আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
ইসলামি আদর্শে মুসলমানি ঐতিহ্যের কবিতা লেখার দশ প্রস্তাব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহপ্রকাশিত : মে ২৭, ২০২২
এই সময়ের কবিতাপাঠে এইটা বলা অমুলক হবে না যে, বাংলাদেশের কবিতার বিষয়বস্তু, গঠন ও বয়নে একটা পজিটভ, প্যারাডাইমিক চেইঞ্জ আসছে। এই পজিটভ ও প্যারাডাইমিক চেইঞ্জটা কী? উত্তরে বলা যায়, বাংলাদেশের কবিতা আবারও ইসলামি আদর্শের বিশ্বাসী ধারার ঐতিহ্যে ফিরা আসছে বা আসতেছে। ত্রিশের সেকুলার/এথিস্ট কবিদের বিপরীতে দাঁড়াইয়া কাজী নজরুল ইসলাম এবং চল্লিশের দশকে ফররুখ আহমেদ ও জসীমউদ্দীনসহ সহ অন্যান্য মুসলমান কবিদের হাত ধরে যে ইসলামি আদর্শে মুসলমানি ঐতিহ্যের কবিতার একটা ধারা শুরু হইছিল এবং পরবর্তীতে আল মাহমুদ ও আব্দুল মান্নান সৈয়দের হাত ধরে পুনর্জীবিত হইছিল, তা আবারও বর্তমান সময়ের কবিদের কবিতায় জীবন ফিরা পাইছে বইলা মনে হয়।
এইটা সত্য যে, বাংলা ভাষাভিত্তিক হার্ডকোর বাঙালি জাতীয়তাবাদের কারণে বাংলা কবিতার যে সংজ্ঞা ও ফর্ম আমাদের সামনে দাঁড় করানো হইছে, তা হিন্দু কবি-সাহিত্যিক এবং সেকুলার মুসলমান কবি-সাহিত্যিকদের ক্রমাগত হেজেমনিক প্রকাশ, বিকাশ, গোষ্ঠীবদ্ধতা এবং অভিভাবকত্বের কারণে তা বাঙালি মুসলমানের ভাব, দর্শন ও চিন্তার ছাঁচটাকে ভালোভাবেই একমুখি করে রাখতে সক্ষম হইছে। তাই ষাট সত্তর, আশি নব্বই এবং পরবর্তী দশকে মুসলমান ঐতিহ্যের কবিতার এক ধরনের উদ্বাস্তু অবস্থা সৃষ্টি হইছে। আধুনিকতার নাম করে ধর্মকে কবিতা থেকে কেটে বাদ দেয়া হইছে। ফলে কবিতাশিল্প হইছে ডিফরমড, ব্যলান্সলেস। আমাদের মনে রাখতে হবে, মানুষের জীবনে আছে দ্বৈত সত্তার অস্তিত্ব, মানে মানুষ স্প্রিট ও ম্যাটার দিয়ে তৈরি। তাই জীবনে দরকার সমন্বয়— ধর্মের সাথে বস্তুর।
বিশ ও ত্রিশের দশকে আধুনিকতার নাম করে বাংলায় যখন ইসলামিক ভাব ধারার কবিতাকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছিল ঠিক একই সময়ে আন্তর্জাতিক কবিতার দিকে বিশেষ করে ইউরোপীয় কবিতার তাকাইলে দেখা যাবে, সেখানে ধর্ম এবং ধর্ম-অনুষঙ্গ বরাবরই উপস্থিত। যেমন টিএস এলিয়টের দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড, যাকে আধুনিক কবিতার উৎসভূমি বলা হয়, সেইটা পুরাটাই একটা স্প্রিচ্যুয়াল জার্নি। দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড পড়লে বোঝা যায়, আধুনিক যুগের আবির্ভাবের ফলে পাশ্চাত্যের আধ্যাত্মিক জীবন শুকাইয়া গেছে এবং আত্মার মৃত্যু ঘটছে। আধুনিকতা মানুষের আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ ছিনাইয়া নিছে। ধর্মের অনুপস্থিতি আধুনিক বিশ্বকে করে তুলছে একটি বর্জ্যভূমি। এইটা এখন অভিশপ্ত জগৎ যেইটা নিঃসঙ্গতা ও একঘেয়েমি হতাশা আর প্রাণহীন মানুষ দিয়া পূর্ণ। এই বর্জ্যভূমির মধ্যে আছে ব্যক্তিগত যন্ত্রণা ও অবক্ষয়, যা মানুষকে করেছে নষ্ট।
