উপকারী পরগাছা
পাবলো শাহিপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০১, ২০১৯
গাছের উপরে জন্মেছে আরেক গাছ, দারুণ কৌতূহলময়। গাছের ডাল বা কাণ্ডে অর্কিড, বাঁদরা ইত্যাদি নানা জাতের গাছ দেখা যায়। সেগুলোর আকার-আকৃতি ঠিক যেন সাধারণ গাছের মতো নয়। কিন্তু গাছের উপর স্বাভাবিক গাছের মতোই জন্মায় ‘বন্দা’ গাছ। ছেলেবেলায় বয়ষ্ক আমগাছে বন্দা গাছ দেখে মনে হতো, হয়তো গাছ বড় হয়ে গেলে চেহারা বদলে যায় গাছের, মানুষের মতোই।
এক লম্বা-দাড়ি কবিরাজ এসে বন্দা গাছের ডাল-পাতা ফুল-ফল সংগ্রহ করে। তাকেই জিজ্ঞাসা করি, ‘গাছের উপর আবার গাছ হয় কেন, মাটিতেই তো গজাতে পারে।’ কবিরাজ মৃদু হেসে জবাব দেয়, ‘এই গাছ ‘উনি’ ইচ্ছে করেই মাটিতি লাগাননি, গাছের উপরেই শোভা করে দেছেন, যাতে মানুষ চিনতি পারে, আর বুঝতি পারে এই গাছের কি উপকার।’ আমি জিজ্ঞাসা করি, ‘উনি কে?’ কবিরাজ আসমানের দিকে আঙুল উঁচু করেন মাত্র। এরপর গাছের ডাল থেকে ফল ছিঁড়ে আমাদের হাতে দিয়ে বলেন, ‘চাবাতি থাকো, অনেক উপকার।’ আমরা দুই বন্ধু ধানতাবিজের মতো দেখতে বন্দার লাল-গোলাপি হাল্কা মিষ্টি ফল চিবুতে থাকি। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে চিবুনোর পরও ফল খাওয়া শেষ হয় না, যেন এক শাশ্বত চুইংগাম। বেশ মজাই লাগছিল, ফল খাচ্ছি অথচ শেষ হচ্ছে না।
উত্তর অস্ট্রেলিয়াতে অনেকরকম বন্দা গাছের ভিড়। বড়রা এই ফল নিজেরা খায় না কিন্তু খেতে দেয় বাচ্চাদের, উচ্চমানের পুষ্টির জন্য। বন্দা-ফলের আঁটির গায়ে এক ধরনের চটচটে আঠা (Viscum) থাকে, এটাই সেই অক্ষয় চুইংগাম। এই আঠা বন্দার বংশবিস্তারের এক অপরিহার্য কৌশল। পাখিরা ফল খাওয়ার সময় ঠোঁটের চাপে বন্দার রসালো ফল ফেটে যায়। কখনো আঁঠালো বীজ লেগে যায় ঠোঁটের এক পাশে। এরপর পাখিরা উড়ে গিয়ে ভিন্ন ডালে বা ভিন্ন গাছে বসে এবং যখন ঠোঁট ঘষে পরিষ্কার করে তখন বীজ লেগে যায় ডালে। কখনো বিষ্ঠার সাথে এই বীজ বের হয়। এই আঁঠায় আটকানো বীজ থেকেই সাধারণত বন্দা গাছ জন্মায়।
গাছ এক-দেড় বছরের হলে পোষক গাছের বাকলের ফাটলে প্রবেশ করে এক ধরনের বিশেষ শিকড় ‘চোষক-মূল’ বা হস্টোরিয়াম (Haustorium)। অনেক ক্ষেত্রে চোষকমূল প্রবেশ করার স্থানটি গোলাকারভাবে ফুলে যায় দীর্ঘকাল পর। শুনেছি এই ফোলা অংশ কেটে সুপারি বানায় মহারাষ্ট্রের মানুষ। এই চোষক মূলের মাধ্যমে বন্দা পোষক গাছ থেকে পানি ও পুষ্টি সংগ্রহ করে। তবে পোষক গাছের উপর বন্দা পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল নয় কারণ এর সবুজ পাতা থেকে সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে তৈরি হয় শর্করা-জাতীয় খাবার। তাই বন্দাকে বলা যায় ‘হেমিপ্যারাসাইট’ (Hemiparasite) বা অর্ধপরজীবী গাছ।
