এলিজা খাতুন

এলিজা খাতুন

এলিজা খাতুনের পাঁচটি কবিতা

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৮, ২০২২

এলিজা খাতুনের পাঁচটি কবিতা

হৃদয় খসিয়ে নাও

অন্তরের প্রশাখা মেলে রেখেছ উদার বৃক্ষের মতো
তাই বলে উটকো ঝড়ের মতো কেউ
তোমার অন্তর-অরণ্যে অনাদৃত মাতম তুললে
মেনে নেবে-না কোনো প্রকার উচ্ছ্বাসে—এ আমি জানি

মৃদু বাতাসের মতো ধীরে যদি নিয়ে আসি
সুপ্ত হৃদয় উন্মোচনের ঘ্রাণ;
তাকে স্বাগত জানাতে দ্বিধা করবে কিনা, জানি না!
নাহয় গোলাপের মসৃণ পাপড়ির বদলে
শুকনো পাতা ঝরিয়ে বরণ করবে;
এমন আশা করা অমূলক ভাবিনি এখনি

বরং জানাবো বলে ঠাহর করেছি যে,
হাড়মাংসের খাঁচা থেকে
এ হৃদয়কে নিজ উদ্যোগে খসিয়ে নিয়ে যাও
চতুর্পার্শ্বে ক্রমশ গতিহীনতার মাকড়শা জাল বুনছে
স্নায়ুতন্ত্রীতে ঘুণপোকা এসে বাসা বাঁধে মনোরম
ফুসফুস খুবলে খাচ্ছে মাঠখেকো শৃগালেরা
হৃদয়ের আসন্ন বিপদ বড়!

তাছাড়া কালের দুঃসহ চালচিত্রে, নিঃশব্দ দুর্দিনে—
হৃদয়ে ক্ষত দাগ বাড়ছে দিনে দিনে
হৃদয়কে বাঁচাবে!

ধানের চারার মতো এ হৃদয় তুলে নিয়ে
তোমার ঊর্বর অন্তঃভূমিতে রোপণ করে দ্যাখো
মূর্ত-বিমূর্ত সব স্বপ্নের কোলাহল ম ম করবে
ছড়া ছড়া স্বর্ণালি ধানের মতো

অনন্ত সম্বল

তুমি, আমি, মুখোমুখি ভাবনার ভূমি
আর আছে কাগজ-কলম, সামাজিক ছক
এত্তসব কী অন্তর-টানের চেয়ে বেশি কিছু!

বেশি নয়, চেয়েছিলাম— সুউচ্চ বৃক্ষের ফল পাড়ার মতো
অনাদি মহাকাল থেকে দু’একটি সকাল পেড়ে দিও,
পৃথিবী হাঁচড়ে পাঁচড়ে সর্বোচ্চ শিখর থেকে
একখণ্ড জমাট জল এনে দিও; বুকে রেখে দেব

দুর্দিনে-সংকটে
দৃষ্টি উপচে, গালের তীর ছুঁয়ে স্রোত বয়ে গেলে
জানবো বেশি কিছুই পাওয়া গেল!

অথচ
পড়ন্ত বেলায় পিছ’পা হলে পৃথিবী তন্নতন্ন করতে
অসময়ে স্পর্ধা করোনি সময়ের শরীর ছোঁবার

ঘরের নৈঃশব্দ্যে স্বাক্ষর করে দিলে বুকের ব্লাঙ্ক চেক
আর ইচ্ছেমতো তাতেই লিখে নিলাম বিশ্বাস শব্দটি
জানি
তা দিয়েই কাবু করা যাবে দুজনের চুড়ান্ত অনটন

ঘ্রাণ

তাঁতি বাড়ি থেকে
একটা জোলাটে গামছা কিনে দেবে?
নতুন গামছার ঘ্রাণ আমার বড় ভালো লাগে।

অথবা এক পুরিয়া মেথি
নারকেল তেলে ভিজিয়ে রেখে চুলে মাখবো
যদি একটা পাটের শিকে পেতাম!
হাসি আর সাধগুলো তুলে রাখতাম

ব্যথার কথা বাদ দিলাম
ব্যথাগুলো সব বোয়েমে বন্দি আচার হোক
আমের বোলের মতো অস্ফুট সাধ
মনের মধ্যে বড্ড আঁতিপাঁতি করে যে!

গামছা, মেথি, শিকে নিয়ে আসবে আমার বাড়ি!
বৈশাখী ঝড়ে ধুলোর ঘ্রাণের সাথে খরা মেখে এলে
সুতোর কারুকাজে ফুল তোলা পাখার
শীতল বাতাস দেব

অবসানে

নকল ফুলে তোমার উদ্ভাসিত হওয়ার মাত্রা
বোধহয় আর লুকোতে পারছো না
পাখির চেয়ে পালকের কারুকাজ ভালোবাসো
জেনে গেছি এরই মধ্যে

অথচ যে মিছিল
‘বকেয়া বেতনের দাবি` নিয়ে রাজপথে চলছিল
আমি ভুল করে
‘ভালোবাসার দাবি` নিয়ে যোগ দিয়েছিলাম তাতে

সেদিনও ছিল বিকেল ভরা তৃষ্ণা, গোধূলির মায়া
কথার মাঝে বেশিই ছিল পদাবলি
কবিতার ঢংয়ে বলেছিলাম ‘নক্ষত্র হবো’

আজ সেই পথে উড়ন্ত মেঘের নিচে
জ্বরতপ্ত একা পথিক আমি
আমাদের দেখা হওয়া পথটা পড়ে আছে
মাথার ফিতের মতো

এ পথে এখন দীর্ঘ অনুজ্জ্বল বেলা, গাঢ় নৈঃশব্দ্য,
অপ্রস্তুত গলির প্রহর, সুনিবিড় পাতার মর্মর

কখনো যদি শিখে নাও প্রতীক্ষার অর্থ
তাহলে হয়তো চেয়ে থাকার মতো
পেয়ে যেতেও পারো ওই দূরের মতো কোনো নক্ষত্র!

পথ

এই পথে যেতে যেতে
আলপথে, শিমুলের ছায়াতলে
ঘুমিয়ে পড়া মানুষেরা সরল শ্বাস নিত

গনগনে দুপুরের বৈরাগ্যে
রাখালদের গল্প বানানো ধুম ছিল
তারা এখন পড়ে থাকে দরবারে মানত-রত

এই পথে যেতে যেতে মনে পড়ে
মাদুরপাতা সন্ধ্যায় চেরাগের আলোয়
যাদের হাতে ছিল কাঠপেন্সিল
ভুলভাল লেখা মুছে নিত নিমেষেই

স্কুলমাঠের এসেম্বলিতে যাদের মুখে ছিল শপথের বাণী—
‘মানুষের সেবায় সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখিবো’
কিংবা যারা নিয়ত শুনতো সাম্যের গান
তাদের হাতে এখন সুদের গণনাযন্ত্র
ক্রীতদাস ব্যাবস্থার বিশ্বস্ত পাহারাদার তারা

এই পথে—
কাঁটাঝোপ, বনবাদাড় উঁচু নিচু সেতু-সড়কের
ফাঁকে ফাঁকে গোপনে বেড়ে গেছে বিছুটির বন
এ পথের শেষ থেকে ফিরবার পথ কোথায়!
‘মানুষ` হেঁটে আসে যদি!