সংগৃহিত

সংগৃহিত

এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়? তেমন যোগ্য সমাধি কই?

অভিষেক মুখার্জি

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৯

সুদীপ চোঙদার গড়বেতার সন্তান। সেই গড়বেতা-কেশপুর, বাংলার সেই মাটি যেখান থেকে বাংলায় সিপিএম জমানার পালাবদলের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল প্রথম। একটা অদ্ভুত সমাপতন বাংলার রাজনীতিতে লক্ষ্য করা যায়। অন্তত দু- দুবার গেছে। প্রথমটা ৬৭ সাল আর দ্বিতীয়টা নব্বই এর দশকের শেষ ভাগ।বাংলায় শাসক-বিরোধী পার্লামেন্টারী রাজনীতি, সংসদীয় বিরোধী রাজনীতি আর বিপ্লবী রাজনীতি দুয়েরই উত্থান হয়েছে একই সাথে। ৬৭-সালে কংগ্রেসী শাসনের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট একদিকে আর অন্যদিকে নকশালবাড়ি আর নব্বইয়ের শেষভাগে সিপিএম শাসনের বিরুদ্ধে মমতাময়ী মমতার রাজনীতি আর অন্যদিকে গ্রামবাংলায় নতুন করে পল্লবিত হওয়া বিপ্লবী সংগ্রাম। যে সংগ্রাম গতি পায় পূর্বতন সিপিআইএমএল(পিপলস ওয়ার) ও সিপিআইএমএল(পার্টিইউনিটি)-র মত দুটি শক্তিশালী বিপ্লবী সংগঠনের একসাথে মিলিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ঐক্যবদ্ধ সিপিআইএমএল(পিপলসওয়ার)গঠিত হওয়ার পর। ৯৮সালে।লালগড় আন্দোলন এর রক্তাক্ত আর ঝোড়ো দিনগুলোর সময় আনন্দবাজার আর গণশক্তির পাঠ নিয়ে যে সকল সিপিআই(এম)সর্মথকরা আজও নেতাদের উগরে যাওয়া কথাগুলো যন্ত্রের মত আওড়ে যায় তাদের জেনে রাখা ভালো যে বাংলার মাটিতে বিপ্লবী আন্দোলনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে তার বছর পনেরো আগে ৯৫-৯৬সাল থেকে। যে দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতি ছিল লালগড়। সত্তরের `আগুনখোর` বিপ্লবীদের কফিহাউস-বিপ্লবের বিপরীতে এই সময় থেকেই শুরু হয় ছাত্র-যুবদের নতুন করে ভূমিহীন কৃষক আর দরিদ্র শ্রমজীবি মানুষের সাথে একাত্ম হওয়ার জন্য গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়া,সিংভূম-বেলপাহাড়ী-ঘাটশিলা-ধলভূমগড়ের রুক্ষ মাটিতে অপরিসীম মেহনত করেও অপরিমেয় দারিদ্র্যের মাঝে বেঁচে থাকা মানুষগুলির কাছে পৌঁছে যাওয়া সমাজ পরিবর্ত্তনের চেতনা নিয়ে। সেই স্থবির জগদ্দল সময়ে স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার আর পাহাড় কাটার হিম্মত দেখিয়েছিল যে মুষ্টিমেয় বঙ্গসন্তান সুদীপ চোঙদার তাদেরইঁ একজন।

 

অপারেশন বর্গার গাজর ঝুলিয়ে নিঃসন্দেহে কুড়ি বছর ঘোষ আর মাহাতোকে এক ঘাটে জল খাইয়ে ছিল সিপিএম;কিন্তু গ্রাম বাংলা ফুঁসছিল। বিকল্প ছিল না। তাই তা কার্যকরী রূপ পায়নি।কিউবার সরকারকে যদি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ২০০ বার ফেলার চেষ্টা করে থাকে আর ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যার চেষ্টা হয়ে থাকে অসংখ্যবার তবে সাম্রাজ্যবাদের যুগে সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতি আর ঘেরাটোপের মধ্যে দাঁড়িয়ে ৩৪ বছর একটা সরকার কাদের স্বার্থ রক্ষা করে টিকে থেকেছে আর তাদের নেতাদের মৃত্যুতে মাল্যদান করে শোকস্তব্ধ হয়েছে কারা, কোন শ্রেণী, অন্য সব আলোচনা ছেড়ে দিলাম, শুধু মাত্র এটুকু দিয়েই যদি তুল্যমূল্য বিচার করি তাহলেও বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। সিঙ্গুর- নন্দীগ্রাম তো অনেক পরের অধ্যায়।