আমাদের সুপরিচিত স্বর্ণলতাও পরজীবী, কিন্তু একে বলা হয় ঘোর-পরজীবী বা ‘হলোপ্যারাসাইট’ (Holoparasite)। স্বর্নলতার দেহে কোনো সালোকসংশ্লেষণ হয় না, তাই জৈব খাদ্য শর্করা, জল ও খনিজ সবই একে সংগ্রহ করে নিতে হয় পোষক গাছ থেকে। কিছুদূর পর পর এর বিশেষ শিকড় ‘হস্টোরিয়াম’ পোষক-গাছের শরীরে প্রবেশ করতে দেখা যায়। বীজ থেকে স্বর্নলতার জন্ম হয় মাটিতে। শিশু গাছ এসময় কাণ্ড ঘুরিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে আশপাশের কোন্ গাছ পোষক হিসাবে অধিক নির্ভরযোগ্য। নির্বাচন করে সেই গাছ বেয়ে উঠে পড়ে লতা, তারপর চোষকমূল বিস্তার করতে থাকে। এক পর্যায়ে পুরাতন মূল বিনষ্ট হয়ে যায় এবং বোঝার কোনো উপায় থাকে না যে স্বর্ণলতা একদিন মাটিতেই জন্মেছিল। তবে পোষক গাছের সন্ধান না পেলে স্বর্ণলতার চারার মৃত্যু হয়।
শুধু ডাল নয়, কখনো শিকড় থেকেও খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে হেমিপ্যরাসাইট গাছ শ্বেতচন্দন (Santalum album)। অন্য গাছের শিকড়ের উপরই জন্মায় শ্বেতচন্দন গাছ। সেখান থেকেই পানি ও খনিজ-পুষ্টি সংগ্রহ করে এবং বাকি জৈব-খাবার শর্করার অভাব পূরণ করে সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে। শ্বেতচন্দনের কাঠে সুগন্ধ তৈরি হতে বহুবছর সময় লাগে। ফসল তোলার নিমিত্তে ৩০ বছরে এটা কাটা যায়, তবে ৭০ বছরের গাছের গন্ধ অনেক তীব্র হয়। প্রবাদ আছে, যে শ্বেতচন্দন গাছ লাগায় সে তার জীবদ্দশায় এর প্রকৃত সুবাস নিয়ে যেতে পারে না। ভারতে এই কাঠ সংগ্রহের ব্যাপারে কড়া নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সরকারি-বেসরকারি যাবতীয় সম্পত্তিতে। অতীতে বন থেকে চুরি করে কাঠ সংগ্রহের ফলে এর প্রায় লুপ্তির অবস্থা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়াতে শ্বেতচন্দন-কাঠ ব্যবসায়িক ভিত্তিতে সংগ্রহ করা হয় অনেক কম বয়সে যদিও তার ঘ্রাণ গাঢ় হয় না তখন। শ্বেতচন্দন সারা পৃথিবীতে সুগন্ধি ও ওষুধ হিসাবে সমাদৃত। এর এক কিলো তেলের মূল্য দেড়লক্ষ টাকার কম নয়। রক্তচন্দন (Pterocarpus santalinus) ভিন্ন, শিম পরিবারের উদ্ভিদ। এর কাঠে সুঘ্রাণ নেই, তবে এর আকর্ষণীয় লাল কাঠ হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও সুফীদের পবিত্র বস্তু হিসাবে বিবেচিত।
