এলিজা খাতুন

এলিজা খাতুন

এলিজা খাতুনের ৩ কবিতা

প্রকাশিত : মে ০৬, ২০২১

চিঠি

আমাদের ভিটের পরে কিছু সম্মানিত বৃক্ষ আর
আটচালা মাটির ঘরের কোণে
একসময় দাঁড়িয়ে ছিল বিশ্বাসযোগ্য দেরাজ

শৈশবে দেখেছি
এ বাড়িতে খুব চিঠি আসতো
সব চিঠি থাকতো দেরাজে

ঘুণে দেরাজের খোলস ঝাঁঝরা হতে হতে
ওটা থেকে এখন ঝরে পড়ে
গুঁড়ো গুঁড়ো সোনালি অতীত

লতাপাতাময়  নিবিড় আচ্ছাদন সরিয়ে
সোনা ক্ষেতের জ্বলজ্বলে আলো নিভিয়ে
দাঁত খিচিয়ে অসভ্যতা বেড়ে ওঠা
দালানকোঠার রুক্ষ্ণ গ্রীবায় প্রাচুর্যের প্রকাশ

হৃৎপিণ্ডের ক্ষত নিংড়ে তোমাকে লেখার মতো
অজস্র খবর এখানে সেখানে

অথচ বৃক্ষহীন, ছায়াহীন বড় অসময় দিন!
দূরে নক্ষত্র মিটিমিটি রাত ধুঁকছে সোডিয়াম আলোয়
এখানে অসহ্য তীব্র আলোয়  পড়া  যায় না
হৃদয়ের কাছে হৃদয়ের লেখা চিঠি

পাতাঝরা দিনশেষে

শস্যের স্মৃতি বুকে ধরা উঠোন
টুকরো টুকরো করে সেখানে তোলা হলো
নৈরাজ্যের টাওয়ার
কারখানার সূচের শরীরে জং ধরা ব্যথা
ইতিহাসের অক্ষর হতে হতে
সুপ্রাচীন অন্ধকারের অতলে

চিনে নেবে চলো
কাদের প্রার্থনায় একে একে জমছে
সুদিন পোড়া ছাই

জেনে নেবে চলো
কোন অশনি টানে
হারিয়েছি প্রিয় পথ, প্রিয়তম গ্রাম

চলো খুঁজে নেবে বোধ
যে বোধে দৃষ্টি ফেরে সবুজ সীমানায়
যে বোধে দেখে নেওয়া যাবে
কাদের হাতের কালো করাত
প্রখর রোদে কাটছে বৃক্ষছায়া

পাতাঝরা দিন ফুরোলে
চলো ভিজি হৃদয়ের বর্ষায়; ধুলো ধুয়ে গেলে
এখনও পাতার সবুজ আলোয়
দেখা যাবে সম্ভাবনার ফুল

শব্দ

বিকেল থেকে শুরু হতো ঘরে ফেরার শব্দ শোনা
দিন ফুরানোর সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে
উসকো খুসকো রাখাল মায়া বুনে যেত মাঠের বুকে
গরুর খুর-আদরে ধুলোপথ মেখে নিতো গোধূলির রং

শোনা যেত, ছানাপোনা আগলে রাখা
মা-মুরগি তেড়ে আসায় চিল শকুনের উড়াল-শব্দ
স্মৃতির শিঁকেয় তোলা আছে কত কত শৈশব-শব্দ

পুকুর ধারে ঘাসের বনে গুনগুনিয়ে হারানো সুরের শব্দ
পথের ধারে অচিন কিশোরের ডাঙুলি খেলা শব্দ
নদী নামের মেয়েটির থমকে দাঁড়ানো শব্দের সাথে
অমন শব্দের খুব বেশি দূরুত্ব ছিলে না!
বরই গাছে ঢিলের শব্দ, হাসির শব্দ, সাইকেলের বেল
বাজানো শব্দ... কীভাবে যেন জোড়া লেগে যেত সব!

তারপর একদিন নদীর একমুখি টানে একরোখা স্রোতের
সমুদ্রে যাবার সিদ্ধান্ত শোনা গেছে স্পষ্ট!

চাপ চাপ মাটিকাটা শব্দ, বৈঠার জল ঠেলা শব্দ
বিশ্বাসের স্থির শব্দ, শতাব্দির প্রতিশ্রুতি-শব্দ
জানালায় পর্দার নৈঃশব্দ্য... শোনা হতো অহরহ

আনমনা দশায় কখনও কখনও শোনা যেত
রোদ্রে মাটি ফাটা শব্দ, চোখের পাশ কেটে উড়ে যাওয়া
ফড়িং-ডানার শব্দ, আকাঙ্ক্ষার শব্দ, বাতাসের ফিসফিস
অজানার শব্দ, চেনাশোনা তোষামোদি শব্দ

এভাবে শব্দরা সারিবদ্ধভাবে জমা হতে থাকে
বিদ্যুৎবিল জমা দেবার লম্বা লাইনের মতো
এখন শুনি শুকনো পাতার মরমর শব্দে আটকে থাকা
পদযুগলে বিষাদ গন্তব্যের স্বর

এখন সন্ধ্যের দরজায় অন্ধকারের কড়া নাড়া শব্দ শুনি
ইট পাথরের দেয়ালে মৌনতা জমা রাখি
তৃষ্ণা ঢেকে রাখি চোখের পাপড়ি-তলে

এখন শোনা বাকি আছে
দাবিদাওয়া অধিকারে মানবকণ্ঠে উচ্চারিত পবিত্র শব্দ