সুইডেনের রাস্তায় লেখক

সুইডেনের রাস্তায় লেখক

এখানে কাজই জীবন, জীবনই কাজ

মারিয়া সালাম

প্রকাশিত : মে ২০, ২০১৯

সুইডেনে আসার পরে তিনদিন প্রায় সারাদিন ইভেন্ট ছিল। গতকাল আর আজ পুরা ফ্রি, আগামীকাল আবার সারাদিন কাজ। এরা সকাল আটটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত টানা কাজ করতে পারে, কোনো ক্লান্তি নাই। দেখলে অবাক লাগে, তবে একটু গভীরভাবে ভাবলে অবাক হবার কিছু নাই, বরং শিখার অনেক কিছু আছে। কেন ওরা পারে, আমরা কেন পারি না বা পারলেও করি না, সেটা একটা গবেষণার বিষয়।

এরা কাজ করে নিজের দায়িত্বে, হাজার রকমের কাজ থাকে। তবে সেটা কাজ হিসেবে বা চাপ হিসেবে কেউ নেয় না, যেটাই করে আনন্দের সাথে করে। সেটার একটা বড় কারণ, এখানে কাজ করার সুযোগের অভাব নাই, যে যার পছন্দমতো ক্যারিয়ার বেছে নিতে পারে। তাই, কাজটা মূলত চাকরি হিসেবে না নিয়ে নিজের জীবনের একটা অংশ হিসেবে দেখে এরা। আর আমাদের যেমন কাজের জায়গায় কাজের বাইরে এক হাজার অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা থাকে, ওদের তা নাই।

আমরা কাজের বিষয়ে চিন্তার পাশাপাশি পাশের টেবিলে বসা সহকর্মীদের কিভাবে শায়েস্তা করা যাবে, বা কিভাবে তাকে পেরেশানের মধ্যে রাখতে হবে, সেটাও আমাদের পবিত্র দায়িত্ব মনে করি। এরা তা মনে করে না, এরা কাজের জায়গায় কাজের আলাপ ছাড়া আর অন্যকিছুকে কোনোই গুরুত্ব দেয় না।

কাজের জায়গায় এদের মোটামুটি টার্গেট থাকে, কিভাবে নিজের কাজটা সুন্দরমতো করা যাবে যাতে করে নিজের কোয়ালিটি ডেভেলপমেন্ট হয়। এখানে কাজ দিয়েই টিকে থাকতে হয়, তেলবাজি করে অযোগ্য লোকের দিনের পর দিন একটা পদে টিকে থাকা অসম্ভব। তাই, সবার উদ্দেশ্য থাকে নিজের দক্ষতা কিভাবে আরো বাড়ানো যায়। এদের প্রতিযোগিতা নিজেদের সাথেই। অন্যকে ল্যাঙ মেরে উপরে উঠার বা যে ভালো করছে তার পিছে লেগে থাকার স্বভাব কম। একদম নাই তা না, তবে যারা এসব করে তাদের সবাই ছোট চোখে দেখে বলে, ইচ্ছা থাকলেও নোংরামি করা সম্ভব না।

আর একটা কারণ হচ্ছে, এদের নিজের মতো জীবন উপভোগ করার স্বাধীনতা। এই ব্যবস্থা রাষ্ট্রই করে রেখেছে। ব্যবস্থা বলতে আমাদের মতো খালি কাগজে কলমে না, ব্যবহারিকভাবেই সেটা বাস্তবায়ন করে। এরজন্য মিটিং মিছিল বা কোনো সংগঠন করার দরকার হয় না। এদের সাপ্তাহিক ছুটি থাকে দুইদিন, এই সময় দুনিয়া উল্টে গেলেও কাউকেই কাজ করতে বাধ্য করা হয় না। সরকারি ছুটি থাকে বছরে ১০, ১২ বা ১৩ দিন, একেক জায়গায় একেকরকম। এটা ছাড়াও, বছরে ঐচ্ছিক ছুটি পায় তারা ৩০ দিন। এই ৩০ দিন ছুটি মানে ছুটিই, কাগজে কলমে কেবল না, এ ছুটি তারা পাবেই বা তাদের নিতেই হবে। কবে নিবে, কিভাবে নিবে সেটা যার যার ব্যক্তিগত বিষয়।

কেউ দিনে আটঘণ্টার বেশি কাজ করলে, অফিস সেটা কাউন্ট করে রাখে, সেই সময়গুলোও সে পরে দিন হিসেবে ছুটি নিতে পারে, নিতে পারে বলতে অফিস তাকে দেয়। আমাদের মতো বলে না, অফিসে সময় দিয়েছ তাতে এমন কি করেছ? এরপরে আছে অসুস্থতার জন্য ছুটি, কেবল নিজের অসুস্থতা না, সন্তানের অসুস্থতার জন্যও মা বাবা ছুটি পায়। এমনকি ইচ্ছা হলে অনেকেই বাসা থেকেই সেদিনের কাজ করে দিতে পারে।

