কবি ফররুখ আহমদ সম্পর্কে লেখকদের মন্তব্য

সীমান্ত আকরাম

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৩, ২০১৮

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ও মৌলিক প্রতিভাধর কবি ফররুখ আহমদের জন্মশত বার্ষিকী এবছর (২০১৮) অতিবাহিত হচ্ছে। তাকে কেউ কেউ বিশেষ ‘মতাদর্শধারী’ চিহ্নিত করে উপেক্ষা করতে চান এবং নানা কটু মন্তব্য করতে দ্বিধা করেন না। যদিও এই উপেক্ষাকারীরা সাহিত্যাঙ্গনের কোনও উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি নন। কিন্তু দেখুন, কবি ফররুখ আহমদ সম্পর্কে আমাদের প্রগতিশীল মুরুব্বিগণের মনোভাব ও মন্তব্য কী প্রকার ছিল:

১. মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন (সওগাত সম্পাদক): ফররুখ আহমদ আত্মসচেতন ধার্মিক প্রকৃতির লোক ছিলেন। কিন্তু কারো অন্যায় কাজ বা অবিচার দেখলেই তিনি রাগান্বিত হয়ে উঠতেন। তার কবিতা ছিল অন্যায়, অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক এবং তাতে মানবতাবোধ সুস্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠত। অতীতের অনেক বিখ্যাত কবির মতো জাতীয় জাগরণ তার বহু কাব্যের লক্ষ্যবস্তু ছিল। কাজী নজরুল ইসলামের মতো ফররুখ আহমদও বাংলার পুঁথি সাহিত্য থেকে শব্দ চয়ন করে ‘জনভাষা’য় নব কাব্যের সৃষ্টি করেছেন। কাব্য রচনায় নিজের মৌলিক আদর্শে তিনি সুমহান ছিলেন।

২. শামসুর রাহমান (কবি): তিনি মারা গেছেন একেবারে নিঃস্ব অবস্থায়। না, ভুল বললাম। নিঃস্ব কথাটা তার সম্পর্কে প্রযোজ্য নয়। তার মানসিক ঐশ্বর্যের কোনও কমতি ছিল না। তিনি রেখে গেছেন এমন কয়েকটি গ্রন্থ, যেগুলি পঠিত হবে দীর্ঘকাল। তার বহু পঙ্‌ক্তি বারবার গুঞ্জরিত হবে কাব্যপিপাসুদের স্মৃতিতে।

৩. আবু জাফর শামসুদ্দীন (কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক): রাজনৈতিক ও সামাজিক বিবর্তন বা বিপ্লবের পথ সম্পর্কে তিনি যে ধারণা পোষণ করতেন তদ্বিষয়ে আমি বা অন্যেরা একমত পোষণ না করলেও তার বিশ্বাস ও নিষ্ঠা সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও সুযোগ তিনি কখনও দেননি। তিনি নিজে যা বিশ্বাস করতেন, ব্যক্তি জীবনেও তা পালন করতেন। তার কবি খ্যাতি নিয়ে আইয়ুবী আমলে ধনৈশ্বর্যের মালিক হওয়া অত্যন্ত সহজ ছিল। তার চাইতে অল্প খ্যাতিমান অনেক লোক সে আমলীয় সুযোগের সদ্ব্যবহার করে যার যার ভবিষৎ অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু তিনি সে পথ ঘৃণাভরে বর্জন করেন। রাও ফরমান আলী, আলতাফ গওহর প্রমুখ ব্যক্তি তার মালিবাগের অন্ধকার খুপরিতে নানা প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে এসব ঘটনার দু’একটি জানি, কিন্তু তিনি ঘৃণাভরে সেসব উদ্দেশ্যমূলক প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। এমনকি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমণের সাধারণ প্রস্তাবও তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।

৪. সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায় (শিক্ষাবিদ, গবেষক): কবিতাটি (সাত সাগরের মাঝি) পড়াতে গিয়ে কবির শক্তিমত্তার পরিচয় পেলাম, তার কবি সত্তার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে পরিচিত হলাম। বাংলা কাব্যে ফররুখ আহমদ যে কেন একটি বিশিষ্ট কবিকণ্ঠ বলে স্বীকৃত তার আভাস আমি পেলাম ওই কবিতা পঠন-পাঠনের ফলে।

৫. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী (শিক্ষাবিদ): বায়ান্ন থেকে তিয়াত্তর- এই একুশ বছর আমি ঢাকার বাইরে কাটিয়েছি। ফররুখ ভাই বরাবরই ঢাকাতেই থেকেছেন এবং চুয়াত্তরে তিনি ইন্তিকাল করেছেন। দুরত্বের কারণে স্বভাবতই যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল। তবে, ঢাকায় তার বাসায় যখনই গিয়েছি, তার সেই সহজ উচ্ছ্বলতায় গ্রহণ করেছেন। ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কোনও দুঃশ্চিন্তা বা সমস্যার কথা কোনও দিন বলতে শুনিনি। শুধু লেখা ও যারা লিখছে তাদের প্রসঙ্গই আলাপ হতো।

