এম. মাহফুজুর রহমানের গল্প ‘যৌবন ও কৈশোরে বিসদৃশ’
প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৮, ২০২৩
মিষ্টিমাখা গ্রামখানিতে তখনও শীতের ঘনঘটা ছড়ায়নি তেমন। রাতটা মায়াভরা জ্যোৎস্নাময়। সেই রাতের প্রতিটি ক্ষণ, প্রিয়ার ধীর অথচ স্পষ্ট, নীরব অথচ কম্পিত, প্রেমময় অথচ ভীরু হৃদয়, ক্ষীপ্র অথচ ভীত পায়ের আওয়াজ এখনো বুকে বাজে ফিরনের। প্রেমের কী অস্ফুট যন্ত্রণা, যৌবনের সে কী নাছোড় আঁকুতি! কী এক নেশা! কী এক আকাঙ্ক্ষিত অজানা প্রেমের স্পন্দন আর স্পর্শ পেয়েছিল ফিরন সে রাতে। দুটি হৃদয় ছাড়া তা কেউ বুঝতে পারে না।
কৈশোর সমাপ্তির পথে সুদর্শন ফিরনের। গড়নে উঁচু। পড়ালেখায় দুর্দান্ত। ইদানীং ফিরন কেমন যেন গম্ভীর। আগে অবশ্য এমনতর ছিল না। তার দুরন্তপনায় গ্রামসুদ্ধ লোক মাঝে মধ্যে এসে মায়ের কাছে নালিশ জানিয়ে যেত। পড়াশোনায় ভালো হওয়ায় অবশ্য সবাই আদরও করতো খুব। সেই ফিরন এখন কারো সঙ্গে তেমন কোনো কথা না বলে চুপচাপ একলাটি বসে থাকে। হয়তো ঘরের কোণে, কিংবা রাস্তার ধারে কোনো গাছের নিচে। ধান খেতের আলে কিংবা সরষে খেতের নির্জন প্রান্তে।
কৈশোর এমনই হয়। বয়ঃসন্ধিতে মনের-দেহের, আকার-আকৃতিতে বড় পরিবর্তন আসে এই সময়। ট্রাঞ্জিশন পিরিয়ড পার হয় মানবজীবনের এই সময়টা। মেয়েদের জন্যে এই পরিবর্তন ছেলেদের চেয়েও বেশি দ্রুত লক্ষণীয়। তারা ছেলেদের তুলনায় বেশি এবং আরো দ্রুত দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রকৃতির বিধানে সময়কে আলিঙ্গন করে।
পাশের ঘরের প্রিয়া। শহরে থাকে। নানা-নানির কাছে থেকে কলেজে পড়াশোনা করছে। মাঝে মধ্যে বাড়িতে মা-বাবার কাছে বেড়াতে আসে। ফিরনের চেয়ে ৪-৫ বছরের বড়। প্রিয়াদের কুঁড়ে ঘর। ধানের নাড়া/ফসলের অবশিষ্টাংশ, ছন, খড়-কুটো, তালপাতা বা হোগলাপাতার বেড়া। শহরে বেড়ে ওঠা যুবতী মেয়ে প্রিয়া গ্রামে এলে সেখানে ঘুমায় না। গ্রামে তখন ডাকাত পড়তো। হয়তো নিরাপত্তার কথা ভেবেই বাড়ি এলে ফিরনদের ঘরে ঘুমায়।
এর আগের এবং তারও আগের বার বাড়ি আসার পর থেকে প্রিয়ার আচরণে পরিবর্তন লক্ষ্য করছে ফিরন। তার সঙ্গে কথা বলতে চায়। ঘুরতে যেতে চায়। কেমন যেন গায়ে পরা একটা ভাব হয়েছে। ইদানীং কেমন করে যেন তাকায় সে। প্রিয়ার নরম শরীরটা একবার কি জানি হয়তো ভান করে হবে ওর শরীরের ওপর ঢুলতে ঢুলতে ফেলেও দিয়েছিল। সেসব লক্ষ্য করে ফিরন। প্রিয়ার অতিশয় কোমল শরীরটা যখন ওর যৌবন ছুঁইছুঁই শরীর স্পর্শ করলো তখন কেমন এক অজানা অনুভূতি খেলে গেল। এই প্রিয়াকে ফিরনের অচেনা। ফিরন সেই অনুভূতি ব্যক্ত করতে পারে না। সেই অনুভূতি কাকেই বা বলা যায়! তার দিক থেকে তেমন কোনো সাড়া পায় না প্রিয়া।
