এলিজা খাতুনের গল্প ‘আগুন গোঁজা মাটি’
প্রকাশিত : জুলাই ২৫, ২০২০
সকাল থেকে এ পর্যন্ত চার ট্রাক বাঁশের মুড়ো এসেছে। ইটভাটার চিমনির পাশে জড়-শেকড়-মাটি সহ বাঁশের মুড়োগুলো পাহাড়ের মতো স্তূপ করে রাখা। সূর্য ঠিক মাথার উপর। স্তূপের পাশে বসে শাহানু ও সুশীলা মাটি ছাড়াচ্ছে বাঁশমুড়ো থেকে, শেকড়ে এঁটে থাকা মাটি ছাড়িয়ে অন্যপাশে রেখে বাড়িয়ে তুলছে জ্বালানি উপযোগী বাঁশ-মুড়োর স্তূপ। দু’দিন বাদেই এগুলো যাবে চিমনির পেটে। শাহানুকে ছোট করে শানু বলে ডাকে সবাই। কনুই চুঁয়ে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম নামছে শানুর; তালুর ঘামে ভিজে উঠেছে দাঁয়ের বাটালিও। সুশীলা পাশের গাঁয়ের, মধ্যবয়সী, খাটুনিঅলা। শানু তাকে খালা ডাকে। সুশীলাকে হাত মেলে লাল ফোসকা দেখায় শাহানু, সুশীলা খালা বলল, পড়ুক ফোসকা। একসময় আর পড়বে না, ঝামা ইটের মতো কড়কড়ে হয়ে যাবে হাত, বাটালি ছাড়িস না।
হেড়্যা সরদার আজ সকাল সকাল চিমনির পাশে গিয়ে তদারকি শুরু করেছে। হেড়্যা সরদার শানুর মামা। তিরিশ বছর ধরে ইটভাটায় সরদারি করে হেড়্যা। রোদ চড়া হয়েছে দেখে সুশীলা খালা শানুকে চুলো ধরানোর তাগিদ দেয়। শানু উঠে গিয়ে অদূরে সিমেন্টের বস্তার ছাউনির নিচে উনুন সাজাতে লাগে। চল্লিশ জনের রান্না। সরদার চেঁচিয়ে বলল, এ শানুউউ... আখাতে টপ কর্যা আগুন দে-রে বেটি। সন্তান তুল্যকে বেটি সম্বধন করে তাড়াতাড়ি চুলো ধরাতে বলে হেড়্যা সরদার। একই জোরালো স্বরে শানুর উত্তর, শুষ্খা দেখ্যা গুটিক মুড়া ফাড়্যা দ্যাও। হেড়্যা সরদার তার ভাতিজা দুরুলকে শুকনো দেখে কিছু বাঁশের মুড়ো ফেড়ে দেবার কথা বলে দিল। এরই মধ্যে শানুর অবিরাম ফুঁ দেয়ায় চুলোয় আধশুকনো কঞ্চি থেকে ধোঁয়া উঠছে, দুরুল আড়চোখে তাকায়; শানুর গলার শিরা ফুলে ফুলে উঠছে, ঘষে ঘষে চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। দুরুলের মন কেমন করে ওঠে, লুঙি কাছা মেরে কুড়োল নিয়ে বাঁশের শুকনো মুড়ো টেনে ফাড়তে শুরু করে সে। এতগুলো মানুষের তিনবেলার খাবার রান্নার দায়িত্ব শানুর কাঁধে। দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করার আগে শানুর মা সম্পর্কে দুরুলের ফুফু দুরুলকে বহুদিন বলেছে তার মেয়ে শানুকে বিয়ে করার কথা।
দুরুল বিয়ে করে বউকে ইটভাটায় রাখতে চায় না। একদিন সে মাটি পোড়ানো ঢিবি থেকে শানুকে নিয়ে চলে যাবে, আগুনের তাপ থেকে দূরে... অনেক দূরে, এমন স্বপ্ন দ্যাখে দুরুল। শানুকেও শোনায় মাঝে মাঝে তার স্বপ্নের কথা। স্বপ্ন পূরণের জন্য দুরুল রাতদিন খাটে, অন্য শ্রমিকের চেয়ে সে মজুরিও বেশি পায়, ওভারটাইম কাজ করে সরদারের কাছ থেকে আদায় করে বাড়তি মজুরি। আরও খাটুনি খাটবে সে, এসব ভাবতে ভাবতে বাঁশের মুড়োয় কোপ বসাতে থাকে দুরুল। পিঠের শিরদাঁড়া থেকে দুপাশে ঘাম বেয়ে নামে। চাতাল থেকে সলিম চাচার চেঁচানোয় সম্বিত ফেরে দুরুলের। অদূরে খাবলে করে কাদামাটি তুলে ইটের ছাঁচ-বাক্সে ভরে ইট কাটছে সলিম চাচা। ছয়তলা বিশিষ্ট ঘনাকৃতির কাঁচা ইট কেটে সার সার করে পেছনে সরছে ; উপরে রোদ চড়া হয়ে উঠেছে। শানুকে উদ্দেশ্য করে, ওই শানুউ উ... একটু পানি দিয়্যা যাস তো! গলাটা ভিজিয়্যা লি।
শানুর পানির জগ হাতে তোলা দেখে দুরুল বাধা দেয়, থো, হামি পানি লিয়্যা যাছি, তুই আখাতে শুকখা লকড়ি দে-গা। সময়মত রান্ধা না হলে সরদার চ্যাঁচাবে।
দুরুল তার চাচা হারান উদ্দিনকে অন্যদের মতো সরদার নামেই ডাকে। ইটভাটার চল্লিশজন শ্রমিকের কাছে হারান হেড়্যা সরদার নামে পরিচিত, সমবয়সীরা কেউ কেউ হেড়্যা বলেই আলাপ করে। ভারি মোটা দরাজ কণ্ঠস্বরের কারণে হেড়ে গলার অধিকারী হেড়্যা সরদার নামে গ্রামেও পরিচিত। হারান উদ্দিনের ভাষায়, যার য্যামন কর্যা ডাকতে মন চাহে।
