একটি কার্যকর একাডেমিয়ার স্বপ্ন

জগলুল আসাদ

প্রকাশিত : জুলাই ১৭, ২০১৯

গুছিয়ে চিন্তা করা ও সুশৃঙ্খলভাবে লেখার চর্চা করা আমাদের শিক্ষার্থীদের আমরা শেখাতে পারিনি। আমরা কতটুকুইবা জানি বা পারি, সে সন্দেহ জারি রেখেই বলছি কথাটা। পদ্ধতিনিষ্ঠ একাডেমিক লেখালেখি শেখা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর অন্যতম প্রধান কাজ। আমরা আমাদের প্রস্তুতি-আগ্রহ-নিবিষ্টতা ও জানাশোনার অভাবের কারণেই হয়তোবা চিন্তা কিভাবে করতে হয়, কিভাবে পাঠ করতে হয় কোন টেক্সট— এসব পদ্ধতিগত প্রশ্নে মাথা ঘামাই না। অথচ শিক্ষায়তনে এ বিষয় নিয়ে ভাবা জরুরি।

একাডেমির গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের মনোজগত ও সৃজনশীলতা নির্মাণে (এবং ধ্বংসেও) একাডেমির আছে সুগভীর ও দীর্ঘস্থায়ী ভূমিকা। বিদ্যায়তনে শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি, পাঠ, পুনঃপুন ব্যক্তিগত অধ্যয়ন ও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ এক বিশেষ দক্ষতা এবং মনোকাঠামো তৈরি করে, যা অন্যভাবে অর্জন করা দুরূহ, অসম্ভব নয় যদিও। শিক্ষকের ক্ষেত্রেও একটি বিশেষ বিষয়ে দীর্ঘদিন শিক্ষাদানের ফলে তার ভেতরে যে অন্তর্দৃষ্টি জন্ম নেয়, সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমরা যারা এ দেশে কলেজ পর্যায়ে অনার্স-মাস্টার্স পড়াই তাদেরকে যেহেতু একসাথে বহু জিনিস পড়াতে হয়, তাই কোনো বিষয়েই বিশেষায়িত জ্ঞান গড়ে ওঠে না। এখানে গাইড বই লেখকেরা নিজেকে লেখক দাবি করেন; প্রশ্নোত্তরভিত্তিক নোট বই উৎপাদকেরা এগুলোকে একডেমিক লেখা ভাবে। এদেশে প্রমোশন মানেই বেতন বৃদ্ধির আলাপ। এ তল্লাটে অধ্যাপক মানেই সর্বোচ্চ বেতনপ্রাপ্ত `সম্মানিত` ব্যক্তি!

যা হোক, কোনো একটা বিশেষ বিষয় বা টেক্সট নিয়ে আলোচনা করতে গেলে মূল টেক্সট পাঠের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ন্যূনতমপক্ষে ভিন্নধর্মী ৩-৪টি রেফারেন্স বই, ৫-৬টা একাডেমিক আর্টিকেল পড়া দরকার। এই ন্যূনতম প্রস্তুতির উপর ভর করেই কেবল কিছুটা নতুন ভাষ্য তৈরির সম্ভাবনা রচিত হতে পারে। পাঠ, চিন্তা-গবেষণা ও লেখালেখির শক্তিশালী ট্রেডিশন সৃষ্টি ছাড়া কোনো একাডেমি হতে পারে না। জ্ঞান বিতরণ ছাড়াও একাডেমির কাজ গবেষণা ও নতুন জ্ঞান সৃষ্টি। বিদ্যায়তন উৎপাদিত জ্ঞানের নির্যাসগুলোই সাংবাদিক, কলামিস্ট, নিবন্ধকারেরা ব্যবহার করেন, করবেন। একটা বিশ্ববিদ্যালয় দেশ ও সমাজ এবং সর্বোপরি বিশ্বে অবদান রাখেন গবেষক তৈরি করে, জ্ঞানার্থী ও নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করে, পুরনো চিন্তার দাসত্বের অভ্যস্ততাকে ভেঙে দিয়ে, প্রবল বয়ান ও ক্ষমতাকেন্দ্রকে প্রশ্ন করে।

