করোনাকে নয়, ভয় পাওয়া উচিত বিশ্ব ব্যবস্থাকে

পর্ব ২

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : জুন ১৯, ২০২০

সার্সের পর আবার মার্সের দেখা পাওয়া গেল দুই হাজার বারো সালে প্রথম মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে। মিডল ইস্ট রেসপাইরেটোরি সিনড্রোম বা মার্স আরম্ভ হয় প্রথম সৌদি আরবে। সেখানকার একজন পঁয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধ দুই হাজার বারো সালের তেরোই জুন থেকে জ্বরে ভোগার পর এগারো দিনের মাথায় মারা যান। তার জ্বর, কাশি আর শ্বাসকষ্ট ছিল। সে বছরের সেপ্টেম্বর মাসের বারো তারিখে কাতারের একজনের এমনটাই ঘটে যা সৌদি রোগীটির ঘটেছিল। সেই সময়ে ইউরোপীয় সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশনে ন কন্ট্রোল তখন যে দেশগুলি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তার একটা তালিকা তৈরি করে। সে দেশগুলি হলো— বাহরাইন, ইরাক, ইজরায়েল, জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, প্যালেস্টাইন, ওমান, কাতার, সৌদি আরব, সিরিয়া, ইউনাইটেড আরব আমিরাত এবং ইয়েমেন। দুই হাজার তেরো সালের জুনের মধ্যে ৫৫ জন আক্রান্তকে পাওয়া যায় যার মধ্যে ৩১ জন মারা যায়। তার মধ্যে ৪৫ জনই ছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের, যেমন: সৌদি আরব, জর্ডান, কাতার, আরব আমিরাতের মানুষ। আটজন ছিল ইউরোপের— ফ্রান্স, ইতালি ও ব্রিটেনের, দুজন ছিল আফ্রিকার তিউনিশিয়ার। দুই হাজার চোদ্দ সালে আক্রান্ত পাওয়া গেল ২৫৫ জন। সে বছরের মে মাসের মধ্যে সংক্রমিত হলো ৫৭০ জন, মারা গেল ১৭৩ জন।

মার্স বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়লেও তার সংক্রমণের হার বেশি ছিল না। মনে হয় সৌদি আরবে হজ্জ করতে এসে অনেকে নিজ শরীরে রোগটি বহন করে নিয়ে গিয়েছিল। মার্স ভাইরাস যে শুধু মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হতো, ব্যাপারটা তা নয়। নিশ্চয়ই আক্রান্ত রোগীর খুব ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এলে একজন মানুষের শরীর থেকে আরেকজন মানুষের শরীরে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু মানুষ ছাড়াই অন্যভাবে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বহুজন মনে করে, উট থেকে মানুষ আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারে। বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। ফলে এ রোগ ছড়ানোর কারণটি এখনো সুনির্দিষ্ট নয়। মার্স ভাইরাস কীভাবে ছড়াতো বর্তমান রচনায় এটা আলোচনার প্রধান বিষয় নয়। বিজ্ঞানীদের কাজ মার্স ভাইরাস কী প্রকারে ছড়াতো, সেটা আবিষ্কার করা। মার্স নিয়ে বক্ষ্যমান রচনায় সামান্য প্রসঙ্গ উত্থাপনের কারণ হলো, ভিন্ন একটি দিক নির্দেশনা খুঁজে পাওয়া।

যখন সার্স ২ বা কোভিড ১৯ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলি খুবই ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সৌদি আরবের মানুষদেরকে অনেকেই মনে করে বর্বর। যদিও সেমিটিক অনেক পুরানো সভ্যতা কিন্তু তা সত্ত্বেও সৌদি জনগণ বা সৌদি আরব দেশটি নিয়ে মানুষের মনে খুব ভালো ধারণা নেই। কিন্তু করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সৌদি আরব একটি যুগান্তকারী বা ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছে। ইসলাম ধর্মের সূতিকাগার আর ইসলামের পয়গম্বরের জন্ম যেখানে, সেই সৌদি আরব প্রথমেই কাবা শরিফ বন্ধ ঘোষণা করে। মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া নিষিদ্ধ করে দেয়। কিন্তু সকল সময় বলা হয় ইসলাম একটি কট্টোর ধর্ম। বলা হয়, মুসলমানরা অন্ধ আর কুসংস্কারাচ্ছ; যাদের জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রতি সামান্য আগ্রহ নেই। করোনা ভাইরাসের আক্রমণে সারা বিশ্বে সবচেয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপটি গ্রহণ করে কিন্তু সেই সৌদি আরবের মুসলমানরা। ধর্মীয় সমস্ত কুসংস্কারকে বাতিল করে বিজ্ঞানসম্মত পথ ধরে তারা হাঁটতে শুরু করে। কারো সাহস হয়নি রাষ্ট্রীয় এই যৌক্তিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার। বা রাষ্ট্রের সকলে সেটা যুক্তিসঙ্গতভাবেই মেনে নিয়েছিল। ধর্ম পালন রাষ্ট্র নিষেধ করেনি, ধর্ম পালনের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা সকলের ছিল। কিন্তু ধর্ম সৌদি আরবের মানুষের স্বাস্থ্যসেবার উপর প্রভুত্ব বিস্তার করতে পারেনি। স্বাস্থ্য বা মানুষের জীবন আগে তারপরে ধর্মীয় বাড়াবাড়ি।

সৌদি আরবে আগামী বছরে হজ্জ পালিত হবে না করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের কারণে। কিন্তু হজ্জ সৌদি আরবের একটি বড় উপার্জনের জায়গা। সৌদি আরব সেটা নিয়ে সামান্য মাথা ঘামাচ্ছে না। স্বীকার করতেই হবে, করোনা ভাইরাসে আক্রমণ প্রতিরোধে সৌদি আরব বহু বিজ্ঞানসম্মত দেশের চেয়ে নিজের বিজ্ঞাসমনস্কতার পরিচয় দিয়েছে। কারণ এই দেশটি গণ জমায়েত ডেকে রোগটি দূর করার জন্য প্রার্থনা সভারও আয়োজন পর্যন্ত করেনি। বরং মানুষকে হাসপাতালগুলিতে সঠিক চিকিৎসা দিয়ে আর বিভিন্ন ধরনের জরুরি পদক্ষেপ নিয়ে সংক্রমণ দূর করতে চেয়েছে। বিষয়টা লোক দেখানো ব্যাপার ছিল না। সৌদি আরব করোনা আক্রমণের ভয়াবহতা বুঝতে পেরেছিল। ধর্ম পালনের নাম করে জনগণকে জমায়েত করতে দিলে যে প্রাণহানী ঘটবে, রাষ্ট্র সেটা বুঝতে পেরেছিল। রাজতন্ত্র সম্পর্কে যতই নেতিবাচক হোক মানুষের ধারণা, সৌদি রাজপরিবার জনগণের জানমাল নিয়ে যে দুশ্চিন্তা করে তার প্রমাণ রেখেছে। গণতান্ত্রিক বহু দেশ তার জনগণের নিরাপত্তা বিধানে সেটুকু করার চেষ্টা দেখায়নি। ফলে সৌদি আরবকে চট করে বর্বর বলার আগে বহুবার বিবেচনা করতে হবে। রাজতন্ত্র তার প্রজার জন্য যা পেরেছে, ভারত এবং বাংলাদেশ সহ বহু রাষ্ট্রের সরকার কি জনগণের মঙ্গলের জন্য সেরকম কোনো উদাহরণ সৃষ্টি করতে পেরেছে? জনগণের মঙ্গলের জন্য সৌদি আরব ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিষয়গুলিকে সামান্য পাত্তা দেয়নি। জুম্মার নামায, ঈদের জামাত সব বাতিল করে দিয়েছে। কিন্তু সকল রকম জমায়েত নিষিদ্ধ করার পরেও দেখা যাবে, সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক। সাড়ে তিন কোটি মানুষের দেশে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় সোয়া লাখ। যদি কাবা শরীফে নামাজ পড়া, উমরাও করার অধিকার দান, জুম্মার নামাজ আদায় করা ইত্যাদি ধর্মীয় বিষয়গুলি চালু রাখা হতো তাহলে আক্রান্তের সংখ্যা কতগুণ বাড়তো? ফলে সরকার যথাসময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার, যখন রচনাটি তৈরি হচ্ছে তখন সৌদি আরবে আক্রান্ত জনসংখ্যা হলো ১১২২৮৮ আর মৃতের সংখ্যা মাত্র ৮১৯। সৌদি আরবকে কি তাহলে বর্বর দেশ বলা যাবে? জন বিচ্ছিন্ন দেশ বলা যাবে? যখন সৌদি আরবে মৃতের সংখ্যা ৮১৯ তখন কানাডাতে আক্রান্ত ৯৭১২৫ জনের মধ্যে মৃতের সংখ্যা ৭৯৬০।