সেবার প্রিয়া যখন শহরে ফিরে যাচ্ছিল তখন ফিরনের মনটা কেমন যেন আহত হয়েছিল। কী যেন চলে যাচ্ছে, কী যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে এমন মনে হলো ওর। চারপাশ কেমন যেন শূন্যতা। কী এক ভালো না লাগা কাজ করে। কোন ভাষা দিয়ে সেই অনুভূতি প্রকাশযোগ্য, জানে না ফিরন। ফিরনের মনের অবস্থা আঁচ করতে পারে প্রিয়া। ভাবছে, তাহলে পেয়ে গেলাম। পরের বার পনের দিনের ব্যবধানে বাড়ি ফেরে প্রিয়া। এবার ভাব জমতে শুরু করেছে। এক সঙ্গে খায়, গল্প করে। ফিরন ওর কাছে শহরের গল্প শোনে। ভাবে, সেও একদিন শহরে পড়তে যাবে। মাঝে মধ্যেই ওর শরীরটা অযথাই ঢলে পড়ে ফিরনের গায়ে। সুন্দরী প্রিয়ার অঙ্গ, তার ঢেউ তোলা যৌবনের স্পর্শ পাওয়ায় ফিরন কেন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যায়। নতুন দেহসৌষ্ঠবের গন্ধ আর স্পর্শ-শিহরণে আচ্ছন্ন হয়।
এ কিসের শিহরণ? অস্থির কিশোর মন। যে শিহরণ তাকে নতুন করে জানতে শেখায়। সুপ্ত সত্তাকে আবিষ্কার করতে শুরু করে। ভেতরে কী যেন একটা তোলপাড় হচ্ছে। প্রবুদ্ধ হওয়া শিহরণটা কেন যেন ভালো লাগে ফিরনের। ভাব জমে ওঠে কৈশোরে আর পূর্ণ যৌবনে। কিশোরের আর যুবতীর। নিয়মিত ওরা ঘুরতে বের হয়। হাত ধরাধরি করে ঘুরে আসে গ্রামের পর গ্রাম। বিষখালী নদীর ধারে ঘুরতে যায়। বসে থাকে হাত ধরাধরি করে। কখন যে সময় বয়ে যায়! ইদানীং প্রিয়ার সঙ্গে কথা বলতে, সঙ্গ দিতে নেশার মতো লাগে। একই অনুরাগ কি প্রিয়াকেও আন্দোলিত করে! বুঝতে পারে না ফিরন।
বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মস্ত এক খাল। শুকনোকালে ওই খালটাই গ্রামের পানির বড় উৎস। খালটা যেন গ্রামের সমস্ত পানি শুষে নেয় গ্রীষ্মে। এক সময়ে ওর পানিও যেন নিঃশেষ হয়ে যায়। বর্ষায় আবার দৈর্ঘ্য-প্রস্থে বিশালতা পায়। পূর্ব আর পশ্চিমের দুই গ্রাম আলাদা করেছে ওই খাল। মিলেছে বিষখালী নদীতে। স্রোতস্বিনী বিষখালী বিরামহীন ছুটে চলছে বঙ্গোপসাগরের মিলনে। বিকেলে ঘুরতে বের হয় ওরা। ফিরন হাতটা ধরলে বিগলিত হয় প্রিয়া। খেয়াল হলো ওর হাত ধরলে ভেতরের মানুষটাও জেগে ওঠে। অজানা শিহরণ কাজ করে। প্রিয়াকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয়। জয়ী হয় সঙ্কোচ।
খালের পাড়ে শুকনো ঘাষের স্তূপে বসে পড়ে ওরা। বসলেই ওদের নিয়ে ঘাষের স্তূপ নিচের দিকে দেবে গেল খানিকটা। তুলোর স্তূপে বসলে যেমন হয়। রৌদ্রক্লান্ত পড়ন্ত বিকেলের খালে ভাটা পড়েছে এখন। ভাটার টানে মাঝে মধ্যে দুয়েকটা বাটা মাছ উল্টো লাফে স্রোতের বিপরীতে যাচ্ছে। যেন স্রোতের বিপরীতে চলতেই তার আনন্দ। খালে ভাটার টানেই চোখ ফিরনের। হঠাৎ এক ঝটকায় প্রিয়া ফিরনের গ্রীবাটা শক্ত করে ধরে নিজের মুখের কাছে ওর কপোলটা নিয়ে দাঁত দিয়ে কষে আঁকড়ে ধরলো। এভাবে একই সময়ে দু’চোয়ালে। কোনো বিরতি না নিয়েই। ফলে ফিরনের গণ্ডদেশে দাঁতের গোলাকৃতির স্পষ্ট দাগ বসে গেল। ফিরন ফর্সা বলে দাগটা একটু বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
