রবিনসন ক্রুসো

রবিনসন ক্রুসো

উপন্যাসের জন্ম ও শৈশব

শেষ পর্ব

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৩, ২০২০

পরবর্তীকালের উপন্যাস সম্পর্কে বলার আগে ইউরোপের রেনেসাঁ সম্পর্কে তোমাকে সম্যক অবহিত করার প্রয়োজন বোধ করছি। কারণ রেনেসাঁর সঙ্গে আধুনিক উপন্যাসের একটা যোগ আছে। কিন্তু হাতে সময় নেই। এ বিষয়ে বিস্তর বই পুস্তক আছে, তুমি পড়ে নিও। শুধু সংক্ষেপে বলি, রেনেসাঁর মধ্য দিয়ে মধ্যযুগের অবসান ঘটে শিল্প, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি এক নবজন্ম লাভ করে। এ সময়ই সৃষ্টি হয় অসংখ্য ধ্রুপদী দর্শন, সাহিত্য ও শিল্পের, যার মাধ্যমে মানবসভ্যতা এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে যায়। রেনেসাঁর মূল কথা হলো মানবতাবাদ। পূর্বের অন্ধকার সময়কে পার করে এ যুগে মানুষ মানবতাবাদে দীক্ষিত হয়। রেনেসাঁ যেকোনো বিষয় নিয়ে মানুষের চিন্তাধারাকে বদলে দিয়েছিল। মধ্যযুগে মানুষ মনে করত জীবন হবে কঠোর ও কঠিন। এই পুরোটা সময় তারা ভেবে এসেছিল জীবন মানেই হলো কঠোর পরিশ্রম, আর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে নিজেদের বিশ্বাস ও আদর্শের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা। এই রেনেসাঁ থেকেই মানবতাবাদের উদ্ভব ঘটে।

রেঁনেসা পরবর্তীকালে রচিত হয় ‘দন কিহোতে।’ এটিকেই বিশ্বের প্রথম পূর্ণাঙ্গ আধুনিক উপন্যাস বলতে পারো। ইংরেজি ভাষায় এটি ‘ডন কুইক্সোট’ এবং স্প্যানিশ ভাষায় ‘দন কিহোতে’। উপন্যাসের শিরোনাম ‘লা মাঞ্চার উদ্ভাবক অভিজাত দন কিহোতে’। লেখকের নাম মিগেল দে সেরভান্তেস সাভেদ্রা (১৫৪৭-১৬১৬)। স্পেনীয় সাহিত্যের পালে নবযুগের হাওয়া প্রবাহিত করেছিলেন তিনি। তাঁর জীবন বিস্ময়কর উত্থান-পতন ও বিপর্যয়ের ইতিহাস। শাস্ত্র অধ্যয়ন, যুদ্ধে যোগদান, বন্দিদশা, পলায়ন যেমন ঘটেছে তাঁর জীবনে, তেমনি দারিদ্র্য, ক্রীতদাসত্বও ভোগ করতে হয়েছে তাঁকে। ষোড়শ শতকের স্পেনের পটভূমিতে রচিত ‘দন কিহোতে’র প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৬০৫ সালে এবং দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৬১৫ সালে। প্রথম আধুনিক উপন্যাস এবং সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাসরূপে আজও ‘দন কিহোতে’ অম্লান। নোবেলজয়ী পেরুর লেখক মারিও ভার্গাস ইয়োসার মতে এটি একবিংশ শতাব্দীর উপন্যাস।

তুমি তো উপন্যাসটি অবশ্যই পড়বে। তবু এখানে তোমাকে কাহিনি সংক্ষেপ বলছি, শোনো। স্পেনের লা মাঞ্চা গ্রামে এক অলস জমিদার বাস করতেন। সারা বছর তার কোনো কাজ থাকত না বলে তিনি সিভালরি গ্রন্থ পড়ে সময় কাটাতেন। এ বইগুলিতে নাইটদের বীরত্বের আজগুবি কাহিনি পড়তে পড়তে তার এমন নেশা হয়ে গেল যে, জমিজমা বন্ধক রেখে ও বিক্রি করে তিনি সিভালরি গ্রন্থ কিনতে লাগলেন। বই পড়তে পড়তে নাওয়া-খাওয়া-ঘুমের কথা ভুলে যেতেন। একটা সময় সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি হবেন ভ্রাম্যমান নাইট। কারণ দেশের দুষ্ট দমন ও শিষ্টের পালন করতে হলে এছাড়া পথ নেই। তিনি বাড়ির পুরনো অস্ত্রাদি ঘষেমেজে একটি হাড়জিরজিরে ঘোড়ার পিঠে চেপে বেরিয়ে পড়লেন দেশোদ্ধারে। নিজের নাম গ্রহণ করলেন ‘দন কিহোতে দে লা মাঞ্চা’ অর্থাৎ লা মাঞ্চা গ্রামের দন কিহোতে। সাঞ্চো পানসা নামে এক দরিদ্র খেতমজুর লোভে পড়ে একটি গাধার পিঠে চড়ে তার সঙ্গী হলো।