শীতের ভাব পড়েছে। হেমন্তের শস্যদানা মাড়াই শেষে ঝেড়েঝুড়ে ঘরে সেঁটে তুলেছে গেরস্থ-মহাজনেরা। যারা কৃষক-মজুর তাদের এসময় কাজ কামাই যায়। গাঁয়ের দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলো বর্ষাকাল থেকেই সরদারের কাছে ধন্না দেয়। বেশিরভাগই পাড়া-প্রতিবেশি। দু’একজন দূরের। প্রতিবেশি শ্রমিকেরা কেউ জোয়ান তাগড়া, উঁচু লম্বা, কেউ রুগ্নদেহের। সরদারের চল্লিশজনের দলে এবছর নতুন যোগ দেয় দুজন কিশোর। ছেলে দুটো গাঁয়ে মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে সরদারের দলের সাথে ভাটায় চলে আসার সময় ওদের মায়েরা সরদারের হাত চেপে ধরে মুখে আঁচল গুঁজে খুব কেঁদেছিল। বিল্লালের মা বলেছিল, অর বয়স বেশি লয় জি হেড়্যা ভাই, খাটতে শিখুক মনে কর্যা। অভাবের ল্যাগ্যা তোমার হাতে তুল্যা দিনু, শিখিয়্যা পড়হিয়্যা লিও।
ভজন চন্দ্র পালের মা বলেছিল, হামার ছ্যাল্যাটা খুব কাম করতে পারবে জি! একটু ঘন ঘন ভোখ লাগে অর, প্যাট ভর্যা খাতে দিলে পালাব্যে না।
শরীরের শক্তি সামর্থ্য বিবেচনা করে সরদার ইটভাটার কাজ ভাগ করে দিয়েছে তাদের। দশ-বারোজন পায়ে খুঁচে কাদা সানার কাজে, কেউ বাহুকে করে জল আনায়, কেউ কাঠের তৈরি ছাঁচ-বাক্সে কাদা বসিয়ে সারি সারি ইট কাটতে নিয়োজিত। কেউ অর্ধশুকনো কাঁচা ইট ঠেলাগাড়িতে তুলে দূরে একপাশে গাদা দিচ্ছে। পরবর্তীতে এগুলো চুল্লির ভেতরে সাজানোর কাজে কেউ কেউ। কারো কারো চুল্লির ভেতরে কাঠ সাজানোর দায়িত্ব। ভজন চন্দ্র পাল কাদা সানার কাজে বেশ পারদর্শী। বংশ পরম্পরায় পাল পাড়ায় মাটির হাড়ি তৈরির দক্ষ কারিগর ভজনের বাবা সুরেশ চন্দ্র পাল। এখন আর চলে না মাটির হাঁড়ি। হাত চলে, সহজে-সচ্ছন্দে; যতক্ষণ না নিয়ন্ত্রণে আসে বালু-মাটি-জলে’র মিশ্রণে ইটের কাঁচামাল কাদা-মণ্ড।
চার বছর ধরে মাটি কেনা, জ্বালানি কেনা, শ্রমিক খাটানো, চিমনি সাজানো, ইট পরীক্ষা, ইট ডেলিভারি দেয়া ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করে হেড়্যা সরদার। এ বছর বর্ষা শেষ হতেই মালিক পক্ষের একজন সরদারকে সংবাদ দেয়, আগামী মাস থেকে ভাটায় ম্যানেজার বহাল হবে। তবে শ্রমিক খাটায়ে ভাটার যাবতীয় কাজ আগের মতো সরদারকেই সামলাতে হবে। সরদার বুঝেছিল, কাজের দায়িত্ব আগের মতো বহাল তবিয়তেই আছে, কেবল মাতব্বরিটা কেড়ে নেয়া হয়েছে। কিছুটা আক্ষেপ জন্মালেও নিজের উপর আনন্দ চাপিয়ে বুঝ দিয়েছে নিজেকে, এমনকি দলের অন্যদেরও বুঝিয়েছে এই বলে, খ্যাট্যা খাওয়া মানুষের ঘে মাতবারি কোন্ কামে লাগে!
দু’পা কাদায় দলতে দলতে ভজন চন্দ্র পাল এ কথায় সায় দিয়েছিল, ঠিক কহ্যাছো কাকা, হামি য্যামন বাপের কথাতে রোজই কাদা সান্যা দিতুন, হাঁড়ি একশোখান হল্যো নাকি একখান হল্যো বাপ বুঝতোক; মাটি খুঁচতে খুঁচতে যখন প্যাটে ভোখ লাগতোক, মাকে কহিতুন, হামাকে ভাত দে। ভজনের সরল কথাতে সরদার আনন্দ পেল। শানুর দিকে মুখ ফিরিয়ে চেঁচিয়ে বলল, টপ কর্যা রান্ধো, আইজক্যা ছ্যাল্যাপিল্যা হামার ম্যালাই কাম করছে।
শানু এরই মধ্যে ভাত বসিয়েছে। সেও জোর গলায় জানিয়ে দেয় আজ ডাল-তরকারি কিছু নেই। সরদার বাক্যব্যায় না করে চিমনির পেছন ঘুরে পাকা সড়কের দিকে এগোয়, ইটভাটার সীমানা ছাড়িয়ে পাকা সড়কে উঠে বাজার অব্দি এক কিলো পথ। জমজমাট বাজার, পানের দোকানে বসার সময় নেই তার, দু’খিলি পান আর এক পোয়া মাসকালাইয়ের ডাল কিনে ফিরে আসে; চালার নিচে ডালের পলিথিন রেখে সরদার নিজের তাঁবুর মুখে বসে পান চিবোয়।
পাশাপাশি তাঁবু দুটোর একটি হেড়ে সরদারের, অন্যটিতে সুশীলা খালার সাথে শানু থাকে। একটু দূরে বড় বড় ছয়টা তাঁবুর ভেতরে সরদারের দলের বাকি সাঁইত্রিশ জন। রাতের রান্না খাওয়ার পর সুশীলা খালা বাসনপত্র সরদারের তাঁবুর ভেতরে উঠিয়ে রাখতে আসে, ও সময় সরদারের সাথে বসে দু’চারটে খোস গল্প হয় সুশীলার। সারাদিন আর সময় হয় না দু’দণ্ড আলাপের। কাজের ফাঁকে সুশীলা একবার তাঁবুর কাছে আসে পানের খিলির টানে।