অস্ট্রেলিয়ায় প্রায় ৯০ জাতের বন্দা পাওয়া যায়, কিন্তু ইউরোপে পাওয়া যায় মাত্র একটি, সাদা ফুলের ‘ভিস্কাস এলবাম’ (Viscus album)। ক্রিস্টমাস উৎসবের সময় এই বন্দার ডাল সিলিং থেকে ঝুলিয়ে রাখা হয়, যার নিচে চুমু খাওয়ার রীতি আছে দ্রুইদদের। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় এই গাছের প্রতি কোনো শ্রদ্ধাই নেই কারণ সেখানে অনেক এলাকায় এটি আগাছা হিসাবে চিহ্নিত। বন্দা গাছ যে কখন কোথায় জন্ম নেয় তা বলা যায় না। হিমালয়ের পাদদেশে, আখরোট, নাশপাতি, আপেল, বাদাম নানা গাছে এদের দেখা যায়।
সাধারণত যে সব গাছের বাকল ফাটাফাটা থাকে সেসব গাছেই এদের বেশি জন্মাতে দেখা যায়। বাংলা অঞ্চলে একে আমগাছেই দেখা যায় সবচেয়ে বেশি। তবে শিমুল, কাফিলা, শরিফা, শিশু, বোতলব্রাশ, কালিকড়ই, সফেদা এমনকি কাঁঠাল ও পেয়ারা গাছেও দেখা যায়। এর ভেষজ ঔষধিগুণ নির্ভর করে এটা কোন গাছের উপর জন্মেছে তার উপর। যেটি যজ্ঞডুমুর গাছের উপর জন্মায় তার ঔষধি ব্যবহার গর্ভ সংস্থাপনের কাজে। আবার যেটি নিম গাছে জন্মায় তার ব্যবহার ভিন্ন। গবেষণায় জানা যায়, নিমজ-বন্দা ব্রেস্ট ক্যান্সারের বিরুদ্ধে ভাল কাজ করে।
বন্দার ফল মৃদু বিরেচক। এটি আফ্রোডিসিয়াক, অর্শ, টিউমার, প্লীহারোগে ব্যবহৃত হয়। ছাল নিদ্রাজনক ও সংকোচক, ধাতুজ পীড়া, শ্বাস ও ক্ষয়রোগেও ব্যবহার হয়। বন্দা গাছ অন্যান্য যে সব রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় তার মধ্যে রয়েছে যক্ষা, অনিয়মিত ঋতুচক্র, প্রদর, বাত, গর্ভপাত, মূত্রপাথরী, হাঁপানি, অন্ত্রপীড়া ইত্যাদি। চরক সংহিতায় বন্দা সম্পর্কে উল্লিখিত আছে... ‘অপত্যসন্তানকরং যৎসদ্যঃ সংপ্রহর্ষণং’,
অর্থাৎ বন্দা সেবনের ফলে বহু সন্তানের জনক হওয়া যায় এবং সদাই দেহমনে হর্ষ উৎপন্ন হয়।
বন্দাকে রাজশাহীর আঞ্চলিক ভাষায় ‘ধাইরা’ বলা হয়। মধ্যযুগীয় বাংলা শব্দ ‘ধাউড়’-এর অর্থ কপট বা প্রবঞ্চক। হয়ত অন্য গাছকে খাদ্য ও আলোক থেকে বঞ্চিত করে বলে ধাউড় নাম হয়েছে এবং বিবর্তনের কারণে এক সময় ‘ধাইরা’তে রূপ নিয়েছে। আর এক হতে পারে, এই পরগাছা গাছের মুকুটের কিনারের দিকে বা ধারে জন্মায় বলে ‘ধাইরা’। হিন্দি ও শুদ্ধ বাংলাতে এটা বন্দা। এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘ডেনড্রপথোয়ি ফালকেটা’ (Dendrophthoe falcata)। ইংরেজি নাম মিসল্টৌ (Mistletoe), অবশ্য মিসল্টৌ নামে একটি জনপ্রিয় ক্যাকটাসও আছে (Rhipsalis cassytha)। ডেনড্রপথোয়ি গণে ৩১টি প্রজাতির মধ্যে ৭টি ভারতীয় উপমহাদেশে পাওয়া যায়। এর দুটি উপপ্রজাতি রয়েছে, যার একটির ফুল লাল (Dendrophthoe falcata var. coccinea) অন্যটির সবুজাভ সাদা (Dendrophthoe falcata var. falcata)।