অভিযানে বেরিয়ে দন কিহোতে দেখলেন যে অনেক কিছুই বইয়ে পড়া জ্ঞানের সঙ্গে মিলছে না। বাস্তব বদলে যাচ্ছে। যাকে শত্রু ভাবছেন তা ঠিক নয়। হাওয়াকল তার চোখে দৈত্য, একদল ব্যবসায়ী তার প্রেমিকাকে সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরী স্বীকার করতে চায় না, তাদের তিনি জোর করে মানাবেন, ওরা মানল না বলে বেধড়ক পেটালেন, ভেড়ার পালকে শত্রুসৈন্য ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, রাতে শোক মিছিলকে ভূতের দল ভেবে আক্রমণ করলেন, বস্ত্রকলের হাতুড়ি পেটার শব্দ শুনে ভাবলেন শত্রু, হাতকড়া বাঁধা অপরাধীদের ছিনিয়ে নিয়ে তাদের হাতে মার খেলেন, গাধাপালকদের মারতে গিয়ে নিজেরাই মার খেলেন, নদীতে নৌকা নিয়ে ময়দার কলের যন্ত্রকে তার অপরাধী মনে হয়, তাদের সঙ্গে লড়তে গিয়ে পর্যুদস্ত হলেন। তারপর এক ডাচেস ও ডিউকের বিনোদন প্রাসাদে মাননীয় অতিথির সেবা এবং আদরে কয়েক দিন কাটিয়ে বাইরে বেরোলেন, কিন্তু ওদের একটা প্রহসনের পরিকল্পনার শিকার হলেন তারা। সেই ফাঁদ না বুঝে সাঞ্চো পানসা কয়েক দিনের জন্যে একটা দ্বীপের গভর্নর পর্যন্ত হলো, কিন্তু তাকে ফিরে আসতে হলো চোখের জলে। শেষ পর্যন্ত এক ছদ্মবেশী বন্ধুর কাছে পরাস্ত হয়ে দন কিহোতে বাড়ি ফিরে আসতে বাধ্য হন। মাত্র কয়েক দিন জ্বরে ভুগে তিনি মারা যান।

‘দন কিহোতে’ উপন্যাসে জীবনের প্রায় সবকিছু নিয়ে বিবিধ গল্প শুনিয়েছেন লেখক। ভাষা, সাহিত্য, প্রেম, জীবনযুদ্ধ, লোভলালসা, পাপপুণ্য, অপরাধজগৎ, যুদ্ধ, স্বপ্ন সবই আছে এ উপন্যাসে।

১৭১৯ সালে প্রকাশিত হয় ড্যানিয়েল ডিপোর (১৬৬০-১৭৩১) উপন্যাস ‘রবিনসন ক্রুসো’। ড্যানিয়েল ডিফো ছিলেন একজন ইংরেজ ব্যবসায়ী, লেখক, সাংবাদিক, প্যাম্ফলেট রচয়তিা ও গোয়েন্দা। ‘রবিনসন ক্রুসো’ উপন্যাসটির জন্য সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। ইংরেজি উপন্যাসের প্রবক্তাদের মধ্যে একজন হয়ে তিনি উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। ‘রবিনসন ক্রুসো’র কাহিনি সংক্ষেপ তোমাকে বলি, শোনো। বিস্তারিত জানতে তুমি অবশ্যই পড়ে নেবে উপন্যাসটি। এটির বাংলা অনুবাদ রয়েছে।