প্রথম প্রথম রান্নার দায়িত্বে ছিল সুশীলা, তখন হেড়ে সরদারও কাজের ফাঁকে দু’একবার এসে সুশীলার হাতে ঢালা এক মগ পানি খেয়ে যেত। দরদরিয়ে ঘাম ঝরা দেখে সুশীলা বলতো, আরেকটু বসে যাও সরদার। উনুনের মুখে বসে চালঝাড়া কুলোয় বাতাস দিতো সরদারের পিঠে। তারপর কতদিন পার হলো, বয়সও কম হলো না। স্বামী ছেড়ে চলে যাওয়ার রাগে বিয়ে-থা করেনি আর। সুশীলার উঁচু লম্বা পুরুট শরীরে এখন আর যৌবন ঝলক দেয় না ঠিকই, কিন্তু বিদ্যুৎ-গর্জনের মতো দেমাগ আর শক্তি সামর্থ এখনও তার টিকে থাকার অস্ত্র।
ওপাশের ছ’টা তাঁবুর ভেতরে দলের শ্রমিকরা অঘোরে পড়ে আছে। সারাদিন মজুরখাটা শরীর, রাতেও ইট টানা বওয়া চলে। অসাড় দেহ ঘুমের স্বাদ পায় না, বেহুশ পড়ে থাকে। শানু স্বচক্ষে ওদের হাড়ভাঙা খাটুনি দেখে। কাজের গতি দেখা যায়, কাজের কষ্ট উপলব্ধি করা যায় না। বহতা নদীর স্রোত দেখার জন্য দূরে পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকাই মোক্ষম। কিন্তু ঢেউয়ের ধাক্কা বুঝতে গেলে নদীর জলে ডুবে ডুবে বুঝতে হয়। ইট ভাটায় শানুর কাজের ধরণ আলাদা, তবে সংসারে মেয়েদের কাজের ধারা থেকে ভিন্ন নয়। রান্না, বাসন মাজা, পানি তোলা, আনাজপাতি কাটাকুটো। মূলত এখানে সরদারের আওতাধীন চল্লিশজন শ্রমিক নিয়েই শানুর আপাতত পরিবার। খুব ভোরে ওঠে শানু। সূর্যের আলো ফোটার আগেই শুরু হয় শানুর চুলোর আগুন জ্বলা। ভাত বসানোর আগেই তেজপাতা ভাসানো এক হাঁড়ি পানি বসিয়ে চুলো ধরায়। পানি টগবগিয়ে উঠলে একমুঠো চা’পাতা ফেলে আরও খানিক ফুটাতে ফুটাতে ডাকাডাকি করে শানু। প্রথমেই মন্টারেএএএ... বলে হাঁক পাড়তে শুরু করে, এরপর যার সাথে যা সম্বোধন সেভাবে শুরু হয় একে একে অন্যদের হাঁক দেয়া।
এ ভজন, বিল্লাল কাকা, মন্টা কত ঘুমাছিস? কাঁড়ির পালঙ্ক ছাড়্যা উঠতে মন চাহিছে না? চা নামিয়্যা ভাত চড়হাবো, চা ঠাণ্ডা হয়্যা গেলে ওট্যায় গিলতে হব্যে কহ্যা দিনু... শেষের কড়া কথা কানে যেতেই আড়মোড়া দিয়ে ওঠে তারা। উনুনের পাশে একে এক এসে সার বেঁধে বসে। তুলে নেয় চায়ের পাত্র টিনের বাঁকাচোরা গ্লাস, বিভিন্ন আকৃতির মগ-কোনটার হাতল ভাঙা, কোনাটির কোণ ফাটা, কোনটির গা খসখসে দাগে ভরা, কেউ বাটিতে, এমনকি কেউ স্টিলের থালায় চুমুক দিয়ে চাঙা হয়ে উঠতে চায়। সবশেষে শানু উনুনের পাশে রান্নার পানি রাখা মাটির কলসের ঢাকনা-বাটিতে চা ঢেলে কয়টি মুড়ি ভাসিয়ে নেয়।
হেড়্যা সরদার চা’ শেষ করে দিয়াশলাই ঠুঁকে ঠোঁটে চেপে রাখা বিড়ি ধরাতে ধরাতে একেক জনকে সারাদিনের কাজের ভার বুঝিয়ে দেয়। ভজন পাল কে বলে আজ এক বেলা কাদা সানলে চলবে না, এ বেলা ও বেলা দু’ফিরে করে সানতে হবে, সাথে আরও দুজন লোক বেশি দেবে। মাঠের ছড়ানো কাঁচা ইট যেগুলোর কাদা শুকিয়েছে তা সব জড় করে পাঁজা দিতে বলল মজদ্দিকে। চুল্লির ভেতরে কাঠ সাজানোর ভার পড়ে দুরুল, আকতাব ও বেল্লালের পরে। চুড় চুড় শব্দে চা টানতে টানতে সবাই হেড়ে সরদারের কথা মন দিয়ে শুনতে থাকে। দুরুল হঠাৎ বলে ওঠে, একদিনে এত কাম শেষ হব্যে না।
ভাতিজার কথায় রেগে উঠলো হেড়ে, তোমাকে ভরণ ঠেলতে ঠেলতে হামার পুটকির ত্যানা ছিঁড়্যা যাছ্যে, হামার মরার পর টের পাব্যা; সরদারি করা মুখের কথা লয়। এ কথা বলে সরদার চিমনির দিকে এগোয়। বেলা বাড়লে রোদ চড়াও হয়ে ওঠে। একগাদা কাদার মধ্যে ভজন হাঁটু ডুবিয়ে লেফট্ রাইট তালে তালে খুঁচে চলেছে। গায়ের গেঞ্জি ভিজে জব জব। চোখ মুখের ঘামে রোদ চকচক করছে। সাথে আরও দুজন কাদা খুঁচছে। মন্টা অন্য দুজনের সাথে সাথে পাশের খাল থেকে বাহকে করে দুপাশে টিনের বালতি ভরে পানি এনে ঢালছে। মন্ড মোলায়েম হয়ে আসলে এগুলো ইট কাটার চাতালে রেখে আসছে কেউ কেউ। আবার শুকনো মাটি ধসিয়ে জল ঢালা, পায়ে খুঁচা শুরু হয়। শুশিলার সাথে শানুও খালে নেমেছে বড় বড় হাড়ি কড়া মাজতে।
শানুকে দেখে মন্টা জিজ্ঞাসা করে, আইজ দু’প্পহরে কী সালুন রে শানু?
