করোনা ভাইরাস ভ্যাকসিনের পরীক্ষা এবং প্রতিযোগিতা
অপূর্ব চৌধুরীপ্রকাশিত : মে ০২, ২০২০
ক`দিন আগে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন ChAdOx1 nCoV-19 এর কথা লিখেছিলাম। নতুন করোনা ভাইরাস SARS-CoV-2 এর বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন যুদ্ধে এই নতুন ভ্যাকসিনটি নিয়ে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন গ্রূপ এবং জেনার ভ্যাকসিন গ্রূপের Jenner Institute যৌথ ভাবে কাজ শুরু করেছিল জানুয়ারির ২০। এরপর প্রথম ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করেছিল ২৩ এপ্রিল। এই জেনার ইনস্টিটিউট প্রথম ভ্যাকসিন আবিস্কারক Dr. Edward Jenner এর নাম থেকে নেয়া। ১৭৯৬ সালে ব্রিটিশ এই ডাক্তার প্রথম স্মল পক্সের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হয়তো একটি দুটি ভ্যাকসিন নিয়ে কথা হচ্ছে। প্রায় একশোটির বেশি প্রতিষ্ঠান করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করছে এই মুহূর্তে। এদের মধ্যে আমেরিকান National Institutes of Health (NIH) নয়টি ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানে প্রায় দুই বিলিয়ন ফান্ড যোগানের ব্যবস্থা করেছে। ব্রিটিশ সরকার এরকম চারটি প্রতিষ্ঠানকে দুশো মিলিয়ন পাউন্ড সহায়তা দিয়েছে ভ্যাকসিন বের করতে। সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে আধা বিলিয়নের মতো ভ্যাকসিন পরীক্ষায় ফান্ড তৈরি করা হয়েছে। কানাডা প্রায় এক বিলিয়নের উপর বিনিয়োগ করেছে ভ্যাকসিন আবিষ্কারে। অস্ট্রেলিয়া, জাপান, জার্মানি, চায়না, ফ্রান্স— কেউ এই ভ্যাকসিন প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই। জিও পলিটিক্সে এ নিয়ে আড়ালেও খেলা হচ্ছে কিছু। বিশ্বে যে এই মুহূর্তে প্রথম বের করবে, বিশ্ব তার দিকে ঝুঁকবে। চীন ও আমেরিকার মধ্যে সে মানসিক যুদ্ধ অলরেডি শুরু হয়ে গেছে। বিশ্বকে রক্ষা করতে এই কাজের চেয়ে বড় জরুরি আর কিছু নেই। আর আমাদের দেশের লোকেরা থানকুনি পাতার মুঠো কিংবা মধু কালা জিরার মধ্যে ভ্যাকসিন খুঁজে বেড়াচ্ছে!
প্রায় সাতটি প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে শক্তিশালী ভ্যাকসিন তৈরিতে কাজ করছে। এই পদ্ধতিতে সরাসরি করোনা ভাইরাসটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ল্যাবে ভাইরাসটি আলাদা করে তার ভিতরের কিছু উপাদান কৃত্রিম ভাবে সরিয়ে দুর্বল বা মৃত করে ভ্যাকসিনটি বানানো হয়। এই পদ্ধতিতে তৈরি ভ্যাকসিনকে বলে Inactivated vaccine। তবে এই পদ্ধতি সবচেয়ে কঠিন, সময়সাপেক্ষ, রিস্কি কিন্তু শক্তিশালী। measles, polio ভ্যাকসিন এমন ধরনের ভ্যাকসিন। চীনের Sinovac Biotech এই ভ্যাকসিন তৈরিতে সবচেয়ে এগিয়ে। ২৫ টি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে Vector ভ্যাকসিন নিয়ে। এই পদ্ধতিকে বলে Recombinant Vector। ল্যাবে Adenovirus জাতের ভাইরাসের দেহে প্রোটিনের পরিবর্তন করে টার্গেট এন্টিবডি তৈরিতে শরীরকে উদীপ্ত করে। অক্সফোর্ডের ChAdOx1 nCoV-19 ভ্যাকসিনটি এই পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়েছে।
