কণ্ঠ: যা-তা করেছে ছবিটা
দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়প্রকাশিত : মে ১৭, ২০১৯
প্রত্যেকটা মানবজীবনের আকাশে একটা করে ধ্রুবতারা থাকে। যার দিকে চাইলে তার জমিনের চূড়াটা না ধরলেও, আলোটা পেতে পারেন। কেমন জানেন? বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেই দেখুন। ঋত্বিক ঘটকের যেমন ‘তিতাস...’, সত্যজিতের যেমন ‘পথের পাঁচালী’, মৃণালের যেমন ‘কলকাতা ৭১’, ঠিক তেমন।
সময়টা পেরিয়ে ’৮০-পরবর্তী পরদায় চোখ রাখুন। গৌতম ঘোষের যেমন ‘পার’, ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘আবহমান’। ঠিক তেমনই কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শব্দ’। ২০১৯-এ দাঁড়িয়ে আর এক বাঙালি পরিচালককে দেখলাম কাল। শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। কাল যদিও ছবি করা ছেড়ে দেয়, ওর ধ্রুবতারার নাম দেব ‘কণ্ঠ’।
আমি ফিনিক্সের পুড়ে যাওয়া দেখেনি। তার ডানার পালক, তার লোমচর্ম, তার হাড়-মজ্জার ঝলসে যাওয়া দেখিনি। দেখিনি নির্বাপণের পর সেই পক্ষীর ধীরে ধীরে ধীরে ধীরে গজিয়ে ওঠা। আবার করে তার উড়তে পারা। কাল ‘কণ্ঠ’ দেখে মনে হল, আমার দেখা প্রথম ফিনিক্স পাখিটার নাম ‘শিবু’, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
গল্পটা অ্যাদ্দিনে সকলেরই জানা। এক অসীম প্রতিভাধর রেডিয়ো-জকি, মারণরোগে যার কণ্ঠটাই স্তব্ধ হয়ে যাবে আচমকা। তারপর ধীরে ধীরে ধীরে ধীরে চলবে তাকে ফিরে পাবার লড়াই। সে লড়াইয়ে ডাক্তার আছে। স্বজন-পরিজন আছে। কিন্তু শেষমেশ জিততে হলে ‘গোল’টা যে তাকেই করতে লাগে!
শরীর যখন মস্তিষ্কে কামড় বসায়, মানুষ তখন চিতার চেয়েও হিংস্র। ব্যাধের যখন তূণীর হারায়, সে তখন ধনুকের বক্র। মেঘ যখন বৃষ্টি-ছাড়া, তার গর্জন তখন পৃথ্বী কাঁপায় সবচেয়ে বেশি। অভিনেতা শিবু তার চরিত্রের গড়নে, প্রতিটা রক্তকোষে যখন এর সব ক’টাকে ধরে, তার সীমাটা তা’ও বোধহয় চেনা-চেনা ঠেকে। কিন্তু একটা প্রস্ফুটিত ফুলের একটু একটু করে পাপড়ি খসা, তার রঙের গায়ে ক্ষয়ের চিহ্নগুলো বাদামী, বাদামী, আরও বাদামী হতে হতে শুকনো মড়মড়ে যাওয়া, এমনকী তার নেতিয়ে যাওয়ার পর ‘রিওয়াইন্ড’ বাটন-এ তার পুনর্জন্মকে যখন ধরল ও, বিশ্বাস করুন, মনে হচ্ছিল ‘মহাজাগতিক’ কিছু দেখে ফেলছি! ছেলেটা না পাক্কা একটা রেলাবাজি করে গেল, দু’ঘণ্টার বেশি সময় ধরে। আড়া ব্যাটে টকাং টকাং করে গ্যালারি টপকানো শট নিতে নিতে কিছু না বলেও বুঝিয়ে দিল, ‘‘বস্, অভিনয়টা এ ভাবে করতে হয়। একটু দেখবেন?’’