শানু মন্টার দিকে না তাকিয়ে আপন মনে হাড়ি ধুতে ধুতে উত্তর দেয়, লিচ্ছাকা খেসারির ডাইল।
মন্টা ভরা বালতি বাহকের দু’পাশে ঝুলিয়ে কাঁধে তুলতে তুলতে তাকায় শানুর দিকে; মন্টার এমন প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে ‘কেন’ প্রশ্ন করার দরকার পড়লো না। সুশীলা খালা বলল, লতুন ম্যানেজার হুট কর্যা আস্যা উঠবে, তার লাগ্যা সরদার কাজ থুয়্যা হাটে যায়নি কাল।
শানু বুঝতে পারে জ্বরের মুখে পরশু থেকে বেচারা কিছু গিলতে পারে না; মনে মনে ভাবে খালি মন্টাকে একটু আলুর সানা মাখ্যা দিবো, ডালের সাথে মুখে রুচবে। ঝুড়ির তলায় একটা আলু পড়ে ছিল, ওটা ভাতে সেদ্ধ দেয় শানু। ভাটায় কাজ করা শ্রমিকদের মধ্যে বয়সে সবার ছোট মন্টা। শানুর থেকেও ছোট। মনে হয় যেন পিঠাপিঠি ভাইবোন এরা। ভাটার সবাই মজা পায় এদের খুনসুটিতে। আবার দুজনের মধ্যে টানটুকুও বোঝে সবাই, শানুর খেয়ালও সবার দিকে। চল্লিশজন শ্রমিক নিয়ে ইট ভাটায় হেড়েল সরদারের পরিবারে শানু একমাত্র তরুণী, যে কাজের ফাঁকে হেসে খেলে, মন্টার সাথে ঝগড়ায়, ভজনের পেটুক স্বভাব নিয়ে তামাসায়, এর ওর সাথে গল্প হাসি মজায় সারাদিন চঞ্চলতায় ভরে রাখে।
যেন সবার আরাধ্য! বাঁচার জন্য থাকতে হয় আরাধ্য কিছু। শানুর সরল মুখখান মাটি পোড়ানো কর্মযজ্ঞের বিশাল পরিসরে যেন মরুভূমিতে ফুটে থাকা ফুল! তবে এতটুকু মেয়ে হলেও দায়িত্বের বেলায় একটু আধটু নয়, পুরোপুরিই! সময়মত রান্না, একসাথে সবাইকে বসিয়ে পাতে পাতে ভাত-তরকারি দেয়া। এদের কারো লুঙি শার্টে চির ধরলে তা জোড়া দেবার কাজে শানু নিজ দায়িত্বেই হাতে তুলে নেয় সুঁই-সুতো। হেড়েল সরদারের দলের সবাই আপন ভাবে শানুকে, আত্মীয় যেন সবার। ওর সাদামাটা নিষ্পাপ মুখ যেন ক্লান্তি ধুয়ে দেয়। সবার ভালোবাসার পাত্রী শানু। ভালোবাসতেই হয় ওকে। নিজ-গ্রাম ছেড়ে অচেনা প্রান্তরে ভালোবাসার মত এদের কেউ নেই আর। শানু সামনে এলে ওর সাথে কথা বলার স্বর পাল্টে যায় সবার।
হেড়্যা সরদার কোমরে বাঁধা গামছা খুলে চারপায়া টেবিল মুছতে মুছতে শানুকে পুরোনো হিসাবের খাতা আনতে বলে। ইট ডেলিভারির সাথে টাকা পয়সার হিসেবটা ম্যানেজারকে বুঝিয়ে দিতে চায় সে। হঠাৎ বাইকের শব্দ। স্টার্ট থামিয়ে ভাটা মালিকের শালা নকুল সিকদারের সাথে আরেকজন মধ্যবয়সি লোক হেঁটে আসছে এদিকেই। এরই মধ্যে শানু পুরোনো হিসেবের খাতাটা বুকে চেপে ধরে হেড়্যা সরদারের সামনে এসে দাঁড়ায়। নকুল সিকদার মোটা গলায় হাঁক দেয়, কই হে সরদার, তোমার পালেরা সব কুন্ঠে? কাজ কাম চলছে ঠিকঠাক?