২০টি প্রতিষ্ঠান Nucleic-acid vaccines নিয়ে কাজ করছে। পদ্ধতিতে করোনা ভাইরাসের RNA এর জেনেটিক কোডটি সরাসরি ঢুকিয়ে দেয়া। বাদবাকি পঞ্চাশটির বেশি Protein-based vaccines। এই প্রোটিন ভ্যাকসিনে করোনা ভাইরাসের চারপাশে থাকা প্রোটিন আবরণের রাসায়নিক উপাদান ঢুকিয়ে দিয়ে ভ্যাকসিনটি বানানো হয়। বিশ্বের ভ্যাকসিন গবেষকরা অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনটির ব্যাপারে সবচেয়ে আশাবাদী। ইবোলা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে শিম্পাঞ্জির দেহ থেকে একধরনের adenovirus কে ল্যাবে পরিবর্তন করে তৈরি করা ChAdOx1 ভাইরাসটিকে আরেকটু পরিবর্তন করে COVID-19 এর ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের উপযোগী করে মানুষের দেহে প্রয়োগ করে দেখা হচ্ছে। মূল পরীক্ষাটি শেষ করতে প্রথমে ধরা হয়েছিল মে, ২০২১। কর্তৃপক্ষের সকল সহযোগিতা পাওয়ায় কাজের ফলাফল আশা করেছে এই বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টবরে সবচেয়ে কঠিন Phase1 পর্বটি শেষ হবে। বেশিরভাগ ট্রায়ালের ভাগ্য নির্ধারিত হয় phase1 এ। এখন কাজের গতি অনেক বেড়েছে এবং সুফল পাচ্ছে, সাথে ভ্যাকসিন টীম ভাবছে জুলাইয়ের আগে কাজের একটা ফলাফলে এসে পৌঁছাবে। এত দ্রুত পাওয়ার কিছু কারণ বলছি।
২৪ এপ্রিল একজন পুরুষ এবং একজন নারীর দেহে প্রথম এই ভ্যাকসিন পরীক্ষামূলক ভাবে দেয়া হয়েছিল। প্রথমে পরিকল্পনা ছিল মে মাসে ৫১০ জন ভলান্টিয়ার পেলে তাদের দেহে পরীক্ষা শুরু হবে। ব্রিটিশ জনগণ এগিয়ে এলো দ্রুত। অনেকেই ভলান্টিয়ার খাতায় নাম লেখালো স্বেচ্ছায়। অন্যসময় এই ভলান্টিয়ার পেতে অনেক সময় লাগে। কে রিস্ক নিতে চায়! আমাদের দেশে এসব করতে বললে দৌড়ে এসে তামাশা দেখবে, খুব কম লোক নিজেকে রিস্কে ঠেলে দেবে। জাতিগত পলায়নপর। যাই হোক, গত এক সপ্তাহে লন্ডন, ব্রিস্টল এবং সাউদাম্পটন এই তিনটি শহরের তিনটি হসপিটালে ৩২০ জনের শরীরে ট্রায়াল হচ্ছে। তৃতীয় ধাপে মে মাসে সবমিলে ১১০২ জনের শরীরে দুটো ভ্যাকসিন দেয়া হবে। দুটোর একটি হলো MenACWY নামের একটি ভ্যাকসিন, আরেকটি COVID-19 এর আসল ভ্যাকসিন ChAdOx1 nCoV-19।
ভ্যাকসিন ট্রায়াল এইভাবে করা হয়। একটি জানা ভ্যাকসিন এবং আরেকটি পরীক্ষার ভ্যাকসিন। এটাকে ট্রায়ালের ভাষায় বলে control for comparison। একটির সাথে আরেকটির তুলনা করে কার্যকারিতা, সাইড ইফেক্ট এসব বোঝা। MenACWY একটি স্বীকৃত ভ্যাকসিন, যা মেনিনজাইটিস প্রতিরোধে ব্যবহার করা হয় ২০১৫ সাল থেকে। বাংলাদেশের হজ্জ্ব যাত্রীদের হজ্বে যাওয়ার আগে এই টিকা দেয়া হয়। এটা বাধ্যতামূলক। জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের কিছু দেশে ঢুকতে এই ভ্যাকসিন দেয়া থাকতে হয়। আফ্রিকার কিছু দেশ থেকে USA ঢুকতে হলেও এই ভ্যাকসিন দেয়া থাকতে হয়। মেনিনজাইটিস ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়ার কারণে মস্তিষ্ক কিংবা স্পাইনাল কর্ডের আবরণে ইনফ্লেমেশন হওয়া। মস্তিষ্কের এই আবরণটির নাম Meninges। প্রচণ্ড জ্বর এবং ঘাড় বাঁকাতে না পারা এর প্রধান লক্ষণ। এটি মারাত্মক প্রাণঘাতী এবং শরীরের কয়েকটি ইমার্জেন্সি সিচুয়েশনের একটি।
