ওয়াজ মাহফিল এখন তামাশার মঞ্চ

কাসেম আল মামুন

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ০৫, ২০২৩

ডিসেম্বর-মার্চ এই সময়টাকে বাংলাদেশে বলা যায় ওয়াজের মওসুম। রাতবিরেতে হরদম ওয়াজ চলবে। আবার ডিসেম্বরে শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষাও। সাধারণ মানুষের সাহসও নাই এসবের বিরুদ্ধে কথা বলার।

আমাদের দেশে নরমালি ওয়াজ শুরু হয় আসর বা মাগরিব নামাজের পরে। প্রধান বক্তব্য শুরু হয় এশার পরে। এটা কতটুকু সুন্নাহ সম্মত? চলুন একটু দেখি...

আবু বার‍যা আসলামি (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (সা.) এশার আগে ঘুমানো ও এশার পরে কথা বলা অপছন্দ করতেন। বুখারি ৫৬৮

ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল রাত জেগে গল্প করাকে কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন। ইবনে মাজাহ ৭০৩

এখন অনেকে বলতে পারে, সব ওয়াজ মাহফিলে তো আর বেহুদা গল্পগুজব হচ্ছে না। দ্বীনী উপকারী কথাও হচ্ছে। আর এশার পরে উপকারী কথা বলা মাকরূহ নয়। এর প্রমাণ হচ্ছে, ওমর (রা.) বলেন, রাতের বেলা রাসুল (সা.) আবু বকরের সাথে মুসলমানদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করতেন আর আমিও তাদের সাথে থাকতাম। তিরমিজি ১৬৯

এখন আলিমদের মাঝে এটা নিয়ে দুইটা মত তৈরি হয়েছে। একটা অংশ এশার পরে কথা বলা মাকরূহ বলেছেনক, আরেক অংশ বলছেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোচনা ও অতিপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলার অনুমতি আছে।

কিন্তু আমাদের ওয়াজ মাহফিলগুলোতে কি হয়? মুসলিম উম্মাহর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কর্মপরিকল্পনা? জ্ঞান বিজ্ঞানের তুখোড় আলোচনা? মানুষকে দ্বীনে আনার আন্তরিক বয়ান? আচ্ছা যদি ধরেও নিই, ওপরের বিষয়গুলোই আলোচিত হয়, তবে মানুষকে কষ্ট দিয়ে এগুলো করার ব্যাপারে একটি হাদিসও আপনি পাবেন না।

যে হাদিস দ্বারা উপকারী জ্ঞান ও প্রয়োজনীয় কথা বলার পারমিশন পাওয়া যাচ্ছে সেখানে নিজের ঘুমকে বাদ দিয়ে নিজে লিপ্ত হওয়ার কথা বলা আছে কিন্তু কোথাও অন্যের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটিয়ে কিংবা অসুস্থ মানুষকে কষ্ট দিয়ে, বড় বড় মাইক দিয়ে এই ধরনের আয়োজন কি জায়েজ হতে পারে?

যেখানে অন্যকে কষ্ট না দিয়েই ইশার পরে রাত জাগা নিয়ে ইখতিলাফ হচ্ছে সেখানে অন্যকে জোর করে জাগ্রত রাখাটা কতটুকু যৌক্তিক? রোগী, পরীক্ষার্থী এদের কথা কি একবারও আপনারা ভাবেন না?

ইবনুল জাওযি (রাহি.) তার `তালবিসুল ইবলিস` গ্রন্থে বলেন, “আমি কোনো কোনো ব্যক্তিকে দেখেছি গভীর রাতে মিনারে উঠে ওয়াজ নসিহত করে,উচ্চস্বরে কুরআন তিলাওয়াত করে, যিকির করে। এভাবে মানুষের ঘুমে ও তাহাজ্জুদে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। এগুলো  সবই অন্যায় ও নিষিদ্ধ কাজ।”

আমাদের দেশে ওয়াজ করায় কারা? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইসলামি রাজনৈতিক সংগঠন বা পাড়ার কোনও সামাজিক সংগঠন বা মাদ্রাসা। এরা সবাই মানুষের কল্যাণে কাজ করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু ওয়াজ করিয়ে কি মানুষের কল্যাণ সাধন হয় নাকি অকল্যাণ হয়, একটু ভেবে দেখবেন।

আর বক্তার ব্যাপারে যদি বলতে হয় তবে সেখানে আরেকটা আর্টিকেল লিখতে হবে। মাঝেমধ্যে মনে হবে, আপনি কোনও কমেডি শো`তে এসেছেন। কখনো বক্তা তার নিজের গুণগান নিজে গাইতে শুরু করেন, কখনো গজল শোনান,কখনো আযান দেন, কেউ কেউ যুবকদের উপদেশ দিতে গিয়ে মারাত্মক লেভেলের রোমান্টিক হয়ে পড়েন।

সেদিন দেখলাম পিচ্চি একটা ছেলে বয়স আনুমানিক ৮/৯ হবে স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক জীবন নিয়ে আলাপ করছে। আরেকটা ছেলে বয়স আনুমানিক ৭/৮ হবে তার ওয়াজি বাবার পাশে বসে লোকদের বয়ান দিচ্ছে। ওয়াজ হয়ে গেছে এখন একটা তামাশার মঞ্চ। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।

আমি ওয়াজ মাহফিলের বিরোধী নই। কিন্তু মানুষের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড যদি কোনও কারণে বিঘ্নিত হয় আপনার সুন্নাহ বিরোধী পন্থায়, যেটাকে আপনি আবার ইসলামের নামে চালিয়ে দিচ্ছেন, তবে সেটার আমি বিরোধী।