সরদার আর তার দলের কেউ প্রকৃত মালিককে কখনও দ্যাখেনি। নকুল সিকদারই মালিকের হয়ে সব দেখাশোনা করে। আগন্তুকের সাথে পরিচয় করায়, এই হলো তোমার ঘে লতুন ম্যানেজার, এখন থ্যাকা বসবে এখানে। খাতাপত্রের আগের হিসেবপাতি বুঝিয়্যা দ্যাও তাকে। আর সামনে কবে কখন কয়জনকে মাল ডেলিভারি দিতে হব্যে তার সাথে জানাবোঝা কর্যা লিও। সরদার মাথা নাড়িয়ে হুম হুম করে যায়।
চশমার উপর দিয়ে তীর্যকভাবে তাকিয়ে শানুর বুকে ধরা খাতাটা হাত পেতে চেয়ে নেয় নকুল সিকদার। হেড়্যা সরদার ম্যানেজারকে কাঁচা ইট সারি সারি ছড়ানো চাতাল ঘুরিয়ে দেখালো, তারপর চিমনির পাশে এসে বলল, কালক্যার ভিতরে চুল্হাতে ইট-কাঠ সাজোন শ্যাস হয়্যা যাব্যে, পরসু আগুন দেওয়া যাব্যে।
নকুল সিকদার আর ম্যানেজার উঁকি দিয়ে চুল্লীর সবগুলো মুখ দ্যাখে। কয়েকজন চাতাল থেকে শুকনো ইট মাথায় করে এনে ভেতরে পাঁজা দিচ্ছে, অন্যেরা তা সাজাচ্ছে। গোলাকার উঁচু ঢিবির মধ্যখান শুকনো ইট ও জ্বালানি সাজাবার ফাঁকা জায়গা রেখে পোড়া ইটে চারপাশ ঘেরা বিশালাকার চুল্লী। ভেতরে দঘদঘে আগুন। আগুন দেবার আগে ভেতর থেকে শ্রমিকেরা বেরিয়ে পড়ে একখানে জড় হয় সবাই। একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে নিশ্চিত হয় প্রত্যেকের উপস্থিতি। একবার আগুন দেওয়া হয়ে গেলে ভেতরে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠা গনগনে আগুনের ঢিবিতে পরে এগোয় না কেউ। চুল্লীর মাঝখানে উঁচু চিমনি, তপ্ত বর্জ্য নিশ্বাস উড়ে যায় চিমনির মুখ দিয়ে।
দুজন চারপাশ ঘুরে এসে ম্যানেজার তার জন্য বরাদ্দ কামরায় চৌকিতে বসে। হেড়্যা সরদার শানুকে পানির জগ নিয়ে হাঁক দেয়। ম্যানেজার সরদারকে বলল, তোমার ছেলেপেলের পায়ে জোর আর হাতের গতি বাড়াতে হবে আরও। কাজের ঘাটতি না থাকলেও এটুকু বলা না হলে ম্যানেজারের কৃতিত্ত্ব থাকে না। অবশ্য নতুন ম্যানেজারের খবরদারিতে হাঁক ডাক নেই বলেই মনে হচ্ছে হেড়্যা সরদারের। নকুল সিকদারের ইশারায় ম্যানেজারের অতি বিনয়ী আলাপ। কথায় বোঝানোর চেষ্টা করে যে, সেও সরদারের দলের একজন, মালিক পক্ষের লোক ভাবার দরকার নেই তাকে। সরদারের দলের হয়ে মালিকের কাছে শ্রমিকের সুবিধাদি আদায়ের জন্য সে প্রয়োজনে প্রাণ দেবে।
খাড়া দুপুর। শানু চালার নিচে উনুনের ধারে। বড় কড়াইয়ে ফুটন্ত ডালের বাষ্প উঠছে; শানুর মুখ যেন কুয়াশায় ঢাকা। চালার ছিদ্র গলিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া রোদ শানুর তামাটে কপালে নামছে, আলোর নাচন হচ্ছে যেন! ঘামে ভেজা কাঁধে দু’চারটি চুল ছড়িয়ে লেপ্টে আছে। কানের লতির পাশে চুল-ঘামের লুটোপুটি। বিপরীত দিকে ম্যানেজারের কামরার দরজা খোলা। ভেতর থেকে খাটে শোয়া ম্যানেজার এদিকেই সোজাসুজি তাকিয়ে, তা বোঝেনা শানু। সুশীলা খালার সাথে গল্প করতে করতে দুরুল এদিকেই আসছে। দুরুল কানে গোঁজা বিড়ি টেনে উপুড় হয়ে উনুনে আগুনের শিখায় ধরে। শানু চট করে হাত থেকে ওটা নিয়ে নেয়। দুরুল হাবার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। অনুনয় করে বলে, দ্যাখ শানু ওট্যা চুলহার ভিতরে ফেলিস ন্যা কহিনু, একটাই সম্বল।
শানু ফেলে দেবার ভাব করে উনুনের মুখে ধরে, আগুন ধরে গেলে দুরুলকে ওটা ফিরিয়ে দেয়। সুশীলা দুজনের খুনসুটি দেখে মিটিমিটি হাসে। হঠাৎ সুশীলাকে সামনে দেখে হন্তদন্ত চোখ সরিয়ে নেয় ম্যানেজার। সুশীলার চোখ এড়ায় না তা। কী যেন টের পায়। রাতের হালকা বৃষ্টি একটু আধটু ছিটে তাঁবুর ভেতরটা স্যাতসেঁতে। মেঝের বিছান কাঁথা পাটি উঠিয়ে নিয়ে সকালে সুশীলা বাইরে বাঁশে মেলে দিচ্ছে। একজন বৃদ্ধ হেঁটে আসছে হেড়্যা সরদারের তাঁবুর দিকে। মাঝখানে সুশীলা খালাকে জিজ্ঞাসা করতেই আঙুল তুলে সরদারের তাঁবু দেখালো। সরদারের সাথে কী যেন সব কথা চলছে বৃদ্ধলোকটির; ভাবখানা রহস্যময়। যেন ওদের গ্রামে তুফান উঠেছে। হেড়্যা সরদারের মুখ দেখে মনে হচ্ছে এখানেও বুঝি এলো সেই ঝড়! বৃদ্ধটি বেশিক্ষণ দাঁড়ায়নি। হনহন করে চলে গেল।
সরদারের কাছে এগিয়ে এসে সুশীলা জানতে চায়, কী ব্যাপার?
