করোনাকে নয়, ভয় পাওয়া উচিত বিশ্ব ব্যবস্থাকে

পর্ব ৩

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : জুন ২০, ২০২০

বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস আছে, থাকবে। মানুষকে তার মধ্যেই টিকে থাকতে হবে। মানুষ বছরের পর সেভাবেই টিকে আছে। মানুষের জিন দিনে দিনে সেভাবেই প্রস্তুত হয়। চালর্স ডারউইনের সেই কথাটাই আবার সত্য হবে, যোগ্যরাই টিকে থাকে। মানুষকে ভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকে থাকার জন্য ভয় পেয়ে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে বেড়ালে হবে না, ভাইরাসকে প্রতিরোধ করা জন্য শারীরিক সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। শারীরিক এই সক্ষমতা অর্জন কঠিন কিছু নয়। নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খাওয়া আর কিছুটা শারীরিক পরিশ্রম করা। চিকিৎসাবিজ্ঞান এরই মধ্যে যা বলেছে আর তা এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে, পৃথিবীর চুরাশি-পঁচাশি শতাংশ মানুষ করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে থাকতে সক্ষম। ফলে করোনা ভাইরাসটি খুব শক্তিশালী কিছু নয়। সকল মানুষ যদি ঠিমত খাবার দাবার পেতো আর কিছুটা শারীরিক পরিশ্রম করতো দেখা যাবে ভাইরাস নিরানব্বই শতাংশ মানুষকে কিছুই করতে পারবে না। প্রতি বছর কিছু মানুষ তো নানাভাবেই মারা যাবে। ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বা বিভিন্নভাবে। সেসব নিয়ে এতদিন তো আমরা দুশ্চিন্তা করিনি। কিন্তু করোনার ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছিলাম কেন? মাত্র পাঁচ-ছয় শতাংশ মানুষের বাঁচা-মরার প্রশ্নে চুরাশি শতাংশ মানুষকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে বা গৃহবন্দি হয়ে থাকতে হয়েছে। স্বাভাবিক জীবন যাপন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

কথাটা বারবার বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত আশি শতাংশ মানুষ সেটা টেরই পায় না। মানে ভাইরাসটি তাদের সামান্য কাবু করতে পারে না। ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো, বিশ্বের আশি ভাগ মানুষের কাছে পাত্তাই পায় না ভাইরাসটি। যদিও বলা হচ্ছে, আশি ভাগ কিন্তু বাস্তব অবস্থায় মনে হচ্ছে সংখ্যাটা হবে আরো বেশি। করোনা আক্রান্ত হলে শারীরিকভাবে টের পাচ্ছে বিশ বা পনেরো শতাংশ মানুষ। বিশ শতাংশের মধ্যে কারো টের পাওয়াটা খুবই সামান্য। কারো টের পাওয়াটা কিছুটা বেশি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে সেরে উঠছে। করোনা রোগ প্রতিরোধে আশি ভাগ মানুষের কিছুই লাগছে না। বাকি বিশ ভাগের মধ্যে কারো চিকিৎসা লাগছে। চোদ্দ-পনেরো শতাংশের দরকার হয় খুব সামান্য চিকিৎসা, জ্বর কাশির অষুধ। হয়তো কারো গলাব্যথা হচ্ছে সামান্য, কিন্তু করোনার নাম শুনে ভয়টা বাড়ছে। কিন্তু আসলে সেগুলি ভয়ের কিছু নয়। মানুষ কিছুদিনের মধ্যেই সেরে উঠছে। বিশ শতাংশের মধ্যে যাদের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে দেশ ভেদে সেটা বিভিন্ন রকম। ধরা যাক, আক্রান্তদের মধ্যে খুব বেশি হলে পাঁচ-সাত শতাংশের শ্বাসকষ্ট হয় থাকে। হাসপাতালে সেজন্য অক্সিজেনের ব্যবস্থা থাকলেই হলো। যদি ঠিক মতো অক্সিজেন পাওয়া যায় তাহলে দেখা যাবে, করোনায় আক্রান্ত আটানব্বই শতাংশ মানুষ সেরে উঠবে কিংবা তার চেয়েও বেশি। বর্তমান বহু ধরনের পরিসংখ্যান তাই বলছে।

বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বহু মানুষের মৃত্যুর একটা বড় কারণ চিকিৎসকরা প্রথম বুঝে উঠতে পারেনি চিকিৎসাটা কী হবে। দ্বিতীয়ত হাসপাতালগুলিতে সংক্রমিত রোগীদের প্রয়োজন মতো অক্সিজেন ছিল না। যদি হাসপাতালে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের ব্যবস্থা থাকতো বহু রোগী বেঁচে যেত। ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে না পারার কারণে প্রাণ দিয়েছে তারা। কিছু ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার অভাবে অক্সিজেন দেয়ার প্রক্রিয়া ভুল ছিল। বিভিন্ন হাসপাতালে অক্সিজেনের ব্যবস্থা রাখাটা কঠিন বা খুব ব্যয় বহুল কিছু নয়। কিন্তু প্রয়োজন হতো না বলে রাখা হয়নি। বাস্তবে তাহলে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? করোনায় আক্রান্তদের একদলের কিছুই দরকার হয় না। সামান্য চিকিৎসাও লাগে না সেরে উঠতে কারণ তারা কিছুই টেরই পায় না। কিছু সংখ্যক রোগীর দরকার হয় সহজে প্রাপ্ত কম দামের কিছু সাধারণ অষুধ। কিছু সংখ্যক রোগীদের আবার অক্সিজেন দিয়েই বাঁচানো যায়। ফলে করোনার চিকিৎসা নেই বলা যাবে না। চূড়ান্ত চিকিৎসা হচ্ছে অক্সিজেন সবচেয়ে জটিল রোগীদের ক্ষেত্রে। হ্যাঁ, হয়তো অক্সিজেন দেয়ার পরেও দুই বা এক শতাংশ মানুষকে বাঁচানো যাবে না। কিন্তু দেখা যাবে তার কারণ করোনার সংক্রমণ যতটা নয় তার চেয়ে ভিন্ন কিছু। হয়তো বিভিন্নরকম রোগে তিনি পূর্ব থেকেই আক্রান্ত বা বয়স অনেক বেশি। পৃথিবীর স্বাস্থ্য তালিকায় কয়টা রোগ আছে, যার ফলে দু-তিন শতাংশ লোক গড়ে মারা যাচ্ছে না? করোনায় যত লোক মারা গেছে গত তিনমাসে তার চেয়ে গাড়ি দুর্ঘটনায়, মদ্যপান আর ধূমপান এবং ক্যান্সারে বেশি লোক মারা গেছে। ক্যান্সারে মারা গেছে সাড়ে এগারো লাখ লোক। বর্তমানে বিশ্বে যে কয়েক লক্ষ মানুষ করোনা দ্বারা আক্রান্ত হয়ে আছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে মাত্র গড়ে দুই শতাংশ রোগীর অবস্থা সংকটজনক। করোনা তাহলে শেষ বিচারে দুই শতাংশ মানুষের জন্য আসলে ভীতিকর। বাকিদের সময় মতো প্রয়োজনীয় অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব। ফলে মুত্যুর হার যেখানে দুই শতাংশ বা তার চেয়ে কম, সেখানে করোনাকে ভয় পাবার কী আছে? করোনা ভয়ে সেখানে দরজা জানালা বন্ধ করে, সকল আত্মীয়স্বজনকে ত্যাগ করে স্বাভাবিক জীবন বাতিল করে ঘরে বসে থাকতে হবে কেন? কারণ আসলেই নেই। কিন্তু ক্ষুদ্র একটা কারণ রয়েছে সেটা আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্বলতা।

চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে আমাদের গৃহবন্দি হয়ে থাকতে হচ্ছে। রাষ্ট্র আর হাসপাতাল আমাদেরকে আমাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রি দিতে পারছে না বলেই, আমাদের গৃহবন্দি করে রেখেছে। না হলে করোনায় আক্রান্ত হলে আমাদের ভয়ের কিছু নেই। কারণ আশি শতাংশ চিকিৎসা ছাড়া সুস্থ্য হয়ে যাবে। চোদ্দ-পনেরো শতাংশকে কিছু প্যারাচিটামল এবং কাশির অষুধ খেতে হবে। সাত শতাংশের দরকার হতে পারে অক্সিজেন। ফলে সরকার আমাদের গৃহবন্দি না করে আমাদের জন্য হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ করলেই হয়। লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন, করোনার আক্রমণে যারা মারা গেছে, তাদের মধ্যে বড়-একটা সংখ্যাকেই হয়তো বাঁচানো যেত, যদি হাসপাতালগুলিতে অক্সিজেনের অভাব না ঘটতো। ফলে যে মানুষগুলি বাঁচতো, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বা হাসপাতাল ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণেই সে মানুষগুলি মারা গেছে। চিকিৎসা সামগ্রির অপ্রতুলতা বা চিকিৎসা ব্যবস্থা দুর্বল না হলেই মানুষগুলি বেঁচে যেতো। যখন এভাবে আমরা অক্সিজেনের অভাবে মানুষকে মরতে দেখছি, নিকটজনদের মৃত্যুর খবর শুনতে পাচ্ছি; খুব ভয় পেয়ে যাচ্ছি করোনা ভাইরাস সম্পর্কে। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে কী তাই? হাসপাতাল তাদেরকে অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারেনি। সরকার নিজের এই দুর্বলতার কথা স্বীকার না করে, বলতে চাইছে করোনা একটি ভয়াবহ ভাইরাস। ভাইরাসটি ভয়াবহ হলে আশি শতাংশ মানুষ কিছুই টের পাচ্ছে না কেন?

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, পূর্বেই দেখানো হয়েছে সৌদি আরব, কাতার, ওমান, বাহরাইন, আরব আমিরাতে মৃত্যুর হার শূন্য দশমিক ছয়। শতকরা একজনও নয়। নিশ্চিত খোঁজ নিলে দেখা যাবে সেখানে সকল রোগীরা দরকার মতো হাসপাতালে অক্সিজেন পেয়েছে। যদি একটি ভাইরাসের সংক্রমণে শতকরা একজনও মারা না যায় তাহলে সে ভাইরাসটিকে ভয় পাবার কী আছে? খুবই দুর্বল ভাইরাস সেটি। সম্ভবত ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার এর বেশি হতে পারে। ফলে এই ভাইরাসটির সংত্রমণের ভয়ে বছরের পর বছর ঘরে বসে থাকতে হবে কেন? সামান্য সময়ের জন্য প্রস্তুতিমূলকভাবে ঘরে বসে থাকা যেতে পারে। যাতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে নতুন রোগটির উপযোগী করে গুছিয়ে নেয়া যায়। মধ্যপ্রাচ্যে বা সৌদি আরবে শূন্য দশমিক ছয়জন মানে যারা মারা গেছেন দেখা যাবে তাদের অন্যান্য অনেক ধরনের রোগ হয়তো ছিল। পাশ্চাত্যে মৃত্যুর হার বেশি, খোঁজ নিলে দেখা যাবে সেখানে তাৎক্ষণিকভাবে সকলকে অক্সিজেন দেয়া যায়নি। প্রথমে সেরকম প্রস্তুতি স্বাভাবিকভাবেই ছিল না হাসপাতাগুলিতে। ফলে সব ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তুতির জন্য কিছুদিন মানুষকে গৃহবন্দী থাকতে হতে পারে। কিন্তু করোনার ভয়ে বছরের পর বছর ঘরে বসে থাকার দরকার নেই। কারণ হাসপাতালগুলিতে সকল রকম চিকিৎসার সুবিধা থাকলে মৃত্যুর হার দেখা যাচ্ছে এক শতাংশের কম। ধরে নিচ্ছি যদি দুই শতাংশ হয় সকলকে ঘরে বসে থাকতে হবে কেন? হ্যাঁ, এই মুহূর্তে আমরা ঘরে বসে আছি, কারণ আমরা জানি হাসপাতালগুলিতে শয্যার অভাব আর তারচেয়ে বেশি অভাব অক্সিজেনের। সরকারের দায়িত্ব সেগুলির ব্যবস্থা করা।

