প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

উপন্যাসের জন্ম ও শৈশব

পর্ব ১

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : এপ্রিল ২২, ২০২০

তুমি উপন্যাসের উৎপত্তির ইতিহাস জানতে চাইছ? চমৎকার প্রশ্ন। উপন্যাস লিখবে, অথচ উপন্যাসের উৎপত্তির ইতিহাস জানবে না, তা কি হয়? তোমার পূর্বজ ঔপন্যাসিকরা কী লিখে গেছেন তা তো জানতেই হবে তোমাকে। শোনো, ইতিহাসের এক বিশেষ পর্বে উপন্যাসের উদ্ভব ঘটেছিল। রূপকথা, উপকথা, পুরাণ ইত্যাদি পরে গদ্যে লিপিবদ্ধ হলেও মানুষ ও মানুষের জীবন ওসব কাহিনির প্রধান বিষয় হতে পারেনি। কারণ তখনো সমাজে ব্যক্তি মানুষের অধিকার স্বীকৃত হয়নি, গড়ে ওঠেনি তার ব্যক্তিত্ব। তাই কাহিনিতে ব্যক্তির প্রধান্য লাভের উপায়ও ছিল অসম্ভব।

বিশ্বের প্রথম পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসটি রচিত হয় জাপানে, ১০০৭ সালে। ‘দা টেল অব গেঞ্জি’ নামের উপন্যাসটির লেখক মুরাসাকি শিকিবু। তাঁর আসল নাম নিয়ে রহস্য আছে। জাপানের হাইন ডায়ানিস্টিতে তাঁর জন্ম। বাবা ছিলেন একজন স্কলার। তখন জাপানের মেয়েরা ইচ্ছে করলেই চাইনিজ ভাষা ইচ্ছা শিখতে পারত না। নিষেধ ছিল। কিন্তু মুরাশাকি শিকিবু অনেকেটা জেদের বশে চাইনিজ ভাষা শিখেছিলেন। এরপর একসময় দেখা গেল তাঁকে জাপানের রানি ‘লেডি-ইন ওয়েটিং’ করার জন্য অনুমোদন করেছেন। হয়তো তাঁর বিদ্যানুরাগের খবর পেয়েছিলেন রানি আকিকো।

শিকিবু রাজদরবারের কাজে যোগ দিলেন এবং এটাই হলো তাঁর নাম। তিনি ভালোমতো দরবারের ইতিহাস জানার চেষ্টা করেন। প্রতিদিনের ঘটনাগুলো একটি ডায়েরিতে টুকে রাখতেন। ঠিক সে সময়েই উপন্যাসটি লিখতে শুরু করেন তিনি। চুয়ান্নি পর্বের উপন্যাসটি একজন রাজকুমারের সোনালি দিনের নানা ঘটনা নিয়ে রচিত। সর্বশেষ আবিষ্কৃত অধ্যায়টি ছাড়াও তার প্রতিলিপির আরও চারটি অধ্যায় জাপানের জাতীয় সাংস্কৃতিক সম্পত্তি হিসেবে নিবন্ধিত রয়েছে। ১৯২৫ সালে আর্থার ওয়েলি ‘দ্য টেল অব গেঞ্জি’-এর ইংরেজি অনুবাদ করেন। উপন্যাসটি আমি পড়িনি। তাই এর কাহিনি সংক্ষেপ তোমাকে বলতে পারছি না বলে দুঃখিত।

এরপর ইবনে তোফায়েল রচিত ‘হাই ইবনে ইয়াকজান’কে বিশ্বের দ্বিতীয় উপন্যাস বলতে পারো। এটি বিশ্বের প্রথম দর্শনভিত্তিক উপন্যাসও বলতে পারো। ইবনে তোফায়েল ১১৬০ সালে এটি মারাক্কেসে আরবি ভাষায় রচনা করেন। এর কাহিনি সংক্ষেপ শোনো। হাই ইবনে ইয়াকজান পিতা-মাতাহীন এক শিশুর কাহিনি, যে জানে না নিজের জন্মপরিচয়। নিরক্ষীয় অঞ্চলের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এক নির্জন দ্বীপে হরিণীর দুধ খেয়ে শিশু হাই বড় হতে থাকে। সে শেখে পশুদের ভাষা। একদিন সে একটি লাঠির সন্ধান পায় এবং সেই লাঠির কার্যকারিতা ও হাতের গুরুত্ব বুঝতে পারে। লাঠি ও হাতের ব্যবহার শিখে সে শিকার করাও শেখে। এরই মধ্যে হঠাৎ হরিণীটি মারা যায়। হাই শোকে বিহ্বল হয়, তার ভেতর জাগে মৃত্যুভাবনা। হাই পাথরখণ্ড দিয়ে মৃত হরিণীটির শরীরের বিভিন্ন অংশ বিচ্ছিন্ন করতে করতে এই ধারণায় উপনীত হয় যে, দেহের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে হৃদপিণ্ডই হচ্ছে প্রধান, যা প্রাণশক্তি সঞ্চার করে।

হৃদপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হলেই প্রাণীর মৃত্যু ঘটে এবং প্রাণশক্তি আত্মা দেহকে ছেড়ে চলে যায়। হরিণীটি ক্রমশ কঙ্কাল হতে থাকলে হাই দাঁড়কাকের মাধ্যমে শিখে নেয় কীভাবে হরিণীটিকে মাটিতে পুঁতে রাখতে হবে। একদিন সে দেখতে পায় শুকনো ডালের ঘর্ষণের ফলে মৃত গাছে আগুন জ্বলে উঠছে। হাই আগুনকে তার বাসস্থানে নিয়ে আসে। এভাবে বাড়তে থাকে তার অভিজ্ঞতা। সে নিজেকে চামড়া ও পশম দ্বারা ঢাকতে শেখে। পাখিদের কাছ থেকে শেখে শন দিয়ে ঘর তৈরির কৌশল।

এভাবে সে দ্বীপের গাছগাছালি, খনিজদ্রব্য, জীবজন্তু ও প্রকৃতিকে যত্নের সঙ্গে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে উপনীত হয় জ্ঞানের এমন এক উচ্চতর পর্যায়ে, যা কেবল সাধক, কবি, শিল্পী, বিজ্ঞানী ও দার্শনিকের পক্ষেই সম্ভব। পর্যায়ক্রমে সে উত্তরণ লাভ করে বৈজ্ঞানিক-দার্শনিক জ্ঞান এবং মরমি অভিজ্ঞতার পর্যায়ে। প্রাকৃতিক ঘটনাবলির বৈচিত্র্য দেখে সে অবাক হয় এবং সব বৈচিত্র্যের মধ্যে এক ঐক্য বা সঙ্গতি লাভের প্রয়াস চালায়। পরিশেষে সমগ্র জগতের মধ্যে এক সর্বব্যাপী ঐক্যের আত্মসন্ধানে সে নিজেকে ব্যাপৃত রাখে। এই জগত সৃষ্টির পেছনে সে এক এককের ক্রিয়া দেখতে পায়। তার ভেতর দুর্বার ইচ্ছার জন্ম নেয় সেই একককে জানার।

এভাবে প্রকৃতির পর্যবেক্ষণ ও অধ্যয়ন থেকে সে সচেতন হয় নভোমণ্ডলের অস্তিত্ব সম্পর্কে এবং প্রয়োজনবোধ করে এক পরম সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করার। সুশৃঙ্খল পৃথিবী ও তার সৌন্দর্য দেখে হাইয়ের অন্তরে এই ধারণা হয় যে, জগতের স্রষ্টা ও পরিচালক সেই সত্তা তার সৃষ্টিজীব থেকে উচ্চতর। তিনি পূর্ণ, স্বাধীন, সর্বজ্ঞ, দয়াবান ও সর্বশক্তিমান। হাই বুঝতে পারে, উন্নত জীবনের জন্য তার কিছু নিয়ম তৈরি ও তা অনুশীলন করা প্রয়োজন। দৈহিক স্পৃহা প্রবৃত্তি ও বিভিন্ন প্রয়োজনে সে সংযমী হয় এবং ভালো-মন্দের মধ্যে বাছবিচার করতে শুরু করে। এভাবেই সে উপনীত হয় উচ্চতম মরমি অভিজ্ঞতার পর্যায়ে। লাভ করে অপরোক্ষ ঐশী জ্ঞান বা দিব্যদর্শন।

একটা সময় এই নির্জন দ্বীপে আফজাল বা আসাল নামের এক ব্যক্তি আসে। আসালের কাছ থেকে হাই জানতে পারে যে, তার নির্জন দ্বীপটির পার্শ্ববর্তী আরেক দ্বীপে বাস করে একদল লোক। তারা ইসলামি বিশ্বাসের স্বীকৃত অনুসারী হলেও পার্থিব আনন্দ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না। আসাল ওই দ্বীপ থেকে এখানে এসেছে নির্জনে ধর্মীয় অনুশীলন ও নৈতিক আত্মোন্নয়ন সাধনের লক্ষ্যে। আসালের কাছ থেকে হাই মানুষের ভাষা শেখে। ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়ে তাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হতে থাকে। পারস্পরিক ভাব-বিনিময়ে দুজনে বুঝতে পারে, স্বাভাবিক প্রচেষ্টায় অর্জিত হাইয়ের দার্শনিক সত্য এবং আসালের শাস্ত্রীয় সত্য এক ও অভিন্ন। অতঃপর তারা পার্শ্ববর্তী দ্বীপের মানুষদের কাছে এই সত্য প্রচার করতে যায়। কিন্তু উচ্চতর দার্শনিক তত্ত্ব যে জ্ঞান ও সত্যের প্রতীক বলে তাদের অভিমত, তাকে বোঝার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নেই। শেষে দুজনে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, জনসাধারণের কাছে রূপক ভাষার আবরণে সত্য-মিথ্যা প্রচারে নবিগণ ঠিক ও বিজ্ঞানোচিত কাজটি করেছিলেন। এই হচ্ছে ইবনে তোফায়েলের হাই ইবনে ইয়াকযান উপন্যাসের কাহিনি সংক্ষেপ।