মধ্যপ্রাচ্যের আরো কয়েকটি দেশ সম্পর্কে এখানে আলোচনা করার ইচ্ছা আছে। কাতারে আক্রান্তের সংখ্যা ৭৩৫৯৫ আর মৃতের সংখ্যা মাত্র ৬৬। ইউনাইটেড আরব আমিরাতে আক্রান্তের সংখ্যা ৪০৫০৭ আর মৃতের সংখ্যা ২৮৪। কুয়েত আক্রান্তের সংখ্যা ৩৩৮২৩, মৃতের সংখ্যা ২৭৫। ওমানে আক্রান্তের সংখ্যা ১৮৮৮৭, মৃতের সংখ্যা ৮৪। সবগুলি দেশের সংখ্যা যদি যোগ করে মিলিয়ে দেখা হয়, তাহলেও মৃতের শতকরা হার এক শতাংশ হচ্ছে না। দাঁড়াচ্ছে মাত্র ০.৬ এর কাছাকাছি। কিন্তু সারা বিশ্বের গড় মৃতের হার সেখানে ৫ শতাংশের বেশি। সবচেয়ে বেশি মৃতের হার ফ্রান্সে প্রায় আঠারো শতাংশের বেশি, ব্রিটেনে ১৪ শতাংশের বেশি, স্পেনে ১০ শতাংশের মতো। ব্যাপারটা কি তাহলে এমন হতে পারে যে, সৌদি বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি মার্স ভাইরাসের আক্রমণের পর এ ব্যাপারে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল বা মার্স ভাইরাসের আক্রমণের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছে? না হলে এরকম সাফল্য খুব সচরাচর ঘটে না। যদি লক্ষ্য করি দেখা যাবে ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর সবচেয়ে বেশি সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘনবসতিপূর্ণ শহর সিঙ্গাপুরে আক্রান্তের সংখ্যা ৪১২১৬ জন হলেও মৃতের সংখ্যা মাত্র ২৬ জন। ভিয়েতনামে মৃতের সংখ্যা নেই আর আক্রান্তের সংখ্যা দীর্ঘদিনেও সাড়ে তিনশোর বেশি হতে দেয়নি। বিষয়টা কি এমন কিছু যে, সার্স ১ এর অভিজ্ঞতা তাদেরকে এ ব্যাপারে সতর্ক হতে সাহায্য করেছিল। করোনা নিয়ন্ত্রণে সব মিলিয়ে এশিয়ার সাফল্য পাশ্চাত্যের চেয়ে বহুগুণ বেশি। মৃতের সংখ্যা পাশ্চাত্যের চেয়ে প্রাচ্যে অনেক কম। নিশ্চয় এর কারণ নিয়ে পরবর্তীত বিজ্ঞানীদের গবেষণা করার সুযোগ থাকবে। মার্স সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য তখনি একটি ভবিষ্যত বাণী করেছিল যে, মার্স ভাইরাসটি পরে আরো বড় মহামারি আকারে বিশ্বে আবার দেখা দিতে পারে। সে কারণে এ নিয়ে গবেষণার প্রস্তাবও রেখেছিল। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সে প্রস্তাব ধনী দেশগুলির কাছে গুরুত্ব পায়নি। বিশ্বের ধনী দেশগুলি নিজেরাও গবেষণায় তেমন আক্রমণ দেখায়নি। কিন্তু তখন থেকে গবেষণা চালিয়ে গেলে বর্তমানে করোনা ভাইরাসের আক্রমণে বিশ্বের সকল দেশকে এভাবে দিশেহারা হতে হতো না।

