ইমাম জাফর সাদেকের কিস্‌সা

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : আগস্ট ৩১, ২০১৮

আপনিও তো মানুষ

দামি পোশাক পরে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন ইমাম জাফর সাদেক। পথে এক লোক সালাম জানিয়ে তাকে বলল, জনাব, কিছু মনে করবেন না, নবিবংশের কোনো ব্যক্তির জন্য দামি পোশাক পরা ঠিক নয়।
জাফর সাদেক লোকটির একহাত নিজের জামার ভেতর ঢুকিয়ে বললেন, দেখুন, ভেতরের জামাটা খসখসে আর মোটা। বাইরের জামাটা পরি যখন আমি মানুষের সামনে চলাফেরা করি। আর ভেতরের জামাটা পরি যখন আমি নামাজে আল্লাহর সামনে দাঁড়াই।
একথা শুনে লোকটি লজ্জা পেল। জাফর সাদেক তার লজ্জিত মুখের দিকে চেয়ে বললেন, মানুষ দ্যাখে বাইরেরটা, আর আল্লাহ দ্যাখেন ভেতরেরটা। আপনি লজ্জিত হবেন না জনাব। আপনিও তো একজন মানুষ।

আল্লাহকে দেখা

নদীর তীরে শিষ্যদের সাথে বসে আছেন ইমাম জাফর সাদেক। এমন সময় এক লোক এলো তার কাছে। সালাম জানিয়ে বলল, জনাব, আমি আল্লাহকে দেখতে চাই।
জাফর সাদেক তাকে বললেন, মূসাকে আল্লাহ বলেছিলেন, ‘তুমি কিছুতেই আমাকে দেখতে পাবে না।’ সেখানে তুমি কীভাবে আল্লাহকে দেখতে পাবে হে?
লোকটি বলল, জনাব, সেটা তো মূসার ব্যাপার। মূসার সময় শেষ, এখন শেষনবির জামানা। আমি শুনেছি, কোনো এক দরবেশ বলেছেন, ‘আমার হৃদয় সৃষ্টিকর্তাকে দেখেছে।’ আরেক দরবেশ বলেছেন, ‘সৃষ্টিকর্তাকে না দেখে তার উপাসনা আমি করব না।’
জাফর সাদেক এবার শিষ্যদের বললেন, লোকটির হাত-পা বেঁধে পানিতে ফেলে দাও।
শিষ্যেরা এগিয়ে এলো। অনেক ধস্তাধস্তি করেও লোকটি নিজেকে রক্ষা করতে পারল না। হাত-পা বেঁধে তাকে ফেলে দেয়া হলো নদীতে। পানিতে পড়তে পড়তে সে চিৎকার করে উঠল, আমাকে বাঁচাও... বাঁচাও...
কিন্তু কেউ তার সাহায্যে এগিয়ে এলো না। ডুবতে ডুবতে লোকটি প্রাণপণে মনে মনে বলল হে আল্লাহ আমাকে বাঁচাও।
ঠিক সেই মুহূর্তে জাফর সাদেকের নির্দেশে দুই শিষ্য তাকে উদ্ধার করে নিয়ে এলো। লোকটি একটু সুস্থ হলে জাফর সাদেক জিগেশ করলেন, আল্লাহকে দেখতে পেছেছো?
লোকটি বলল, যতক্ষণ আমার চোখের সামনে পর্দা ছিল ততক্ষণ আমি মানুষের কাছে সাহায্য চেয়েছি। কিন্তু মৃত্যুমুহূর্তে আমার চোখের পর্দা সরে যায়। আর আমি অনুভব করলাম পরম সেই সত্ত্বাকে। তার কাছেই আমি বাঁচার আকুতি জানালাম।
জাফর সাদেক বললেন, হ্যাঁ, এরপর আমার নির্দেশ পেয়ে দুজন তোমাকে উদ্ধার করে নিয়ে এলো।
লোকটি জিগেশ করল, আমি যে ঠিক ওই মুহূর্তেই আল্লাহর কাছে আশ্রয় চায়, এটি আপনি কীভাবে টের পেলেন?
জাফর সাদেক বললেন, ওই মুহূর্তেই আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দেন তোমাকে উদ্ধার করার জন্য।
লোকটি জিগেশ করল, কীভাবে নির্দেশ দিলেন?
জাফর সাদেক বললেন, ইঙ্গিতে। তার ইঙ্গিতের ভাষা বুঝতে পারলেই তাকে চেনা যায়। দেখা যায়। যে রকম মৃত্যুমুহূর্তে তুমি তাকে দেখতে পেয়েছিলে।

জ্ঞানী কে

ইমাম আবু হানিফাকে জাফর সাদেক জিগেশ করলেন, জ্ঞানী কে?
আবু হানিফা জবাব দিলেন, যে মানুষ ভালো-মন্দের মধ্যে তফাৎ করতে পারে।
জাফর সাদেক বললেন, সে তো যে কোনো জন্তু-জানোয়ারও পারে। ভালোবাসা বোঝে বলেই বনের হিং¯্র বাঘ মানুষের পোষ মানে। আবার এই বাঘের আক্রমণেই মানুষ প্রাণ হারায়। জগতের সব প্রাণীরই ভালো-মন্দের বোধ আছে।
আবু হানিফা এবার বললেন, তবে আপনিই বলুন, কে জ্ঞানী?
জাফর সাদেক বললেন, দুটো ভালো কাজের মধ্যে যে বেশি ভালোটা নেয়, আর দুটো খারাপ কাজের মধ্যে কম খারাপটি নেয়, সে মানুষই জ্ঞানী।

অবৈধ সন্তান

খোলামেলা মাঠ। বাচ্চারা হই হুল্লোর করে মাঠে বল খেলছে। মাঠের একপাশে মুসলিম জগতের ইমাম আবু হানিফা শিষ্যদের নিয়ে বসে কথাবার্তা বলছেন। বলটি হঠাৎ এসে পড়ল আসরের মাঝখানে।
বাচ্চাদের কেউ-ই সেই আসরে গিয়ে বল আনতে রাজি হলো না। এক বালক কোনো কিছু তোয়াক্কা না করে আসরের মাঝখানে গিয়ে বল নিয়ে এলো।
ইমাম সাহেব বললেন, বালকটি নিশ্চয়ই তার বাবা-মায়ের অবৈধ সন্তান।
শিষ্যেরা হতবাক। কী বলছেন তাদের দরবেশ?
এক শিষ্য ওই বালককে চিনত। তার বাবা-মাকেও চিনত। সে অবাক হয়ে বলল, জি, আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু ব্যাপারটা আপনি কীভাবে জানলেন?
ইমাম বললেন, বালকের ব্যাবহার দেখে। জগতে সে এসেছে অসামাজিক মিলনের মাধ্যমে। তাই তার ব্যাবহারেও রয়ে গেছে অসামাজিকতা।

সূত্র: তাজকেরাতুল আউলিয়া