দক্ষতা তৈরি করা বিদ্যালয়ের কাজ না, ওটার জন্য আছে নানা ইনস্টিটিউট ও কর্মক্ষেত্র। শিক্ষায়তনে ‘শিক্ষা’ ছাড়া আর যেন সবই হয় আমাদের দেশে। এমকি শিক্ষাসফরগুলোও আনন্দভ্রমণ ছাড়া আর কিছু হয় না। কিছু বিষয় আছে যেগুলো জীবনের প্রয়োজনে মানুষ এমনিতেই শিখে নেয়, কিছু বিষয় আছে যেগুলোর প্রতি মানুষের আগ্রহ সহজাত। তবে বিদ্যায়তনের প্রধান কাজ কঠিনের সাধনা, অনাগ্রহের জায়গাগুলোতেও আগ্রহ সৃষ্টি, শ্রমের ভেতরেও যে আনন্দের আবাহন আছে সেই উপলব্ধি তৈরি করা। যাকে বলে Domain of the non-utilitarianএ আগ্রহ ও মত্ততা ছাড়া একাডেমি প্রাণহীন। আহা, যদি এমন হতো—

আমার প্রতিটি ক্লাস হবে এক একটি সেমিনার লেকচার। ক্লাস রুম হবে ছোট গবেষণাগার। স্টুডেন্টরা হবে হাইলি আপডেটেড, যাদের কাছে থেকে আমরাও শিখব, তাদের সান্নিধ্যে আমরাও থাকব জানাশুনার দিক দিয়ে সাম্প্রতিক ও চিরতরুণ। একটা লেখাকে নানা দিক থেকে নানা জন ব্যাখ্যা করছে, নানা আরটিকেল-বই সংগ্রহ করে বুঝতে চেষ্টা করছে সবাই। তর্ক-কথা হচ্ছে নানা আইডিয়া নিয়ে। শিক্ষার্থীরা পেপার তৈরি করছে, শিক্ষকেরা সেমিনার দিচ্ছেন। সারাদেশ থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা এসে বক্তৃতা করছেন। জার্নাল বের হচ্ছে। একাডেমিতে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে কমিউনিটির বরেণ্য ব্যক্তিকে। রাজনীতিবিদ তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন, বড় ব্যবসায়ী তার সৃজনশীল তৎপড়তা নিয়ে আলাপ করছেন শিক্ষার্থীদের সাথে, সাহিত্যিক-সাংবাদিকরা তাদের নিজ নিজ অভিজ্ঞতাজাত জ্ঞান ভাগাভাগি করছেন একাডেমি কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে।

কোনো এক গবেষকের কথা শোনার জন্য অধীর-উন্মুখ হয়ে বসে আছে শ্রোতারূপী শীক্ষার্থীরা। ছাত্র হয়ে যাচ্ছে শিক্ষক, শিক্ষক হয়ে যাচ্ছে ছাত্র। সমাজও এক জীবন্ত টেক্সট। সমাজের একজন হিশেবে শিক্ষার্থী, একাডেমিসিয়ান, গবেষক, শিক্ষক এগিয়ে আসবেন সম্মিলিত ভাবে সমাজের সংকটে, সোসাল ডিনামিক্স বুঝতে, কালো হরফের জগত ও অভিজ্ঞতার জমিনকে একসাথে বাধতে, নিজেকে ও অপরকে বুঝে নিতে, ‘নিজ’ এর সীমানা বাড়াতে... একাডেমির কাজ বহু, দায় অগণিত। আহা! আমার সাধের বিদ্যায়তন! স্বপ্নের শিক্ষালয়। আহা, আমার মাতৃভূমি!