হেড়্যা সরদার বলতে শুরু করলে সুশীলা হা করে শোনে, প্রশাসনের দরবারে ইটভাটার নামে অভিযোগ হয়েছে। ভাটার মালিক সত্তর-বিঘা চাষের জমি লিজ নিয়ে একদিকে বাগানবাড়ি, আরেকদিকে ইটভাটা বসিয়েছে। প্রাচীর ঘেরা বাগান বাড়িতে শহরের সাহেবরা হাওয়া খেতে আসে, হাওয়া বদলে আসে। ওটার তদারকির দায়িত্বও নকুল সিকদারের উপরে। ইটভাটার মালিক নাকি জমির কৃষক-মালিকদের ঠকিয়েছে। প্রশাসনের লোক সরেজমিনে তদন্ত করতে আসবে।
সুমীলা সরদারকে দুঃশ্চিন্তা করতে নিষেধ করে, যা বোঝার ভাটার মালিক আর নকুল সিকদার বুঝুক। সরদারের চিন্তা অন্যখানে, দলের এতগুলো লোকের রুজি-রোজগারের প্রশ্ন। হেড়ে সরদার খোঁজ নিয়ে জেনেছে, এই উপজেলায় দশটির বেশি ইটভাটা, আইন ভঙ্গ করে কয়েকজন প্রভাবশালী গড়ে তুলেছে ভাটা। অনুমোদন ছাড়াই তারা দোফসলা জমি নষ্ট করে ভাটা চালু করেছে। কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে। প্রশাসনও নড়েচড়ে উঠেছে। সুমীলার দিকে চিন্তিত চাহনিতে বলল, শুন্যাছি হামারঘে মালিকের নাকি ইটভাটা বসাব্যার কোন সরকারি কাগজপত্তর নাই, সরকার চাহে তো এ্যখোনি বন্ধ হয়্যা যাব্যে।
সুশীলা আবার সান্ত্বনা দেয় হেড়্যা সরদারকে, এঠে কাম বন্ধ হলে, আর কুন্ঠি যাবো; গতরে তাগদ থাকতে হামরা কি না খায়্যা মরবো? তুমি ঠাহর হও সরদার!
পড়ন্ত বেলায় দূর থেকে ধুলো উড়িয়ে কালো কাঁচে ঢাকা জীপ ভোঁ করে এসে থামলো চিমনির পাশ দিয়ে সুরকি পেটানো চওড়া গলিতে। ওখান থেকে সরু পথে গাড়ি ঢুকবে না আর, একপাশে পাহাড় সমান উচু করে মাটির স্তূপ, অন্যপাশে বাঁশের মুড়োর গাদা। এটুকু হেঁটে আসতে হচ্ছে কর্মকর্তাকে। পেছনে পেছনে নকুল সিকদার। ইনি নতুন কর্মকতা হলেও কদিনেই উনার সাথে বেশ দহরম মহরম। হরেক রকম ভেলকি দেখিয়ে এরা যে যার নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে থাকে; ম্যানেজারও জানে। হেড়্যা সরদার আদার ব্যপারি, জাহাজের খবর না রাখলেও, জাহাজ সম্পর্কে যে ভালো ধারণা তার এমন নয়! ভাটার ম্যানেজার তার কামরা থেকে বেরিয়ে বড় সাহেবদের সাদরে এগিয়ে নিয়ে এলো। কামরায় ফিরে চৌকিতে বসতে দিয়ে স্ট্যান্ড ফ্যানকে বড় অফিসারের দিকে ঘুরিয়ে দিল। হাঁক ছেড়ে শাহানুকে চা দিতে বলল। নকুল সিকদার বড় অফিসারের পায়ের কাছে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে অফিসারের সুস্থতা-অসুস্থতা, সুবিধা-অসুবিধার খোঁজ নিতে থাকে। চোখমুখে ঠাণ্ডা পানির ছিটে লাগাবে কিনা! ডাব খাবে কিনা! চৌকিতে পা খানা তুলে আরামে বসতে বলা... এভাবে চলতে থাকে।
বলা থামে না, স্যার এখানে ঐ পাশটায় খালধারে বড় মনরম পরিবেশ, বাগানবাড়ি আছে। আপনাদের জন্যই। আপনাদের মতো মানুষদের জন্যই মালিক-মহাজন তৈরি করেছেন স্যার। ছেলেমেয়ে আর ভাবিকে সাথে নিয়ে বেড়ানোর দারুণ জায়গা। এরপর নকুল সিকদার মুখটা আরও কাত করে নিচু হয়ে সাহেবের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, চাইলে একাও আসতে পারেন স্যার, সব ব্যবস্থা করবো। আপনাদের যে মাথার কাজ করতে হয় তার জন্য একটু রিক্রেশন দরকার হয় স্যার।
হেড়ে সরদার বাইরে থেকে কাশির আওয়াজ দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, চা আনতে বলবে কিনা? সরদারের গলার স্বর শুনে নকুল সিকদার অন্যকথা বলতে লাগলো, স্যার বোঝেনইতো! এখানে যারা ইটকাটার কাজ করছে তারা নিতান্ত অসহায়, পেটের দায়ে খাটে তারা। ওদের কথা ভেবেই কাগজপত্তর হাতে না পেয়েই তোড়জোড় করে ইটভাটা চালু করা, ভাটা বন্ধ হলে এতগুলো শ্রমিক নির্ঘাত না খেয়ে মরবে স্যার! ভাটায় যাদের জমি বেড় পড়েছে, তাদেরকে দলিলের বদলে টাকা দেয়া হয়েছে। এসব ছোটখাটো বিষয়ে মাথা ঘামাবেন না স্যার, অভিযোগকারীরা কদিন বাদে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। একদিন সন্ধ্যায় আসুন না বাগানবাড়িতে, একটু সেবা করার সুযোগ পাবো তাহলে।
সুমীলা আর হেড়্যা সরদার কামরার দরজার মুখে মেঝেয় হাঁটু ভাঁজ করে বসে। ভেতরে ওদের কথাবার্তা শুনে দুজন দুজনের দিকে তাকালো। কথা শুনে মনে হচ্ছে দলের শ্রমিকদের ভালোর জন্যই কথা হচ্ছে। নকুল সিকদার আর ম্যানেজার যা যা বলছে তা যেন ভাটার শ্রমিকদেরই কাজের ক্ষেত্র বাঁচাতে। দুদিন হলো আসা নতুন ম্যানেজারও কেমন অকপটে কথা বলে যাচ্ছে, যেন কতদিন ধরে ভাটায় নিয়জিত সে। এরই মধ্যে শানু চা নিয়ে এলো সবার জন্য। নকুল সিকদার বড় স্যারকে ইশারা করলো, শানুকে দেখিয়ে বলল, এই দেখুন স্যার কচিকাচা মেয়েছেলেগুলোও এখানে কীভাবে খেটে খুটে পেট চালায়। বড় স্যার চশমার উপর দিয়ে চোখের মনি ঠেলে গোল ড্যাবডেবে চাহনিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। নকুল এই সুযোগে শানুকে বলল, সান্ধের বেলাতে বাগানবাড়ির দিকে যাইস তো রে শানু, স্যারের থাকার ঘরটা ঝাড়া মোছা কর্যা আসিস।