ক্রুসো ১৬৫১ সালের আগস্ট মাসে হালের কুইন্স ডক থেকে সমুদ্র যাত্রা শুরু করে। এই যাত্রা তার বাবা-মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। তাদের ইচ্ছে ছিল সে কোনো পেশায় নিযুক্ত হোক। প্রথম যাত্রায় ঝড়ের কবলে পড়ে ক্রুসোর জাহাজটি ধ্বংস হয়ে যায়। তবু তার সমুদ্র যাত্রার আকাঙ্ক্ষা আগের মতোই অটুট। আবারও সে সমুদ্র যাত্রা করে। এই যাত্রাও দুর্যোগের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। তার জাহাজটি স্যালি জলদস্যুরা ছিনিয়ে নেয় এবং ক্রুসোকে করা হয় একজন মুরের দাস। দু-বছর পরে ক্রুসো একটি নৌকা ও জুরি নামের এক বালককে নিয়ে সেখান থেকে পালায়। পর্তুগীজ জাহাজের একজন ক্যাপ্টেন ক্রুসো ও জুরিকে উদ্ধার করে। জাহাজটি ব্রাজিল যাচ্ছিল। ক্যাপ্টেনের সাহায্যে ক্রুসো ওজুরি সেখানে গিয়ে আবাদ করার সুযোগ পায়।

কয়েক বছর পরে ক্রুসো আফ্রিকা থেকে দাস আনার জন্য একটি অভিযানে বের হলো। পথিমধ্যে ঝড়ের কবলে পড়ে তার জাহাজ বিধ্বস্ত হয় এবং সে সমুদ্র থেকে চল্লিশ মাইল দূরে একটি দ্বীপে আশ্রয় নেয়। দ্বীপটি অরিনোকো নদীর মুখের কাছে অবস্থিত। ক্রুসো দ্বীপটিকে ‘আইল্যান্ড অফ ডেসপেয়ার’ নামে ডাকে। ওই দ্বীপে পেঙ্গুইন ও সীল দেখতে পায়। ক্রুসো ছাড়া আরো তিনটি প্রাণী ওই দ্বীপে আছে: ক্যাপ্টেনের কুকুর ও দুটি বিড়াল। ক্রুসো তার হতাশাকে জয় করে ভাঙা জাহাজ থেকে অস্ত্র, যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য দরকারি জিনিস নিয়ে আসে। একটি গুহার কাছে বেড়া দিয়ে বাসস্থান তৈরি করে। কাঠের ক্রসের উপর চিহ্ন দিয়ে ক্যালেন্ডার তৈরি করে। জাহাজ থেকে উদ্ধার করা এবং লোহা-কাঠ দিয়ে নিজের তৈরি কিছু যন্ত্রপাতি দিয়ে সে শুরু করল শিকার। উৎপাদন করে বার্লি, ধান এবং আঙ্গুর থেকে কিসমিস। মাটির জিনিসপত্র তৈরির কৌশল রপ্ত করে। ছাগল পালন করে এবং পোষে একটি তোতা পাখি। বাইবেল পড়তে শুরু করে এবং সে ধার্মিক হয়। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেয় সব কিছু পাওয়ার জন্য, যদিও সে মানব সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন।

কয়েক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরে ক্রুসো স্থানীয় নরখাদকের দেখা পায়, যারা মাঝেমধ্যে ওই দ্বীপে আসে বন্দিদের হত্যা করে খাওয়ার জন্য। ক্রুসো প্রথমে তাদেরকে হত্যার পরিকল্পনা করলেও পরে তার মনে হলো তাদেরকে হত্যা করার কোনো অধিকার তার নেই। কারণ তারা তো জেনে এই কাজ করছে না। তাদের হাত থেকে একজন বা দুজন বন্দিকে উদ্ধার করে তার চাকর বানানোর পরিকল্পনা করে সে। একজন বন্দি ওই নরখাদকদের হাত থেকে পালায়। তাকে সে উদ্ধার করে। ক্রুসো তাকে শুক্রবারে পায় বলে তার নাম রাখে ফ্রাইডে। তাকে ইংরেজি শেখায় এবং খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করে।

পরবর্তীকালে যখন আরও স্থানীয় নরখাদক তাদের ওই ভোজ উৎসব করতে আসে তখন ক্রুসো ও ফ্রাইডে মিলে অধিকাংশ নরখাদককে হত্যা করে এবং দুজন বন্দিকে রক্ষা করে। তাদের একজন ফ্রাইডের বাবা এবং অপরজন একজন স্পেনীয় নাবিক। নাবিকের মাধ্যমে ক্রুসো জানতে পারে যে, আরও একটি স্পেনীয় জাহাজ বিধ্বস্ত হয়েছে। ওই জাহাজের অন্য স্পেনীয়দের উদ্ধার করে এনে একটি জাহাজ তৈরি করে সবাই মিলে স্পেন বন্দরের দিকে যাত্রার পরিকল্পনা করে তারা।