সেরা সময়ে ভিভ রিচার্ডসকে মনে পড়ে? চিউইং গাম চিবোতে চিবোতে গামা-গাম সব বোলারকে কেমন রান্না-বাটি খেলা এলেবেলের দলে করে টেনে নামিয়ে রেলা করত, অনেকটা তেমনই করল শিবু! বললে বাড়াবাড়ি লাগতে পারে, তবু বলি, বলিউডে এই লেভেল-এ অভিনয়টা ইরফান, নওয়াজরা যদি করত, অ্যাদ্দিনে না, ভোটের ঘোঁট-বোটকে থামিয়ে ড্যাস্ দিয়ে শ’খানেক অ্যাঙ্কর-স্টোরি হয়ে যেত ন্যাশনাল লেভেলের খবরের কাগজের পাতায়। ‘কণ্ঠ’র দুর্ভাগ্য, শিবু-নন্দিতার (রায়) দুর্ভাগ্য, এখনও বাংলা ছবি হাজার ভাল কাজ করুক, দক্ষিণিদের মতো ‘রিজিওনাল’ ছাপ্পাকে পটাপট তুলে দেওয়ার মতো ‘ইরেজার’ জোটাতে পারেনি।
সন্দেহ নেই শিবু হল কণ্ঠ-র ‘আন্দ্রে রাসেল’। কিন্তু বাকিরা? লাইন-আপটা দেখুন, পাওলি, জয়া আহসান, চিত্রা সেন, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কণীনিকা...!
ডাক্তার জয়া, তাও চরিত্রে ‘মাঠ’ পেয়েছে, এবং ফাটিয়েছে। কিন্তু পাওলি? ‘মাঠ’ বানিয়ে নিতে হয়েছে ওকে। ওর চোখ, ওর আঙুল, ওর ঠোঁটের ওঠাপড়া, ওর ডুকরে ওঠা যে ভাবে, প্রেম-যন্ত্রনা-ব্যাকুলতা-কাতরতা-ঈর্ষা-বিদ্বেষকে সেকেন্ডেরও কম সময়ে ধরেছে, সিম্পলি অমানুষিক লাগে। চিত্রাদি-কণীনিকা বা পরাণদাও তাই। সঙ্গে দু’টো বাচ্চা, কী যেন নাম! আহা, ভুলে গেছি। কিন্তু টেরিফিক টেরিফিক।
তার ওপর ওই ফ্যাট-ফ্রি সংলাপ, আর তার মাঝে মাঝে ছোট্ট গুগলি দেওয়া এমন এক-একটা সুগার-কোটেড ডেলিভারি, ধুপধাপ বোল্ড হতে হয়!
যা-তা করেছে ছবিটা। কাঁদিয়েছে। কাঁপিয়েছে। ভয় ধরিয়েছে। রাগ পাইয়েছে। আর কী কী সব করালো! একটাই শুধু পারেনি। ঘুম পাড়াতে!
কিন্তু মুশকিল কোথায় জানেন, ছবিটায় এমন সব সাবটেক্টের খেলা আছে না, দড়াম করে আনমনা করে দেয়। কখন যে টেক্সট ছেড়ে মার্জিন, মার্জিন ছেড়ে ধু-ধু হাওয়ায় পাঠিয়ে দেয়, বোঝা যায় না! আর ঠিক তখন, ঠিক তখনই নিজেকে বড় শূন্য মনে হয়। শূন্য মনে হয়। হাতলে হাত গেলেও অসহ্য লাগে। বসার অংশটাকে লাগে বাড়তি। পায়ের নীচে ইঞ্চি কয়েক কার্পেটটা পা ঠেকলে জমাট বিরক্তি। বাক্যিহারা হওয়ার সেখানেই শুরু...
কারা যেন সব কণ্ঠ-র মধ্যে ইতালীয় ছবি ‘আ বিগার ল্প্ল্যাস’-কে দেখেছেন, তাদের ‘গড়’ করি দাদাভাই। ভাল থাকুন। আমরা নয় ছবিটা দেখি। পারলে ‘কণ্ঠ’র লেভেল-এ কিছু একটা নামান না, টিকিট কেটে দেখে আসব কথা দিচ্ছি। আর সামনে পেলে আপনাকে জোড়া পেন্নাম ঠুকব।