আধুনিক যুগে ধর্মের অনুপস্থিতিতে ব্যক্তির ইচ্ছাই (ডিজাইয়ার) হয় ব্যক্তির জীবন পরিচালনার মূল চালিকা শক্তি। তাই ঘটে সম্মতিসূচক কিন্তু বিধিবহির্ভূত যৌনাচার, যা আধুনিক মানুষকে একটি আধ্যাত্মিক মরুভূমিতে ডুবাইয়া দেয়। তাই সে প্রতিমুহূর্তে সন্ধান করে একটি আধ্যাত্মিক বাড়ির, যা কেবল ধর্মেই পাওয়া যায়। ধর্মই পুনরুদ্ধার করতে পারে আধুনিক মানুষের এই মনস্তাত্ত্বিক ভারসাম্য। এইভাবে, এলিয়টের দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড হয়ে যায় আধ্যাত্মিক ও মনস্তাত্বিক বন্ধ্যাত্ব শোধনের একটা আধ্যাত্মিক ভ্রমণ। এই বন্ধ্যাত্ব ঘুচাইতে এলিয়ট ব্যবহার করছেন খ্রিস্টীয়, বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন অনুষঙ্গ। তাই বলা যায়, সফল কবিতায় আধুনিক যুগ চেতনার সাথে মেশানো যায় ধর্ম বিষয়ক বিষয়বস্তু ও অনুষঙ্গ।
নব্বইয়ের দশকে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে উত্তর আধুনিক আন্দোলন নামের একটা সাহিত্য আন্দোলন বেশ জনপ্রিয়তা পায়। ইউরোপীয় পোস্ট মর্ডানিজমের ন্যারেটিভিটিকে বাদ দিয়া দুই বাংলায় বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, গ্রামীণ লোকজীবন ধারায় কবিতা লেখার পরামর্শ পাওয়া যায়। সেই সূত্রে সেই সময়ের লিটল ম্যাগ যেমন একবিংশ, নিসর্গ, লিরিক, সকাল ইত্যাদিতে দেশজ আবহে প্রচুর লেখালেখি হয়। কিন্তু তাতে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মের আচার অনুষ্ঠান দেবদেবির বিষয়আশয় ও নামধাম উল্লেখ থাকলেও ইসলাম ধর্ম বিষয়ক অনুসঙ্গ ছিল ব্রাত্য, মানে প্রবেশ নিষেধ। কবি ইশারফ হোসেন সম্পাদিত ‘সকাল’ লিটল ম্যাগের মাধ্যমে বিশ্বাসী নন্দনতাত্বিক কবিতার খোঁজ, প্রকাশ ও নার্চারিং করার মাধ্যমে ইসলামি কবিতা চর্চার একটা প্লাটফর্ম দেখতে পাওয়া যায়।
যা হোক, আবার মূল কথায় ফিরা আসি। আজ বিশ্বজুড়ে লিবারেল রাজনৈতিক দর্শন ও লিবারেল পুঁজিবাদী অর্থনীতির ভ্রস্টচারিতা, নীতিহীন উদার বাণিজ্যের কারণে পৃথিবীতে ধন সম্পদের যে অসম বণ্টন, এবং স্বাধীনতার সর্বোচ্চ ব্যবহারের কারণে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে যে অবক্ষয় নাইমা আসছে— তার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আজ মানুষ বুঝতে পারছে যে, তাদেরকে মর্মের কাছে— বিশ্বাসের কাছে ফিরা যাইতে হবে। তাই গ্লোবালি মানুষের মধ্যে একটা মানসিক শান্তির আশ্রয়স্থল খোঁজার পালা শুরু হইছে যা এতদিন এই লিবারেল জীবনবিশ্বাস দিতে পারে নাই। সেই সূত্রে শিল্প সাহিত্যেও এর আগমন দেখা যাইতেছে। আমাদের বাংলা কবিতাও এর থেকে যে বাদ যাবে না, তা নিশ্চিত। কিন্তু কথা থাইকা যায়, আমরা কীভাবে আগাবো। কীভাবে ইসলামিক