৬. মুহম্মদ হাবীবুর রহমান (বিচারপতি, লেখক): ফররুখ ভাই বয়সে আমার চাইতে ১৮-১৯ বছরের বড়। বয়সের এই বিরাট ব্যবধান সত্ত্বেও তিনি আমাকে কখনো তুমি বলতেন না, বরং আপনি সম্বোধনই করতেন। বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিতজনদের মধ্যে বয়সে জুনিয়রদের তো বটেই, অনেক সিনিয়রকে পর্যন্ত তুমি সম্বোধন করতেন। অথচ এ ব্যাপারে তিনি আমার বেলায়ই ছিলেন ব্যতিক্রম। তার আপনি সম্বোধনে আমি লজ্জায় সঙ্কুচিত হয়ে যেতাম। মাঝে মাঝে তাকে সম্বোধনটা পাল্টাতে অনুরোধ করতাম। কিন্তু কেন জানি না, তিনি ছিলেন এক্ষেত্রে অনড়। হয়ত এ ছিল আমার প্রতি তার অপরিসীম স্নেহের নিদর্শন।

৭. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম (শিক্ষাবিদ, লেখক): আজ ভাবতে বড় ভালো লাগছে, ঢাকা বেতারের চা খানায় যে সময়গুলো কাটাতাম, তার তো সীমা-সরহদ ছিল না-  ফররুখ ভাই ছিলেন মধ্যমণি। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে আসতেন মুনীর চৌধুরী, শামসুর রাহমান, বেতারের ছিলেন আবদুল আহাদ, ফতেহ লোহানী, শামসুল হুদা চৌধুরী, নাজির আহমদ- আরো কত জন। দিনভর আড্ডা হতো।  চা এবং পান সহযোগে আড্ডা। আলাপ হয়েছে প্রধানত কবিতা নিয়ে। রাজনীতিও এসেছে। সবাই জানেন, ফররুখ আহমদের বিশেষ এক মতাদর্শ ছিল এবং সে ভূমিতে কট্টরভাবে তিনি আপোষহীন। তখন কতই বা বয়েস আমাদের! ছাত্র রাজনীতিতে উত্তপ্ত সে সব দিন। সাহিত্য আর রাজনীতিতে অবশ্যই কোনও ফারাক ছিল না। আলাপ-আলোচনায় বিতর্কমূলক নানা কথা উঠে যেত। আমরাই কী আর হারতে রাজি হতাম? কিন্তু কলহের কোলাহলে চা-খানা উত্তেজিত হয়েছে, এমন ঘটনা কদাপি ঘটেছে, মনে পড়ে না। ফররুখ ভাইয়ের সেই উচ্চকণ্ঠ সরল হাসি আর ভালোবাসার মাধুর্য সব সময়েই সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে।

৮. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (শিক্ষাবিদ, লেখক): প্রবল ছিল তার (কবি ফররুখ আহমদের) আবেগ, প্রাকৃতিক শক্তির তীব্র কল্পনাশক্তি এবং অনমনীয় ছিল চরিত্র। সমঝোতা, সুবিধাবাদিতা, নম্রতার পথানুসন্ধান তার পক্ষে সম্ভব ছিল না আদৌ। এই অনমনীয়তা তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে অনেকের কাছ থেকে, বিরূপ করেছে অনেককে, কিন্তু এই অনমনীয়তা রক্ষা করেছে তার নিজস্বতাকে।

৯. হাসান হাফিজুর রহমান (কবি ও ইতিহাসবিদ): আমাদের আধুনিক কাব্যধারার পথনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিসমূহের মধ্যে ফররুখ আহমদ অন্যতম। ঐতিহ্যবোধ ফররুখ আহমদের মজ্জাগত। ঐতিহ্যবোধে উজ্জীবিত হতে না পারলে ফররুখ আহমদ লিখতেও পারেন না। ঐতিহ্যের জগতই তার স্বাভাবিক স্বস্তির জগৎ।

১০. সৈয়দ আবুল মকসুদ (কলামিস্ট): সমাজতন্ত্রী বিপ্লবীদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়েই যে তিনি ইসলামের জীবনাদর্শে সমর্পিত হন তা অনুমান করা ঠিক নয় এজন্য যে, কোনও দিন তিনি কম্যুনিস্টদের সম্পর্কে কটুক্তি করেননি। তবে তিনি তার নিজের মতাদর্শের প্রতি অবিচল এবং তা অমিততেজে প্রচারও করেছেন। তিনি বস্তুবাদের বিরোধিতা করেছেন কিন্তু মানবতাবাদী ছিলেন আমৃত্যু।