প্রিয়ার আচানক আক্রমণে কিছুটা ভরকে যায় ফিরন। দূরে সরে গিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। ভেতরে ওই একই শিহরণ। তবে এবার কেন যেন একটা ভয় ভর করছে ওর ওপর। এ এক সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। জীবনের নতুন, ভয়ার্ত অথচ পরমপুলক। গণ্ডদেশ মধুরভাবে আহত হওয়ার মূহুর্তে প্রিয়ার উন্নত বক্ষযুগলের দ্রুত ও উষ্ম স্পন্দন ওর বুকের এক পাশের পাঁজরটা আলতো করে ছুঁয়ে যায়। দূরে সরে গিয়ে কোনো কথা বলছে না ফিরন। ঠোঁট কাঁপছে। ভাবলো প্রিয়া- এতটা জবরদস্ত না হলেও পারতাম! পরক্ষণেই ভাবে, ভালোই হয়েছে। ও বুঝুক। ওকে আমি কতটা ভালোবাসি তা অনুভব করুক। আমার ভালোবাসার শক্তিটা পরখ করুক! ওকে জেগে উঠতেই হবে যে।
প্রিয়া এগিয়ে গিয়ে আলতো করে চোয়ালে ধরে ব্যথার জায়গাটা হাত দিয়ে স্পর্শ করে। কাটা ঘায়ে এবার আলতো করে চুমো বসিয়ে দেয়। ফিরন বুঝতে পারে এবার তপ্ত ধাতব কোনো পদার্থ নয়। প্রিয়ার গোলাপি ওষ্ঠাধর। এবারে যে স্পন্দন ফিরন পেলো সেটা অন্য এক আঁকম্পন। অস্থির হয়ে ওঠে ফিরন। প্রিয়াকে জড়িয়ে ধরবে না পালাবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। কি এক অজানা প্রবল বাঁধা তাকে গ্রাস করে। প্রিয়ার কৃশকায় সুমিষ্ট অধরটা আক্রমন করতে মন চাইছিলো। তার পরাজয় হলো। শুকনো ঘাষের কুন্ডলী এলোমেলো করে দিলো দৌড়!
রাত করে ঘরে ফেরে ফিরন। চোখ বুজতে চেষ্টা করে। চোখ বন্ধ করলেই প্রিয়ার মুখচ্ছবি সামনে এসে হাজির হয়। এতো ভারি যন্ত্রণা! প্রিয়া রীতিমতো ওদের ঘরে এসে ঘুমাতে যায়। দেখে ফিরন ঘুমিয়ে আছে। ওকে দেখতে পেয়ে এবার নিশ্চিন্ত প্রিয়া। দরজাটা খোলাই ছিলো তবে সঙ্কোচে আর ওমুখো হয় না।
রাতে হঠাৎ স্বপ্ন-শিহরণে ঘুম ভেঙে যায়। লাফ দিয়ে উঠে যায় বিছানা থেকে। একি! সারা শরীর ঘেমে গেছে! বিকেলে প্রিয়া যা ওর সঙ্গে করেছে স্বপ্নেও ঠিক একই রকম! ধীরে ধীরে বিছানা ছাড়ে। ঘর থেকে বাইরে এলে বাইরের বাতাসটা ওকে মৃদু দোলা দিয়ে গেলো। ঘর্মাক্ত শরীরে দারুন শীতলতার স্পর্শ পায়। পেছন ফিরে তাকালো। ওই রুমটায় ঘুমাচ্ছে প্রিয়া। লোহার গ্রিলে কাঠের জানালার দুটো অংশ খোলাই রয়েছে। পশ্চিমের জানালা থেকে হেলা পড়া চাঁদটার আলোয় পরিস্কার দেখা যাচ্ছে ওর চাঁদমাখা মুখখানা। সে যে কী এক ঐন্দ্রজালিক মায়ামাখানো নিষ্কলঙ্ক মুখ! যৌবনের ফিরন ভাবে, আহা সেসময় মোবাইল ক্যামেরা থাকলে মুখখানার ছবি তুলে চাঁদের দেশে পাঠিয়ে দিতাম। ওই মুখচ্ছবি দেখে নিশ্চয়ই চাঁদ লজ্জা পেতো। ঈর্ষান্বিত হতো।