লক্ষ্য করলে দেখতে পাচ্ছি, মধ্যপ্রচ্যে মৃতের হার মাত্র ০.৬। মৃতের হার এত কম হলে করোনাকে ভয় পাবার আদৌ কোনো কারণ কি থাকে? মৃতের হার সেসব দেশে কম কেন? প্রথম কারণটি হলো করোনায় আক্রান্তদের পঁচানব্বই শতাংশ এমনিতেই সুস্থ হয়ে যান। মধ্যপ্রাচ্যে তার চেয়ে কম মানে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভালো ছিল। যতদূর জানি সৌদি আরবের স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়ের পরিমাণ এক ট্রিলিয়ন ডলার। ধরে নিতে হবে যথেষ্ট সেবারমান তাদের, ফলে আক্রান্তরা রক্ষা পেয়েছে। না হলে এমন তো হতে পারে না। দয়া করে করোনা মুসলমানদের খুব খাতির করেছে তা নিশ্চয় নয়! নিশ্চয় সামান্য ভিন্ন কিছু ব্যতিক্রম থাকতে পারে। ধরা যাক তার মধ্যে বিভিন্ন দেশের ভৌগলিক অবস্থা এবং তাপমাত্রা সেই সঙ্গে রোগীদের গড় বয়স। বিশ্বাস করবার কারণ আছে যে শীত আর বয়স দুটাই করোনা ভাইরাস সংক্রমণে এবং মৃতের সংখ্যা বাড়াতে সাহায্য করে। বিভিন্ন শীত প্রধান দেশের দিকে তাকালে সেটা ধারণা করবার কারণ রয়েছে। কিছু গবেষণাও হয়েছে। কিন্তু সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু কিছু দেশ এমন সব অষুধ ব্যবহার করেছে, বহুজন মনে করেন তা সেসব দেশে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়েছে। নিশ্চয় তা নিয়ে পড়ে গবেষণা হবে। চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সিঙ্গাপুরের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরো বিস্ময়ের। সিঙ্গাপুর খুবই ঘনবসতিপূর্ণ শহর। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ৮ হাজার মানুষের বাস। সেখানে মোট আক্রান্ত ৪১২১৬ জন আর মৃতের সংখ্যা ২৬। মৃতের হার শূন্য দশমিক একও নয়। ভিয়েতনামে একজনও মারা যায়নি। সংক্রমণ ঘটেছে খুবই কম। কথাটা খুবই সঠিক রাষ্ট্রের চিকিৎসা ব্যবস্থা দুর্বল হলেই করোনার হাতে মানুষ বেশি মারা পড়বে।

চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্বলতাকে নানাভাবে চিহ্নিত করা যাবে। কেবল মাত্র ব্যয় বরাদ্দ নয়। দুর্নীতি হচ্ছে কিনা, চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সেবার মান কেমন? চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে আর একটা কথা থাকে, সেটা হলো রাষ্ট্রব্যবস্থা। বহু ধনীদেশ চিকিৎসা ব্যয় বেশি থাকা সত্ত্বেও, সংক্রমণ কমাতে পারেনি। বহু রাষ্ট্র সংক্রমণই বাড়তে দেয়নি। ভিন্ন আলোচনা সেটা। বাংলাদেশে যেমন বহু সাধারণ বা বিশেষজ্ঞ হাসপাতাল থাকা সত্ত্বেও মানুষ করোনা ভাইরাসের চিকিৎসার বাইরে ভিন্ন ধরনের চিকিৎসা নিতে পারেনি। কারণ করোনা ভাইরাসের সংক্রমণকালে তারা নিজেদের স্বার্থে হাসপাতালে দরজা বন্ধ রেখে মানুষকে মরতে দিয়েছে। ভিন্ন দিকে বিভিন্ন রকম অব্যবস্থপনার কারণে হাসপাতালে যেতে ভরসা পায়নি বহু মানুষ। বাংলাদেশে বহু হৃদরোগী খারাপ শরীর নিয়ে হাসপাতালে যেতে ভরসা পায়নি করোনায় সংক্রামিত হবার ভয়ে। ধরা যাক এগুলি হচ্ছে রাষ্ট্র ব্যবস্থার ত্রুটি। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও তেমনটা ঘটতে দেখা গেছে। মানুষ সংক্রমিত হওয়া আর মরণের ঢল নেমেছে যুক্তরাষ্ট্রে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন এরকম দেশের সম্পর্কে একই কথা বলা যাবে। সকলের তাদের চিকিৎসা প্রদানের কাঠামো যতোটা জোরালো, কিন্তু রাষ্ট্রটা আবার জনগণের নয়, ধনীকদের। ধনীকদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে তাই নানান রকম অঘটন ঘটেছে সেইসব দেশে। ঠিক আবার জনগণের রাষ্ট্র কিউবা, ভিয়েতনাম সেখানে দেখা গেছে সংক্রমণের সংখ্যা কম। কিউবা দরিদ্র দেশ হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশকে চিকিৎসা সহায়তা দিচ্ছে। বিষয়গুলি খুবই ভিন্ন রকমের আলোচনার। পরে কখনো তা নিয়ে কথা বলা যাবে। কারণ এমনিতেই লেখাটা বড় হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে সরকারের হিসেব মতে বর্তমানে আক্রান্তের হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেলেও আক্রান্ত রোগীদের মৃতের হার বেশি নয়। দেড় শতাংশের মতো। বাংলাদেশের মানুষ সঠিক চিকিৎসা পেলে হয়তো সেটা সিঙ্গাপুরের হারের কাছাকাছি থাকতে পারতো। কারণ বাংলাদেশের জনসংখ্যার বড় অংশটাই তরুণ। কিন্তু অনেকেই সঠিক চিকিৎসা পাননি। বহুজন চিকিৎসা পাওয়া দূরের কথা, হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেননি। নানারকম দ্বিমুখী আইন করে রাখা হয়েছে হাসপাতালে ভর্তির ব্যাপারে। বর্তমানে শয্যা নাই হাসপাতালগুলিতে। কারণ বিভিন্ন জনের পরামর্শ সত্ত্বেও সরকার হাসপাতাল বাড়ানোর চেষ্টা করেনি। চিকিৎসা সামগ্রি ঠিকমতো জোগান দেয়নি। সুচিকিৎসার জন্য প্রয়োজন মতো অক্সিজেন রাখার ব্যবস্থা নেয়নি। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. রুহুল হক দুদিন আগেই বললেন, তিনি বারবার হাসাপাতাল, শয্যা সংখ্যা, চিকিৎসা সরঞ্জাম, অক্সিজেন এসব বাড়াবার কথা বলে বলে হয়রান হয়ে এসেছেন মার্চ মাস থেকে। কিন্তু সরকার বা প্রশাসন গা করেনি বা পাত্তা দেয়নি। বাংলাদেশের মানুষের এই মুহূর্তে স্বাভাবিকভাবেই আতঙ্কিত হওয়া কারণ হলো, সবাই জেনে গেছে চাইলেই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া যাবে না। করোনার রোগী হাসপাতালে সাধারণত কখন ভর্তি হয়, যখন তার অক্সিজেনের প্রয়োজন। কিন্তু হাসপাতালে গিয়ে যদি অক্সিজেনই না পান, নিশ্চিত মৃত্যু। মৃত্যুর প্রধান কারণ কিন্তু করোনার সংক্রমণ নয়, চিকিৎসা না পাওয়া। বাংলাদেশের নাগরিকরা এখন ঘরে বসেও কীরকম ভয়াবহ আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন ভাবুন একবার। যদি করোনা রোগ তাকে পেয়ে বসে আর সেরকম দরকারে যদি অক্সিজেন না পান! নিশ্চয় এ রকম ভয় পাওয়াটা সকল মানুষের জন্য স্বাভাবিক। পাশাপাশি নিত্যদিন এই রকম ভয় পেতে পেতে মানুষ নানাবিধ মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন।

