উৎসব ও ইসলাম অথবা জাগতিক ও পরমার্থিক

জগলুল আসাদ

প্রকাশিত : আগস্ট ০৭, ২০১৯

ধর্ম জাগতিকভাবে চর্চিত হলেও তার মূলশাঁস আধ্যাত্মিক। ধর্ম ছাড়া কোনো মতবাদই পরলোকের কথা বলে না। এমন কি মৃত্যু নিয়ে ভাবনাও চলে ধর্মীয় পরিসরেই। জগৎ শুধু দ্যাখে কর্ম ও কর্মের ফলটুকু, ধর্মের নজর কর্মের উদ্দেশ্যর দিকে, যা হৃদয়ের পরিমণ্ডল। ‘নিয়ত’ জানা জগতের অসাধ্য, বেশিরভাগ সময় অপ্রয়োজনীয়ও বটে। কিন্তু আল্লাহ দেখেন অন্তর ও কর্মের লক্ষ্য। নিয়ত গুণেই কর্মের বিচার (ইন্না মা’আল আমালুবিন্নিয়াত)। ‘খবরে ওয়াহিদ’ পর্যায়ের এ হাদিস ইসলামের মর্মভাবের অতুলনীয় প্রকাশক। কর্মের ফল দেখবে, বিচার করবে জগৎ; আর কর্মের উদ্দ্যশ্য দেখবেন আল্লাহতা’য়ালা।

কোরবানির পশুর রক্ত-মাংস-চামড়া কিছুই পৌঁছুবে না আল্লাহর কাছে, তা পৌঁছুতে হবে মানুষের কাছে। আল্লাহ’র কাছে পৌঁছুবে শুধু ব্যক্তির খোদাভক্তি, খোদাভীতি ও ভালোবাসার বিশুদ্ধ নির্যাসটুকু, যার নাম তাকওয়া। (দেখুন, সুরা হজ্জ,আয়াত ৩৭)। এভাবে জগতের ভেতরে থেকেও মুমিনের হৃদয় হয়ে ওঠে জগৎঊর্ধ্ব। আনন্দ-উৎসবের ভেতরেও মুমিনের হৃদয় অশ্রুসিক্ত থাকে কবুলিয়াতের অনিশ্চয়তায় আর আশংকায়। বিজয়ের উজ্জ্বল মুহূর্তেও সে বড়ত্ব ঘোষণা করে খোদার, এবং অজানিতে ঘটে যাওয়া কোনো ভুল বা পাপের জন্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করে সে স্রষ্টার (দেখুন, সুরা নসর)। চারদিকের ক্রন্দনের ভেতরেও সে অসাধ্যসাধনকারী যে পরওয়ারদিগার, তার উপর ভরসা ও তাওয়াক্কুল করে থাকে। সে জানে, প্রেমময় সে অমোঘ নির্দেশ, লা তাহজান ইন্নাল্লাহা মাআ’না। মানে, হতাশ হইও না, আল্লাহ তোমাদের সাথে আছেন। (সুরা তাওবা ৩০)।

সমাজসংস্থানে ও বিশ্বব্যবস্থায় মোমিনের দায়িত্ব অনেক। জালেম অধ্যুষিত অঞ্চলের অসহায় নারী-পুরুষ ও শিশুদের রক্ষার জন্য লড়াই ও সাহায্যের হাত বাড়ানোর দায়িত্বও আছে তার। সূরা নিসার ৭৫ নম্বর আয়াতে খোদা প্রশ্ন করছেন যে, ‘তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা অসহায় নারী-পুরুষদের রক্ষার জন্য লড়াই করছো না? অথচ তারা সাহায্যপ্রার্থী ও অভিভাবক অন্বেষী।’ জুলুমের শিকার রোহিঙ্গাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া, তাদের শরণ দেয়া ধর্মের জায়গা থেকেও অনস্বীকার্য দায়িত্ব। মোমিনের কাছে ধর্ম ও মানবিকতা অভিন্ন।