একটি পাতলা নকশি কাঁথা বুকে জড়িয়ে আছে প্রিয়া। এক হাঁটু ছড়িয়ে রেখে অন্য হাঁটু গুটিয়ে নিয়েছে। কিছুক্ষণ প্রিয়ার ঘুমন্ত মুখে তাকিয়ে থেকে আবার নিজের বিছানায় ফেরে।
পরদিনও লাপাত্তা। কোথাও নেই। ধুর! ছেলেটার এত লজ্জা কেন? বিরক্ত হয় প্রিয়া। রাত এলে বাড়ি ফিরলো। মেয়েদের দল সবাই উঠোনে বসে গল্প করছে। আব্বা ওই ঘুমাচ্ছে হয়তো। আর বাইরে বের হলো না ফিরন। বসে আছে ঘরের সামনের বড় বারান্দার একবারে মাঝখানটিতে। যেখানে ওদের ভেতরের ঘরে যাওয়ার একটা দরজা আছে। আব্বা ঘুমিয়েছেন কিনা বলা মুশকিল।
মা ও বোনেরাও ডাকলো, কি রে তুই অন্ধকারের মধ্যে একলা কি করিস? এখানে আয়। বোনেরা বলাবলি করছে, ও ইদানীং তেমন কথা বলে না, একা একা বসে থাকে। কি ব্যাপার? কি হয়েছে মা?
মা বললেন, কই, কিছুইতো জানি না।
আবার বোনের ডাক, ফিরঅঅঅন, ফিরঅঅঅন, এই ফিরঅঅঅন, এদিকে আয়।
কোনো সাড়া নেই। সে কাঠের দেয়ালে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। সাড়া না পাওয়ায় সবাই ভাবছে হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। এসবই উঠোনে থাকা মেয়েদলের মধ্যে থেকে শুনছে প্রিয়া। ফিরনের চোখ উঠোনের জ্যোছনাভরা আলো-আঁধারির দিকে। সবই দেখা যাচ্ছে চাঁদের জমকালো আলোর আয়োজনে।
ধীর পায়ে জ্যোছনার আলো ভেঙে একটি ছায়া এগিয়ে আসতে দেখছে ফিরন। ছায়াটা তাদের ঘরের দিকে আসছে। চাঁদ তখনও পূবে থাকায় ছায়াটা একটুখানি পশ্চিমে বেঁকে আছে। যত কাছে আসছে তত স্পষ্ট হচ্ছে অবয়ব। ধীর পায়ে ছোট বারান্দা পেরিয়ে বড় বারান্দায় পা রাখলো ছায়াটা। নিঃশ্বাসেই বুঝতে পারলো কোথায় বসে আছে ফিরন। সোজা গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো প্রিয়া। বসা থেকে দাঁড় করালো।
বললো, ব্যথা পেয়েছো বলে রাগ করেছো?
লা জবাব!
শক্তভাবে চেপে ধরায় প্রিয়ার সুডৌল বক্ষ ফিরনের বক্ষপঞ্জরে মিলে যাওয়ায় কি এক অজানা লজ্জায় ফিরন এদিক-ওদিক করলো। কিন্তু ছাড়া পায় না।
ভেতরের দিকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে প্রিয়া। এতে আরো শক্তভাবে গায়ে লেপ্টে গেছে। আবারো সেই উন্মাতাল উষ্মতা। এবার আরো গভীরভাবে। ফিরন স্ট্যাচু। ভেতরে টানতে পারে না। এবার নানামুখী আদরে জর্জরিত-উপদ্রুত ফিরন। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে ব্যর্থ হয়। এসব উচ্চ শ্বাস প্রশ্বাস, মৃদু এবং নিরর্থক অভিমানি খেলা ফিরনের আব্বার কানে পৌঁছে যায়।
এই কে রে ওখানে?, কি করো ওখানে? যা... আব্বার শ্বাসানির শব্দ।
ব্যস শেষ। এক ঝটকায় প্রিয়াকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলো কিনা ঘরের অন্ধরকারে আর বুঝতে পারে না। উঠোনের দিকে না গিয়ে পেছনের জ্যোছনাস্নাত বিশাল বাগানের দিকে এগিয়ে যায় ফিরন।