ব্যাপারটা তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? মনের ভিতরে আমাদের যে ভয়, সেটা কিন্তু আসলে করোনাকে নয়। করোনা ভিয়েতনামে একজন মানুষেরও মৃত্যু ঘটাতে পারেনি। সিঙ্গাপুরে একচল্লিশ হাজার আক্রন্তের মধ্যে শতকরা ০.১ জনের মৃত্যু ঘটাতে পারেনি, মধ্যপ্রাচ্যে শতকরা ০.৬ জনের মৃত্যু ঘটাতে পারেনি। করোনা নিয়ে মানুষের মনে যে ভয়, সেভয়টা আসলে আমাদের সামগ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কে। যদি অসুস্থ হন, যদি হাসপাতালে যেতে হয় কে আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে? নিশ্চিতভাবেই জানেন হাসপাতাল থেকে গাড়ি পাঠাবে না। নিজে গাড়ি বা কাউকে নিয়ে গেলেই যে ভর্তি হতে পারবেন তার নিশ্চয়তা নেই। যদি কিছু একটা করে ভর্তি হতে পারলেন, কপালে অক্সিজেন জুটবে কিনা। নিশ্চয় প্রধান ভয় এগুলিই। সত্যি বলতে এই ভয়টা সঠিক। যা এতক্ষণ বলা হলো, তা ঢাকা বা বিভাগীয় বা জেলা শহরের কথা। যদি প্রত্যন্ত অঞ্চলে কারো এমন আক্রান্তের ঘটনা ঘটে, সে চোখের সামনে নরক দেখবে। করোনা কেন, ভিন্ন অনেক রোগেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের এই নরক দর্শন ঘটে থাকে। মানুষের ভয়টা কি তবে করোনাকে? নাকি রাষ্ট্রের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে? নাকি আরো সঠিকভাবে বললে, রাষ্ট্রের চিকিৎসা ব্যবস্থার বিশৃঙ্খলাকে? চিকিৎসা ব্যবস্থার সেই বিশৃঙ্খলা এতটাই প্রকট যে, চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রতিদিন অনেক সংখ্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন, প্রতিদিন তাদের মৃত্যুর খবর আসছে খুব মর্মান্তিক ভাবে। পরের ভয়টা বা বিষন্নতা হলো, মৃত্যুর পরের সৎকার বা দাফন নিয়ে। সৎকার বা দাফন নিয়ে নানারকম ভুল ধারণার জন্ম দেয়া হয়েছে। মানুষ শেষবারের মতো প্রিয়জনকে দেখতে পাচ্ছেন না।

বাংলাদেশে আমরা দেখতে পাচ্ছি, বহুদিন ধরে জনগণের চিকিৎসার জন্য সরকারের বরাদ্দ ছিল খুবই কম। বাংলাদেশের জনগণের চেয়ে চিকিৎসা ব্যয় এতটাই কম যে বিস্মিত হতে হয়। বাংলাদেশের তুলনায় জনসংখ্যা কম এশিয়ার এরকম প্রায় প্রত্যেকটি দেশের স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় বরাদ্দ বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশে বরাদ্দ এত কম কিন্তু সেই টাকাটাও জনগণের চিকিৎসাসেবায় ব্যয় না হয়ে, হাসপাতালের প্রয়োজনীয় সামগ্রি কেনার কাজে ব্যয় না হয়ে ব্যয় হয়েছে লুটপাটে। সরকারের আমলারা আর ঠিকাদাররা মিলে লুটপাট করেছে বরাদ্দকৃত টাকার বড় অংশটা। যদি সে টাকাটা ঠিক মতো দীর্ঘদিন ধরে সঠিকভাবে খরচ করা হতো হাসপাতালগুলির এমন বিপর্যয়কর অবস্থা হতো না। ফলে বর্তমানে করোনায় আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছেন, ঠিক মতো অক্সিজেন পাননি বা আদৌ হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেননি, তার প্রধান কারণ হচ্ছে স্বাস্থ্যবিভাগের টাকাগুলি লুটপাট। সরকারের কাছে জনগণের এর জন্য শ্বেতপত্র দাবি করা দরকার। বিভিন্ন ব্যক্তির মৃত্যুর দায় নিতে হবে লুটপাটকারীদের। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের বিচার হতে হবে। নিজেদের লুটপাটের ভিতর দিয়ে তারা মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে। মানুষের চিকিৎসার টাকা দিয়ে ভোগবিলাসিতা করেছে, নিজের পরিবারের জন্য সম্পদ বৃদ্ধি করেছে একদল মানুষ। প্রতিটি সরকারের চোখের সামনে বছরের পর বছর ধরে এটা চলছে। কিন্তু বিনা চিকিৎসায় মারা পড়ছে জনসাধারণ। করোনার ক্ষেত্রে ঠিক একই ব্যাপার ঘটেছে। বরাদ্দের টাকাটা ঠিক মতো ব্যয় হলে করোনায় এতো মানুষের মৃত্যু ঘটতো না। ফলে মনে রাখতে হবে মৃত্যুর প্রধান কারণ করোনা নয়, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা। ঠিক চিকিৎসা পেলে করোনায় মানুষ মারা যাবে না।