MenACWY ভ্যাকসিন দেবার মজার একটি কারণ আছে। যখন ভ্যাকসিন ট্রায়াল দেয়া হয়, ভলান্টিয়ারদের দুটি গ্রূপে ভাগ করা হয়। একটি গ্রূপকে আসল ভ্যাকসিন দেয়া হয়, আরেকটি গ্রূপকে নকল ভ্যাকসিন দেয়া হয়। তারপর তাদের উপর ফলাফলের তুলনা করা হয়। কিন্তু কোনো গ্রূপ জানে না তাকে কী দেয়া হয়েছে। এমনকি পরীক্ষা দলের বেশিরভাগ ডাক্তার কিংবা বিজ্ঞানীদেরও জানা থাকে না। টপ অল্প ক’জন জানে কেবল। এমন করে ব্লাইন্ড রাখার কারণ হলো, সবাই যাতে ভাবে সবাইকে ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে। করোনা ভাইরাসের ChAdOx1 nCoV-19 দিলে শরীর একটু গরম হয়ে যায়, যে হাতে দেয় সে হাত ভারি হয়ে যায়, হালকা মাথা ব্যথা করে, খানিক বমির ভাব হতে পারে। সচরাচর ট্রায়ালে নকল ভ্যাকসিন হিসাবে সেলাইন ওয়াটার দেয়া হয়। কিন্তু এই ট্রায়ালে মেনিনজাইটিস ভ্যাকসিন MenACWY ব্যবহার করা হচ্ছে। MenACWY ভ্যাকসিনটি দিলেও করোনা ভাইরাসের মতো শরীর গরম হয়ে যায়, হাত ভারি হয়ে যায়, মাথা ব্যথা করে, বমির একটু ভাব আসে। নরমাল সেলাইন দিলে ট্রায়ালের ভলান্টিয়াররা বুঝে যাবে যে, তাকে আসল ভ্যাকসিন দেয়া হয়নি। মেনিনজাইটিসের ভ্যাকসিন দিয়ে তাকে তখন বিভ্রান্ত করা হয়, একই সাইড ইফেক্ট হয় বলে বুঝতে পারে না, ভ্যাকসিনটি আসল নাকি নকল । রোগী অথবা ভিলান্টিয়ার, এমনকি ডাক্তার বা বিজ্ঞানী, যিনি পর্যবেক্ষন করছেন, তখন biased হবার সম্ভাবনা থাকে না। রোগী চাইলেও বানিয়ে কিছু বলতে পারে না। এভাবে পরীক্ষায় সঠিক চিত্রটি ফুটে ওঠে। মানুষের স্বভাবটাই এমন। এ ধরনের বিভ্রান্ত করাকে বলে Placebo effect। সাইকোলজিতে মনের উপর এমন প্রভাবকে বলে Classical conditioning। স্কুলের বইতে অনেকেই একটি গল্প পড়েছিলেন হয়তো। ১৮৯৬ সালে Ivan Pavlov নামের রাশিয়ান এক বিজ্ঞানীর কুকুরকে ঘণ্টা বাজিয়ে লালা ঝরানোর গল্প। তাই অনেকে একে Pavlov conditioning বলে। দৈনন্দিন জীবনেও আমাদের এমন হয়। একদল লোক যদি ভদকা খেয়ে একটু মাতলামি করে এবং তাদের একজনকে শুধু স্প্রাইট খেতে দিলেও সে অন্যদের দেখাদেখি ভাববে যে, সেও ভদকা পান করছে। এমনকি স্প্রাইট খেয়েই সে মাতাল হয়ে যাবে।
অক্সফোর্ড গ্রুপ এরই মধ্যে আরেকটি কাজ শুরু করেছে। পৃথিবীর ১৪তম বৃহৎ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি AstraZeneca এর সাথে চুক্তিতে চলে গেছে যে, ভ্যাকসিনটি কার্যকরী প্রমাণিত হলে খুব দ্রুত যেন সারা পৃথিবীর জন্যে সাপ্লাই রেডি করতে পারে। ট্রায়ালের পাশাপাশি এটিও জরুরি। একটি ভ্যাকসিন বাজারে আসতে এটিও একটি দীর্ঘসূত্রিতা এবং অন্তরায়। AstraZeneca মূলত ব্রিটিশ এবং সুইডেনের দুটো বড়ো কম্পানি Astra এবং Zeneca. ১৯৯৯ একসাথে মিলিত হয়ে তৈরি হওয়া একটি কোম্পানি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ওষুধ কম্পানি হলো Johnson & Johnson। সময় বলে দেবে কাজের ফলাফল কতটা দ্রুত পাওয়া যাবে।