মানুষ বিভিন্ন জাতি-বর্ণ, লিঙ্গ ও ধর্মে বিভক্ত। সূরা হুজুরাতের ১৩ নম্বর ভার্সে বলা হচ্ছে, ‘হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে। পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো।’ দুনিয়ায় জাতি-গোত্র-লিঙ্গ–ধর্মে বিভক্ত এই মানবপ্রজাতি সৃজনের উদ্দেশ্য, যাকে বলে knowledge of the other. বৈচিত্র্যপূর্ণ মানবসমষ্টি একসাথে বসবাস করবে আধিপত্য ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, একে অপরকে জেনে স্রষ্টার উপলব্ধির জন্য। যাকে বলা হয়, তাআ’রুফ (Ta’aruf)। মক্কার সমরূপ সমাজ (Homogenous society) নয়, মদিনার বহুসাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল (Multi cultural society) এই আয়াতের আশু পরিপ্রেক্ষিত, যাকে বিস্তৃত করা হয় বৈশ্বিক পরিসরের সমস্ত জাতিগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও। ন্যায়ের পথে অপরকে সাহায্য-সহযোগিতা (তা’ঊন Ta’awun) করতে বলা হয়েছে মুসলিমদের, এখানে শর্ত আরোপ করা হয়নি জাতি-বর্ণ–গোত্রের বিবেচনাকে। দেখুন সূরা মায়িদার দ্বিতীয় আয়াত। তাছাড়া আল্লাহ এক জাতি বা জনগোষ্ঠী দিয়ে অন্য জাতিকে সাহায্য ও শায়েস্তা করেন যাতে সমাজে ও বিশ্বে মানবিকমর্যাদা ও ধর্ম সুরক্ষিত থাকে, রক্ষিত হয় শক্তির বাস্তব ভারসাম্য। ‘আল্লাহ যদি এক দলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন তবে বিধ্বস্ত হয়ে যেত খ্রিস্টানদের গীর্জা, ইহুদিদের উপাসনালয় ও মসজিদগুলো।’ (সূরা হজ্জ, আয়াত ৪০)

ধর্ম, বিশেষত ইসলাম, জীবনের কোনো প্রান্তকেই ছেড়ে দেয় না। বরং জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যু পার হয়ে অনন্ত-অসীম জগতের কথা বলে। মোমিন পৃথিবীতে তার অংশকে ভোলে না (সূরা আল কাসাস, আয়াত ৭৭); ইহজাগতিক অধিকার ও দায়িত্ব, এবং দুনিয়া আবাদের কর্তব্যও সে ছাড়ে না। মুমিন তো দুনিয়াকে শস্যক্ষেত্র-ভাবা-নিবিষ্ট আবাদি। সে সত্যিকার ফসল ঘরে তুলবে কিছুকাল পরই, জাগতিক সময় পেরিয়ে ওইতো আগামীতে। মোমিন হবে তাই সহিষ্ণু, কল্পনাপ্রবণ, সৃজনশীল প্রতিনিয়ত।

ক্ষুৎ-পিপাসাসহ দেহের কোনো প্রয়োজনই তার কাছে অস্বীকৃত নয়; আবার দেহাতীত বাসনা ও আকুলতাও তার আছে। তার পরম লক্ষ্য ‘অসীমের’ দিদার ও প্রাপ্তি। সসীমে তার যত কর্মমুখরতা, বাক বা নীরবতা— তা তো ওই আদি-অন্তহীনের সাথে মোলাকাতেরই প্রস্তুতি।

মোমিন মুসলমান হওয়া এক দীর্ঘ সাধনার পথ। এ পথে বিছানো আছে অজস্র কাঁটা— ধার্মিকতার অহংকার, আত্মপ্রচার, দেখানোপনা-প্রদর্শনবাদিতা, আলস্য, হতাশা, ঈর্ষা-বিদ্বেষ, পরচর্চা, ঘৃণা-বিদ্বেষ, সম্পদনিমগ্নতা, মৃত্যকে ভুলে থাকা, দায়িত্ব ও কর্তব্যকে অবহেলা ইত্যাদি। প্রতিটি ঈদে মোমিন হওয়ার শপথ থাকুক।