কিন্তু যদি এমন হতো, চিকিৎসা মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি নেই, সরকার মানুষকে চিকিৎসা দেয়ার ব্যাপারে আন্তরিকভাবে উদগ্রীব; নিশ্চয় গত উনপঞ্চাশ বছরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে হাসপাতাল পৌঁছে যেতো। সেখানে মানুষের চিকিৎসার জন্য জরুরিসহ সকল প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রি থাকতো। যদি সেরকম একটি অবস্থায় হঠাৎ করোনার আক্রমণ ঘটতো, দুশ্চিন্তার কিছু ছিল কি? কিছু অর্থ বরাদ্দ করে তখন প্রত্যেক হাসপাতালে অক্সিজেন আর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রি পাঠিয়ে দিলেই হতো। চিকিৎসকদের জন্য সুরক্ষা সামগ্রি ঠিকঠিক মতো পৌঁছে যেতো। দরকার মতো প্রশিক্ষণ পেয়ে যেতেন তরুণ চিকিৎসক সহ স্বাস্থ্যকর্মীরা। মানুষ যে করোনাকে ভয় পাচ্ছে, সত্যিকার অর্থে করোনাকে ভয় পাওয়ার কিছুই ছিল না মানুষের। মানুষ ভয় পাচ্ছে গত উনপঞ্চাশ বছরের দুর্নীতি আর অব্যবস্থার ফলাফলকে। কিন্তু বর্তমান সরকার আন্তরিক হলে এখনো মানুষের মনের ভয় দূর করতে পারে। নিশ্চয় উনপঞ্চাশ বছরে ব্যর্থতা দুদিনেই ঘুঁচিয়ে দেয়া যাবে না। কিন্তু বর্তমান করোনাকে মোকাবেলা করার জন্য স্বাস্থ্যখাতে যা যা করা দরকার তা করা সম্ভব। সরকার করোনার ভয়াবহ সঙ্কটকালে খুব চমৎকারভাবে খাদ্য সরবরাহ চালু রেখেছে। মানুষ কিনতে চাইলে ঠিকমতো হাতের কাছে খাদ্য সামগ্রি পেয়ে যাচ্ছে। দামটাও অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে। সরকারের বিরাট একটি সাফল্যের দিক এটা। গণ মানুষের চিকিৎসায় সেরকম সাফল্য আনতে পারবে না কেন সরকার?

করোনার চিকিৎসা ব্যয়বহুল কিছু না, অস্ত্রোপচারের ব্যাপার নেই। ভিন্ন দিকে করোনা চিকিৎসায় প্রধানত দরকার আর একটি বিষয়ে লক্ষ্য রাখা, চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যকর্মীদেরকে সুরক্ষা দেয়া। সরকার যদি আন্তরিকভাবে চায় জনগণকে শতভাগ চিকিৎসা প্রদান করতে তার জন্য দরকার, বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু অস্থায়ী হাসপাতাল বাড়ানো; সেইসঙ্গে বর্তমান হাসপাতালগুলিকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো। সেজন্য প্রধানত আর কী দরকার? সকল মারাত্মকভাবে আক্রান্ত রোগীরা যেন অক্সিজেন পান সেটা সুনিশ্চিত করা। অক্সিজেন, অক্সিজেন আর অক্সিজেন করোনার ভয়াবহ সংক্রমণে প্রধান একটি চিকিৎসা। করোনার সাধারণ সংক্রমণে তেমন কিছুই দরকার নেই। মাত্র আক্রান্তদের সাত শতাংশর জন্য যেকোনো প্রকারে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। যদি তা করতে না পারে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দেবে। সরকার যদি তার দৃষ্টিকে প্রসারিত করে তাহলে চিকিৎসাজগতে বিরাট আলো ফেলতে পারবে করোনার এই সঙ্কটকে কেন্দ্র করে। যা অর্থনৈতিকভাবেও সরকারকে নতুন পথ দেখাবে। মানুষ ঘরে বন্দী থাকাতে রাষ্ট্রের যে পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধিত হয়েছে, সু সম্পন্ন হাসপাতাল বানাতে খরচ পড়বে তার চেয়ে কম। চলবে