এলিজা খাতুন
এলিজা খাতুনের ৭ কবিতা
প্রকাশিত : অক্টোবর ২৮, ২০২২
বদল
বছরের পর বছর নিদারুণ নীরবতায়
শিরা-উপশিরায় বাসা বেঁধেছে উপেক্ষার ঘূণপোকা
অবজ্ঞা-শঙ্কিত প্রাণে
যতবার গেছি প্রেমে-বিনম্র ওই মুখ-সম্মুখে
গ্রীবার নিচে অহমিকা দেখি ততবার
এমন করে আর কতটা কাল! আর কতটা জীবন!
শব্দহীন জেগে থাকা এই সেই অনিদ্রা-ভেজা চোখ
যেখানে তাকিয়ে ঋতুবদলের ভোর দেখতে চেয়েছো
ঘাসের ডগার শিশিরের মতো নাকফুল দেবে বলেছো
আজকাল তোমার নিঃশব্দতা যেন
ভাতের সাথে মেখে দেওয়া দ্রব্যমূল্যের বিষের মতো
কবে, কখন, কেন হলে অমন ঘাতক!
পোড়াকাব্য
খড়কুটো জ্বেলে বৃত্তাকারে ঘিরে বসে
ঘরহীন কিছু বালক-বালিকা আগুন তাপাচ্ছিল
আমি পাশ দিয়ে হেঁটে যাই
কাঁধের ঝোলায় কবিতার পুরু পান্ডুলিপি নিয়ে
ডাকযোগে পাঠাতে হবে মধ্যশীতেই
যেতে যেতে দেখি,
ওদের খুঁটে আনা খড়কুটো ফুরিয়ে আসছে
আগুনের লাল শিখা কমে যাচ্ছে ধীরে
আর দেখি, বালক-বালিকাদের
আলোমাখা রক্তিম মুখজুড়ে মেঘ নেমে আসছে
অথবা কুয়াশার ধোঁয়াশায়
খানিক অস্পষ্ট ম্লান হয়ে পড়ছে প্রত্যেক মুখাবয়ব
নাকি আগুন-আনন্দ মিশেল মাঠের বুকের
ক্ষণিক আবির-আভায় আমার হৃদপিণ্ডে
গোধূলির বন্যা বয়ে যেতে যেতে নিঃশেষ হচ্ছে!
কাব্য-সম্বলিত দৃষ্টিজালে ধরা পড়া শীতার্ত মুখগুলো
জমে যাচ্ছে ক্রমেই... রুক্ষ-শুষ্ক বিধ্ধস্ত হচ্ছে...
নীল হচ্ছে... দারিদ্রের পাশবিক বিষে!
ইত্যাদি ভাবনার সুরাহা না হতেই
খড়ের শেষ টুকরোটি বালক-বালিকারা কুড়িয়ে
ছাই হতে চাওয়া আপাত দগদগে স্তূপে ফেলে দেয়
আগুন জিইয়ে রাখার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায়
বিচলিত হয়ে ওঠে আমারও প্রাণ
এরই মধ্যে শামিল হয়ে গেছে স্নায়ুর কাব্য-প্রবণতা
ঝোলা থেকে পান্ডুলিপি বের করে একটা একটা করে পাতাগুলো দিতে থাকি আগুনের নিস্তেজ হলকায়
কবিতার কাগজে উসকে ওঠা আগুন
ওদের ফাটা ঠোঁটের হাসিতে ঠিকরে পড়ছে
জন্ম নেয় অন্য তুমুল কবিতার!
আমার পান্ডুলিপির সমূহ কবিতা
এভাবেই উন্মোচিত হয় আগুন তাপানো উচ্ছ্বাসে
আর পোড়া কবিতাগুলো আলো-আঁধারিতে
পাঠ হতে থাকে বালক-বালিকাদের স্বস্তির ধ্বনিরূপে
একফালি রোদ
ভোরের চোখে তখনও কিছু ঘুম লেগে ছিল
জানালা খুলেছি মাত্র, দেখি,
রাত্রের পড়া বইটা মাথার কাছে খোলা এখনো
একফালি রোদ এসে পড়ে
খোলা পাতার কালো কালো অক্ষরে
তাপ-আলো পেয়ে গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠে বর্ণসমূহ
একে একে মাথা চেঁড়ে ওঠে সমস্ত শব্দ, বাক্য,
আর অন্ধকার রঙে নির্লিপ্ত থাকা
খণ্ড খণ্ড জনপদের মতো প্রত্যেক অধ্যায়;
স্পষ্ট হতে হতে আরও স্পষ্ট কৃষ্ণাঙ্গ হয়ে উঠছে
বেলা বাড়ার সাথে সাথে
প্রবল উজ্জ্বল আর তীক্ষ্ণ হয়
লিপিবদ্ধ কালচে শরীরগুলো
পৃষ্ঠাজুড়ে সারি সারি লাইনে দাঁড়িয়ে আছে
তীব্র কালো এক একটা জ্বলন্ত কয়লার দেহ
বৈষম্যের দুপুরে পুড়ে পুড়ে কঠিন থেকে কঠিনতর
শ্বাসরোধ করা ফ্লয়েডের কষ্টধ্বনি বুকে সেঁটে
বিক্ষোভ চলতে থাকে... চলতে চলতে...
পাতা থেকে নেমে আসে রাজপথে
এমন আছে কোনো!