যখন চীনে ডিসেম্বরে করোনা ভাইরাসের আক্রমণ আরম্ভ হলো, চীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে তা সঙ্গে সঙ্গে অবগত করে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেটাকে নতুন একটা খবর ছাড়া খুব বেশি ভয়াবহ মনে করেনি। বিশ্বকে এ ব্যাপারে বা নতুন করোনা ভাইরাসের মহামারি সম্পর্কে প্রথম দুমাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেইভাবে সতর্ক করেনি। বড়-ছোট বিভিন্ন রাষ্ট্রের কর্ণধরসহ সংশ্লিষ্টরা ব্যাপারটাকে পাত্তা দেয়নি। ফল যা হবার হয়েছে। বিরাট বিরাট দেশ বলে যাদের লোকে সমীহ করতো, তারাই এখন ভয়াবহভাবে করোনা ভাইরাসের শিকার। চীন হয়তো উহানেই করোনা ভাইরাসকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারতো বাকি বিশ্বের সহযোগিতা পেলে। চীন সেরকম কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েই পুরো শহরটাকে কারাগার বানিয়ে এর প্রতিবিধান করার পদক্ষেপ নিয়েছিল। কিন্তু বাইরে বসে আমাদের অনেকের কাছেই মনে হয়েছিল সেটা নিষ্ঠুরতা। পুরো শহরের মানুষকে কঠিনভাবে এভাবে অবরুদ্ধ করে ফেলা আমরা মেনে নিতে পারছিলাম না। মায়াকান্নাটা আমাদের বেশি, সেজন্য পুরো ঘটনা সম্পর্কে না জেনেই মনে করেছিলাম চীন নিষ্ঠুর আচরণ করছে তার নাগরিকদের সঙ্গে। বলা হলো, চীন সরকার কীরকম নিষ্ঠুর, চিকিৎসার নামে পুরো একটা শহরের মানুষকে বন্দী করে রেখেছে। চীনের স্বৈরাচারী শাসনের স্বরূপ নিয়ে সারাবিশ্বে তখন সমাালোচনা আরম্ভ হলো। বাংলাদেশসহ বিশ্বের যতো দেশের মানুষরা তখন উহানে ছিল বা যারা পড়াশুনার জন্য গিয়েছিল, সকলের আহাজারি শোনা গেল, শহরটাকে বন্দি করে চীন সরকার তাদের জীবনটা অনিশ্চিত করে ফেলেছে। মৃত্যুপুরীর মধ্যে তাদের বন্দি করে রেখেছে। ব্যাপারটা নিশ্চয় তেমন ছিল না। কিন্তু প্রচারগুলি ছিল খুব নেতিবাচক।