 

৯৬-৯৮-সালের এই পর্যায়ে অর্থাৎ প্রাথমিক পর্যায়ে কিন্তু কোনো সশস্ত্র সংগ্রাম হয় নি। আগ্রহীরা পুলিশ ফাইলস খুলেও দেখে নিতে পারেন। হয়েছিল একের পর এক গণ-আন্দোলন পশ্চিমমেদিনীপুরের মাটিতে। আলুচাষের সাথে যুক্ত কৃষিমজুরদের মজুরী বৃদ্ধির দাবীতে(যেহেতু গড়বেতা-চন্দ্রকোণা আলুচাষ, মজুত ও বিপণনের একটি অন্যতম বড় কেন্দ্র), সেচের দাবীতে, বিদ্যুতের দাবীতে, কেন্দুপাতার রেট বাড়ানোর দাবীতে, ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে, জঙ্গলের বনজ সম্পদের ওপর বনবাসীদের অধিকার কায়েমের পক্ষে গড়ে ওঠে একের পর এক গণআন্দোলন। ক্ষমতায় সিপিআই(এম)থাকলেও এ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল গ্রামীণ সামন্তরা। কেশপুর-গড়বেতার রাজনীতিতে ততদিন এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্ত্তন ঘটে গেছে। ৯৮-সালে বাংলায় তৃণমূলের জন্ম, ৯৯-সালে মমতাদেবীর এনডিএ-তে যোগদান এবং বিপুল কেন্দ্রীয় অর্থের সরবরাহের সুযোগ নিয়ে গড়বেতা-কেশপুরে একদা সুশান্ত ঘোষের অনুগত লেঠেলবাহিনীর একাংশকে নিজের পক্ষে নিয়ে আসা(যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য রফিক ও তার অনুগত বাহিনী) এবং `কেশপুর হবে সিপিআই(এম)-এর শেষপুর`, এ শ্লোগানে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করা। দাপুটে নেতা সুশান্ত ঘোষকেও সেদিন তৃণমূল-বিজেপির এই আক্রমণের মুখে নিজের এলাকা ছেড়ে পালাতে হয়েছিল। তৃণমূল-বিজেপির এই রণক্ষেত্রের সামনে একমাত্র মুখোমুখি যদি কেউ দাঁড়িয়ে থাকে সেদিন তা ছিল জনযুদ্ধ পার্টি আর তার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা গণআন্দোলনকারী শক্তিই। ইতিহাসের আরও একটা উল্লেখযোগ্য তথ্য এ প্রসঙ্গেই তাই দিয়ে রাখা দরকার যে বাংলার মাটিতে মাওবাদীদের হাতে প্রথম কিন্তু কোনো সিপিআই(এম)নেতা খুন হয় নি। হয়েছিল তৃণমূল-বিজেপির নেতা জগদীশ তেওয়ারী। যে সত্য কোনোদিন সিপিআই(এম)এর নেতারা সামনে আনবে না। কারণ তৃণমূল-বিজেপির মিলিত আক্রমণ যখন প্রতিরোধ করছিলেন কেশপুর-গড়বেতার মানুষ তখন নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল সুশান্ত ঘোষ-দীপক সরকার জুটি। তাদের পরিকল্পনাও ছিল পরিষ্কার। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। কারণ বিপ্লবী শক্তির পাল্টা প্রতিরোধে তৃণমূল-বিজেপি যদি নিশ্চিহ্ণ হয় তাহলে একদিকে তাদের ভোটব্যাঙ্ক সুরক্ষিত থাকবে আর পরে প্রশাসনকে ব্যবহার করে এদেরকে শেষ করা তো সুশান্ত ঘোষের বাঁ হাতের খেল। হয়েছিলও তাই। এলাকা থেকে বিজেপি-তৃণমূল নিশ্চিহ্ণ হওয়ার পর নির্মম সন্ত্রাস নামে গ্রামের পর গ্রামে। রাতের অন্ধকারে গণ-আন্দোলনকর্মীদের বাড়ী থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়। অকথ্য অত্যাচার, পেটানো, বাড়ী ভেঙে দেওয়া, যে কৃষক সংগঠনের ছত্রচ্ছায়ায় সংগঠিত হচ্ছিলেন কৃষকরা সেই মজদুর কিষাণ সংগ্রাম সমিতি-কে অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ করা,তার প্রকাশ্যে সভা,সমিতি করার সমস্ত সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া কিই না করেছে সিপিআই(এম)। সন্ত্রাসের চূড়ান্ত রূপ ছিল এই গড়বেতারই ছোট আঙ্গারিয়া যেখানে মিটিং করতে আসা এগারোজন গণআন্দোলনকর্মীকে বাড়ীর মধ্যে বন্ধ করে বাইরে থেকে আগুন লাগিয়ে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। কেশপুর-গড়বেতার মানুষ সত্যিই অনেক অনেক কিছু দেখেছেন। পুলিশ-ক্যাডার-প্রশাসনের মিলিত আক্রমণের বিরুদ্ধে আন্দোলন এ সময়ই সশস্ত্র রূপ পরিগ্রহ করে। বাঁচার তাগিদে। কারণ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের সমস্ত সুযোগ রাষ্ট্রযন্ত্রের পায়ের তলায় পিষে দেওয়া হয়।

