একজন মিতুর নামও করোনাকালের ইতিহাসে যোগ হবে না
লতিফ জোয়ার্দারপ্রকাশিত : মে ১৪, ২০২০
এপ্রিল মাসের সতেরো তারিখ। মধ্যদুপুর বেলায় খবর এলো, মিতু না বাঁচা। করোনা মনে করে অফিসের কেউ তার কাছে ভিড়ছে না। অথচ রাতের বেলায়ও মিতুর শরীরে কোনো অসুখের কোনো উপসর্গ ছিল না। অথচ হঠাৎ করে এমন কী হলো! মাঝে মধ্যে ঠাণ্ডাজনিত কিছু সমস্যা ছিল মিতুর। তবে আজ কিছুদিন হলো সে সমস্যাও নেই। হঠাৎ আমার মাথার মধ্যে চরকির মতো ঘুরতে থাকলো। সংবাদপত্র অফিসে চাকরি তার। বাসা থেকে মিতুর অফিস ছয় কিলো মতো দূরে।
আমার হাতে পোশাক চেঞ্জ করার সময়ও হাতে ছিল না। যে অবস্থায় ছিলাম কাউকে কিছু না বলেই সে অবস্থায় রওনা দিলাম। রাস্তায় এসে একটিও রিকশাও চোখে পড়লো না। দুই একটি সেনাবাহিনী ও পুলিশের গাড়ি দেখলাম ছুটোছুটি করছে। কোনো উপায় না দেখে হাঁটতে শুরু করেছি ততক্ষণে। অথচ বাসার অন্য সবাই বিষয়টার কিছুই জানে না। আর এ সময় কাউকে টেনশন দেবার কোনো ইচ্ছেও ছিল না আমার। আমাদের দুই সন্তান। দুজনই বেশ ছোট। একজনের বয়স পাঁচ আর একজনের সাত বছর মাত্র । আর আমাদের সাথে থাকে আমার বৃদ্ধ মা। আমার চাকরি চলে যাওয়ার পর থেকে আমিই ওদের দেখাশোনা করি। মা অবশ্য মাঝে মধ্যে বলে, পুরুষ মানুষের এভাবে সারাদিন বাসায় থাকতে নেই। লকডাউন চলছে তো কি হয়েছে! বাসার নিচে গিয়েও কিছু সময় কাটিয়ে আসতে পারিস?
কিন্তু আমার ওসব হয় না। আমার ওসব ভালো লাগে না। কখন কী হয়ে যায়! তাই একটু নিয়ম মেনেই চলার চেষ্টা করি আমি। তবে মিতুর কারণে কখনো কখনো সব নিয়ম মানতে পারি না। কারণ মিতুকে বাইরে যেতেই হয়। ইদানীং আমার চাকরি নেই। ও চাকরি না করলে থাকবো কোথায়! খাব কি? হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুটা পথ চলে এসেছি আমি। মনে হচ্ছে কত দীর্ঘ সময় অথচ আমি সামন্য একটু পথও এগুতে পারিনি। সব স্মৃতির জঞ্জাল এসে আমার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। সব দোষ তো আমারই! আমার নিজের একটা চাকরি থাকলে আর কী মিতুকে ঘর থেকে বেরুতে দেই আমি।
মরলে আমি মরি তবুও মিতু বেঁচে থাক। এখন এ সময় খুব দ্রুত পা চালানোর চেষ্টা করছি আমি। আল্লাহপাকই জানেন মিতু এখন কী অবস্থায় আছে। সামনে গলির মোড়ে বৃক্ষের ছায়ায় তিনজন রিকশাঅলাকে দেখা গেল। রিকশার উপর বসে বসে ঘুমোচ্ছে। তাদের নিকটবর্তী হতে একজনকে জেগে উঠতে দেখলাম। অতঃপর মনে হলো পকেটে হাত দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট বের করছে সে। আরো নিকটবর্তী হতে বারুদের গন্ধ নাকে এলো। তখন আমার মনে হলো, এই মহানগরীতে একজন মাত্র রিকশাঅলাকে আমি চিনি। যখন আমার চাকরি ছিল। তখন মাঝে মধ্যে দেখা হতো তার সাথে। আমাদের বাসার গলির মোড়ে কত কতবার বসে থাকতে দেখেছি তাকে।
মানুষটা বড় ভালো। কোনোদিন চেয়ে ভাড়া নেয়নি। নাম নজরুল। দীর্ঘদেহী মানুষটার পিট একটু একটু করে বেঁকে যাচ্ছে। তিন তিনটি ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করে বলে, নিজের চিকিৎসাটাও সময় মতো করাতে পারছে না নজরুল। আমি অবশ্য তাকে কতদিন বলেছি, নজরুল মামা, চলো তোমাকে নিয়ে ডাক্তার দেখাই। খরচের চিন্তা তুমি করো না। আমার পরিচিত ডাক্তার আছে। কিন্তু কোনোদিনও মানুষটাকে রাজি করাতে পারিনি। যা ভেবেছি ঠিক তাই। নজরুলই বিড়ি ছেড়ে সিগারেট ধরেছে। আমাকে দেখা মাত্রই সিগারেট ফেলে দিলো। মামা, তুমি এই করোনা দুপুরে। আর তোমাকেই এমন দেখাচ্ছে কেন।
আর বলো না মামা, তোমার মামি অফিসে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তুমি যেতে পারবে?