নক্ষত্রের দিকে ছুটছি একা, এই শহরের মতো
কাঙ্ক্ষাকে যা-কিছুই চমৎকৃত করুক
যাবতীয় সবুজ চারাগাছ মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে
মারাত্মক স্বভাবের একদল হায়েনা
অগ্নিতাণ্ডবে ঝাঁঝরা করছে সংস্কৃতির বিকাশ
অনাদৃত কার্নিশে কতক পাখি বর্বরতার উদ্দেশ্যে
আর্ত আহাজারি কিংবা হা-হুতাশ প্রহসন করে চলছে
ফুলেরা নিজস্ব গন্ধ ঠোঁটে চেপে
প্রস্ফুটিত হতে হতে আচমকা পিছু হটে এলো
কুঁড়িতেই তা স্থগিত আপাতত
এদিকে সুবিধাবাদী প্রবণতা নিদারুণ শোষণ করছে
সৃজনোন্মুখ স্নায়ুকে। চৈত্রের বিলে ফাটা মাটির
শেষ জলবিন্দুটুকু যেভাবে শুষে নেয় রৌদ্রপ্রখর তাত
রাত ঘন হলে, কী জানি কোন্ আশায়
নক্ষত্রের দিকে ছুটছি একা, এই শহরের মতো!
ব্লটিং পেপারের কালি শোষণ-বৈশিষ্ট্যের মতো
এ অন্ধকার অধিকার করে নিতে পারে
এমন আছে কোনো নক্ষত্র-আলো?
তবুও কাঙ্ক্ষা
চতুর্দিকে ভিড়ভাট্টা হৈচৈ
মাঝখানে ম্লান ঐতিহ্য দাঁড়িয়ে
অন্ধকার যা দেখেছি এ যাবৎ
সম্মুখে তারও বেশি সম্ভাব্য অন্ধকার
জল মাটি পাহাড় অনন্ত সুদূর
কী ভীষণ জেগে থাকে সৃজনের কাঙ্খায়!
বিগত এবং আসন্ন দুর্ভিক্ষে বেরিয়ে আসা
বুকের পাঁজর যেমন
মনুষ্য-ক্রমোন্নতি ব্যাপার
জগতে স্বীকৃত হওয়ার পরেই
মনস্তত্ব-সম্বন্ধীয় পুস্তক বের হয়েছে
অথচ এখানে মানুষের মুখে ক্ষয়িষ্ণু ভাষা
শেলফের সর্বোচ্চ সারির বইতে জমেছে
ধুলো কীট মাকড়শার জাল
এখানে তবু অনড় অপেক্ষা;
নদীর স্থির কাকচক্ষু জলের মতো
জলের গভীরে সূর্যের বিম্ব দেখতে পাওয়ার মতো
শব্দ
বিকেল থেকে শুরু হতো ঘরে ফেরার শব্দ শোনা
দিন ফুরোনোর সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে
উসকো খুসকো রাখাল মায়া বুনে যেত মাঠের বুকে
গরুর খুরে মাড়ানো ধুলোপথ মেখে নিত গোধূলির রং
শোনা যেত, ছানাপোনা আগলে রাখা
মা-মুরগী তেড়ে আসায় চিল শকুনের উড়াল-শব্দ
স্মৃতির শিকেয় তোলা আছে কত কত শৈশব-শব্দ
পুকুর পাড়ে ঘাসের বনে হারানো সুরের শব্দ
পথের ধারে অচিন কিশোরের ডাঙ্গুলি খেলার শব্দ
বরই গাছে ঢিলের শব্দ, হাসির শব্দ, সাইকেলের ক্রিং ক্রিং
কীভাবে যেন জোড়া লেগে যেত সব!
চাপ চাপ মাটি কাটা শব্দ, বৈঠার জল ঠেলা শব্দ
বিশ্বাসের স্থির শব্দ, শতাব্দির প্রতিশ্রুতি-শব্দ
জানালায় পর্দার নৈঃশব্দ্য... শোনা হতো অহরহ
আনমনে কখনো কখনো শোনা যেত
রোদ্রে মাটি ফাটা শব্দ, চোখের পাশ কেটে উড়ে যাওয়া
ফড়িং-ডানার শব্দ, আকাঙ্ক্ষার শব্দ, বাতাসের ফিসফিস
অজানার শব্দ, চেনাশোনা তোষামোদি শব্দ
এভাবে শব্দরা সারিবদ্ধ জমা হতে থাকে
বিদ্যুৎবিল জমা দেবার লম্বা লাইনের মতো
এখনো শুনি শুকনো পাতার মরমর শব্দে আটকে থাকা
পদযুগলে বিষাদ গন্তব্যের স্বর
এখন সন্ধের দরজায় অন্ধকারের কড়া নাড়ার শব্দ শুনি
ইট পাথরের দেয়ালে মৌনতা জমা রাখি
তৃষ্ণা ঢেকে রাখি চোখের পাপড়ি-তলে
শোনা বাকি আছে
দাবি-দাওয়া অধিকারে জনকণ্ঠে উচ্চারিত পবিত্র শব্দ
সীমাবদ্ধতা
‘মিছিলে নামবো’ ভাবনাকে দাঁড় করিয়ে রেখে
আমি কেবল ডাকতে পারি তোমাদের
শহরের গলিতে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে
নর্দমার জলে স্নানরত নাগরিক সভ্যতা;
সে হিসেবে চাইতেই পারি
সভ্যতার পোশাক কিংবা নর্দমার ঢাকনা
কিন্তু চাইতে গেলে
আমিও সভ্য নাগরিক হয়ে যেতে পারি
নর্দমার স্রোতে একলা একা নাগরিক
হাবুডুবু খেলে, অন্ধকারে কাতরালে,
তোমরা কেউ কি টুঁ শব্দ করবে!