এদের ফুল ফোটে প্রচণ্ড শীতের ভিতর যখন অন্য গাছে ফুল তেমন দেখা যায় না। এমন খাদ্যাভাবের সময়ে ফুল ফোটানোর পেছনে হয়ত ক্ষুৎপীড়িত পতঙ্গ আকর্ষণের ইঙ্গিত থাকতে পারে। ফুলে মধু থাকে প্রচুর এবং সে-কারণে অনেক কীটপতঙ্গ ভীড় করে ফুলে। এসব পোকামাকড়ের লোভে অনেক পাখি আসে। ফুল টিউব আকৃতির বলে সাধারণত পরাগায়ন করে লম্বা-ঠোঁট মৌটুসি পাখি। ফল খায় কোকিল, টিয়া, ময়না, শালিক ইত্যাদি পাখিরা।
বন্দার পাতায় ডিম পাড়ে সুদর্শন জেজেবেল (Jezebel) প্রজাপতি যার কারুকাজ করা ডানা দেখে মনে হয় রেড-ইন্ডিয়ানের মাথার মুকুট। আমাদের দেশে এসব প্রজাপতির কোনো নাম নেই, এমনকি মথ ও প্রজাপতিকেও অনেকসময় আলাদা করে দেখা হয় না। আমরা একটি প্রয়োজনীয় নাম নিয়ে মাথা ঘামাই না অথচ দেখাদেখি একই গাছের ডজন ডজন নাম দিয়ে ফেলি। এতে বিভ্রান্তির অতলে চলে যায় অনেক গাছ, সোমলতার মতই। এসব আচরণ বিশ্লেষণযোগ্য নয়, তবু ভাবি এখন সময় এসেছে উত্তরণের।
অস্ট্রেলিয়াতে নানা জাতের বন্দা গাছ দেখা যায়। জগৎজুড়ে প্রায় ২৪০ রকম পাখি বাসা বাঁধে বন্দা গাছে যার মধ্যে ১৮০টিই অস্ট্রেলিয়ার। বন্দা গাছে বাস করে ‘মিসিলটৌ বার্ড’। লাল-কালো-সাদা পালক মেশানো পাখিটা সুন্দর সুর করে গান গায়। এই পাখির সঙ্গে বন্দা গাছের একটা নিবিড় মিথোজীবী (Symbiotic) সম্পর্ক আছে। মিসিলটৌ পাখির পাকস্থলি বন্দার ফল পরিপূর্ণভাবে হজম করার জন্য বিশেষভাবে তৈরি। মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যেই এই পাখি হজম করে ফেলে ফল, এবং দ্রুত বীজের বিসরণ ঘটায়। বংশরক্ষার এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য গাছ পাখিকে দেয় পুষ্টিসম্পন্ন খাবার ও নিরাপদ জংলা নিবাস।
প্রকৃতিতে গাছ জন্মাতে দেখি ডাঙা আর জলে। আবার শূন্যেও এক প্রকার গাছ জন্মে বিদেশে, টিল্যান্ডসিয়া বা এয়ার প্ল্যান্ট যার নাম। এরা হাওয়া আর বাষ্প থেকে খাবার খায়, কখনো ইলেকট্রিক তারের সঙ্গে পেঁচিয়ে থাকে, ওখানেই চলে তার জীবনচক্র। পরাশ্রয়ী বা পরজীবী যাই হোক এসব গাছের ভেষজ মূল্য রয়েছে অনেক, যাদের তুচ্ছ জ্ঞান করার ফলে গবেষণা এগুতে পারেনি তেমন। আমাদের কাজ, বন্দার মতো যে কোনো গাছই ভালমত পরীক্ষা না করে তাকে কখনো ক্ষতিকর আগাছা হিসাবে চিহ্নিত না করা।
লেখক: কবি