সুশীলা খালা শানুকে ধমক দিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি হাত চালা, চা দেয়া হলে এখান থেকে যা। শানু বোঝে না সুশীলা খালার এমন মেজাজের কারণ, মুখ গোমড়া করে চলে যায়।
এরই মধ্যে নকুল শিকদারের ফোন বাজে। ফোনের কথায় হেড়্যা সরদার ঠিক বুঝলো মালিকপক্ষ কর্মকতাকে খুশি করার জন্য নকুলকে তাগিদ দিচ্ছে। ফোন রেখে নকুল শিকদার কর্মকর্তার হাত ধরে বাগানবাড়িতে আসার দাওয়াত দিয়ে দাওয়াত কবুল করিয়ে ছাড়লো। নকুল নিরিবিলি ঘর আর পছন্দের ব্রান্ডের কথা তুলতেই কর্মকতা ‘পরে জানাবো’ বলে থামিয়ে দেয়।
পরদিন সন্ধ্যায় চুল্লির ভেতরে আগুন দেবার কাজে সবাই ব্যাস্ত। ইট-কাঠ সাজানো শেষ করে সবাই ঢিবির উপরে উঠে এলো, ভেতর থেকে সবাই বেরিয়েছে কিনা দেখেশুনে সরদার মশাল জ্বেলে চুল্লির এক একটা মুখে ধরে আগুন দিচ্ছে। সবাই সোরগোল চেঁচামেচিতে মেতে উঠেছে। আশপাশে শানুকে দেখা যাচ্ছে না, কেউ খোঁজ না করলেও সুশীলা ঠিক টের পায় শানুর অনুপস্থিতি।
হেড়্যা সরদারকে দেখে জিজ্ঞাসা করলো, এত হুড়াহুড়ির সময়তে তোমার ম্যানেজার কুন্ঠে গেল সরদার! সরদার উত্তর দেয়, বাগানবাড়ির গেস্ট রুমের বাল্ব কেটে গেছে, নতুন বাল্ব লাগাতে গেছে। শানুকে দেখেছে কিনা জানতে চাইলো সুশীল। নকুল সিকদার ওকে লিয়্যা গেছে রুম পরিষ্কার করতে, এটুকু বলে হেড়্যা সরদার চিমনির দিকে চলে গেল। খচখচিয়ে ওঠে সুশীলার মন।
চুল্লির ভেতরে ধোঁয়া পাকাতে পাকাতে গনগনে আগুন জ্বলে উঠতে উঠতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। শ্রমিকরা সবাই খালের পানিতে ডুব দিয়ে এসে তাঁবুর সামনে জড় হয়েছে। আজ আর রাত্রকালীনখাটুনি নেই, বেশ ঝরঝরা লাগছে সবাইকে দেখে। কাল থেকে আবার মাটি কাটা, কাদা সানা, বাঁহকে জল টানা, মন্ড বয়ে ইটের চাতালে নেওয়া, নতুন ইট কাটা, কাঁচা ইট শুকোলে আরেকদিকে পাঁজা দেওয়া এভাবে শুরু হয়ে যাবে। খোশ গল্পে মেতেছে সব শ্রমিকরা। লাল সুরকির পথের দিকে একটু করে এগিয়ে গিয়ে উঁকি দেয় সুশীলা।
রাত খুব বেশি বাড়েনি, খানিক দূর থেকে বাইক থামার শব্দ শোনা যায়, শানু ফিরে এসে তাঁবুতে ঢোকে। সুশীলা সবাইকে খাবার তুলে দিতে দিতে শানুকে দেখে খাওয়ার জন্য ডাক দেয়। শাহানু খাবে না বলে দেয়, শুয়ে পড়ে।
ভাটার কাজ চলতে থাকে। একই তালে পার হয় ঘণ্টা, দিন, মাস...। সবকিছু ঠিকভাবে তদারকি করে ম্যানেজার। হেড়ে সরদার তার দলের শ্রমিকদের কাজের গতি বাড়ানোর জন্য আরও আরও কাজ চাপায়। ইটের ডেলিভারি আগের চেয়ে বেশি বেশি। যত কাজের বায়না আসে সরদার আর তার শ্রমিকেরা তত স্বস্তি পায়। কষ্ট বাড়লেও ওরা শান্তিতে ঘুমায়। কাজের জায়গাটা পাকাপোক্ত। এই কাদা, মাটি, চুল্লি এমনকি আগুন খুব নিজের মনে হয় ওদের। আগুন বুকে আঁকড়ে ইট ভাটার ভালো করে যায় ওরা। শাহানুর চলনে বলনে আগের মতো চঞ্চলতা নেই, তা কারো চোখে পড়ে না; হয়তো কাজের চাপ বেড়েছে বলে। সেই দৌড়ঝাঁপ করে বেড়ানো, এর ওর সাথে খুনসুটি হারিয়ে গেছে কে তার খবর রাখবে! ইদানীং বড় বিষণ্ণ, বড় থিতু হয়ে গেছে থৈ থৈ করা মেয়েটা।
সুশীলা খালা দু’একবার জিজ্ঞাসা করেছে তার শরীর খারাপ কিনা; শানু কেবল মাথা নাড়ায়। তাতে সুশীলার তেমন জানা হয় না, ধারণা করে নেয় শানুর বয়স বাড়ার উদাসীনতা এটা। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে বেশ কিছুদিন। সুশীলা ধরে নেয়, খরার দিনে হাসফেসে গরমের দাপটে খাওয়ায় এমন অরুচি হয়।
একদিন ভোরে নকুল সিকদার এসে হাজির, অনেক ইটের বায়না আছে হাতে, চুল্লি বসিয়ে রাখার জো নেই। পোড়া ইট বের করে নতুন ইট সাজাতে যেন বিলম্ব না হয়, এসব খোঁজ নিতেই আসা। আইজ কালের মধ্যে আবার ইটপাঁজায় আগুন দেয়া হয় যেন। ম্যানেজারের রুমের দিকে যেতে শানুর দেখা পেয়ে নকুল সিকদার প্রশ্ন করে, কিরে শানু, তোকে যে কহ্যাছি রোজই ঘর মুছ্যা আসবি, কদ্দিন ধর্যা যাইস না যে!