বিষয় আশয় ব্যবহার করবো? এখন তো আর ফররুখ, নজরুল, আল মহামুদ— এদের মতো করে লেখা যাবে না। কারণ অনেক সময় পার হইছে, মানুষের সমাজে ও রাজনীতিতে পরিবর্তন আসছে, মানুষের কগনিটিভ কাঠামো চেইঞ্জ হইছে, তার ফলে বিষয় আশয় শব্দ ভাষাসহ সবকিছু একটা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়া যাইতেছে। সেই কথা চিন্তা করে নিচে আমার নিজের বিবেচনায় কয়েকটি পয়েন্ট প্রস্তাব আকারে পেশ করলাম।
১. আমাদের অনেকেরই ব্যাকগ্রাউন্ড ও মনোজগৎ সেকুলার ঘেঁষা, কিছুটা হিন্দু বাঙালি সংস্কৃতি কথা, কাহিনি, মিথ, উপখ্যানভিত্তিক জ্ঞান কাঠামোয় গড়ে ওঠা। এর কারণে অনেকেই কবিতায় না জেনে না বুঝে ইসলামিক ডিস্কোর্স, বিশেষ করে কোরান ও সুন্নাহর বিষয় আশয় সেই মডেলে ব্যবহার করেন। যার ফলে ব্যাপক ফ্যালাসির ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়। গ্রীক মিথোলজি এবং হিন্দু মিথোলজির সাথে ইসলামিক ডিস্কোর্সকে এক করে দেখলে চলবে না। গ্রীক মিথলোজি এবং হিন্দু মিথোলজি দাঁড়াইয়া আছে প্যাগানিজমের (পৌত্তলিকতা) ওপর। তাই এইগুলিরে যথেচ্ছচভাবে আধুনিক কবিরা ব্যবহার করেছেন। কিন্তু কোরান হইল আল্লাহর বাণী, ঐশী গ্রন্থ, তাই এখান থেকে রেফারেন্স দিতে চাইলে তার ব্যবহার অবশ্যই সম্মানজনক হইতে হবে। উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক এবং রেফারেন্স হিসাবে কোরান এবং হাদিসের কোনো সুরাহ বা ঘটনা ব্যবহার করার সময় মনে রাখতে হবে, যাতে করে তা কখনোই মূল টেক্সটের বাইরে না যায়, তা অবসিন (অশ্লীল) হইয়া না পড়ে, আল্লাহর একত্বের বিরুদ্ধে না যায়, রাসুলের সাথে বেয়াদবি না হইয়া পড়ে।
২. ত্রিশের কবিরা সেকুলার/এথিস্ট হওয়ার কারণে এবং হিন্দু-বাঙালি সংস্কৃতির আবহে জীবন ধারণ ও পালনের জন্য ইসলাম ধর্মজাত মুসলমানি বাংলা শব্দ যা মূলত আরবি/ফার্সি থেকে উদ্ভূত, তা বাংলা কবিতা থেকে বাদ দিছে। ত্রিশের কবি-পুরোহিত বুদ্ধদেব বসু তার প্রভাববিস্তারি কাব্যবিষয়ক প্রবন্ধগুলিতে আধুনিকতাবাদী কবিতার যে চরিত্র চিত্রণ করছে, সেখানে হিন্দু ধর্মের দেবদেবির প্রবেশ থাকলেও ইসলাম ধর্মের কোনো প্রবেশ নাই। বুদ্ধদেব শয়তান পূজারি ফরাসি কবি বোদলেয়ারকে নিয়েছেন কাব্যগুরু হিসাবে। তাই তিনি চাইছেন, বাংলা কবিতায় চাষ হোক অবক্ষয়ী ভাবধারা। যাতে থাকবে না কোনো মরাল ভ্যালুজ। তাই সেই সূত্রে বাংলা আধুনিক কবিতা পক্ষপাতদুষ্ট, একমুখী কবিতা-শিল্প কারখানা। পরবর্তীতে কল্লোল গ্রুপের সুনীল ও শক্তিসহ অন্যান্য কবিরা ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির নামে, মদ্যপান থেকে শুরু করে ফ্রি মিক্সিং, নারীর শরীরের নগ্ন প্রকাশ, যৌনতা ইত্যাদি লিবারেল ধ্যান ধারণাপ্রসুত কাব্যভাবনা ব্যাপকহারে কবিতায় আমদানি করেন, যা দশক দশক ধরে উভয় বাংলার কবিদেরকে উৎসাহিত করছে। বাংলা আধুনিক কবিতার এই ‘অবক্ষয়ী’ অন্ধকার চেতনাকে আমাদেরকে বুঝতে হবে এবং সেখানে ইসলামি টেক্সট, ডিস্কোর্স, ইতিহাস, ঐতিহ্যের আলোকে সুস্থ কাব্যভাবনা ও চর্চাকে বেগবান করতে হবে।