যাদের রোস্টার ডিউটি তারা তাদের সময়মতো অফিস করে, যাদের অফিসে ২৪ ঘণ্টা কাজ হয়, তারা আলোচনা সাপেক্ষে যেকোনো সময় গিয়ে ডিউটি করে আসতে পারে। ওখানে ছুটি নেয়া হয় সাপ্তাহিক ছুটির সাথে মিল রেখে আগে বা পরে, তাতেও তাদের সমস্যা হয় না। মানে নিজের জীবন এরা নিজের ইচ্ছামতো স্বাধীনভাবে কাটানোর সুযোগ পাচ্ছে। নিজের কাজের জায়গা নিয়ে এদের কোন হতাশাবোধ কাজ করে না, মনে ক্লান্তি আসে না।

এখানে মায়ের সাথে সাথে নতুন বাবারাও ছুটি পাচ্ছেন। যেমন, জার্মানিতে মা- বাবা মিলে প্রায় এক বছর ছুটি নিতে পারে। মা ছয় মাস নিলে বাবা ছয়মাস নিতে পারে। মা আটমাস নিলে বাবা চার মাস, মানে দুইজন মিলে যেকোন ভাবেই হোক এক বছর ছুটি নিতে পারে। এই ছুটি যে আবার একবারে নিতে হবে তা না, তিন বছরের মধ্যে যেকোন সময় সেটা নেয়া যাবে।

আবার বৃহস্পতিবার যদি কোন সরকারি ছুটি পরে, সরকারি অফিসগুলো শুক্রবার এমনিতেই বন্ধ থাকে। আর বেসরকারি অফিসে কর্তৃপক্ষ ধরেই রাখে শুক্রবার সবাই ছুটি নিবে, তারা ঐদিনের কাজ এমনিতেই শিথিল রাখে। কোন সহকর্মীকে প্রেসার দেয়া তাদের ধাতে নাই। এখানে বসিং বলে কিছু নাই। সবাই মিলে কাজ করে, টিম লিডারের বয়স এখানে ম্যাটার করে না। অনেক জুনিয়রের টিমে অনেক সিনিয়র লোকজন কাজ করে, তাতে তাদের কোন সমস্যা হয় না। কারণ, কেউ কারো মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খায় না বা ক্ষমতা আছে বলেই সহকর্মীকে চাপে রাখে না। বরং, নিজের টিমের লোকজনকে কিভাবে আরো চাপহীন রাখা যায়, তাদের প্রাপ্য সম্মান আর সুবিধাগুলো বুঝিয়ে দিয়ে, তাকে কিভাবে টিমের প্রতি আরো অনুগত রাখা যায়, সেটাই টিম লিডারের লক্ষ্য থাকে।

কথা হচ্ছিল আমি যে ইভেন্টে এসেছি, সেই ইভেন্টের এক কর্মীর সাথে। নাম মারিয়ানা। মারিয়ানাকে বললাম, এত কাজ, প্রায় তিন হাজার মানুষের আয়োজন। তোমরা রাতদিন খেটে যাচ্ছ, রহস্য কি? সে বলল, শৃঙ্খলা ভালো কিন্তু তার বেড়াজালে মানুষকে আটকে দিলে, আমরা কেবল যা আদায় করে নিতে পারবো, তাই পাব। তার চেয়ে একচুল বেশি আমরা পাব না। আর কর্মীদের যদি তাদের নায্য পাওনা বুঝিয়ে দেয়া হয় বা তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতি সম্মান দেখান হয়, তাদের পরিবারের প্রয়োজনে তাদের পাশে দাঁড়ানো যায়, তারা সংগঠনের একটা অংশ হয়ে ওঠে। তারা তখন সংগঠনের প্রয়োজনে দিনরাত, সময় ঘণ্টা ধরে হিসাবে যায় না। আর তারা জানে, যা দিবে সেটাই তারা ফেরত পাবে, যা তাদের কাজের স্পৃহা দ্বিগুণ করে দেয়।

এরকম চিন্তা বাংলাদেশে খুব কম প্রতিষ্ঠানে করে, আমি আমার প্রতিষ্ঠানের (কালের কণ্ঠ) পরিবেশ তুলনামূলক ভালো পেয়েছি সবসময়। ঢাকা ট্রিবিউনেও এ বিষয়টা বেশ ভালো পেতাম। তবে, অন্যান্য অনেক নামকরা প্রতিষ্ঠানেও দেখি শৃঙ্খলার নামে বাড়াবাড়ি, কর্মীদের রক্ত পানি করে খাওয়ার প্রবণতা। চাকরি করা বলতে যা বোঝায় সেটাই আমরা করি। ওরা সভ্য সমাজের মানুষ, ওদের মনোভাব ওদের এগিয়ে নিয়ে যাবে আরো বহুদূর। আমাদের আবিবেচনা আর পরশ্রীকাতরতা আমাদের টেনে নিয়ে যাবে আরো পেছনে, আরো নিচে।

লেখক: গল্পকার ও গণমাধ্যমকর্মী