এই দেবশিশুরা দানবীয়!
রিফাত বিন সালামপ্রকাশিত : আগস্ট ০২, ২০১৮
দুনিয়ার ইতিহাসে আর কোনো দেশে স্কুলের শিক্ষার্থীরা এভাবে রাস্তায় নেমেছে কীনা, জানি না। টানা দু’দিন তারা রাজধানী ঢাকাসহ এর আশপাশের প্রায় সকল অঞ্চলের রাস্তাঘাট নিজেদের দখলে রেখেছে। শুধু দখলে রেখেছে বললে ভুল হবে, বরং বলতে হবে, ‘নিরাপদ রেখেছে’।
দেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা আর আছে কী নাই, এ মুহূর্তে সে তথ্য খোঁজার সময়ও নাই হাতে। আন্দোলনের দিকেই আমাদের আগ্রহ বেশি। কী ঘটতে যাচ্ছে, এই দেবশিশুরা কী ঘটাতে যাচ্ছে, ওরা এত সাহস পেল কোথায়, কীভাবে একত্র হলো— সেসব আমাদের কল্পনার বাইরে। তাই শুধু দেখছি আর শিখছি। সাথে এ নিয়ে নানা ভাবনাও জারি আছে।
আগামীকাল দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। কাল কী হবে, সেটাও একটা রোমাঞ্চকর বিষয়। অনেকেই এই আন্দোলনকে এরই মধ্যে ‘কিশোর বিদ্রোহ’ নামে ডাকা শুরু করেছে। আসলেই কিশোর বিদ্রোহ বটে! কিন্তু একটা প্রশ্ন আমাদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কীভাবে হুট করেই লাখ লাখ শিশু রাস্তায় নামলো? কোথায় পেল এত সাহস?
যারা আজ রাস্তায় তারা তো মাত্র ১৪ থেকে ২০ এর ঘরে। অনেকের বয়স তো ১২ কিংবা ১৩। এই শিশু-কিশোরেরা তো ঢাকার বিল্ডিংয়ের ভেতরে বন্দি থাকে সারা বছর। তারা মাঠ বা পুকুরঘাট চেনে না। তারা গাছে উঠতে পারে না। তারা সারাদিন ভিডিও গেমস, ইউটিউব আর রেস্টুরেন্টে সময় কাটায়। ওদের ফেসবুক ওয়ালে তো শুধু সেলফি আর বিশ্বকাপের উন্মাদনা ছাড়া কিছু দেখাও যায় না। আবার ইয়াবার মতো ড্রাগও এই পুরো প্রজন্মটাকে ঘিরে আছে চারপাশ থেকে। দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ে এদের তেমন জ্ঞানও নাই। এরা গা বাঁচানো প্রজন্ম। এসব তো আমাদের বড়দের কথা, আমরা যারা অন্যায় দেখে চুপ করে বসে থাকি।
কিন্তু উপরের এসব সমীকরণ উল্টে দিয়ে ওই শিশুরা, যাদের ফার্মের মুরগি বলা হতো, তারা এখণ রাস্তায়। ওরা রাস্তায় কোনো সাধারণ মানুষের যানবাহনে আগুন দেয় নাই। বরং ওরা এক ছাত্রলীগ কর্মীকে আটক করেছে বাসে আগুন দেয়ার দায়ে। ওরা পুলিশের ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক করছে রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে। এমনকি রাস্তায় উল্টো পথে গাড়ি চালানো মন্ত্রীর গাড়ি আটকে দিয়েছে। আবার অসুস্থ, বৃদ্ধ, নারী কিংবা অন্য শিশুদের জন্য রাস্তাকে নিরাপদ করেছে। ধানমন্ডি এলাকায় তো ওরে ঝাড়ু নিয়ে রাস্তাও পরিষ্কার করেছে আজ, যাতে বাসের ভাঙা কাঁচে কেউ যেন আহত না হয়। নিরাপদ সড়কের জন্য ওরা আজ সকালেও ট্রাকের নিচে রক্ত দিয়েছে।
কীভাবে এসব হচ্ছে, সত্যি সেটা কল্পনায় আসছে না। কীভাবে সম্ভব! এদেশে ট্রাফিক আইন না মেনে চলাটায় আইন। সেই দেশেই ভেতরে ভতরে এমন একটা প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে, যারা এতটাই বেঅইনি যে, ওরা বড়দের গড়ে তোলা এই ‘বেআইনি’ সমাজকেও আর মানছে না। ‘পুলিশের ড্রাইভিং লাইসেন্স কেন থাকবে না?’ এই প্রশ্ন কি আগে কেউ তুলেছে? একমাত্র এরাই সে সাহস দেখিয়েছে। শুধু দেখানো না, এরা পুলিশকেও ছাড় দেয়নি। লাইসেন্স ছাড়া গাড়ির গায়ে বড় করে লিখে দিয়েছে, লাইসেন্স নাই।
ওরা আসলে বারুদের স্তূপের মতো। এই অবান্তর আর অনিয়মে ভরা রাষ্ট্রই ওদের জন্ম দিয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা থেকে সামাজিক আইনের জাঁতাকলে ওদের নৈতিকতা এমনভাবে ভেঙেছে যে, ওরা ‘অনৈতিক’ সিস্টেমে ক্লান্ত, ওদের কাছে এই সমাজ, শিক্ষা, আইন, রাষ্ট্র সবই এখন অরুচিকর। তাই আজ এক সাংবাদিকে জানিয়েছে, ওরা কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ওরা নতুন রাষ্ট্রের দাবি তুলেছে। এটাকে আমরা তারই একটা আগাম পদক্ষেপ বলতে পারি।
লেখাটা অন্যরকম হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আপাতত ওদের গান গাওয়া ছাড়া আর কিছুই মাথায় আসছে না। পরে হয়তো এই আন্দোলনের কারণ এবং বেড়ে ওঠার পদ্ধতি নিয়ে অনেক জটিল মনস্তাত্ত্বিক আলাপ করা যাবে। অনেকে এখনই সেটা শুরু করে দিয়েছে। তবে শেষ কথা এটাই, ওরা কিভাবে এলো? এই প্রশ্নের চেয়েও বড় কথা, ওরা এসেছে। ওরা বারুদের মতো বিস্ফোরক ক্ষমতা নিয়ে এসেছে। এই প্রজন্ম শুধু ফ্যাসিবাদী সিস্টেম বা নাগরিক অনিয়মকেই নয়, বরং আস্ত একটা রাষ্ট্রকে জ্বালিয়ে দিতে পারে। আমাদের বড়দের উচিত, ওদের এই মহান নৈতিক অবস্থানের পক্ষে দাঁড়ানো। ওদের পিছে পিছে রাস্তায় নামা। ওদের জন্য একটা দুর্নীতি ও মাদকমুক্ত স্বাধীন সমাজের আন্দোলন করা। এভাবেই একটা জাতি ও সমাজ অগ্রসর হয়, অথবা ডুবে যায়।
এই দেবশিশুদের জন্য শুধুই ভালোবাসা।
লেখক: কবি, কলামিস্ট, কার্টুনিস্ট ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী