এক টুকরো বাংলাদেশ ‘গোসলের পুকুরসমূহ’
ইসমাইল হামিমপ্রকাশিত : এপ্রিল ২৪, ২০২০
কিছুদিন আগে মেহেদী উল্লাহর একটা লেখা পড়েছিলাম সমকালের কালের খেয়ায়। ‘ফলিত স্বপ্নের বাসনা’ নামে। তার প্রথম উপন্যাস ‘গোসলের পুকুরসমূহ’ লেখার নেপথ্যকাহিনি জানতে পারি সেখান থেকেই। মূলত তারই ধারাবাহিকতায় অনেকটা কৌতূহলবশত উপন্যাসটা পড়তে শুরু করি।
এই উপন্যাসটা পড়েছি অনেকটা গল্পের বই পড়ার মতো করে। থেমে থেমে। উপন্যাসের কাহিনির শুরু ঘোরগ্রস্থ একজন কথকের রহস্যময় কথামালা দিয়ে, এভাবে— গ্রামের গোসলের নিজস্ব নিয়মে একটা লুঙি ও গামলাকে পাড়ে ঘাসের উপর এবং সাবানের কেসটাকে ঘাটের কাছে থুয়ে আমি প্রথমে পানিতে ডান পা বাড়ালাম। বাম পা নামানোর আগেই ওদের দিকে চোখ গেল। আঁতকে ওঠার মতো পরিস্থিতি। এত বছর বাদে একসঙ্গে সবাইকে পেয়ে যাব ভাবিনি। কেউ সাঁতার কাটছে, কেউ হাঁটু মাজন করছে, কেউ কোমরপানিতে দাঁড়িয়ে আঁচল বিছাচ্ছে, কেউ ডুব দিচ্ছে, কুলকুচি করছে, কে-বা পা দিয়ে তেল খোঁজার চেষ্টারত, কেউ তালুতে পানি তুলে ছুড়ছে ওপরে; প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ভঙ্গিতে। ওরা বারো জন। পুকুরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। সত্যি আমি আশা করিনি। আমাকে দেখে তারা নিজ নিজ ভঙ্গিমা মুলতবি করে সমস্বরে আহ্বান করতে থাকল, ‘আসো, আসোও, আসোওও না।’ যেন আমি আসব, ওরা জানত। আর এলেই ওদের সঙ্গে গোসলে ডাকবে, এটাও ঠিক করে রাখ। আমার ভয় বা অপ্রস্তুত হওয়ার কিছু নেই। আমি স্থলে ওদের সবার সঙ্গ পেয়েছি। জলে এই প্রথম। প্রেম পৃথিবীর সর্বত্র এক, স্থল কিংবা জলে যেখানেই হোক। ওরা সবাই আমার প্রেমিকা। বিভিন্ন সময়ের, জীবনে প্রথম পুকুরে গোসল করার সময় থেকে শুরু করে।
জীবন পথের সংক্ষিপ্ত ভ্রমণে তার প্রত্যাশা, আকাঙ্ক্ষা ও সম্ভাবনার গল্পে আমরা দেখতে পাই, শৈশব-কৈশোরের চোখে দেখা গোসলের পুকুরসমূহকে সময়জ্ঞানের সাথে মিলিয়ে বর্তমান সময়ে বসে আত্মমগ্ন হয়ে একজন প্রেমিক স্মৃতির ঝাঁপি খুলে হাতড়ে বেড়াচ্ছে তার স্বপ্নকে। পাঠকদের স্বপ্ন-কল্পনা-বাস্তবতার মিলিত এক জগতে নিয়ে যেয়ে সে বলে যাচ্ছে প্রেমিকাদের নিয়ে তার প্রেমকালীন সময়ের কথা, বিচ্ছিন্নতার কথা। একই সময়ে জীবন-যাপন করেও অনিবার্য নিয়তি আর বাস্তবতার ফাঁদে আটকা পড়া মানুষের কথা।
গোসলের পুকুরসমূহ, বিবাহস্বপ্নের কনে, রেণু বালার ব্যস্তগলার দিনগুলিতে, উড়ির চরের আয়নাবুড়ি ও মঞ্জুরির ড্রেসিংটেবিল, সর্পবংশের শেষদিন, দাগ, মনসামঙ্গল, কোন পরান বিদ্যাশ হইলায়, ইচ্ছামৃত্যু হবে তুমি, মেডেন/মেডেন বিহীন, ক্ষেত-খামার, গৃহপালিত পশু তথা কৃষি, ভাষা ও উন্নয়ন অধ্যায়ন প্রেক্ষিত প্রেম ও পরিবার, এতিমখানার ইলম, আক্ষরিক, মাতাই পূখিরী, হোরাজের নন্দনতত্ত্ব, আমার অসুখ। আই মিন আমি অসুখী ‘গোসলের পুকুরসমূহ` উপন্যাসটি এই ষোলো অধ্যায়ে লেখা। অধ্যায়গুলোর ব্যতিক্রমী গদ্যভাষার জন্য পাঠক এর আঙ্গিক নিয়ে খানিকটা দ্বিধান্বিত হবেন।
মূলত এই উপাখ্যানগুলোই এই উপন্যাসের উপজীব্য। যেগুলো কোনো নির্দিষ্ট কাহিনির গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়। জীবনের বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতার অন্তর্গত প্রেমবিষয়ক নানা বোধের ধারাবাহিক বর্ণনা মাত্র। তবে গল্পগুলোর চারপাশটা তেমন গোছানো নয়। তাই কোনো কোনো আখ্যানে আমরা দেখি, লেখক বিষয়ের চেয়ে আঙ্গিকের দিকে অতিরিক্ত মনোযোগী হওয়ার ফলে নানা জায়গায় অনেক গল্পই হারিয়ে গেছে দৃষ্টিকটুভাবে।