তোমার ছ্যালা হামাকে বিছান ধরা কর্যাছে, প্যাটে খাইদপানি দিতে পারিন্যা, কুনো কাম করতেও পারিন্যা যে!
নকুল সিকদার আঁতকে ওঠে ভেতরে ভেতরে। তোতলানো কণ্ঠে চাপা ধমকের সুরে বলে, ছ্যাল্যা!
কেনে! তুমি কহোনি! প্যাট বাধ্যা গেলে হামাকে বিহ্যা কর্যা তোমার ঘরে উঠিয়্যা লিব্যা!
নকুল সিকদার চাপা স্বরে থামতে বলে শানুকে। আশ্বাস দেয় সময় হলে ব্যাবস্থা হবে। নকুল সিকদার মনে মনে আওড়ায়, এসব ব্যাপারে দেরি করা চলে না, ব্যাবস্থা যা করার আজই করতে হবে।
আজ সন্ধ্যা থেকে চিমনির চারপাশে চুল্লীর ঢিবির উপরে হৈচৈ। আগুন দেওয়া হবে একটু পর। মন্টা, ভজন, আকতাব, সলিমচাচা আর বাকিরা কেউ চুল্লীর ভেতরে, কেউ উপরে। সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিচ্ছে চুল্লীর সবগুলো মুখে উঁকি দিয়ে। আজ নকুল সিকদার তদারকি করছে। অনেকক্ষণ ধরে চুল্লির ওপাশের মুখের দিকে ঘুরঘুর করছে। শানুকেও পাশে পাশে নিয়ে এটা ওটা কাজে বলছে। হেড়্যা সরদার আরও খানিক বাঁশ মুড়ো, মশাল, কেরোসিন আনতে বলল। দুরুল শানুউউউ বলে হাঁক দেয়, ওদিকের ঢিবির কোনে চুল্লির শেষ মুখটাতে ফাটল দেখেছে দুপুরে ইট সাজানোর সময়।
সুশীলা খালা তাঁবুর ভেতর থেকে কেরোসিনের ঢিব্বা নিতে যায়। অন্য সবাই বাঁশ মুড়ো, কাঠ মশাল নিয়ে ছুটোছুটি করে কাজে মেতে আছে। কেরোসিনের ঢিব্বা হাতে নিয়ে ধুপধাপ করে বের হয় দ্রুত। যাবার সময় ম্যানেজারের কামরায় উঁকি দেয়, তার ঘর ফাঁকা, এদিকটা সব শূন্য খা খা। সুশীলা দেরি করে না। বাঁশ মুড়োর স্তূপের পাশ দিয়ে জোর পায়ে হেঁটে যায়। তাড়াহুড়ো করে কেরোসিন নিয়ে চিমনির কাছে হাজির হয় সে। সুশীলা দাঁতে দাঁত চেপে চাপা স্বরে বলল, হেড়্যা তোমার কামের গোড়াতে ম্যানেজারকে দেখতে পাও?
সুশীলা ফুঁসে ওঠে। ম্যানেজারের সব দায়িত্ব পালন করে হেড়্যা সরদার। অথচ খামখা কতগুলো টাকা পায় ম্যানেজার। সুশীলার ছলছলে চোখের ভেতরে আগুন! সরদারের চোখ থেকে সুশীলা দৃষ্টি টেনে সরিয়ে আঁচলের মুড়ো কোমরে গুঁজে নেয়। চুল্লীতে আগুন দেবার জন্য সরদার সামনে হাঁটে, বিষণ্ণ মুখে কেরোসিনের ঢিব্বা হাতে ধরে সরদারের পেছনে পেছনে এগোয় সুশীলা। এতগুলো শ্রমিক নিয়ে সরদারের পরিবার এই ভাটাকে নিজেদের সংসার মনে করে।
এদিক ওদিক তাকিয়ে শানুকে দেখতে না পেয়ে একবার শানুউউউ বলে হাঁক দেয় শুশিলা। সাড়া না পেয়ে ভেবে নেয় আজও বোধহয় বাগানবাড়ির ঘরদোর ঝাড়ামোছা করতে গেছে শানু। দুরুলও ফাঁকে ফাঁকে কয়েকবার ডেকেছে, ওদিকটার ফাটা ধসে চুল্লির শেষ মুখটাতে কেউ পড়ে গেলে বা ধাক্কা খেলে তার চিহ্নটুকু অবশিষ্ঠ থাকবে না। অবশ্য নকুল সিকদারের সাথেই তো আছে! আবার হৈচৈ হুলস্থুলে মিলিয়ে যায় দুরুলের খোঁজাটুকুও। ধোঁয়ায় একাকার হয়ে যায় চিমনির চারপাশ, ঢিবির উপর থেকে নেমে আসে শ্রমিকের পাল। ধোঁয়া আরও গাঢ় হয়। খানিক পরে দূর থেকে নকুল সিকদারকেও নেমে আসতে দেখা গেছে। কিন্তু পালের ভেতরে শানুকে দেখা যায় না।
একদিন বাদেই মাটি পুড়ে বের হবে। ঝামা ইট, এক নম্বর ইট, দুই নম্বর ইট, তিন নম্বর ইট। এবারের আগুনটা বেশ ভালো মনে হচ্ছে, এক নম্বর ইটের পরিমানই বেশি হবে হয়তো, এ চালানটা লাভজনক; এসব ভাবনাসহ নানা কথোপকথন চলছে চুল্লী থেকে বেশ দূরে জড় হওয়া শ্রমিকদের মধ্যে। চুল্লীর ভেতরে সারি সারি ইটের ফাঁকে গনগনে আগুনে মিশে যাচ্ছে একটা গোঙানির শব্দ। খালি গতরে ফাঁকা চাতালে দাঁড়িয়ে সবাই উল্লাস করছে; জ্বলন্ত মশালটা তখনও নেভায়নি কেউ, আলো আঁধারে শ্রমিকদের তামাটে দেহে চকচক করছে আগুনের লাল আভা।