তারা যাত্রা করল। কিন্তু তারা ফিরে আসার আগেই একটি ইংরেজ জাহাজ আসে। এ জাহাজের বিদ্রোহীরা ওই জাহাজটিকে নির্দেশ দিয়ে চালাচ্ছে। বিদ্রোহীরা তাদের ক্যাপ্টেনকে এই দ্বীপে পরিত্যাক্ত অবস্থায় রেখে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে পুরো জাহাজ তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ওই ইংরেজ ক্যাপ্টেন জাহাজের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার জন্য ক্রুসোর সঙ্গে একটি চুক্তি করে। ক্রুসো, ক্যাপ্টেন ও ইংরেজ জাহাজের বিশ্বস্ত নাবিকেরা মিলে জাহাজটি তাদের আয়ত্তে নিয়ে আসে এবং বিদ্রোহীদের দ্বীপে রেখে তারা ইংল্যান্ডের উদ্দেশে যাত্রা করে। যাত্রার আগে ক্রুসো বিদ্রোহী নাবিকদের দেখায় যে কিভাবে সে একাকী এই দ্বীপে টিকে ছিল এবং বলে যায় যে এই দ্বীপে আরও লোক আসতে থাকবে।

ক্রুসো ১৬৮৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর তার দ্বীপ ত্যাগ করে ১৬৮৭ সালের ১১ জুন ইংল্যান্ডে পৌঁছায়। বাড়ি ফিরে সে জানতে পারে যে, তার পরিবার মনে করেছে সে মারা গেছে। ফলে তার বাবা উইলে তার জন্য কিছুই রেখে যায়নি। ক্রুসো তারপর লিসবনে যায় ব্রাজিলে তার এস্টেটের মুনাফা ফিরে পেতে এবং সেখান থেকে সে প্রচুর সম্পদ লাভ করে। অবশেষে সে তার সম্পদ নিয়ে স্থল পথে আসে। ফ্রাইডে তার সঙ্গে ছিল এবং পথিমধ্যে তারা ক্ষুধার্ত নেকড়ের সঙ্গে শেষ একটি দুঃসাহসিক যুদ্ধের সম্মুখীন হয়। পরবর্তীকালে বিয়ে করে সংসারী হয় ক্রুসো। মোটামুটি এই হচ্ছে ‘রবিনসন ক্রুসো’র কাহিনি সংক্ষেপ।

১৭২৬ সালে বৃটেনে প্রকাশিত হয় জোনাথন সুইফট রচিত ‘গালিভারস ট্রাভেলস’। প্রথমে বইটির লেখক বা প্রকাশকের নাম ছিল না। এই নাম-পরিচয়হীন বইটি এতই বিখ্যাত হয়ে ওঠে যে, দ্রুতই এর সংস্করণ ফুরিয়ে যায়। পাঠকদের চাহিদা মেটাতে ছয়টি ছাপাখানায় পাল্লা দিয়ে বইটি ছাপা হয়, তবু কুলিয়ে উঠতে পারছিল না প্রকাশক। শেষ পর্যন্ত যে ভয়ে তারা নাম-পরিচয় গোপন রেখেছিল সেটিই সত্যি হয়। বইটি নিষিদ্ধ করা হয়। নাম ছিল না বলে লেখক বেঁচে গেলেন। তাকে যেন ধরতে না পারে সেজন্য নিজের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিটিও তিনি ব্যবহার করেননি। একজন নকলনবীশ দিয়ে সেটার একটি প্রতিলিপি বানিয়ে সেটা পাঠিয়েছিলেন প্রকাশকের কাছে।

‘গালিভারস ট্রাভেলস’-এর কাহিনি সংক্ষেপ শুনতে চাইছ? আচ্ছা বলি, শোনো। উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র লেখক নিজেই। একটি জাহাজে ডাক্তার হিসাবে কর্মরত তিনি। হঠাৎ ঝড়ের কবলে পড়ে জাহাজটি ডুবে যায়। জোনাথন নিজেকে সঁপে দিলেন ভাগ্যের হাতে। ভাসতে ভাসতে একসময় নিজেকে আবিষ্কার করেন ডাঙায়। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েন সেখানে। ঘুম ভাঙার পর নিজেকে দেখতে পান বন্দি অবস্থায়। হাত-পাঁ বাধা। তাকে বন্দি করেছে ছয় ইঞ্চি আকৃতির কিছু মানুষ। প্রথমে ভেবেছিলেন মতিভ্রম বুঝি। কিন্তু পরে দেখলেন ক্ষুদে কিছু মানুষ অকৃতির প্রাণি সত্যি সত্যি তার শরীরের উপর হাঁটাহাঁটি করছে। মানুষগুলো তার আঙুলের চেয়ে বড় হবে না। ক্ষুদে মানুষগুলো বন্দি অবস্থায় খুব দক্ষতার সঙ্গে তাকে বহন করে নিয়ে গেল নগরিতে, সম্রাটের কাছে। সম্রাট, রাজপরিবারের সদস্য এবং নগরবাসী সবাই কৌতুহলভরে তাকে দেখতে লাগল।