ফিরনের ভয়ার্ত অথচ লাজুক প্রেমের মাদকতা কাটে না। কিশোর মন ভাবে, প্রিয়ার যে উষ্ম আলিঙ্গন সে পেয়েছে সেটা কি? একি অনন্দ নাকি আন্দোলন! পরমানন্দ নাকি পরমান্দোলন। নাকি এক মোহ! এ কোন ডাকিনী! আলিঙ্গনের সময় খুবই ভালো লাগছিলো। ভয়ও হচ্ছিলো প্রচণ্ড। সারা শরীর অজানা মাদকতায় আচ্ছন্ন। তবে ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়ে সর্বনাশ করে দিয়েছেন আব্বা। উহ্! মানুষের বুকের মাঝে এতো উষ্মতাও থাকতে পারে! হৃদয়ে হৃদয়ে না মিললে হয়তো বুঝতেই পারতো না যে এ এক মহাশক্তী। উন্মাদনা! শেকল ছেঁড়া প্রণয়।
পাশের ঘরের যে মেয়েটিকে এতদিন দেখে এসেছে এ তো সে নয়। তাহলে এ কোন প্রিয়া? এ কোন মায়া! এই মায়া তার কাছে কি চায়! কি-ইবা সে দিতে পারে? কিভাবেই বা দিতে পারে? অজান্তে আর উত্তেজনায় এসব ওলট-পালট ভাবনায় আনমনা হয় সে। ফিরন সেদিন প্রিয়ার বুকের ধড়ফড়ানি, আঁকুতি-মিনতি বুঝতে পেরেছিলো কিনা কে জানে। ভালো-খারাপ, উচিৎ-অনুচিৎ এসব পেছনে ফেলে যৌবনের ফিরন ভাবছে, কী অবমূল্যায়নটাই না করেছে প্রিয়ার প্রেমের!
পরদিনই প্রিয়া নানা-নানির কাছে চলে যায়। প্রিয়ার চলে যাওয়ায় আহত হয় ফিরন। পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে আগের মতোই। আগের চেয়ে আরো গম্ভীর। কারো সাথে তেমন কথা বলছে না। মাঝে মধ্যে রাস্তায়, খালের পাড়ে, নদীর ধারে একা বসে থাকে। ফিরনের মাকে কে যেন বলে যায়- ফিরনকে একটা গাছের সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে কান্না করতে দেখলাম। মাঝে-মধ্যেই এরকম খবর অনেকে দিচ্ছে মায়ের কাছে, কখনো আব্বার কাছে। জিজ্ঞেস করলে কোনো উত্তর মেলে না।
ফিরন স্কুল-কলেজ শেষ করে শহরে ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হয়েছে। এরই মধ্যে মাত্র দুবার বাড়িতে এসেছে প্রিয়া। ফিরনের সাথে দেখা না করেই আবার ফিরে গেছে। এসবের অনেক দিন পর পর্যন্ত আর প্রিয়ার খোঁজ পায় না কেউ। বাড়িতেও আসে না প্রিয়া। শহরে ওদের নানা-নানির কাছে খোঁজ নিতে গিয়েছে। সেখানেও দেখা হয় না। লোকজন বলাবলি করছে প্রিয়া নাকি নিখোঁজ!
বছরখানেক পর হঠাৎ প্রিয়া বাড়িতে আসে। এবার অবশ্য একা নয়। সঙ্গে রয়েছে ফুটফুটে একটা বাচ্চা। প্রিয়া আর ওদের ঘরে যায় না। রাতে প্রিয়াদের ঘরে গিয়ে ফিরন দেখে ও বাচ্চাকে স্তন্য দিচ্ছে। পায়ের আওয়াজ পেয়ে কুপি বাতির ওপর দিয়ে তাকায় প্রিয়া। চোখাচোখি হয়। একবার বাচ্চা আরেকবার ওর দিকে তাকিয়ে মুহুর্তেই চোখ নামিয়ে এক দৌড়ে ঘর থেকে বের হয় ফিরন। পাছে কান্নাজড়িত প্রিয়ার কণ্ঠ কানে বাজে, ফিরন, একবার আমার সামনে দাঁড়া, একবার তোকে দেখি। আমাকে তোর আর বুঝতে হবে না রে ফিরন। তুই ভালো থাকিস।
সেই গেল! বহু জায়গায় খোঁজাখুঁজির পরও আর কোনো হদিস মেলে না ফিরনের।