উপন্যাসটি কী বার্তা দিচ্ছে? এই বার্তা দিচ্ছে যে, কীভাবে একটি শিশু পিতামাতা, ধর্মগুরু বা সমাজের সহায়তা ছাড়া বড় হয়েছে। হাই যে কেবল আগুন জ্বালাতে শিখেছে, ঘর বানাতে শিখেছে, বন্য পশুকে পোষ মানাতে পেরেছে, বা হাতিয়ার আবিষ্কার করেছে তাই নয়; সে শিখেছে কী করে একজন চিকিৎসক, জীববিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিদ, পদার্থবিদ, মনোবিজ্ঞানী এবং দার্শনিক হওয়া যায়। লক্ষ্যে পৌঁছাতে তাকে কেউ সাহায্য করেনি, কেবল তার কারণ অনুসন্ধান এবং বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ছাড়া। হাই ইবনে ইয়াকজানের কোনো ধর্ম ছিল না। সে মুসলমান নয়, খ্রিস্টান নয়, ইহুদি নয়। সে কালোও নয়, সাদাও নয়। যখন সে পিতামাতা, সমাজ অথবা কোনো ধর্মীয় গুরুর সহায়তা ছাড়া নিজে নিজেই বড় হচ্ছিল, তখন সে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একটি শক্তি আবিষ্কার করে এবং বলবিদ্যার বিজ্ঞান থেকে এর একটি নামকরণ করে। সেই শক্তি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চালক, গড, আল্লাহ, ঈশ্বর বা জিহুয়া নয়। হাইয়ের মূল যুক্তি দর্শন ও ধর্মের মধ্যে সাদৃশ্য খুঁজে বেড়ানো ছিল না। তার যুক্তি ছিল মানুষকে নিয়ে, মানুষের ভিন্নতা, একে অন্যের সঙ্গে সমঝোতা করার প্রয়োজনিয়তা এবং যতদূর সম্ভব শান্তিপূর্ণ পন্থা অবলম্বন করে সহিংসতা ও রক্তপাত এড়িয়ে চলা নিয়ে।

চৌদ্দ শতকে মোসেস রাব্বি নারবোনেনসিস বইটি হিব্রু ভাষায় অনুবাদ করেন। ১৪৯২ সালে ‘মেনিফেস্টো অফ রেনেসার’ রচয়িতা ইতালীয় দার্শনিক জিওভান্নি পিকো ডেল্লা মিরানডোলা (১৪৬৩-৯৪) বইটির সর্বপ্রথম ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেন। পরে ১৬৫৩ সালে বিখ্যাত ব্রিটিশ প্রাচ্যবিশারদ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এডওয়ার্ড পোকোক জুনিয়র (১৬৪৮-১৭২৭) এবং আরবি ভাষায় একজন প-িত উপন্যাসটি সরাসরি আরবি থেকে ‘ফিলোসফাস অটোডিডাকটাস’ নামে ল্যাটিনে অনুবাদ করেন। ১৬৭১ সালে বইটি আরবি টেক্সটসহ অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত হলে পুরো ইউরোপের বুদ্ধিজীবী মহলে হৈচৈ পড়ে যায়। তখন যুক্তি ও বিজ্ঞান বিকাশের হাওয়া পুরোদমে বইছিল। জার্মান দার্শনিক লিবনিজ (১৬৪৬-১৭১৬) ও ডাচ-ইহুদি দার্শনিক স্পিনোজা (১৬৩২-১৬৭৭) দুজনেই এর দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। স্পিনোজার উৎসাহে এর সফল ডাচ অনুবাদ (বাউমিস্টার, আম্সটার্ডাম ১৬৭২) এবং লিবনিজের কারণে দুটি জার্মান অনুবাদ প্রকাশিত হয়।

চৌদ্দ শতকে ইতালি ভাষায় বোকাচিও যে ‘ডেকামেরন’ রচনা করেন সেটিও অনেকগুলো ঔপন্যাসিকার সমন্বয় বলতে পারো। কেউ কেউ একে উপন্যাসের স্বীকৃতি দিয়েছেন। ডেকামেরন থেকে ইউরোপের গদ্যভাষার যথার্থ আখ্যান শুরু হয়। তিনি এই গ্রন্থকে Novella storie বা ‘নতুন গল্প’ আখ্যা দিয়েছিলেন। ১৫৬১ সালে ইংরেজিতে প্রকাশিত হয় উইলিয়াম বাল্ডউইন রচিত Beware the Cat নামক একটি গ্রন্থ। এটি সংক্ষিপ্ত ইংরেজি উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃত। এটিকে ছোটগল্পের চেয়ে বড় আকারের একটি ভৌতিক ঔপন্যাসিকা বলতে পারো। এটিকে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস হিসেবে ধরা হয়।

লেখকের নোট: ২০১৭ সালে আলোঘর প্রকাশনী থেকে প্রাকশিত ‘উপন্যাসের পথে’ বইটির পুনর্লিখন করছি। পরবর্তী সংস্করণে উপন্যাসের জন্ম ও শৈশব অধ্যায়টি যুক্ত হবে।