জোনাথনের বন্দি জীবন শুরু হলো লিলিপুটদের রাজ্যে। তিন সপ্তাহর মধ্যে লিলিপুটদের ভাষাও কিছুটা শিখলেন তিনি। সম্রাটের সঙ্গেও মোটামুটি খাতির হয়ে গেল। সম্রাট তার জন্য ভাষা শিক্ষা ও কাপড়ের ব্যবস্থা করলেন। এক সময় কিছু শর্তের মাধ্যমে তাকে শিকল মুক্ত করে পুরোপুরি মুক্তি দেন সম্রাট। রাষ্ট্রের কিছু কাজে তাকে নিযুক্ত করেন। সম্রাট তাকে জানান যে তার দেশ যে কোনো সময় অন্য একটি দেশ দ্বারা অক্রান্ত হতে পারে। আক্রান্ত হলে জোনাথন যেন তাকে সাহায্য করে। জোনাথন সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। এভাবেই তার বেশ কয়েকটি বছর কেটে যায় সেখানে।

অবশেষে লিলিপুটদের সাহায্য নিয়ে তিনি তৈরি করেন ছোট কিন্তু মজবুদ একটি নৌকা। বিদায়ের সময় সম্রাট, রাজপরিবারের সদস্য এবং নগরবাসী সবাই একসঙ্গে তাকে বিদায় জানাতে আসে। ছোট নৌকাটি নিয়ে তিনি ভেসে পড়েন সাগরে। একটি জাহাজ তাকে উদ্ধার করে এবং তিনি বাড়ি পৌঁছেন। কিন্তু বাড়িতে দু-মাসের বেশি বসে থাকতে পারেননি তিনি। কাহিনির দ্বিতীয় ভাগেও ঝড়ের কবলে পড়ে জোনাথনের জাহাজ। জনমানবহিন একটি দ্বিপে ফেঁসে যান তিনি। কিন্ত এবারর কাহিনি উল্টো। লেখক নিজে লিলিপুট এই দ্বিপে। পরের কাহিনি আরো সুন্দর। তুমি পড়ে নিও। ননী ভৌমিক এটির অসাধারণ অনুবাদ করেছেন।

১৭৫৯ সালে রচিত হয় ভলতেয়রের ‘কাঁদিদ’ উপন্যাস। জার্মান ভাষায় গ্যাটে ১৭৭৪ সালে লেখেন, The Sorrows of Young Werther। এটিও উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃত। আকারের বিবেচনায় এটিকে ঔপন্যাসিকা বলতে পারো। এই হচ্ছে উপন্যাসের শৈশবকাল।

পরবর্তীকালে শুরু হয় উপন্যাসের যৌবনকাল। আঠারো শ শতকে ড্যানিয়েল ডিফো, স্যামুয়েল রিচার্ডসন ও হেনরি ফিল্ডিংয়ের রচনার মাধ্যমে ইংরেজি সাহিত্যে উপন্যাস সাহিত্যের সূচনা ঘটে। ১৭৪০ সালে রচিত স্যামুয়েল রিচার্ডসনের ‘প্যামিলা, অর ভার্চু রিওয়ার্ডেড’ উপন্যাসটি প্রথম যুগের রোম্যান্স উপন্যাসের একটি নিদর্শন। দুটি কারণে উপন্যাসটি ছিল যুগান্তকারী। প্রথমত, উপন্যাসটির উপজীব্য বিষয় ছিল কোর্টশিপ বা প্রণয়যাঞ্ছা এবং দ্বিতীয়ত, উপন্যাসটির মুখ্যচরিত্র ছিল এক নারী, যার দৃষ্টিকোণ থেকেই লেখক কাহিনিটি উপস্থাপন করেন। ড্যানিয়েল ডিফোর যুগ থেকে রিচার্ডসন উপন্যাসকে নিয়ে গেলেন শিল্পের দিক থেকে মনস্তত্ত্বের দুয়ারে। বাস্তবধর্মী উপন্যাস হিসেবে রিচার্ডসনের চার খণ্ডের উপন্যাস ‘ক্লারিশা হারলো’ Clarissa of THE history of a Young Lady খুবই তাৎপর্যপূর্ণ রচনা।