১১. সরদার জয়েন উদ্দীন (শিক্ষাবিদ): প্রতিভা-দীপ্ত কবি ফররুখ আহমদের কবিতা এবং কবিসত্তা সম্বন্ধে পণ্ডিতেরা অনেক আলোচনা করেছেন এবং ভবিষ্যতে আরো আলোচনা হবে বলে আমার বিশ্বাস। গত তিন যুগের মধ্যে কাব্য সম্ভারে প্রতিভা-ভাস্বর এই কবির আমি একজন পাঠকমাত্র। তার কাব্য-দ্যোতনা আমার হৃদয়কে উদ্বেলিত করে, তাই আমি তার ভক্ত- এইটুকু বলতে পারলেই আমি নিজেকে ধন্য মনে করতাম।

১২. আহমদ ছফা (কবি ও প্রাবন্ধিক): কবি ফররুখ আহমদকে আমরা এতোসব লাঞ্ছনার মধ্যে ফেলেছি, তার কারণ তো একমাত্র কবিতাই। ফররুখ আহমদের একমাত্র অপরাধ তিনি একদা পাকিস্তানের সপক্ষে কবিতা লিখেছেন। তার কবিতায় বিশেষ জীবনাদর্শের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ পেয়েছে। আর সে জীবনাদর্শ দুষ্টু লোকের ভাষায় ইসলামি জীবনাদর্শ। এখন কথা হলো, তখন কি পাকিস্তানের সপক্ষে কবিতা লেখা অপরাধ ছিলো? আমরা যতটুকু জানি, পাকিস্তান এবং ইসলাম নিয়ে আজকের বাংলাদেশে লেখেননি এমন কোনো কবি-সাহিত্যিক নেই বললেই চলে। অন্য অনেকের কথা বাদ দিয়েও কবি সুফিয়া কামালের পাকিস্তান ও জিন্নাহ’র ওপর নানা সময়ে লেখা কবিতাগুলো জড়ো করে প্রকাশ করলে ‘সঞ্চয়িতা’র মতো গ্রন্থ দাঁড়াবে বলে আমাদের ধারণা।

১৩. অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম (নজরুল গবেষক): যে কোনও জীবন্ত, প্রাণবন্ত, মৌলিক ও সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্বই বিতর্কিত প্রতিভা; কারণ তারা প্রচলিত মত ও পথের পথিক হন না। ফররুখ আহমদও ব্যতিক্রম নন। জীবদ্দশায় তিনি তার আদর্শগত কারণে অনেক বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু স্ব-আদর্শে তার নিষ্ঠা সম্পর্কে কেউ কখনো প্রশ্ন তোলেননি, বরং সে জন্যে তার বিপরীত আদর্শবাদীরাও তাকে শ্রদ্ধা করেছেন। কবি ফররুখ আহমদের মধ্যে কোনও আদর্শগত ফাঁক বা ফাঁকি ছিল না। তাই তার কবিতায় আমরা একজন সতেজ কবিকে সর্বদা প্রত্যক্ষ করি। সুকান্তের পর এমন আদর্শনিষ্ঠ কবি বাংলা সাহিত্যে বিরল। একজন দক্ষিণপন্থী কবি হিসেবে তার মধ্যে যে আদর্শনিষ্ঠার পরিচয় পাওয়া যায়, আমাদের দেশে কোন বামপন্থী কবির মধ্যে তেমনটি পাওয়া যায় না।

১৪. সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম (কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক): ফররুখ আহমদ শক্তিশালী কবি, সচেতন কবি। দেশকাল ভূগোলের পরিপূর্ণ বিকাশ তার কবিতায়। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল হবে কোনও বিশেষ চিহ্নে তাকে আলাদা করে দেখলে। তার একটি পিঠ দেখে তার সম্বন্ধে রায় দেয়ার প্রথা এখন বাতিল করা প্রয়োজন। যার সৃষ্টি বিশাল, যার নির্মাণ নিখুঁত, তাকে ক্ষুদ্র গণ্ডী ও স্থুল দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা নির্বুদ্ধিতা।

১৫. মুহম্মদ নুরুল হুদা (কবি ও গবেষক): কেউ কেউ অবশ্য ফররুখের কাব্যভাষাকে ডেড ল্যাং গুয়েজ বা মৃতভাষা হিসেবে চিহ্নিত করতে আগ্রহী। তাদের মতে, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ইংরেজ পাদ্রীদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষার যে নবায়ন, সেটিই হচ্ছে জীবন্ত বাংলাভাষা। ফররুখ আহমদ এ সত্য সম্পর্কে অনবহিত ছিলেন না; এবং এও আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, ফররুখ আহমদ বাংলা ভাষাতেই কবিতা লিখেছেন এবং পাকিস্তানের জন্মের অব্যবহিত পরে ভাষাবিতর্কে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে বাংলা ভাষার সপক্ষে রায় দিয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাষার পরিবর্ত অন্য ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করলে এই দেশে ইসলামি সংস্কৃতিকে হত্যা করা হবে।’

সূত্র: ফররুখ আহমদ: কবি ও ব্যক্তিত্ব, শাহাবুদ্দীন আহমদ সম্পাদিত, গ্রন্থনা: সরদার আবদুর রহমান, এপ্রিল ২০১৮