বিভিন্ন ধরনের খবর আসছিল তখন চীনের উহান সম্পর্কে, যার মধ্যে সকলে কমিউনিজমের ভূত দেখতে পেয়েছিল। সরকার মানুষগুলিকে বন্দি করে রেখেছে, খাবার দিচ্ছে না ঠিকমতো। সপ্তাহে যে খাবার দেয়া হচ্ছে সেটা পরিমাণে অনেক কম। চীনের যেসব খাবার দেয়া হচ্ছে তা খাওয়া যায় না। খাদ্য কেনার জন্য পর্যন্ত কাউকে ঘর থেকে বের হতে দিচ্ছে না। বিশ্বের জন্য করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের ভয়াবহ কতটা বিপজ্জনক হতে পারে সে-খবরটাকে কম গুরুত্ব দিয়ে, চীনের শাসকদের দমনপীড়নের কথাগুলিই বেশি বলা হলো। কখনো এ ইঙ্গিতটা দেয়া হলো না যে, সকল নিষ্ঠুরতার পরেও উহানেই যদি এ ভাইরাসকে নির্মূল করা সম্ভব হয় সারা বিশ্বই তাতে লাভবান হতে পারে। কিন্তু সকল রাষ্ট্র চাইলে করেনা সঙ্কটের সমাধান তখনি হতে পারতো। যদি উহান থেকে এ ভাইরাসের উৎপত্তি হয়ে থাকে, সেটা উহানের মধ্যে আটকে রেখে নির্মূল করার পদক্ষেপই ছিল সবচেয়ে সঠিক। পাশাপাশি ইতিমধ্যে যেসকল নাগরিক উহান ভ্রমণ শেষে বিভিন্ন দেশে ফিরে গেছে তাদের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। সকল সরকার তাদের নিজনিজ দেশে কড়া নজরদারিতে রাখলে, তাদের সংক্রমিত হতে দেখলে তার প্রেক্ষিতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই সংক্রাণের সমাপ্তিটা সেখানেই ঘটতে পারতো। কিন্তু কারো পক্ষেই তখন করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা হৃদঙ্গম করা সম্ভব হয়নি, বিশ্বের জন্য তা কী পরিণতি ডেকে আনতে পারে তার প্রতি দৃষ্টি দেয়া হয়নি। চীন যে মহামারির হাত থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে কতোটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেটাও বোঝা যায়নি। ফলে বিভিন্ন সমালোচনার মুখে চীন উহানে অবরুদ্ধ বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের সেসব দেশে পাঠাবার ব্যবস্থা করলো। বাংলাদেশে ফিরে এলো অনেকে। নিশ্চয় এখন তারা টের পাচ্ছে উহানে থাকা সঠিক ছিল নাকি এই ফিরে আসাটা।

করোনা ভাইরাস নিয়ে চীন সম্পর্কে নানারকম মুখরোচক গল্প পরেও শোনা গেছে। কিন্তু বাস্তব সত্যটি হলো, চীনই করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে প্রথম সঠিক পদক্ষেপটি নিয়েছিল। বিশ্বের বহু রাষ্ট্রই এ ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের অযোগ্যতা প্রমাণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রই এখন সবচেয়ে ভয়াবহরকম করোনা ভাইরাসে সংক্রামিত, মৃতের সংখ্যাও সবচেয়ে বেশি সেখানে। কারণ রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প প্রথমে কিছুতেই চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কথা শুনতে চাননি। ট্রাম্পের জেদই যুক্তরাষ্ট্রকে ভয়াবহ বিপদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রেই শুধু করোনায় আক্রান্তদের সংখ্যা সারা পৃথিবীর আক্রান্তদের প্রায় এক চতুর্থাংশের বেশি। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে মানুষের মৃতের ক্ষেত্রেও তাই। বর্তমানে এমন খবরও পাওয়া যাচ্ছে, করোনা ভাইরাসের ভয়বহতার কথা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানরা জানতো। কিন্তু খবরটা তারা গোপন করেছিলেন। নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থেই রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পসহ বড় বড় ব্যবসায়ীরা তা চেপে গিয়েছিল। কারণ তাদের ভয় ছিল, খবরটি প্রকাশ হয়ে পড়লে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে ধ্স নামবে। ট্রাম্পের নিজেরই বিরাট ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য রয়েছে। ফলে শেয়ারবাজারে নিজেদের শেয়ারের দাম ঠিক থাকতে থাকতে সেগুলির একটা বিলিব্যবস্থা করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে করোনা ভাইরাসের ভয়াবহ বিপদ সম্পর্কে নীরব রইলো। বরং ট্রাম্প বলে বেড়ালো, এটা একটা সাধারণ ফ্লু। কিছুদিন আবার চীনকে দোষারোপ করলো। কিন্তু এখন বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ করছে, ট্রাম্প ইচ্ছাকৃতভাবে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের পদক্ষেপ নিতে দেরি করাতে যুক্তরাষ্ট্রে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে এবং এরই মধ্যেই এক লক্ষ বিশ হাজার মানুষ মারা যায়। ধনিক দেশগুলির কাছে আসলে আগে নিজেদের মুনাফা, তারপর জনগণের জীবনের মূল্য। নিজেদের মুনাফার স্বার্থে লক্ষ লক্ষ লোককে মৃত্যুপথে পাঠাতে তাদের মনে সামান্য দ্বিধা নেই। যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টভাবেই তা প্রমাণ করেছে। চলবে