দুই.
কোরবানি ঈদের সাথে ত্যাগের সম্পর্ক নাই। বরং কর্মের মধ্য দিয়ে মহৎ এক ঐতিহাসিক স্মৃতির (ইব্রাহিমি সুন্নাত) উদযাপন ও তার সাথে একাত্মতার অনুভবের মধ্য দিয়ে খোদার সন্তুষ্টি অর্জনের সঙ্গে এর সম্পর্ক। কোরবানি ঈদ নিয়তেরও পরীক্ষা নেয়। কারণ পশুর রক্তমাংস পৌঁছুবে না খোদার কাছে, পৌঁছোবে শুধু নিয়তটুকু। পশু কোরবানি তাই বিশুদ্ধ নিয়তের পরীক্ষা মূলত। মোটাতাজা গরু কেনা, প্রদর্শনী আর বিপুল আর্থিক আয়োজনের সাথে কোরবানির আধ্যাত্মিকতার কোনোই সম্পর্ক নাই।

হজ্জের মৌসুমের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কোরবানির। হাজিদের সাথে সাথে বিশ্বের সম্পন্ন মুসলমানদেরকেও কোরবানি দিতে হয়, ও তিন দিন ফরজ নামাজের পর মুসুল্লিগণকে সমবেতভাবে পড়তে হয়, ‘আল্লহু আকবার... লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক...।’ এ ঈদ তাই উম্মাহ চেতনা জাগরণের দ্বীনি উদ্যোগও বটে।

সুতরাং কুরবানির মধ্য দিয়ে ইব্রাহিমি স্মৃতির ঐতিহাসিক গুরুত্বর ধারাবাহিকতা ও তার প্রয়োজনীয়তা উদযাপন করা হয়, নিয়তের বিশুদ্ধতা পরীক্ষা হয় ও উম্মাহ বোধের জাগরণ ঘটে। এই তিনটিই প্রধানত কোরবানির তাৎপর্য। আর কোরবানির সামাজিকতার প্রসঙ্গ তো না বললেও চলে। কোনো ইবাদতই জাগতিক লাভ ও কল্যাণমুক্ত নয়।

তিন.
আপনি দেখবেন, ঈদ আসলেই বা ধর্মীয়ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ কোনো দিন আসলেই ‘অতিপ্রগতিপন্থি’ বন্ধুরা আপনেরে ‘সঠিক’ পথে নেয়ার একটা দায় বোধ করবে। যেমন ঈদ আসলে বলবে, বনের পশুর চেয়ে মনের পশুরে কোরবানি দ্যান। পশু কোরবানিতে তারা দেখতে পাবেন রক্তারক্তি ও আদিম অসভ্যতা। গাভী কোরবানিতে দেশের প্রাণিজ সম্পদ নষ্ট হওয়ার আশংকাও তারা করবেন। রমজান এলে ইফতারে বা সেহেরিতে তারা দেখবেন ভোগবাদিতা। পত্রিকায় তারা রিপোর্ট করবেন, ‘ফাস্টিং না ফিস্টিং!’ মনে রাখবেন, আপনি আপনার ধর্মীয় অবস্থান থেকেও ‘তাযকিয়ায়ে নাফস’ (মনের পশুরে কুরবানি!), কানায়াত (অল্পে তুষ্টি), মুহাব্বাতে খালক (সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা) এবং হক্কুল ইবাদের (জীবের/প্রাণের প্রতি দায়িত্ব) সিফত (গুণাবলি) অর্জন করতে পারবেন। তারপরও আপনেরে কিন্তু শুনতে হইব, আপনিও লোভি, পরকালে হুর আর শুরা পাওয়ার লোভে ধর্মকর্ম করেন।

