
ঈর্ষার পাশে তুমিও জুঁইফুল
শ্রী দেবপ্রকাশিত : জুন ১৮, ২০১৯
শুভ্র সরকার রচিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঈর্ষার পাশে তুমিও জুঁইফুল’। কবির লেখার সাথে ফেসবুকেই পরিচয়। সেই সুবাধে বইয়ে স্থানপ্রাপ্ত `গভীর মনোলিথ` কবিতাটা আগেই পড়া। ছন্দের প্রতি আমার গোপন দুর্বলতা আছে এবং সবসময় থাকবে। বর্তমানে কবিরা গতানুগতিক চাল থেকে বেরিয়ে এসেছে কবিতার শব্দকে উপস্থাপন করতে। সেখানে শুভ্র সরকার স্বরবৃত্তের সাধারণ এক চালে অনন্য করেছেন `গভীর মনোলিথ` কবিতাটা। এ কবিতা ছাপার অক্ষরে নিজের কাছে রাখতেই মূলত সম্পূর্ণ বইটি সংগ্রহ করার টান জাগে এবং সংগ্রহ করি।
আরেকটা বিষয় উল্লেখ করি সততার সাথে। কোনো বই সংগ্রহকালে প্রচ্ছদের বাহার যতই বলুক `লাগ ভেলকি লাগ, চোখে মুখে লাগ` ততই আমি অন্ধ হয়ে যাই। আমি প্রচ্ছদের বিষয়ে বর্ণান্ধ। সেই দিক থেকে `ঈষার্র পাশে তুমিও জুঁইফুল` এর প্রচ্ছদ আমাকে মোটেও বিরক্ত করেনি। এজন্য একটা গোপন ভালো লাগা কাজ করেছে বইটির উপর। তাই হয়তো আলোচনা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে যেতে পারে। তবুও চেষ্টা করবো সুষ্ঠু আলোচনার।
কবি শুভ্র সরকারের চোখ তার কবিতার মতোই ধনুর্বিদের চোখ। গতানুগতিক ধারা থেকে নিজেকে কাটিয়ে আমাদের চারপাশের জীবনের প্রেম, বিভ্রম, শোক ও খানিকটা দ্রোহ ফুটিয়ে তুলেছেন। যেমন:
আমার ক্ষুধা লাগলে বলতাম, বাবা, আমার একটা ক্ষুধা আঁকুন।
বাবা মায়ের মুখ এঁকে দিতেন।
(কবিতাংশ: অভাব)
ঋণগ্রস্থ পিতার কাঁধ একটা উড়তে থাকা পতাকা...
(কবিতা: দেশ)
এই কবিতার বিষয়ে আমার একটা সরল ভুল, দেশের স্থলে আমি শোক উচ্চারণ করি।
উনুনের আঁচে একা হয়ে যাচ্ছে শীতকাল...
(কবিতা: মা)
মুখস্থ অঙ্কের মতো আমি ভুলে যাই মানুষের শব্দার্থ। সন্ধ্যাঝোপে ধ্বনিত হয় অভিজ্ঞ অন্ধকার, দিগন্তচোখে চেয়ে থাকে মেঘধুলো। অনভ্যস্ততায় বিদার হয়ে যায় ধুলোর স্নান; পাখির বাগান।
(কবিতাংশ: মানুষের শব্দার্থ)
প্রথম দরজায় আছে মৃত্যু
দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দরজায় আছে সাপ
চতুর্থ থেকে শেষতম দরজায় আছে অভিশাপ
নীরু আমাকে বলে দাও
বলে দাও, কোন দরজায় তুমি আছ
(কবিতাংশ: বিভ্রম)
কবির দুটো কবিতা নয় বরং শিরোনামই আমার কাছে মনে হয়েছে পূর্ণাঙ্গ কবিতা:
আমার পদবি কেটে মানুষ লিখে দিও
তোমার নামে আমার কোনো প্রেমিকা নেই
এ কবিতাগুলোর পূর্ণাঙ্গ পাঠেই কবির লিখনশক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। যেকোনো পাঠক কবিতাগুলো পাঠশেষে কবির কল্পনাশক্তির সাথে বাস্তবিক দর্শনের মিশেল আঁচ করতে পারবে। তবে, বইয়ের আরো কিছু কবিতা:
বাংলাদেশ
খসে পড়ছে আলো
ভ্রান্ত অপেরা
দোতরা মন
উঠে রিকসা হুড নামিয়ে তুমি ভিজছো
এই কবিতাগুলো অত্যন্ত সাধারণ ও গতানুগতিক মানের মনে হয়েছে। যা প্রথমে ভেবেছিলাম বইতে না আনলেও চলতো। অনেকেই হয়তো দ্বিমত করতে পারেন বা আপত্তি করতে পারেন ভালো না লাগা কবিতাগুলোর চরণ তুলে ধরিনি কেন? এখানে ভালো না লাগার ব্যাপার নেই। মূলত কবিতাগুলোর চর্চা পুরাতন। সময়ের সাথে আরো অগ্রসরমুখী কবিতা আশা করেছিলাম। এতটুকুই ব্যস। তো যেটা বলছিলাম, কবিতাগুলো বইয়ে এসে বরং উচিত হয়েছে। যেহেতু কবি নিজেই ফ্ল্যাপে স্বীকার উক্তি দিয়েছেন কবিতায় পার হয়ে আসা ডাইমেনশনগুলোর। কবিও এও উল্লেখ করেছেন, `ঈর্ষার পাশে তুমিও জুঁইফুল` একটা জার্নি।
পরিশেষে সমস্ত দিক বিবেচনা করে বলতে পারি, ঈর্ষার জুঁইফুল চমৎকার একটা জার্নি। যেহেতু কবিতার পাঠে ডাইমেনশনগুলো বলে দিচ্ছে কবির কবিতার ভাবনা কোথায় ছিল আর কোথায় অগ্রসর হয়েছে। কবির কবিতায় যে মোচড় পেয়েছি নিঃসন্দেহে কবির ভবিষ্যৎ জার্নি আরো বর্ণিল হবে বলে আশা রাখতে পারি।
অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৯ এ বইটি প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশ করেছেন চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন। প্রচ্ছদ করেছেন সারাজাত সৌম। বইটির মূল্য রাখা হয়েছে মাত্র ১৫০ টাকা।