এটি নিছক কোনো প্রেমকাহিনি নয়। এখানে যদিও প্রায় অর্থহীন, প্রয়োজনহীন কার্যকলাপ ও কথাবার্তা আছে অনেক। কিন্তু একইসঙ্গে আছে পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলির অভিঘাতে সৃষ্ট জটিল সব মনোজাগতিক সংকটের নিরাসক্ত আর নির্মোহ বিবরণও। অবশ্য নানা জায়গায় তার এই বর্ণনাভঙ্গি কখনো কখনো ক্লান্তিকর। জনজীবনে প্রবাহমান নানা মিথের উল্লেখযোগ্য ব্যবহার দেখা যায় ‘মনসামঙ্গল’ ও ‘সর্পবংশের শেষদিন’ প্রভৃতি পর্বে। বিষয় আর প্রকরণের বৈচিত্র্যে ভরা এই উপন্যাসের বিশাল অংশজুড়ে আছে প্রচলিত লোকাচার, লোকবিশ্বাস ও সংস্কারের নানা গল্প।
কথক ভঙ্গিতে থাকা চরিত্রটির যে গভীর দার্শনিক বোধ জীবন ও জগৎ সম্পর্কে; তার সাথে ব্যাখ্যাতীত অনেক বিষয়কে, ব্যাখ্যাহীন মানবজীবনের অনেক সত্যকে সে উন্মোচন করে গেছে একের পর এক। যা পাঠককে ভাবায়। কাহিনির প্রেক্ষাপটে এমন অনেক তাৎপর্যময় ঘটনাবলির সন্নিবেশও আমরা দেখি উপন্যাসের জায়গায় জায়গায়। পাশাপাশি উপন্যাসের কাহিনির দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিবর্তনকে মূর্ত করে তুলেছে ‘কোন পরান বিদ্যাশ হইলায়, ক্ষেত-খামার, গৃহপালিত পশু তথা কৃষি, ভাষা ও উন্নয়ন অধ্যায়ন প্রেক্ষিত প্রেম ও পরিবার’ আর ‘মাতাই পূখিরী’ ইত্যাদি পর্ব।
ভাষার অদ্ভুত আচরণ, চরিত্র ও কাহিনির পরম্পরা নির্মাণে লেখকের অদ্ভুত উদাসীনতা, গল্প বলার ভঙ্গি একইসঙ্গে চরিত্রদের কৌতুককর নানা অভিব্যক্তি যেভাবে চিত্রিত হয়েছে এই উপন্যাসে; সব মিলিয়ে তা পাঠক মনে একটা অন্য রকম অনুভূতির সঞ্চার করবে নিঃসন্দেহে।
এককভাবে উপন্যাসের বিষয়বস্তুকে সনাক্ত করা আমার মতো পাঠকদের জন্য অবশ্য একটু কঠিন। তারপরও সংক্ষেপে বললে, স্বপ্ন নিয়ে নাগরিক মানুষ ও তাদের জীবনের যে পৌনঃপুনিকতা, এদের জীবনবোধের যে গভীর উপলব্ধি; তারই চিত্রায়ণ করেছেন লেখক কুশলতার সঙ্গে। সেখানে ইঙ্গিতে ও ইশারায় তিনি এমন সব স্বপ্নের কথা বলেন, যেখানে ব্যক্তির স্বপ্নবিষয়ক অভিজ্ঞতাকে ছাপিয়ে মুখ্য হয়ে উঠেছে একই সাপেক্ষে সমাজের মানুষদের চিন্তাগত সহাবস্থানের শিল্পিত প্রকাশ। পরবর্তীতে যা পাঠকের মনে এমনসব দৃশ্যপটের বিস্তৃত রূপ তৈরি করে, এমনসব দৃশ্যাতীত জগতের সন্ধান দেয়, যার সন্ধান আদতে আমরা কেউই পাই না!
কিন্তু লেখক মনে হয় এগুলো নিয়ে বিস্তৃত কোনো কাজ করতে চাননি। তাই হয়তো উপন্যাসটি যে প্রেক্ষপটে লেখা তার সামগ্রিক কোনো চিত্র পাঠ শেষে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে না। যদিও প্রতীকী আবহে একটা সময়ের নানা প্রসঙ্গ হাজিরা দেয় মাঝে মাঝে। তারপরও যে ভাষাভঙ্গিতে তিনি পর্বগুলো রচনা করেছেন তা পাঠকের প্রেমবিষয়ক অনুভূতিকে গভীরভাবে স্পর্শ করবে।
সবশেষে, এই উপন্যাস পড়ে মনে হয়েছে মানবস্বভাব, মানবজীবন ও সমাজ নিয়ে লেখক আসল এক টুকরো বাংলাদেশকেই নির্মাণ করতে চেয়েছেন! উল্লেখ্য ‘গোসলের পুকুরসমূহ’ উপন্যাসে ‘পুকুর’ সময়ের সমার্থক।
গোসলের পুকুরসমূহ। লেখক, মেহেদী উল্লাহ। প্রচ্ছদ, ধ্রুব এষ। প্রকাশক, ঐতিহ্য। প্রচ্ছদ মূল্য, ১৭৫৳