সো, আপনি আপনার ধর্মকর্ম নিয়া শরমিন্দা থাইকেন না। বলুন, ধার্মিক বলিয়া লজ্জা নাই। তবে সবচেয়ে উত্তম হইলো, অন্যের সমালোচনাকে নিজের আত্মশুদ্ধির উসিলা হিশেবে গ্রহণ করা। কারণ এক হাদিসে আছে, জ্ঞান মোমিনের হারানো সম্পদ। ধার্মিক–অধার্মিক সকলের মধ্যেই নবি মহাম্মদের (সা.) সিফতগুলা (virtues) ছড়িয়ে আছে। সেগুলো জোড়া লাগানোতেই ব্যক্তির কামালিয়াত (perfection)।

আরেকটা কথা, ধর্মের পরমার্থিকতাকে নষ্ট কইরেন না। খালি চোখে সব কিছুর সামাজিক তাৎপর্য খোঁজায় সংকট আছে। নিজের হৃদয়ের দিকেও যেন আমরা নজর দিই। ‘রিচুয়াল’ বা আচারকে তুচ্ছ মনে করবেন না, রিচুয়ালের শক্তি আছে। দিল দিয়ে রিচুয়ালগুলো পালন করি যেন। তাছাড়া এমনিতেই প্রতিটি ইবাদতের সামাজিক বাই-প্রোডাক্ট আছে। আলাদা করে অলয়েস এটা নিয়ে না ভাবলেও চলবে, যদিও ভালো বামপন্থী বা গুড সেকুলাররা আপনেরে সমাজ দেখাইবো শুধু। বাট, খুব গুরুত্বপুর্ণ হচ্ছে এই বোধ যে, আপনার সামাজিকতা আপনার আধ্যাত্মিকতারই অংশ। প্রাণ, প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি আপনার দায়িত্ব আপনার স্পিরিচুয়ালিটির পার্ট।

কোরবানির ঈদের একটা তাৎপর্য  হচ্ছে, সৎকর্মকে শুধু স্মৃতি করে না রেখে কর্মের ধারাবাহিকতায় সেটাকে উৎযাপন। ঈব্রাহিমের (আ.) ত্যাগের স্মৃতিকে সকলে মিলে পশু কোরবানির মাধ্যমে উদযাপন করা হয়। ইব্রাহিম (আ.) নিজের প্রিয় জিনিস অর্থাৎ তার সন্তানকে কোরবানি দিতে গিয়েছিলেন। পরে সেটা পশু কোরবানি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। এটার প্রতীকী মানে আছে বটে। কতটা ‘প্রিয়’কে আমরা ত্যাগ করতে পারলাম, কতটা ত্যাগ হলে আপনার আমার কিছুটা ত্যাগ হয়, এ সবই দ্বীনেরই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। আর সূরা হজ্জে তো বলাই হয়েছে, কোরবানির রক্ত মাংস খোদার কাছে পৌছায় না, পৌঁছোয় শুধু ‘তাকওয়া’ (খোদার সন্তুষ্টি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বা খোদাভীতি)। তার মানে, এ জগৎ শুধু কাজটাই দেখে, দৃশ্যমান ফলাফলটাকেই বিবেচনা করে। দুনিয়া আপনার মোটাতাজা গরুটাকে দেখে, কিন্তু খোদাই শুধু দেখেন আপনার আমার হৃদয়ের অবস্থাটুকু, ক্কল্বের জিকির। দুনিয়া দেখে ‘জাহির’কে, আর খোদা দেখেন তা-ই যা অগোচরে থাকে সকলের— পুলিশের, সমাজের, রাষ্ট্রের।

‘আল্লাহ দেখেন ত্যাগের অনুভূতি, তাকওয়া’ এই বোধ তৈরি করে নতুন মানুষ, জাদিদ। এই জাদিদ, এই নতুন মানুষই তৈরি করবে নতুন সমাজ, মানবিক ও ইনসাফপূর্ণ। ইসলামের জাগতিক প্রত্যাশাও এই।

 

লেখক: প্রাবন্ধিক ও চিন্তক