কেন পারবো না মামা।
তবে তাড়াতাড়ি চলো।
ততক্ষণে মিতুদের সংবাদপত্র অফিসের সামনে মানব নামে জন্তুর ভিড়। বিষয়টা ছড়িয়ে পড়েছে অথচ দীর্ঘ সময় তার চিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সবার একই কথা যদি করোনা হয়! তারপরও কারো জন্য কারো মায়া হয়। কারো জন্য কারো ভালোবাসা থাকে। তেমনি দুই একজন হাসপাতালে সংবাদ দিয়েছে। কিন্তু কোনো হাসপাতালেই কেউ ফোন ধরছে না। তখন কী কী ডিসিশন নেবে, এমন সময় আমি রিকশা থেকে নামি। নজরুল মামা তুমি কিছু সময় অপেক্ষা করো, আমি আসছি দেখি কি অবস্থা ওদিকে।
লিফটের পাঁচ তলায় বসে মিতু। সেখানে গিয়ে দেখি কেউ নেই। পুরো অফিস ফাঁকা। আতঙ্কে কেউ কেউ অফিস থেকে কেঁটে পড়েছে মনে হয়। শুধু মাত্র দারোয়ানকে দেখলাম। সে আমাকে চেনে। আমাকে দেখা মাত্র আমার কাছে এগিয়ে এলো। জানেন ভাই, মিতু আপার করোনা টরোনা কিছু হয়নি। হয়তো অন্য কোনো রোগ হবে। এই মাত্র তাকে অফিসের গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে এলাম।
সাথে কে কে আছে?
আরিফ সাহেব, আফজাল সাহেব আর রীতা ম্যাডাম।
আমি আবার নিচে নেমে এলাম। আফজাল সাহেবের ফোন নম্বর আমার কাছে ছিল। ফোন বের করে দেখি আফজাল সাহেবই নয়বার ফোন দিয়েছে। আমি ফোন ব্যাক করতেই সে বললো, আপনি কোথায়? আমি আমার অবস্থান জানাতেই সে বললো, আমরা আপনার সামনের গাড়িতে। এই যে এদিকে তাকান।
তখনো মিতু কথা বলছে। বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। সে ইশারায় আমাকে তার দু`হাত ধরে থাকতে বললো। অথচ যন্ত্রণায় ছটফট করছে মিতু। মনে হলো তার ব্যথা বুকে। চোখ দুটো কেমন যেমন মলিন বিবর্ণ মনে হলো। তখনো মিতুর শরীরে করোনার কোনো লক্ষণ দেখতে পেলাম না আমি। মিতুকে অভয় দিলাম। মিতু তোমার তেমন কিছু হয়নি। একটু ধৈর্য ধারণ করো। সামান্য চিকিৎসায় আবার তুমি সুস্থ হয়ে যাবে। কিন্তু মনে হয় মিতু আমার কোনো কথায় শুনতে পেল না। তখন জগৎ সংসার আমার কাছে তুচ্ছ মনে হলো।
অতঃপর এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে দৌড়াচ্ছি আমরা। কোথাও মিতুর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সম্ভব হলো না। কেউ বলে ডাক্তার নেই। কেউ বলে চিকিৎসা নেই। আবার কেউ বলে করোনা টেস্ট ছাড়া আমরা ভর্তি নিতে পারবো না।
এই যখন অবস্থা তখন ভাবছি ফিরে চলে যাই। মরলেও বাসায় গিয়ে মরুক মিতু। এমন সময় আফজাল সাহেব কাকে যেন ফোন করলো। কি কথা হলো তার কিছুই জানি না। ড্রাইভারকে গাড়ি উল্টো দিকে ঘুরাতে দেখলাম। কিছু সময়ের মধ্যে আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপালাতে পৌঁছে গেলাম। কিন্তু হাসপাতালে যাওয়ার ভাগ্য হলো না মিতুর। আমি তখন একটা নিথর দেহের হাত ধরে আছি। মিতুর প্রাণপাখি কখন যে পালিয়েছে। একটুও টের পায়নি আমি!