 

সুদীপ চোঙদার এই পুরো পর্যায় জুড়ে আন্দোলনের অন্যতম কুশীলব, সংগঠক, জঙ্গলমহলের মানুষের অনেক বড় আশ্রয়স্থল।কামারপুকুর কলেজের ছাত্র সুদীপ চোঙদার একসময় এসএফআই করতেন। পরিবারে অসচ্ছলতা হয়তো ছিল না।কিন্তু চারপাশের গ্রামীণ জীবনের বঞ্চনা;দারিদ্র্য, আর শোষণকে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতাই তাঁকে বিপ্লবী রাজনীতিতে টেনে আনে। প্রথমবার গ্রেপ্তার হন ২০০১-সালে। মুক্তি পান ২০০৫-এ। ২০০৬-এই আবার সংগঠনে যোগদান ও ২০০৮-সালে সিপিআই(মাওবাদী)সংগঠনের রাজ্য কমিটির সম্পাদক।২০১০-সালে লালগড় আন্দোলন চলার পর্যায়েই আবার গ্রেপ্তারী। তারপর দীর্ঘ নয়বছর শুধু বিচারাধীন বন্দী হিসাবেই এই সুদীর্ঘ জেলজীবন। কেশপুর-গড়বেতা এলাকায় মানুষের মধ্যে তাঁর যা প্রভাব ও গ্রহণযোগ্যতা যে কোনদিন রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে, তৃণমূলের সাথে আপোষ করে মুক্ত হতে পারতেন। করেন নি সেজন্যই অবহেলায়, বিনা চিকিৎসায় ছটফট করতে করতে রাষ্ট্রেরই কারাগারে মরতে হল তাঁকে।

 

খুব গল্প করতে ভালবাসতো, বলতেও যারা কাছ থেকে দেখেছে তারা জানে প্রত্যেকেই। দু-একজন কথায় কথায় একবার জিজ্ঞেস করেছিল:সুদীপদা,জীবনটাকে কিভাবে দেখো?উত্তর ছিল,জীবন? ঐ তো সকালবেলা লাট্টুর মত আকাশে ছুঁড়ে দিই। আর লুফে নিই সন্ধে হলে। সুদীপ চোঙদার যেখানেই থাকুক,মানিয়ে-গুছিয়ে নেওয়া জীবনের বিরুদ্ধে একজন কমিউনিষ্টের মতই সব বাধা-বিঘ্ন তুচ্ছ করে এই হেলায় জীবন নিয়ে লোফালুফির খেলা ঠিক দেখিয়ে যাবে।