, অসুবিধা হবে, পুরোনো গাড়ির সংখ্যা তো অসীম না, নতুনের ধাক্কায় একদিন পথ ক`রে দিতেই হবে। কিছুই অসীম না, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আর মানুষের দু:খ ছাড়া।

আমার কাছে এম্বাসেডর হলুদ ট্যাক্সি কলকাতার অবিচ্ছেদ্য অংশ, এর ঐতিহ্যের ভাগিদার। এর সম্পূর্ণ অপসারণ হয়তো অবিধারিত, কালের স্রোতে, কিন্তু তা বড্ড বেদনাদায়ক হবে, অন্তত আমার বয়সী মানুষদের কাছে। নতুনেরা হয়তো এখনই একে কটাক্ষ ক`রে `জালোপি` ডাকে। লক্কড়ঝক্কড় হ`লেও, ওতে চড়ে একেক সময়ে মহাবিরক্ত হ`লেও, ড্রাইভারদের চালাকির শিকার হ`য়েও আমার এম্বাসেডরের প্রতি একটা মায়া আছে, তা বেশ অনুভব করলাম। যদি আয়ুতে কুলায় হয়তো আজ থেকে দশ বছর পরে এই শহরে এসে একটাও হলুদ এম্বাসেডর ট্যাক্সি দেখবো না, আবার হয়তো রাস্তার হাজারো রঙের মাঝে হঠাৎ ছিটেফোঁটা হলুদের দেখা পাবো, তাতে হয়তো চড়ে বসবো। কালের সাক্ষীর মত বুড়ো গাড়ি, বুড়ো ট্যাক্সিচালক, বুড়ো আমি।