৩. শিল্পচর্চা জীবন-আদর্শের সাথে জড়িত। কবিতা যদি একটা শিল্প মাধ্যম হয় তাহলে তার নির্মাণকারীকেও একটা বিশেষ জীবন-আদর্শের চর্চার মধ্য দিয়া যাইতে হয়। আপনি যেইটা না, সেইটা নিয়া আপনি শ্রেষ্ঠ শিল্প বানাইতে পারবেন না। তাই ইসলামি আদর্শের কবিতা লিখতে হইলে আপনাকেও সর্ব প্রথম ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মোহাম্মাদুর রাসুল্লাল্লাহ’ এই শাহাদা-বাণীর ধারক ও পালক হইতে হবে। এর থেকে নির্দেশিত বিশ্বাস ও কাজে আপনাকে নিজকে একিভূত করে নিতে হবে। অর্থাৎ আপনি লিখতে চান ইসলামি কবিতা কিন্ত পালন করেন আন-ইসলামিক লাইফ, এইটা হবে একটা ভণ্ডামি।
৪. একজন মুসলমান, তার রিয়েলিটি বা অস্তিত্ব জানতে কোরান ও সুন্নাহভিত্তিক এপিস্টেমোলজিতে (জ্ঞানতত্ত্ব) বাস করেন এবং ব্যবহার করেন। সে জ্ঞানের চূড়ান্ত উৎস হিসাবে আল্লাহকে স্থান দেয় মহাবিশ্বের কেন্দ্রে। এই জ্ঞানতত্ত্ব পশ্চিমা নৃ-কেন্দ্রিক, বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির একদম বিপরীত। বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি শুধু বস্তু তথা ম্যাটারকে তার আধেয় ও আধার হিসবে দেখে যার ফলে শুরুতেই একটা ‘অভাব’ দিয়া শিল্প সাধনা শুরু হয়। কিন্তু ইসলাম ফিতরাগতভাবে ডুয়ালিজমকে মূল্য দেয় মানে তার বিকাশ ও সম্ভাবনা স্প্রিট ও ম্যাটার উভয়কে ধরেই।
৫. বাউল/সন্যাসী ধর্ম-দর্শনে বিশ্বাসী এবং বাউল জীবনধারায় জড়িত অনেক কালচারাল (সেকুলার) মুসলমান কবিদেরকে ঈমান ও আক্বিদাগত বিভ্রান্তির কারণে আল্লাহ ও রাসুলকে এক করে দেখা, আল্লাহকে সকল বস্তুর মধ্যে দেখতে পাওয়া, রাসুলকে হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্মের অবতারের সাথে তুলনা করা, ইত্যাদি করতে দেখা যায়। এইটা একটা মারাত্মক কনসেপ্টচ্যুয়াল ফ্যালাসি। তাই মুসলমান কবিদেরকে শুদ্ধ আক্বিদাগত জ্ঞান লাভ করা জরুরি। এইটা ঠিক থাকলে ইসলামিক বিষয় আশয় সঠিকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হবে। (আরও পাঠ: অধ্যাপক আহমদ শরীফ তার বাউলতত্ত্ব বইটিতে বাউল ধর্মমত সম্পর্কে বলেন, ব্রাহ্মণ্য, শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সমবায়ে গড়ে উঠেছে একটি মিশ্রমত যার নাম নাথপন্থ। …দেহতাত্ত্বিক সাধনাই এদের লক্ষ্য। (নাথপন্থ ও সহজিয়া) এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক একসময় ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়, কিন্তু পুরনো বিশ্বাস-সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও এরা পুরনো প্রথায় ধর্ম সাধনা করে চলে, তার ফলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বাউল মতের উদ্ভব। তাই হিন্দু গুরুর মুসলিম সাগরেদ বা মুসলিম গুরুর হিন্দু সাগরেদ গ্রহণে কোনো বাধা নেই। তারা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও শরিয়তী ইসলামের বেড়া ভেঙে নিজের মনের মতো করে পথ তৈরি করে নিয়েছে। (বাউলতত্ত্ব পৃঃ ৫৩-৫৪।) বাউলরা মন্দিরে কিংবা মসজিদে যায় না। জুম্মার নামায, ঈদ এবং রোযাও পালন করে না। তারা তাদের সঙ্গিনীকে জায়নামাজ নামে অভিহিত করে। বাউলরা মৃতদেহকে পোড়ায় না। এদের জানাজাও হয় না। হিন্দু মুসলমান নামের সব বাউলদের মধ্যেই এই রীতি)।
৬. মুসলমান হিসাবে আমরা দুই ভাগে বিভক্ত, কালচারাল মুসলিম ও প্রেক্টিসিং মুসলিম। কালচারাল মুসলিম বলা যায় অধিকাংশই সেকুলারাইজড, আধুনিক মুসলিম। এরা নিজেদেরকে উদার ও মুক্তমনা বলে মনে করে। বাংলার মুসলমান কবি, শিল্প সাহিত্যিকদের মধ্যে এই ধারাটা বেশি লক্ষ্য করা যায়। ইউরোপ আমেরিকা বা বলতে গেলে পশ্চিমা দুনিয়ায় খ্রিস্টান, ইহুদিরা নিজেদের রিয়েলিটি হারিয়ে যেভাবে লিবারেল-সেক্যুলার জীবন ধারায় নিজেদেরকে মিশাইয়া দিছে, তেমনিভাবে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যেও এই ধারার মুসলিম দেখা যায়। এতে করে কবিতার পারস্পেক্টীভ চেইঞ্জ হইয়া যায়। মূল ইসলামিক টেক্সট, ব্যাখ্যা আখ্যান তখন তার জেনিউনিটি হারায়। সত্য হয়ে পড়ে দূর তাই তার শিল্প হয়ে পড়ে ত্রুটিপূর্ণ। আবার কালচারালি আমরা অনেক কিছু করি ইসলামের সাথে যার কোনো যোগাযোগ নাই। যেমন ধরেন মুসলমান বাঙালির ধাপে ধাপে করা বিবাহ অনুষ্টান। এইটা কালচারাল, বাঙ্গালি সংস্কৃতি থেইকা আসছে, ইসুলামিক না। আমাদের উদ্দেশ্য থাকবে কালচারাল মুসলিম হিসাবে নয় শুধু, প্রেক্টেসিং মুসলমান হিসাবে ইসলামিক থিম এবং এসেন্সের আধারে কবিতা লেখা।
৭. ইসলামিক আর্কিটেকচার বিশেষ করে মসজিদের স্ট্রাকচারাল ডিজাইন, নকশাকে কবিতায় অনেক সেকুলার মুসলিম কবি নারীর গোপন অঙ্গ বা সৌন্দর্যের সাথে তুলনা করছেন— যেন, মতো উপমা দিয়া বা নারীকে সরাসরি ঐ স্ট্রাকচারাল ডিজাইন হিসাবে ভাবতে চেয়েছেন। আবার বিপরীতভাবে অনেকেই নারীর অঙ্গকে অজ্ঞতা হোক বা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই হোক ইসলামিক আর্কিটেকচারাল ডিজাইনের সাথে তুলনা করছেন। এইটা ইসলামিক ঐতিহ্য এবং স্বাভাবিকতার বিপরীত। আমাদেরকে এরকম অজ্ঞান আধুনিকাতাবাদী, শিল্প-চিন্তন ব্যবহার থেইকা দূরে থাকতে হবে।