১৭৪৮ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসে পত্র-ব্যবহারে ‘প্যামিলা’ থেকে ভিন্ন রীতি গৃহীত হয়েছে। এখানে দুইগুচ্ছ পত্রের গুরুত্ব দেখা যায়। ক্লারিশা ও তার বন্ধু কুমারী হাউ-এর মধ্যে এবং লাভলেস ও বেলফোর্ডের মধ্যে যে পত্রালাপ চলেছে তার মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছে এক করুণ ট্র্যাজেডি। গ্রামের সরল পবিত্রচেতা মেয়ে কীভাবে নাগরিক জীবনের শঠতা ও প্রতারণায় পীড়িত ও লাভলেসের দ্বারা নির্যাতিতা হৃত-কৌমার্য হয়ে শেষে নিজের গ্রামেই ফিরে গেল তার মাটিতে সমাধিস্থা হওয়ার জন্য, তার বাস্তব করুণ চিত্র রিচার্ডসন এঁকেছেন এ উপন্যাসে।

হেনরি ফিল্ডিং (১৭০৭-১৭৫৪) ইংল্যান্ডের শার্পাম পার্কে জন্মগ্রহণ করেন। জোসেফ অ্যানড্রুস, জোনাথন ওয়াইল্ড, টম জোনস, অ্যামেলিয়া― এ চারটি উপন্যাস রচনা করে তিনি ইংরেজি তথা বিশ্ব কথাসাহিত্যে রিয়েলিজমের পথ প্রশস্ত করলেন। প্লট, চরিত্র, বাস্তবতা― সব দিক থেকেই কথাসাহিত্যের গতি ফিল্ডিংয়ের কলমে বহুদূর এগিয়ে গেল।

পরবর্তীকালে অসাধারণ সব উপন্যাস রচিত হতে লাগলো ফ্রান্সে। ফরাসি উপন্যাস প্রকৃতপক্ষে স্তাঁদাল এবং বালজাকের রচনাতেই শক্তিশালী ও পূর্ণাঙ্গ অবয়ব লাভ করেছে। তাঁরা দুজনেই এসেছেন ফরাসি বিপ্লবের পর। ফরাসি বিপ্লব সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ থেকে প্রকাশিত প্রফুল্ল কুমার চক্রবর্তী রচিত ‘ফরাসী বিপ্লব’ বইটি পড়ে নিতে পারো। ফরাসি বিপ্লব সংঘটটিত হওয়ার পরই ফরাসি মধ্যবিত্ত সমাজ যথার্থ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। স্তাঁদাল ও বালজাকের জীবন ও সাহিত্য তারই সাক্ষ্যবহ। পরবর্তীকালে ঔপন্যাসিক হিসেবে আবির্ভূত হলেন ভিক্টর হুগো (১৮০৩-৮৫), দুমা (১৮০২-৭০), গুস্তাভ ফ্লোবেয়ার (১৮২১-৮০), এমিল জোলা (১৮৪০-১৯০২) প্রমুখ।

ওদিকে প্রথম রুশ ঔপন্যাসিক ছিলেন নিকোলাই গোগোল (১৮০৯-১৮৫২)। পরবর্তীকালে নিকোলাই লেস্কভ, ইভান তুর্গেনেভ, মিখাইল সালতিকভ-শেদ্রিন সবাই ছোটগল্প ও উপন্যাসে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ল্যেভ তলস্তয় ও ফিউদর দস্তয়ইয়েভস্কি এ সময়ে ঔপন্যাসিক হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। বস্তুত বিশ্বসাহিত্যে উপন্যাসের সিংহাসন রুশদের অধিকারে। তুমি রুশ সাহিত্যের ইতিহাসটা পড়ে নিও। দেখবে, রুশ ঔপন্যাসিকরা উপন্যাসকে শিল্পের কত উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন।

লেখকের নোট: ২০১৭ সালে আলোঘর প্রকাশনী থেকে প্রাকশিত ‘উপন্যাসের পথে’ বইটির পুনর্লিখন করছি। পরবর্তী সংস্করণে উপন্যাসের জন্ম ও শৈশব অধ্যায়টি যুক্ত হবে।