৮. যেহেতু ত্রিশের দশকে শুরু করে আধুনিক কবিতার প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠা বাংলা কবিতার একটা ফর্ম ও চরিত্র আমাদের মাঝে দাঁড় করাইয়া দিতে সক্ষম হইছে, এবং এরই মধ্যে পাঠকের একটা রুচি তৈরি হইয়া গেছে, তাই এই কবিতা-সভ্যতাকে সহজে ভাঙা সম্ভব না। তাছাড়া মানুষের চিন্তা চেতনা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এক জায়গায় স্থির নাই। এখন আমাদেরকে প্রাচীন ও মধ্য যুগের কবিদের ভাষা ও ছন্দে কবিতা লিখলে তা পাঠকের মনোপুত হবে না, উচিতও হবে না। আমাদের লক্ষ্য হবে পাঠককে ফিরাইয়া আনা। তাই আধুনিক কবিরা শিল্প সাহিত্যে যে ‘অভাব’ তৈরি করে দিছে সেই অভাবটাকে, বিশ্বাসের নানবিধ বিষয়বস্তু দিয়ে ভরে দিতে হবে। যেহেতু আমাদের চেতনা একটা কালিক স্লোটে পরিপক্ক হয় সেহেতু আমরা বর্তমানকে এরিয়ে যেতে পারবো না। তার মানে এই সময়ের জীবনের সঙ্গ, অনুসঙ্গ সবই কবিতায় আসবে। এক্ষেত্রে উত্তর আধুনিকতা আমাদের চারণভূমি হতে পারে। কারণ উত্তর আধুনিকতা ইতিহাস ঐতিহ্য, লোকজীবনের সাথে সাথে বিশ্বাসি ধারার শিল্প সাহিত্য চর্চাকে উৎসাহ এবং পরিচর্যা করে।
৯. কবিতার দাবি কবিতা। তার মানে কবিতাকে আগে কবিতা হইতে হবে। এখন কথা থাকে কিভাবে বুঝবো যে কবিতা আসলেই কবিতা হইছে কিনা? উপরে উল্লেখ করেছি যে, বিশ্বব্যাপী আধুনিক কবিতা এক ধরণের পাঠক-জগৎ সৃষ্টি করতে পারছে। এর সূত্র ধরে কবিতার যে একটা আদল বা ফর্ম আমাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হইছে তার শরীরটা একটা নাড়াচাড়া করলে আমাদের কবিতা সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হবে। মনে রাখতে হবে, সব আধুনিক কবিতাই অবক্ষয়ী আধুনিকতাবাদের ফসল নয়। আধুনিক অনেক কবিতা আছে আধুনিকতার নামে আসলে আধুনিকতারই বিরোধী যেমন টিএস এলিয়টের দ্য ওয়েস্ট ল্যাণ্ড। বাঙালি কবি জীবনানন্দের চেতনাকাঠামো ইউরোপীয়, তাই তার কবিতা ইয়েটসের অনেক কবিতারি প্রতিধ্বনি। জীবনানন্দ পুরাপুরি আধুনিকতাবাদী কবি ছিলেন না হয়তো, হইলে তিনি রপসী বাংলার মতো কবিতা লিখতে পারতেন না এবং যার ফলে আল মাহমুদ সোনালী কাবিন লিখতে পারতেন না।
১০. জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্পকলা ইত্যাদি ক্রিয়েটিভ আর্ট পরম্পরাগত। শিল্প সম্ভাবনাময়, ভবিষ্যৎমুখী হইলেও তার চিন্তার উৎস পরম্পরাগত। আবার জ্ঞান ও শিল্পকলা যে শাখায় যত বেশি রিডারশিপ থাকে তার তত বিস্তার। আর এইটা সম্ভব হয় যদি পাঠাগার বেইজড কবিতা, সাহিত্যের পাঠ হয়। এখন যেহেতু অনলাইন সোসাল মিডিয়ার যুগ তাই অনলাইন প্লাটফর্মটাকে কাজে লাগানো যায়। প্রাচীন গ্রীক ফিলোসপির হাত ধইরাই আধুনিক পশ্চিমা দর্শনের সৃষ্টি। প্লেটোর রীডারশিপ আছে বইলাই কান্ট এবং হেগেলের নতুন ফিলোসফি তইরি হইছে। এপিকিউরাস এবং শোপেনহাওরের পঠন না থাকলে নিৎসের দার্শনিক লেখাগুলি লেখা হইত না। আমাদের বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যারা বিশ্বাসী ধারার কবি, যারা আগে লিখছে এবং বর্তমানে যারা সফল হইতেছে বইলা মনে হয়, তাদের কবিতা পড়তে হবে, তাদেরকে জানতে হবে। তাদেরকে পাঠকের কাছে তুলে ধরতে হবে তথা রিডারশিপ তৈরি করতে হবে।
লেখক: কবি